সহদেব হালদার
লেখক পেশায় একটি সরকারি অফিসে কন্ট্রাকচুয়াল সুইপার। নাটক, গান, ছড়া লেখেন। নাটক করেন, যাত্রা করেন
প্রথম দৃশ্য
[পর্দা খুলতেই ঘরের মধ্যে খাট, বিছানা, চেয়ার, দুটো টেবিল। টেবিলে বই, খাতা, টেবিল ল্যাম্প। কমলা টেবিলে বসে বই পড়ছে। কমলার মা প্রমীলার প্রদীপ হাতে গান করতে করতে প্রবেশ]
প্রমীলা (আপন মনে প্রদীপ থেকে তাপ সেঁক দিতে দিতে): এসো মা লক্ষ্মী, বোসো ঘরে…
[বিভূতিভূষণের প্রবেশ]
বিভূতি: বৌমা তোমার সন্ধ্যা দেওয়ার কাজ শেষ হলে আমাকে এক কাপ চা করে দিও তো মা। সন্ধ্যাবেলা চা না খেলে মাথাটা কেমন ধরা-ধরা ভাব লাগে। এই চা খাওয়ার অভ্যাসটা কিন্তু তুমিই ধরিয়েছ বৌমা।
[প্রমীলা গান গেয়েই চলে। শ্বশুরের কথা যেন কানে নেয় না]
বিভূতি: না না থাক। সন্ধ্যা দেওয়ার সময় চা চেয়ে বৌমাকে বিরক্ত না করাই ভাল। (প্রস্থানে উদ্যত)
প্রমীলা: আমার হয়ে গেছে বাবা। আপনি আর একটু অপেক্ষা করুন, দেখবেন চা পৌঁছে গেছে আপনার কাছে। আমার ওপর রাগ করলেন নাকি, বাবা?
বিভূতি: কী বলছ বৌমা! আমি তোমার ওপর…
প্রমীলা: আমি জানি বাবা আপনি আমার ওপর রাগ করবেনই না। মেয়ের ওপর বাবার রাগ হলেও সে রাগ সাময়িক। কি বাবা, আমি ঠিক বলেছি তো?
বিভূতি: একেবারে নির্ভুল…
কমলা: দাদু…
বিভূতি: বলো দিদিভাই…
কমলা: মা তোমার মেয়ে?
বিভূতি: মেয়েই তো!
কমলা: ও, সেইজন্য তুমি মাকে ভীষণ ভালবাসো, আর আমি বুঝি তোমার কেউ নই?
বিভূতি (কমলাকে কোলে তুলে): হা হা হা! বেশ বুড়িদের মতো কথা বলতে শিখেছ যে দিদিভাই। তোমাকে না ভালবেসে কেউ কি থাকতে পারে!
প্রমীলা: বাবা আপনি ওর সঙ্গে গল্প করুন, আমি এক্ষুনি আপনার জন্য চা নিয়ে আসছি।
বিভূতি: হ্যাঁ বৌমা, তুমি যাও। আর আমি ততক্ষণে (কমলাকে কোল থেকে নামিয়ে) দিদিভাইয়ের সঙ্গে এক ঝলক জমিয়ে গল্প করি। এসো দিদিভাই। (কমলাকে নিয়ে খাটের ওপরে বসে) এক দেশে এক রাজা ছিল, নাম রুদ্রনাথ। তার স্ত্রী রুদ্রাণী সন্তান জন্ম দিয়েই মারা যায়। রুদ্রনাথের একটিমাত্র সন্তান— রাজকুমার চন্দ্রনাথ। যত দিন যায় চন্দ্রনাথ ক্রমশ বড় হতে থাকে। একসময়ে চন্দ্রনাথ বিবাহযোগ্য হয়ে ওঠে। রাজা রুদ্রনাথ এক সুপাত্রী দেখে তার বিয়ে দেয়। চন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম বিদিশা। বিয়ের পর রাজ্যের ভার চন্দ্রনাথের ওপর ছেড়ে দেয় রুদ্রনাথ। চন্দ্রনাথ কিন্তু তার বাবার মতো সৎ চরিত্রবান রাজা হয়ে উঠতে পারল না। দিন রাত মদ্যপান করে…
কমলা: মদ্য কি দাদু?
বিভূতি: মদ্য মানে মদ বা সুরা, যা খেলে নেশা হয়।
কমলা: ছিঃ! চন্দ্রনাথ ভীষণ খারাপ রাজা… তাই না দাদু?
