Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কমল এবং ইন্দ্রজিৎ: ভাবমূর্তি ভাঙার গল্প

মালবিকা মিত্র

 

কমল এবং ইন্দ্রজিৎরাই শ্রমজীবী সংগঠনে, শ্রমিকশ্রেণির পার্টিতে জাঁকিয়ে বসে। একটি বিপ্লবী তত্ত্ব এদের হাতে পড়ে সংশোধনবাদী বিপ্লববিরোধী তত্ত্বে পরিণত হতে পারে এবং হয়েছিল। সামাজিক পুঁজি, সামাজিক শ্রম, কিন্তু মালিকানাটি ব্যক্তিগত। এমন একটি ব্যবস্থা খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিল। আদর্শ ও সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতার মরাল ইনসেনটিভ দিয়ে মানুষকে যৌথ খামারের আত্মত্যাগে সামিল করা হল। কিন্তু আত্মত্যাগের ফসলটি উঠল ব্যক্তিগত খামারে। এই অবস্থা চলা সম্ভব ছিল না

 

প্রত্যেকে তাকিয়েছে প্রত্যেকের দিকে, কেন এমন হল! একদম ঠিক তাই। ৯০-এর শুরুতে সোভিয়েত-সহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় ধস নামার পর আমরা প্রত্যেকে হতচকিত হতবাক হয়ে পড়েছিলাম, কেন এমন হল! আমরা পূর্ব-অনুমান ও পূর্বসিদ্ধান্ত থেকে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে চেয়েছি। অনিবার্যভাবেই খুঁজে খুঁজে দিশেহারা হয়েছি। সঠিক ধারণা পাইনি। তাই মনে হল, বরং নিজের জানাচেনা জগৎটাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, সাত সাগরের পাড়ে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিপর্যয়ের কারণ খোঁজ করা যাবে। অতএব আসুন বাড়ির আশপাশ থেকে সমস্যার উৎস খোঁজা শুরু করি। প্রসঙ্গত বলি এ-রাজ্যের বহুলপরিচিত বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত এক হাসপাতালে বেশ কিছু গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ শুনতে পেলাম। তখন ডাক্তারবাবুকে বললাম আপনি এসব কথা সিনিয়র নেতা সনৎদাকে জানাচ্ছেন না কেন? তিনি বললেন এই বয়সে মানুষটাকে আর কষ্ট দিতে চাই না। উনি মনে মনে বিশ্বাস করেন, মানে বিশ্বাস করতে ভালবাসেন, হাসপাতাল খুব ভাল চলছে। সেই বিশ্বাস নিয়েই থাকুক, বাঁচুক। না হলে বাঁচবেন কী নিয়ে? মানে বলতে চাইছি একটা ঘুণধরা বন্দোবস্ত, সেটাকে মহিমান্বিত করে, সাজিয়েগুজিয়ে পরিবেশন করে চলেছি। তারপর একদিন সব সমেত হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লে তখন কপাল চাপড়াব, কেন এমন হল।

অমল বিমল কমল এবং ইন্দ্রজিৎ একটা অর্থনৈতিক সমাজের মধ্যে, একটা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে, এরা ঘুরছে। বলা ভাল বিরাজ করছে। অমল ১০০ টাকা নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে। ব্যবসাটা হল উৎপাদনমুখী। ওই ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে কিছু উৎপাদন করবে। ধরা যাক ফার্নিচার তৈরির ব্যবসা। কাঠ, পেরেক, হাতুড়ি, বাটালি, করাত ইত্যাদি কিনবে। একটা কাজের জায়গা, ওয়ার্কশপ লাগবে। কিন্তু অমল নিজে ছুতারমিস্ত্রি নয়, ফলে মিস্ত্রি বিমলের সঙ্গে তার চুক্তি হল বিমলকে সে ২৫ টাকা মজুরি দেবে। শর্ত হল টেবিলটা বিক্রি হলে তবেই যে লাভ হবে তা থেকে মজুরি দেওয়া হবে।