বিভূতি: একেবারে ঠিক বলেছ দিদিভাই। তারপর কী হল জানো?
কমলা: কী হল?
বিভূতি: চন্দ্রনাথ মদ যা খেত সে তো খেতই, অন্যদিকে রাজার বাগানবাড়িতে বাইজিদের নাচ দেখতে যেত।
কমলা: নাচ? কী মজা, কী মজা!
বিভূতি: ওই নাচ দেখে নিজের ঘরে ফিরে বিদিশাকে বেধড়ক মার মারত। রাজা রুদ্রনাথ ছেলের এইরূপ আচরণ সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করে। কিন্তু ফল হল উল্টো। রুদ্রনাথ প্রতিবাদ করায় চন্দ্রনাথ তাকে খুন করে।
কমলা (মুখে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে): এ তো খুনি রাজা! তারপর?
বিভূতি: রাজা চন্দ্রনাথের একটিমাত্র কন্যসন্তান ছিল, নাম পারমিতা। বয়স বছর দশেক হবে…
কমলা: আমার মতো?
বিভূতি: হ্যাঁ, প্রায় তা-ই হবে। একদিন চন্দ্রনাথ বিদিশা আর তার ছোট কন্যাটিকে মারতে মারতে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়।
কমলা: রাজা ভীষণ খারাপ লোক। যাও, আমি আর গল্প শুনব না… (খাট থেকে নেমে যায়)
বিভূতি: এই দেখো! রাজার ওপর রাগ করে নাকি গল্প শুনবে না! হা হা হা! তা বেশ! আর তোমাকে গল্প শোনাব না… হা হা হা…
[কথা বলতে বলতে চায়ের কাপ-প্লেট হাতে প্রমীলার প্রবেশ]
প্রমীলা: তোমাকে আর গল্প শুনতে হবে না, তুমি এবার পড়তে বসো। সামনে আর কদিন পর পরীক্ষা সেটা খেয়াল আছে?
[কমলা মুখ ভার করে পড়ার টেবিলে বসে পড়ে]
বিভূতি: চা নিয়ে এসেছ বৌমা? দাও দাও… (চায়ের কাপ-প্লেট প্রমীলা থেকে নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে) আ…
প্রমীলা: বিদিশা আর তারা ছোট্ট শিশুকন্যাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়ে রাজা চন্দ্রনাথ কিন্তু ভীষণ ভুল করেছে…
বিভূতি: তুমিও শুনছিলে বৌমা?
প্রমীলা: হ্যাঁ বাবা। তারপর কী হল?
বিভূতি: তারপর আর কী হবে! বিদিশা তার ছোট্ট শিশুকন্যাকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে থাকে। একদিন তাদের একটা আশ্রয়ও মিলল। আর মিলল তো মিলল, এক বাইজির বাড়িতেই আশ্রয় মিলল। সেই আশ্রয়ের মালকিন ছিল রমাবাই। রমাবাই ভীষণ দয়ালু। কিন্তু দু-দুটো পেটের অন্ন জোগাতে গেলে বিদিশাদের কিছুটা শ্রম তো দিতেই হবে।
কমলা: শ্রম মানে কাজ, তাই না দাদু?
বিভূতি: একেবারে ঠিক বলেছ দিদিভাই।
কমলা: আচ্ছা দাদু, কী কাজ করতে হয় তাদের?
বিভূতি: রমাবাই ছোট্ট পারমিতাকে তালিম দিতে শুরু করে। রানি বিদিশা স্বামী-সংসার হারিয়ে মেয়েকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়ে দিনরাত কাঁদত। কাঁদতে কাঁদতে বিদিশা অন্ধ হয়ে যায়, চোখে সে আর দেখতে পায় না। যেমন দৃষ্টিহীন পাখি দিশা হারিয়ে দুর্যোগের রাতে বৃষ্টির জলে ভিজে কোণঠাসা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি বিদিশাও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে পারমিতা বড় হয়ে ওঠে। নাচে গানে সে সম্পূর্ণ পারদর্শী। বিরাট নামডাক তার। পারমিতা নাম বদলে নাম হল মিতালিবাই। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল মিতালিবাইয়ের নাম। দেশ-বিদেশ থেকে লোকজন এসে মিতালির নাচ দেখত, গান শুনত, আর টাকার বর্ষা হত তার নাচঘরে। একদিন ঘটে গেল এক ঘটনা। দশ বছর পর রাজা চন্দ্রনাথ এল রমাবাইয়ের মহলে মিতালির নাচ দেখতে। চন্দ্রনাথ নিজের মেয়ে পারমিতাকে চিনতে পারল না।
প্রমীলা: পারমিতা কি চিনতে পেরেছিল তার বাবাকে?
বিভূতি: না পারেনি। শুরু হল নাচগান। মিতালির নাচে-গানে মুগ্ধ হয়ে রাজা চন্দ্রনাথ গোছা গোছা টাকা তো ওড়ালই, নিজের গলার থেকে সবচেয়ে দামী হিরের একটা হার খুলে পারমিতাকে উপহারস্বরূপ দান করল। ঠিক সেই সময়ে রানি বিদিশা পারমিতার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে নাচঘরে ঢুকে পড়ে।
প্রমীলা: রাজা চন্দ্রনাথ বিদিশাকে দেখে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছিল?
বিভূতি: পেরেছিল বইকি! রাজা চন্দ্রনাথ বিদিশাকে দেখে চমকে ওঠে। রাজা জানতে পারল মিতালি আর কেউ নয়, তার একমাত্র মেয়ে পারমিতা।
প্রমীলা: তারপর কী হল?
বিভূতি: রাজা চন্দ্রনাথ লজ্জায় ঘৃণায় নিজের মুখ ঢাকতে নিজের ছুরি নিজের পেটে বসিয়ে দিয়ে বিদিশা বলে আর্তনাদ করে ওঠে। বিদিশা চোখে না দেখলেও স্বামীর কণ্ঠস্বর বুঝতে পেরে দৌড়ে আসতে গিয়ে সজোরে মেঝেতে পড়ে যায় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। রাজা চন্দ্রনাথ তার পরিপূর্ণ পাপ স্বীকার করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল।
প্রমীলা: পারমিতা কি পুনরায় বাবার রাজ্যে ফিরে এসেছিল?
বিভূতি: না, পারমিতা বাবার রাজ্যে আর ফিরে আসেনি।
কমলা: তাহলে কোথায় গেল?
বিভূতি: কোথায় আবার যাবে, রমাবাইয়ের নাচমহলেই সারাজীবনের জন্য থেকে গেল। আর আমার গল্প ফুরিয়ে গেল।
প্রমীলা: আমি যাই বাবা, আপনার ছেলের আসার সময় হয়ে গেল। ঠিক সময় খেতে না পেলে বাড়ি মাথায় করে তুলবে। বাবা, আপনি কমলাকে প্রশ্ন-উত্তরগুলো বুঝিয়ে দিন, সামনে পরীক্ষা। ফেল করলে ওর বাবা ওকে আস্ত রাখবে না… (কথা বলতে বলতে প্রস্থান)
বিভূতি: হ্যাঁ আমি দেখছি, তুমি যাও বৌমা। এই যে দিদিভাই, এবার যে পড়তে বসতে হবে…
কমলা: আচ্ছা দাদু, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?
বিভূতি (প্রাণখোলা হাসি): হা হা হা…
কমলা: তুমি হাসছ যে!
বিভূতি: হাসির কথা বললে হাসতে তো হবেই দিদিভাই। আর তাছাড়া আমি তো তোমার মতো ছোট্টটি নেই, আমি যে বুড়ো হয়ে গেছি। আমি তোমাকে একটা ছোট্ট কবিতা শোনাব।
কমলা: কবিতা শোনাবে তুমি? শোনাও দেখি…
বিভূতি: এবার মৃত্যু আসিয়া, দাঁড়াইবে দোরগোড়ে/হাতছানি দিয়ে ডাকিবে, সে আমায় বারে বারে/চলিয়া যাইব আমি, এই ধরিত্রী ছাড়ি/আবার লইব পুনঃজনম, ফিরিব এই বাড়ি/তখন তুমি জানিবে না কো, সেই ছিলাম আমি/ (কমলার হাত ধরে) এই দুটি হাতে মোরে, আদর করিবে তুমি।
কি দিদিভাই, আমাকে তখন আদর করবে তো?
কমলা: আচ্ছা দাদু, মানুষ মরলে কি আবার জন্মগ্রহণ করে?