কিন্তু টেবিল তৈরি হলেও, সেই টেবিল তো আপনা থেকেই বিক্রি হবে না। তাকে বাজারে নিয়ে যাওয়া, ক্রেতার চোখের সামনে সাজিয়ে রাখা, এসব কাজ করতে হবে। তা না হলে কোনও ক্রেতা তো আর খোঁজ করে কারখানায় এসে টেবিল কিনবে না। অর্থাৎ টেবিলটার প্রচার, বিজ্ঞাপন, মানুষের মধ্যে ডিজায়ার বা কিনবার আগ্রহ জাগাতে হবে। এর জন্য কমলকে কাজে রাখা হল। নির্দিষ্ট পঁচিশ টাকা বেতনের চুক্তিতে। এই দেখুন দেখতে দেখতে কাজের পরিমাণ কেমন বেড়ে গেছে। অমলবাবুর বিনিয়োগ, বিমলবাবুর শ্রম, তার মজুরি, আবার কমলবাবুর বাজারে বিক্রি করার দায় ও তার বেতন। আছে ওয়ার্কশপের ভাড়া। এতসব জটিল হিসেব রাখতে হবে, আবার বিক্রির পর এদের সবার প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে হবে এবং বিনিয়োগকারীর লাভ বা মুনাফা দেখতে হবে। এইসব হিসেব করে, তৈরি কাঠের আসবাবটির দাম ধার্য করতে হবে। এইসব জটিল হিসেব করার জন্য নিযুক্ত হলেন ইন্দ্রজিৎ। এই ইন্দ্রজিতের আবার নিজের বেতন আছে। তাকেও হিসেবের মধ্যে ধরতে হবে। বেতন পঞ্চাশ টাকা। সব মিলিয়ে আসবাব তৈরির সঙ্গে একটা বিরাট অর্থনৈতিক বৃত্ত বা চক্র জড়িত হল। অমল বিমল কমল এবং ইন্দ্রজিৎ।

আচ্ছা অমলবাবু ১০০ টাকা বিনিয়োগ করবে কেন? তাকে লাভ পেতে হবে বলে। কমলবাবু তৈরি সামগ্রী বাজারে নিয়ে বেচবে কেন? বেতন পাবে বলে, এবং ইন্দ্রজিৎবাবু এত জটিল হিসেবপত্র দেখবে কেন? ভাল বেতন পাবে বলে। অমলবাবুর লাভ, কমলবাবু এবং ইন্দ্রজিৎবাবুর এই বেতন, এসব আসবে কোথা থেকে? বিমলের তৈরি সামগ্রী বিক্রি হলে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা থেকেই আসবে। এই অর্থ হিসেব করে দেখা গেল অমলবাবুর বিনিয়োগ ১০০ টাকা, বিমলবাবুর মজুরি ২৫ টাকা, কমলবাবুর বেতন ২৫ টাকা এবং ইন্দ্রজিৎবাবুর বেতন ৫০ টাকা, মোট দুশো টাকা খরচ। এর ওপর আছে অমলবাবুর লাভ। ধরা যাক ১০০ টাকা। তাহলে তৈরি হওয়া আসবাবটি কত দামে বিক্রি করতে হবে, (১০০+২৫+২৫+৫০+১০০) = ৩০০ টাকায়।

এবার আমরা এই তিনশো টাকার একটা নামকরণ করব, সবাই বুঝতে পারবে এমন একটা নাম। ঠিক, নাম দিলাম বিক্রয়মূল্য। আর এই আসবাবটি বানাতে যে খরচ হয়েছে তার কী নাম দেব? বলা যাক উৎপাদন ব্যয়। যেটাকে আমরা প্রোডাকশন কস্ট বলি। আচ্ছা প্রোডাকশন কস্ট বা উৎপাদন মূল্য কত? কাঠ, কিছু যন্ত্রসামগ্রী, এসব কিনতে লেগেছে ১০০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিমলবাবু যে শ্রম দিয়েছে, তার মজুরি ২৫ টাকা। তাহলে আসবাবটি বানাতে ১২৫ টাকা খরচ। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয় ১২৫ টাকা। বিমল তার শ্রমশক্তির দাম পেয়েছে ২৫ টাকা। কিন্তু আসবাবটি বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকায়। তার মানে (৩০০-১০০) = ২০০ টাকা হল বিমলের শ্রমশক্তির মূল্য। কিন্তু বিমল পেয়েছে ২৫ টাকা। তাহলে ১৭৫ টাকা গেল কোথায়? এটাই বড় প্রশ্ন।

এই পৃথিবীতে মানুষ তো কোনও পদার্থ সৃষ্টি করতে পারে না। প্রকৃতিতে যা আছে, শ্রমশক্তি প্রয়োগ করে, তার পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে, রিঅ্যারেঞ্জ করে মাত্র। ১০০ টাকার কাঁচামালের সঙ্গে বিমলের শ্রমশক্তি যুক্ত হয়ে তাকে রিঅ্যারেঞ্জ করেছে। পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছে। ছিল কাঠ তৈরি হয়েছে টেবিল। একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। কাঠের একরকম ব্যবহার, আর একটি টেবিলের অন্যরকম ব্যবহার। টেবিল কাঠকে একটা নির্দিষ্টতা দিয়েছে। চেয়ার একটি নির্দিষ্টতা, দরজা-জানালা-বেঞ্চ-আলমারি এসবই কাঠের এক-একটি নির্দিষ্টতা। এই নির্দিষ্টতা শ্রমশক্তি যুক্ত হয়েই তৈরি হয়। অর্থাৎ কাঁচামাল + শ্রমশক্তি = উৎপাদন, একটি নির্দিষ্ট পণ্যের জন্ম। এই পণ্যটি সৃষ্টি করতে ২৫ টাকার শ্রমশক্তি ব্যয় হয়েছে। তাহলে পণ্যটির মূল্য হওয়া উচিত ছিল ১০০ + ২৫ = ১২৫ টাকা। কিন্তু পণ্যটির মূল্য হয়েছে ৩০০ টাকা অর্থাৎ শ্রমশক্তির মূল্য হওয়া উচিত ৩০০ – ১০০ = ২০০ টাকা। বিমল মূল্য পেয়েছে ২৫, পাওয়া উচিত ছিল ২০০, তাহলে কাকা, ১৭৫ টাকা কোথায় গেল? ১৭৫ টাকা উদ্বৃত্ত মূল্য, সৃষ্টি হয়েছে বিমলের শ্রমে, যেটা বিমল পায়নি।

এই উদ্বৃত্তটা ভাগ হয়েছে অমল কমল এবং ইন্দ্রজিতের মধ্যে। এরা তিনজনেই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোনও শ্রমশক্তি ব্যয় করেনি, অর্থাৎ মূল্য সৃষ্টি করেনি, কিন্তু মূল্য পেয়েছে। এই মূল্যটা বিমলের সৃষ্ট। বিমলের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তির মূল্য। অমলকে আমরা সহজেই চিনতে পারি। সে পুঁজির জোরে, ক্ষমতার জোরে, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর, যন্ত্রের ওপর, আধিপত্য করে। ফলে উদ্বৃত্ত মূল্যের একটি বৃহৎ অংশ সে আত্মসাৎ করে। কিন্তু কমল এবং ইন্দ্রজিৎ এরা যে মূল্যটা পায়, সেটা আসে কোথা থেকে? তারাও তো কোনও মূল্য সৃষ্টি করেনি। এখানে একটা অস্পষ্টতা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। কমল ২৫ টাকা পেয়েছে এবং ইন্দ্রজিৎ ৫০ টাকা পেয়েছে। কোথা থেকে পেল এই অর্থ? এই অর্থ এসেছে বিমলের সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে। তার মানে মালিক অমল পুঁজির জোরে যন্ত্র ও প্রাকৃতিক শক্তির ওপর এবং বিমলের শ্রমশক্তির ওপর আধিপত্য করে, বিমলের উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করে মুনাফা হিসেবে। কিন্তু কমল এবং ইন্দ্রজিৎ, যন্ত্র কাঁচামাল কোনও কিছুর উপরেই তারা আধিপত্য করে না। এরা শ্রমশক্তিও ব্যয় করেনি। কিন্তু এদের প্রাপ্ত বেতন এসেছে বিমলের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি থেকেই। বিমল-সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে।

তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল অমল যন্ত্রের মালিক ও পুঁজির মালিক। কাঁচামালের উপর আধিপত্য, ফলে বিমলের শ্রমশক্তির ওপরেও আধিপত্য, সে নিজে কোনও শ্রমশক্তি দেয়নি। বিমল যন্ত্রের বা কাঁচামালের মালিক নয়, কিন্তু শ্রমশক্তির মালিক। কমল যন্ত্রের বা কাঁচামালের মালিক নয়, শ্রমশক্তিরও মালিক নয়। ইন্দ্রজিৎ যন্ত্রের বা কাঁচামালের মালিক নয়, শ্রমশক্তিরও মালিক নয়। এই সমীকরণ থেকে স্পষ্টই বলা যায়, অমল ছাড়া কেউই যন্ত্র বা কাঁচামালের মালিক নয়। এখানেই বিমল কমল এবং ইন্দ্রজিতের সাদৃশ্য। আবার এখান থেকেই আরেকটি সূত্রায়ন উঠে আসে বিমল একমাত্র শ্রমশক্তি ব্যয় করে। অমল কমল এবং ইন্দ্রজিৎ এরা অশ্রমশক্তি ব্যয় করেছে। এখানে এদের সাদৃশ্য। আরও সহজ ভাবে বললে দাঁড়ায়, কমল এবং ইন্দ্রজিৎ অনেকাংশেই বিমলের ঘনিষ্ঠ কারণ এরা কেউ মালিক নয়। আবার অন্য চোখে দেখলে এরা কেউ বিমলের ঘনিষ্ঠ নয়, অমলের ঘনিষ্ঠ। কারণ এরা কেউ শ্রমশক্তি খরচ করেনি। এরা বিমলের সৃষ্ট মূল্যকে আত্মসাৎ করেছে। কারণ বিমলই একমাত্র মূল্য সৃষ্টি করেছে। শ্রমসক্রিয়তা ছাড়া কোনও সম্পদ সৃষ্টি হয় না। ফলত মূল্য সৃষ্টি হয় না।

অমল মুনাফা অর্জন করে বিমলের সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে। আবার কমল এবং ইন্দ্রজিৎ যে বেতন পায় সেই বেতনও আসে বিমলের উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে। সেই বিচারে অমল কমল এবং ইন্দ্রজিৎ একই গোত্রের। এরা সকলেই বিমলের উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে। বাস্তবিকই কমল এবং ইন্দ্রজিৎ অর্থনীতির এক জটিল চরিত্র। এরা মালিক নয়, আবার শ্রমিক নয়। এরা শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য হজম করে, এই শ্রেণি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। উৎপাদনের আকৃতি ও প্রকৃতি যত ক্ষুদ্র পরিসরে হবে ততই অমল, কমল এবং ইন্দ্রজিতের প্রয়োজনীয়তা কমবে। বৃহদায়তন উৎপাদন হলেই কাঁচামাল ও তৈরি মাল গুদামজাত করা, সেলস ম্যানেজার, সিকিউরিটি অফিসার, সুপারভাইজার, শোরুম ম্যানেজার, সেলস বয় অ্যান্ড গার্ল, হিসেবপত্র রাখা, ক্যাশিয়ার, বিজ্ঞাপন, কত না ঝামেলা, কত কমল এবং ইন্দ্রজিতের প্রয়োজন। আর বৃহদায়তন উৎপাদন মানেই বেশি পুঁজি, একটি বৃহৎ ক্ষমতাবান মালিকের, অর্থাৎ অমলের প্রাধান্য বাড়বে।

অমলকে সহজেই চেনা যায়। সে পুঁজি বিনিয়োগ করে। সরাসরি বিমলের শ্রম, প্রাকৃতিক কাঁচামাল কিনে নেয়। কমল এবং ইন্দ্রজিতের পরিষেবা কিনে নেয়। কমল এবং ইন্দ্রজিতের যা কিছু দাবিদাওয়া, বিমলের দাবিদাওয়া সবই মালিক অমলের কাছে। এদিক থেকে বিচার করলে অমল একটা পক্ষ ও বিমল কমল এবং ইন্দ্রজিৎ অপরপক্ষ। শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিত, স্পষ্ট বিভাজিত দুই পক্ষ। কিন্তু বিন্যাসটা যদি পাল্টে দেওয়া যায়? বিমল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় একমাত্র শ্রম দিয়েছে, অমল কমল এবং ইন্দ্রজিৎ কোন শ্রম দেয়নি। অর্থাৎ কোনও মূল্য তৈরি করেনি। তাহলে দাঁড়ায়, এরা তিনজনেই বিমলের উদ্বৃত্ত শ্রম ও উদ্বৃত্ত মূল্য ভোগ করেছে। তাহলে এরা তিনজনেই পীড়নকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আসলে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট দুটি প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়— ১. কাঁচামাল যন্ত্র এসবের ওপর কার নিয়ন্ত্রণ, ২. কে শ্রম দিয়েছে। অথচ এই দুই প্রশ্নের মাঝে অসংখ্য মানুষের অবস্থান, যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, কিন্তু যন্ত্র বা কাঁচামালের মালিক নয়, আবার শ্রমেরও মালিক নয়। এই শ্রেণির আলোচনা করতে হবে।