বিভূতি: নিশ্চয়ই করে, তবে সে যদি কর্মফল ভাল করে। ওসব কথা এখন থাক, এবার চলো দিদিভাই আমরা এখন পড়তে বসি। তোমাকে ভাল করে পড়তে হবে দিদিভাই, বড় হয়ে তোমাকে বাবার মতো চাকরি করতে হবে…
[টেবিলের দুদিকে দুটো চেয়ারে দুজন বসে। কমলা বইয়ের পাতা ওল্টাতে থাকে]
কমলা: না আমি চাকরি করব না। আমি বড় হয়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার হবে।
বিভূতি: সে তো অনেক কঠিন দিদিভাই। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার হতে গেলে শিক্ষিকা তো হতেই হবে। তার উপর বিপ্লবী বীর হয়ে বন্দুক হাতে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে…
কমলা: আমি যুদ্ধ করব, প্রয়োজনে মৃত্যুবরণও করতে রাজি।
বিভূতি: তবে মনে রাখবে দিদিভাই, একুশ বছরের বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বুকের মধ্যে আগুন জ্বেলে সাদা চামড়ার পশুদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিল। দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের জন্য তাকে আঁখি বলিদান দিতে হয়েছিল। সেই প্রীতিলতা হতে গেলে প্রথমে তোমাকে এই দেসের অনিষ্টকারীদের নিপাত করতে হবে, তবেই হবে তুমি আজকের প্রীতিলতা।
প্রমীলা (রান্নাঘর থেকে): বাবা, ও পড়তে বসেছে?
বিভূতি: এই রে, তোমার মা বোধহয় শুনতে পেয়েছে আমরা গল্প করছি। (জোর গলায়, প্রমীলার উদ্দেশে) হ্যাঁ বৌমা, দিদিভাই পড়তে বসেছে। (আবার গলা নামিয়ে, কমলাকে) পড়ো দিদিভাই, জোরে জোরে পড়ো…
কমলা (জোরে জোরে): ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীদের যোগদানের অন্যতম নজির আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি বাহিনি। কংগ্রেসে থাকাকালীনই সুভাষচন্দ্র নারীদের সামরিক কাজে অংশগ্রহণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছিলেন।
[পরনে প্যান্ট-শার্ট-টাই, হাতে অফিসিয়াল ব্যাগ, মদ্যপ অবস্থায় দ্বিজেনের প্রবেশ]
দ্বিজেন: প্রমীলা… প্রমীলা… (ব্যাগটা রেখে এক হাতে অন্য হাতের মাসলটা চেপে ধরে)
প্রমীলা (রান্নাঘর থেকে): আসছি… (আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢোকে) হ্যাঁ, বলো… (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) কী গো, আজ এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরলে যে?
দ্বিজেন: ওই এলাম আর কী… একটু গরম জল দাও তো…
প্রমীলা: গরম জল! কী হবে গরম জল দিয়ে?
দ্বিজেন (রাগান্বিতভাবে): আঃ! যা বলছি তাই করো! একটা কাজ বললে বিশটা প্রশ্ন করে। তোমার স্বভাবটা দিন দিন বদলে যাচ্ছে। প্রশ্ন করার স্বভাবটা বদলে ফেলো তা না হলে…
বিভূতি: দ্বিজেন, বৌমার সঙ্গে এরকম আচরণ কেন করছ? বৌমা প্রশ্ন করে তো কোনও অন্যায় করেনি। তোমার সুবিধা-অসুবিধা সে-ই যখন দেখে, তাহলে গরম জলটা কোন কাজে লাগবে সেটা জানার অধিকার নিশ্চয়ই তার আছে।
দ্বিজেন: দেখুন বাবা…
বিভূতি: তোমার আর কী দেখব দ্বিজেন, যা দেখার আমি দেখে নিয়েছি। ছিঃ, তোমার লজ্জা করছে না? মদ খেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি বৌমার সঙ্গে অশ্লীল ব্যবহার করছ!
[কমলা পড়া বন্ধ করে দেখে]
প্রমীলা: আমি জলটা গরম করে নিয়ে আসি।
দ্বিজেন: থাক থাক… আর সোহাগ দেখাতে হবে না…
বিভূতি: থাক কেন! দেখো দ্বিজেন, আমি তোমার বাবা, জন্মের পর থেকে আমি তোমাকে দেখছি। তোমার স্বভাবচরিত্র কেমন তা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। আচ্ছা দ্বিজেন, তুমি তো শিক্ষিত, সরকারি চাকরি করছ। একজন সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার তুমি। তোমার একটা সংসার আছে, স্ত্রী আছে, একটা কন্যাসন্তান আছে। সেখানে তুমি রোজ মারদাঙ্গা করে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরো! কেন? হোয়াই? তোমার স্ট্যাটাস, আভিজাত্যকে তুমিই গলা টিপে শেষ করে দিচ্ছ!
দ্বিজেন: আমি স্ট্যাটাস=আভিজাত্য নিয়ে ধুয়ে খেতে চাই না। আমি চাই টাকা। অনেক-অনেক টাকা। তাতে দু-চারটে মার্ডার করতে হয়, করব।
বিভূতি: দ্বিজেন! (গালে চড় মারতে গিয়ে থমকে যায়)
দ্বিজেন: থেমে গেলেন কেন বাবা? মারুন…
বিভূতি: লেখাপড়া শিখিয়ে আমি তোমাকে বর্বর তৈরি করেছি। তাই বর্বরের গায়ে হাত দিতে আমি ঘৃণা বোধ করি।
প্রমীলা: থাক বাবা, যে বোঝে না তাকে হাজার বোঝালেও সে বুঝবে না। তার চেয়ে ও যেটা ভাল বোঝে সেটাই করুক। তাতে যদি আমার কপাল ভাঙে, ভাঙুক।
বিভূতি: কী বলছ বৌমা! তুমি আমাকে নিষেধ করছ ওকে শাসন করতে!
প্রমীলা: অপরাধ নেবেন না বাবা। ও কি আপনার কথার মর্যাদা দিচ্ছে?
দ্বিজেন (মোবাইলের রিং বাজলে ফোন কানে তুলে): হ্যালো… হ্যাঁ হ্যাঁ… কী বললেন? হোয়াট! আমি এক্ষুনি আসছি…
[ফোন অফ করে প্রস্থানে উদ্যত, প্রমীলা বাধা দেয়]
প্রমীলা: না… তুমি যাবে না…
দ্বিজেন (প্রমীলার গালে একটা চড় মেরে): সরে যাও… (ঠেলে দেয়, প্রমীলা পড়ে যায়)
প্রমীলা: আঃ…
বিভূতি: দ্বিজেন…
কমলা (চেয়ার থেকে নেমে): মাকে কেন মারছ বাপি? মা তো কোনও দোষ করেনি। তুমি তখন থেকে মার ওপর মেজাজ নিয়ে কথা বলছ!
বিভূতি: বিচার কাকে বলে দেখলে দ্বিজেন? একেই বলে বিচার! একটা ছোট্ট শিশু, সে সঠিক বিচার করল, আর তুমি তার বাবা, একজন এডুকেটেড মানুষ হয়েও স্ত্রীর প্রতি অবিচার করলে। পাড়ার লোকজন তোমার কৃতিত্বের কথা জানতে পারলে তোমার গায়ে কাদা ছেটাবে, গঙ্গাজল নয়।
দ্বিজেন: পাড়ার লোক কাদা ছেটাবে কি না আমার জানা নেই, তবে তার চেয়ে তিনগুণ কাদা আপনি আমার গায়ে ছেটাচ্ছেন। আপনি বাবা না শত্রু সেটাই বুঝতে পারছি না।
বিভূতি: কী বললে? আমি তোমার শত্রু? (ধপ করে বসে পড়ে মেঝের ওপর)
দ্বিজেন: সেটাই তো মনে হচ্ছে। আচ্ছা আমার অর্থ হোক, প্রতিপত্তি হোক, সেটা কি আপনি চান না?