প্রথম প্রশ্ন হল এই যে শ্রেণির কথা বলা হচ্ছে, যন্ত্রের মালিক নয়, আবার শ্রমের মালিক নয়। তাহলে এ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কী ভূমিকা নেয়? তাদের অবদান কী? কন্ট্রিবিউশন কী? ইনি সার্ভিস দেন, যাকে বলতে পারি পরিষেবা দান। এরা ছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপটি বাস্তবায়ন হয় না। অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি হবে, ব্যবহারমূল্যটি বিনিময়মূল্যে রূপান্তরিত হবে, অর্থে পরিণত হবে। সমগ্র অর্থনীতিতে এই পরিষেবার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই পরিষেবা শ্রম নয়। মাঝেমাঝেই আমরা শ্রমের সঙ্গে পরিষেবাকে গুলিয়ে ফেলি। এরা গোটা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় একটা উপযোগিতা, ডিজায়ার বা ওয়ান্ট তৈরি করে। এরা মূল্য সৃষ্টি করে না, কিন্তু এদের বাদ দিয়ে মূল্যটি বাস্তবায়িত হয় না। ধরা যাক একজন মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক মজুর যাকে আমরা ময়রা বলি, সে দোকানে দই বানিয়েছে। প্রবল গ্রীষ্মের দাবদাহে আমার দই খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, আমি দই কিনতে বেরোচ্ছি না। ধরা যাক একজন সেলস বয় যদি তখন থার্মোকলের বাক্সে, ঠান্ডা দই নিয়ে পাড়ার দরজায় দরজায় বিক্রি করতে আসে তখন আমার দই খাওয়ার ইচ্ছা পরিপূর্ণতা লাভ করে। আমি ওই সেলস বয়ের কাছ থেকে দই কিনলাম। সেলস বয় দই প্রস্তুত করেনি, মিষ্টির দোকানের মালিক সে নয়। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা ডিজায়ার বা ওয়ান্টকে বাস্তবায়িত করেছে। এটা একটা সার্ভিস দেওয়া এবং সেই সার্ভিসের অবশ্যই একটি কমিশন বা চার্জ থাকবে। মনে রাখতে হবে সেটা মজুরি না। শ্রমিকই একমাত্র মজুরি পায় শ্রমের বিনিময়। এটাকে বলা যায় সেবামূল্য। এই কমল এবং ইন্দ্রজিতের ভূমিকাটি ভারী বিচিত্র। এদের ছাড়া টেবিলের ব্যবহারিক মূল্য বাস্তবায়িত হবে না। অর্থে পরিণত হবে না। অথচ কাঠ থেকে টেবিল তৈরি, এই পরিবর্তনে, শ্রম পদ্ধতিতে বা উৎপাদনে, এদের কোনও ভূমিকা নেই। অর্থনীতিতে এদের এই ভূমিকাকে বলা হয়েছে বাস্তবায়ন বা রিয়েলাইজেশন। এদের প্রদেয় (২৫+৫০) ৭৫ টাকা হল বাস্তবায়ন খরচ বা রিয়েলাইজেশন কস্ট।