প্রমীলা: বাবা তোমার শত্রু, এ-কথা তুমি বলতে পারলে? আজ বুঝতে পারছি আমারই ভুল। আমি তোমায় দেবতার আসনে বসিয়েছিলাম। কিন্তু আমার দেবতা যে এতখানি নির্দয় পাষাণ জঘন্য চরিত্রের হবে, সেটা আমি ভাবিনি।
কমলা: তুমি কিন্তু ভীষণ খারাপ হয়ে গেছ বাপি…
দ্বিজেন (প্রচণ্ড রেগে): চুপ করো। ছোট ছোটর মতো থাকো। বেশি বড় হওয়ার চেষ্টা কোরো না। যাও পড়তে বসো গিয়ে…
[কমলা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে পড়ার চেয়ারে গিয়ে বসে]
বিভূতি: কমলা ছোট বলে তুমি তাকে হেঁকে বকে চুপ করিয়ে দিলে, কিন্তু তুমি কি পারবে তাদের চুপ করাতে? যারা তোমার-আমার মতো দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ আর রক্তমাংসে গড়া শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সমাজের বুকে? পারবে না তুমি তাদের চুপ করাতে। রাস্তায় বের হলে তারা আমার দিকে আঙুল তুলে বিদ্রূপের হাসি হেসে বলবে—
নেপথ্য থেকে প্রথম কণ্ঠ: ও… ওই দেখো… একজন সমাজবিরোধীর বাবা যাচ্ছে। ছেলে নামেই সরকারি চাকরি করে। এদিকে ছেলে তলে তলে বাড়িতে সন্ত্রাসের আখড়া বানাচ্ছে। আর এ বাবা হয়ে ছেলের সমস্ত অপরাধ গায়ে মেখে নিচ্ছে…
নেপথ্য থেকে দ্বিতীয় কণ্ঠ: নেবে না কেন? মাস গেলে পঞ্চাশের জায়গায় যদি এক লাখ-দু লাখ আসে, অপরাধ গায়ে মাখতে বাধ্য!
নেপথ্য থেকে তৃতীয় কণ্ঠ: ছিঃ ছিঃ! এদের জন্য দেশটা শেষ হয়ে যেতে বসেছে…
নেপথ্য থেকে চতুর্থ কণ্ঠ: এদের মুখ দেখাই পাপ…
[বিভূতি মাথা ঘুরে পড়ে যায়]
প্রমীলা: বাবা! (বিভূতির মাথাটা কোলে তুলে নেয়) বাবা, কী হয়েছে আপনার?
বিভূতি: মাথাটা একটু ঘুরে গেল বৌমা… (আস্তে আস্তে উঠে বসে)
[কমলা চেয়ার থেকে নেমে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক গ্লাস জল নিয়ে ফিরে আসে]
কমলা: এই নাও দাদু জল…
প্রমীলা: আমাকে দে (কমলার হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে) বাবা জলটা খেয়ে নিন…
[বিভূতি জলটা নিয়ে খায়]
দ্বিজেন: হুঁঃ… যত্ত সব ব্যাকডেটেড… (বেরিয়ে যায়)
বিভূতি: দ্বিজে… দ্বিজেন… বৌমা, কোথায় গেল দ্বিজেন?
কমলা: বাবা চলে গেল দাদু…
বিভূতি: না না, তোমরা ওকে যেতে দিও না। আমি হেরে গেলাম বৌমা, বাবা হয়ে ছেলের কাছে হেরে গেলাম। যদি সম্ভব হয়, তুমি ওকে ফিরিয়ে এনো… (হঠাৎ বাইরে গণ্ডগোল আর বোমা-বন্দুকের আওয়াজ শোনা যায়) ও কী! বাইরে থেকে দাঙ্গার আওয়াজ আসছে! তবে কি দ্বিজেন…
[রক্তাক্ত অবস্থায় রক্তমাখা ছুরি হাতে দ্বিজেন ঘরে ঢোকে]
বিভূতি (ছেলেকে দেখে চমকে উঠে): এ কী!! এ আমি কী দেখছি বৌমা!! আমি ভুল দেখছি না তো?
প্রমীলা: আপনি ঠিকই দেখেছেন বাবা…
বিভূতি: তাহলে আমি যেটা ভাবতাম সেটাই আজ সত্যি হয়ে গেল! আমি তো অনেক কিছুই ভাবি… অনেক অনেক স্বপ্ন দেখি… জানি না সেগুলো কেন সত্যি হয় না… সেই স্বপ্ন সেই ভাবনাগুলো কেন নিমেষে শেষ হয়ে যায়… আ… হা হা হা হা… (কান্না)
দ্বিজেন: আঃ… চুপ করুন তো! তখন থেকে বকবক বকবক করেই চলেছে। শালা আমি মরি আমার জ্বালায়, আর ওরা মরে অন্যের জ্বালায়…
বিভূতি: অন্য! মানে তুমি আমাদের কাছে পর??
দ্বিজেন: নিশ্চয়ই! তা না হলে নিজের ছেলের কাজে খোটা মারতে না!