কিন্তু এই ৭৫ টাকা এসেছে বিমলের সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে। কারণ কমল এবং ইন্দ্রজিৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি। কিন্তু উদ্বৃত্ত মূল্যের অংশ পেয়েছে। কমল এবং ইন্দ্রজিতের সংখ্যা ক্রমাগতই বেড়ে চলে। ধরা যাক একটি সোফা। তার একটি নির্দিষ্ট ব্যবহারমূল্য আছে। এবার এমন একটি ডিজাইন তৈরি করা হল যে ওই সোফাটি প্রসারিত হয়ে বিছানায় পরিবর্তিত হবে। বিছানার ব্যবহারমূল্য পৃথক। অর্থাৎ শোফার ব্যবহারমূল্য এবং বিছানার ব্যবহারমূল্য, দুরকম ব্যবহারমূল্য, অতএব অতিরিক্ত অধিক বিনিময়মূল্য সৃষ্টি, অধিক দাম। এবার এই ডিজাইনারের সেবামূল্য দিতে হবে। সেও আসবে বিমলের শ্রমশক্তি দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে। আপনাকে যে ছেলেটি জয়শ্রী ফার্নিচারে নিয়ে যাবে আসবাব কেনার জন্য, জানবেন তারও একটা কমিশন প্রাপ্তি ঘটে। সেটাও দেওয়া হয় বিমলের শ্রমশক্তি সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে। শ্রমশক্তি ব্যয় না হলে কোনও উৎপাদন, সম্পদ সৃষ্টি, ব্যবহারমূল্য তৈরি হয় না। অতএব বিমল একমাত্র সম্পদ স্রষ্টা, মূল্য সৃষ্টি করে। আমরা বাকিরা, শিক্ষক অধ্যাপক ডাক্তার করণিক আইনজীবী সকলেই নানাবিধ পরিষেবার বিনিময়ে বেতন-কমিশন-সার্ভিস চার্জ ভোগ করি। মালিককে সহজে চিনতে পারি। তাই মালিক বাদে বাকি সকলকে শ্রমিক বলে বিবেচনা করি। এটা একটা বিভ্রান্তি। কাজ আর শ্রমের মধ্যে ফারাক বুঝতে না পারার বিভ্রান্তি। বিমল, কমল এবং ইন্দ্রজিৎ সবাই কাজ করে। কিন্তু বিমল একমাত্র শ্রমসক্রিয়তা সম্পন্ন করে, অন্যরা অশ্রমসক্রিয়তা সম্পন্ন করে।

ওপর ওপর দেখলে বিমল, কমল এবং ইন্দ্রজিৎ তিনজনেই সক্রিয়, তিনজনেই কাজ করে। এই দেখায় ভুল নেই। কিন্তু একটু গভীরে প্রবেশ করলে বুঝতে পারি, বিমল একমাত্র শ্রমশক্তি ব্যয় করে। অথচ আমাদের শ্রমিক সংগঠনগুলি অধিকাংশই শ্রমিক ও কর্মচারীদের নিয়ে তৈরি। শ্রমিকশ্রেণির পার্টিও শ্রমিক-কর্মচারীপূর্ণ। এমনকি অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন শিক্ষক, আইনজীবীদের নেতৃত্বে চালিত। শ্রমিকশ্রেণির পার্টি কমিউনিস্ট পার্টিতেও এই অশ্রমসক্রিয় শ্রেণির প্রাধান্য। অনেকেই তাত্ত্বিকভাবে উপযোগের যুক্তি হাজির করে, অশ্রমিকশ্রেণিকে যথার্থতা দিতে চেষ্টা করেন। তাদের মতে ব্যবহারমূল্য সৃষ্টি করাটাই প্রধান কথা নয়, সেই সৃষ্ট সামগ্রীকে ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেওয়াই হোক, তার মধ্যে উপযোগ বা ইউটিলিটি তৈরি করা, যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আসলে ইউটিলিটি বা উপযোগকে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু ব্যবহারমূল্যকে পরিমাপ করা যায়। প্রবল বর্ষণে আপনি নিশ্চয়ই চেষ্টা করেন বাইরে না বেরিয়ে ঘরে যাহোক করে ম্যানেজ করে নিতে। আবার নেশাগ্রস্তের কাছে প্রবল বর্ষণে যেকোনও মূল্যে তার নেশার সামগ্রীটি পাওয়ার জন্য সে বৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে পড়তে পারে। উপযোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আপনি চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে উঁচু তাক থেকে বই নামাতেই পারেন, চেয়ারটি সেক্ষেত্রে মই বা টুলের কাজ দিল, মইটি আনলেন না। কিন্তু তাই বলে চেয়ার তো মই নয়, চেয়ারটি নির্দিষ্ট চেয়ার। কলম দিয়ে আপনি লিখতে লিখতে কলমের পেছন দিয়ে পিঠ চুলকাতেই পারেন, ভিন্ন ইউটিলিটি পেতে পারেন। কিন্তু কলমটি তো কলমই। তাই বলছি শ্রম যে নতুন ব্যবহারমূল্য সৃষ্টি করে সেটার নির্দিষ্টতা আছে, কিন্তু উপযোগ অনির্দিষ্ট। উপযোগের সঙ্গে ব্যবহারমূল্যকে গুলিয়ে ফেলাটা ভুল হবে।

গুলিয়ে ফেলার আরও অনেক দিক আছে। ধরা যাক, একজন আসবাব দোকানের মালিক, সে কাঠমিস্ত্রির শ্রমশক্তি ক্রয় করে, কিন্তু শোরুমে নিজেই সেলস বয় হিসেবে বসে থাকে। তাহলে এক অর্থে সে মালিক, সে মজুরের শ্রমশক্তির ক্রেতা। আবার নিজেই সার্ভিস বা সেবা দান করে কর্মচারীর মতো। এটা এক জটিলতা। আরও জটিলতা দেখা যায়, যদি মালিক বিশেষ সময়ে, কাজের চাপ থাকার দরুন, নিজেই করাত হাতুড়ি বাটালি ধরে কাঠমিস্ত্রির কাজও করে। সে নিজে শ্রম দেয়, আবার অন্য কাঠমিস্ত্রির শ্রমশক্তি ক্রয় করে। এই মালিকের চরিত্রটি আরও ঘোলাটে। এভাবেই বিশুদ্ধ মালিক ও শ্রমিকের মাঝে বিরাজ করে এক বিরাট সংখ্যক অশ্রমজীবী। কার্ল মার্কস পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রেণিবিন্যাস অনেক স্পষ্ট সহজ সরল হয়ে এসেছে বলে মনে করতেন। মালিক ও শ্রমিক এই দৃষ্টি থেকে, সে-কথা সত্য। কিন্তু যে বিরাট সংখ্যক বহুস্তরবিশিষ্ট অশ্রমিক ও মালিক তৈরি হয়, তারা শ্রেণিসংগ্রামকে, শ্রমিকশ্রেণির ট্রেড ইউনিয়নকে, ও তার পার্টিকে ডাইল্যুট করে দেয়।

একটু উদাহরণ দিলে কতটা স্পষ্ট হয়। ধরা যাক ছোট ছোট জোতের কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের একেকটি যৌথ খামারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল সোভিয়েতে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৩ এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০ শতাংশ জমিতে যৌথ খামারের সিদ্ধান্ত হল। যদি ১০০০/২০০০ একর জমির খামার গড়ে ওঠে, সেটার পরিচালনব্যবস্থা একরকম। কিন্তু বাস্তবে বালান্দা, ইয়েলান, বালাকভ, সাময়লোভকা-তে ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার একর, ১০ লক্ষ একর, ৭ লক্ষ ৭৫ হাজার একর, ৩ লক্ষ ৫ হাজার একর, এইরকম সুবিশাল এক-একটা খামার গড়ে ওঠে।

(১) বহু মাঝারি ও ধনী কৃষক যৌথ খামারে অংশ নিয়ে সরকারি রাষ্ট্রীয় ইনসেনটিভ লাভ করে দিব্যি ফুলে ফেঁপে ওঠে।
(২) বড় জোতের মালিক হওয়ার কারণে যৌথ খামারে এরা বৃহৎ অংশীদার হয়ে যৌথ খামারের উপর এদের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।
(৩) খামারের আয়তন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে খামারের প্রাত্যহিক কাজের হিসাবপত্র রাখার জন্য, দেখভাল করার জন্য উচ্চক্ষমতাবিশিষ্ট ভারী মাপের অফিসার ও ম্যানেজারিয়াল স্টাফ প্রয়োজন হয়।
(৪) আনুভূমিকভাবে বিস্তার হল না, অসংখ্য যৌথ খামার গড়ে ওঠার পরিবর্তে, খুবই স্বল্প সংখ্যক পিরামিড আকৃতির, উল্লম্বভাবে উন্নয়ন ঘটতে থাকল।
(৫) সাইনবোর্ডে যা থাকল যৌথ খামার, বাস্তবে সেই খামারে বড় ধনী মালিককুল জাঁকিয়ে বসল। এরা স্বপ্নের যৌথ খামারকে নিদারুণ ভয়ঙ্কর যৌথ খামারে পরিণত করল। মাত্র তিন বছরের মধ্যে, ১৯৩০-৩১ সালের মধ্যে ষাট শতাংশ কৃষিজমি যৌথ খামারের অন্তর্ভুক্ত হল। যে বৃদ্ধিটা ছিল অস্বাভাবিক।