প্রমীলা: বাঃ! চমৎকার তোমার ভাবনাচিন্তা! এই না হলে সন্তান! সন্তান কুকর্ম করবে আর বাবা সন্তানের কুকর্মে সায় দেবে— এটা সন্তান ভাবে কী করে! আমার কী মনে হয় জানো? তুমি অন্য গ্রহের মানুষ। তাই অন্যের কথা না ভেবে নিজের কথাই ভাবো…
দ্বিজেন (প্রচণ্ড রেগে): প্রমীলা…
প্রমীলা: রাগ কোরো না… আজ আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। তুমি তো দেখেছ, আমি তোমার কোনও কাজে কোনও কথায় কখনও কথা বলিনি, কারণ সেদিন তুমি ছিলে আমার স্বামী। আর আজ তুমি আমার কাছে একজন খুনের আসামি। আয় কমলা…
[মেয়ের হাত ধরে প্রমীলা ঘর থেকে বেরোতে যায়। দ্বিজেন পেছন থেকে তার চুলের মুঠি ধরে]
দ্বিজেন: যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! আমার খাবি আবার আমার সঙ্গে বিবাদ করবি! আজ আমি তোকে খুন করব। তোকে বাঁচিয়ে রাখলে আমার প্রতি পদে বিপদ। তাই বেঁচে থাকার অধিকার থেকে আমি তোকে বঞ্চিত করলাম…
[চুলের মুঠি ধরেই প্রমীলাকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে পেটে ছুরি মারতে যায়]
বিভূতি: না…. (সামনে এসে দাঁড়ায়। ছুরি বিভূতির পেতে ঢুকে যায়) আঃ…
দ্বিজেন: বাবা…
প্রমীলা: বাবা…
বিভূতি: এই বেশ ভাল হল দ্বিজেন…
প্রমীলা: এ আপনি কী করলেন বাবা! আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আপনি নিজেকে শেষ করে দিলেন! (কান্নায় ভেঙে পড়ে)
বিভূতি: তু… তুমি… আ… কে… কেঁদো না বৌমা। আ… আমার যথেষ্ট ব… বয়স হয়েছে। এ… এই সংসারে আ… আমি অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু তোমার ভীষণ প্র… প্রয়োজন। তু… তুমি না থা… থাকলে সংসারটা নিমেষে শে… শেষ হয়ে যাবে। দিদিভাইয়ের জী… জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। বেঁচে থাকলে সে… সেই মর্মান্তিক দৃশ্যটা আমি দেখতে পা… পারব না…
প্রমীলা: বাবা… (কান্না)
দ্বিজেন: আপনি বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে মারতে চাইনি বাবা…
বিভূতি: বো… বৌমাকে মারতে চেয়েছিলে! কেন দ্বিজেন, বৌমা প… পরের মেয়ে বলে? কিন্তু সে তোমার সহধর্মিনী। তোমার সুখ-দুঃখের বো… বোঝা ওই ব… বহন করবে। আর তুমি তাকে পৃ… পৃথিবী থেকে মুছে দিতে চাইছ?
দ্বিজেন: আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি বাবা, প্রমীলার ওপর আমি আর অত্যাচার করব না…
বিভূতি: তু… তুমি স… সত্যি বলছ দ্বিজেন?
দ্বিজেন: আপনাকে যখন কথা দিয়েছি সে-কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব বাবা। আজ থেকে আমার সমস্ত সুখ আমি প্রমীলার পায়ে অর্পণ করব। আর কমলাকে এমনভাবে মানুষ করব যা দেখে এই সমাজের চোখে ছানি পড়ে যাবে…
বিভূতি: আ… এবার আমি মরে শান্তি পাব। জা… জানো বৌমা, আ… আজ আমার মনে হচ্ছে এতদিন আ… আমরাই ছিলাম ঠিক, আ… আর দি… দ্বিজেন ছিল ভুল। কিন্তু না! আজ ও আ… আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দে… দেখিয়ে দিল ও ভুল নয়। আ… আমার দ্বিজেন স… সঠিক মা… মানুষ (মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে)
প্রমীলা: বাবা বাবা বাবা… বাবা… হা হা হা হা… (কান্নায় ভেঙে পড়ে)
কমলা (বিভূতির গায়ে হাত দিয়ে ঠেলা দেয়): দাদু, ও দাদু… দাদু, কথা বলো না…
প্রমীলা: তোমার দাদু আর কোনওদিন তোমার ডাকে সাড়া দেবে না…
কমলা: কেন, আমার ডাকে দাদু সাড়া দেবে না কেন? নিশ্চয়ই সাড়া দেবে। দাদু, ও দাদু… ওঠো না…
[দাদু ওঠে না]
কমলা: ও মা… ও বাবা… দেখো না, দাদুকে কত করে ডাকলাম দাদু আমার ডাকে সাড়া দিল না। তোমরা দেখো দাদুর সাথে আর আমি কোনওদিন কথা বলব না। আজ থেকে দাদুর সাথে আমার আড়ি আড়ি আড়ি…
দ্বিজেন: তোর দাদু মারা গিয়েছে…
কমলা: না আমার দাদু মরেনি। তুমি মিথ্যা কথা বলছ। তুমি মিথ্যুক।
দ্বিজেন: হ্যাঁ আমি মিথ্যুক, আমি বর্বর, আমি কদাকার। এবার বর্বর কদাকারের আসল রূপটা তুই আর তোর মা দুজনেই দেখবি…
প্রমীলা: ওকে ওরকম বোলো না! তোমার শরীরে কি মায়া মমতা বিবেক বলতে কিচ্ছু নেই?
দ্বিজেন: না নেই। মায়া মমতা বিবেক নামের শব্দগুলো আমি আমার জীবন থেকে মুছে দিয়েছি। (প্রমীলার চুলের মুঠি ধরে) তাই তোর মতো মায়াবিনীদের আমার আর প্রয়োজন নেই। তোর জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। যে বাড়িতে আমার বাবা নেই, সে বাড়িতে তোদের থাকার কোনও অধিকার নেই… (চুলের মুঠি ধরে ঠেলে ফেলে দেয়)
প্রমীলা: তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাদের তুমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিও না। এইটুকু দুধের বাচ্চা নিয়ে আমি কোথায় যাব?
দ্বিজেন: তুই জাহান্নমে যা। তোর মতো অলক্ষ্মী এ-বাড়িতে থাকলে এ-বাড়িতে অমঙ্গলের ছায়া নেমে আসবে…
কমলা: ও বাবা… আমাদের তুমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন? আমরা তো কোনও দোষ করিনি। আমাদের তাড়িয়ে দিলে তোমাকে কে দেখবে? কে খেতে দেবে?
প্রমীলা: হা হা হা… (কান্নায় ভেঙে পড়ে)
কমলা (প্রমীলার গলা জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে): মা… ও মা… তুমি আর কেঁদো না। বাবাকে আমি বলেছি। বাবা আর আমাদের তাড়িয়ে দেবে না… তুমি দেখো…
দ্বিজেন: শুধু শুধু ন্যাকাকান্নায় তুই আমার মন গলাতে পারবি না। আর একটা কথা। আমি কিন্তু এক কথা বারবার বলতে পছন্দ করি না। সেটা তুই ভাল করেই জানিস। ভালয় ভালয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা— তা না হলে বাবার মতো তোদের মা-মেয়েকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে আমার এতটুকু হাত কাঁপবে না…
প্রমীলা: বেশ, আমরা চলে যাচ্ছি। তবে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে একটা কথা বলে যাচ্ছি দ্বিজেন্দ্রলাল লাহিড়ী—যে অহঙ্কারে তুমি তোমার স্ত্রী-সন্তানকে তাদের আশ্রয় থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছ, একদিন তোমার সেই অহঙ্কার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ধুলোয় মিশে যাবে। সেদিন অহঙ্কারচ্যুত হয়ে নিজের স্ত্রী-কন্যার পায়ের নিচে এসে তোমাকে পড়তে হবে… পড়তেই হবে। হা হা হা…
[কাঁদতে কাঁদতে কমলাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়]
দ্বিজেন: যাক, একদিক দিয়ে ভালই হল। আমার আর কোনও ঝামেলা রইল না। এখন আমি একা… শুধু একা। যখন যেটা মনে করব, তখন সেটাই করব। কিন্তু না… ঝামেলা আরেকটা আছে। বাণীব্রত মুখার্জিকে টপকে দিতে পারলেই এই কলকাতা শহরে রাজ করবে এই দ্বিজেন্দ্রলাল লাহিড়ী একাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজটা হাসিল করতে হবে…
[বেরিয়ে যায়। মঞ্চের আলো নিভে যায়]
[আবার আগামী সংখ্যায়]