মাও সে-তুং কিন্তু দ্রুত উন্নয়নের এই সোভিয়েত মডেলের বিপদের দিকটি বহু আগেই উপলব্ধি করেছিলেন: The authority of state farm managers and collective farm chairmen developed to such a degree that coupled with the encouragement of individual enterprise, there was in many cases the exploitation of collective and state farm workers to create individual wealth. এভাবেই শ্রমিক সংগঠন ও কমিউনিস্ট পার্টির সাইনবোর্ডের আড়ালে পুঁজিবাদ ধীরে ধীরে স্থায়ী ভিত্তি রচনা করে। …elite planned and bureaucratically administrated programmes of economic development… কমল এবং ইন্দ্রজিৎদের প্রাধান্য বাড়িয়েই চলে।

প্রসঙ্গক্রমে ইন্দ্রজিৎদের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ল। এটি গল্প নয়, তখন পার্টি অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরদের সংগঠিত করার কর্মসূচি নিয়েছে। হকার, রিকশা ও ভ্যানচালক, রেলের কুলি পোর্টার, দোকান-কর্মচারী, বাবুর বাড়ির কাজের লোক, ইত্যাদি অংশকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমি রিক্সা ও ভ্যানচালক ইউনিয়নের সংগঠনে কাজ করছি। কাজ করছি মানে, রিক্সা বা ভ্যান চালাচ্ছি না, তাদের সভায় গিয়ে বক্তৃতা করছি। রাজ্য কমিটি থেকে এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাদের রাজ্যনেতা মৃণাল দাসকে। ঘটনা হল চন্দননগরে রিক্সা ও ভ্যানচালকদের সভা শেষ করে একটা চায়ের দোকানে বসে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছি। তখন রিক্সাচালক হারাধনদা আমাকে বললেন, আচ্ছা কমরেড কোন আক্কেলে আপনারা রিক্সা আর ভ্যানচালককে একটা ইউনিয়নে জড়ো করলেন? আমি অবাক চোখে তাকালাম। কেন, অসুবিধা কোথায়? উনি বললেন, আমার চোখে তো রিক্সা আর ভ্যানের তিনটা চাকা ছাড়া আর কোনও মিল নাই। শুনে আমি বিস্মিত।

এরপর হারাধনদা যা বললেন তা শুনে অবাক হতেই হয়। তিনি বললেন ভ্যানচালকের একটা নির্দিষ্ট মালিক আছে। সাধারণত ইমারতি মালপত্রের গোলা, সিমেন্টের গোলা, চাল-গমের বা খোল-ভুষির গোডাউন, অথবা লোহালক্কর, লোহার রড, কলের পাইপ, এইসব নিতে গেলে আমরা রিক্সাভ্যান খুঁজি। আমি এগুলো নিতে ভ্যান ধরতে একরকম বাধ্য। ফলে ভ্যানরিক্সাচালক আমার ওপরে তার প্রাপ্য ভাড়া নিয়ে জোর খাটাতে পারে। বাধ্য করতে পারে। আপনি কাঠের গোলা থেকে দরজা-জানলা নেবেন, কি খাট-আলমারি নেবেন, গ্রিলের জানালা নেবেন, ভ্যান ছাড়া আপনার উপায় নেই। কিন্তু রিক্সা ধরার ক্ষেত্রে আপনি অতটা বাধ্য নন। হ্যাঁ, অসুস্থ রোগী থাকলে আপনি বাধ্য হতে পারেন। কিন্তু সাধারণভাবে রিকশাচালক আপনার মনপসন্দ ভাড়া না চাইলে, আপনি দু-পা এগিয়ে অন্য রিকশায় দরদাম করেন। বা আরও একটু এগিয়ে যান। কখনও একরাশ বিরক্তি নিয়ে হেঁটেও যেতে পারেন। অর্থাৎ রিক্সাচালক আপনাকে বাধ্য করার ক্ষেত্রে কম সক্ষম। তুলনায় ভ্যানরিক্সা নিতে আপনি অনেকাংশেই বাধ্য। আরও মজার কথা চারদিকে কলকারখানা এসব যত বন্ধ হচ্ছে নতুন নতুন অস্থায়ী রিক্সাচালক বাড়ছে। ফলে এরা যেহেতু স্থায়ী নয়, এরা যে কোনওরকম ভাড়ায় কয়েক খেপ মেরে, কিছু পয়সা কামিয়ে, ঘরে যায়। এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় স্থায়ী রিক্সাচালকদের ভাড়া কম রাখতে হবেই। অর্থাৎ অনেক বেশি অসহায়। এবার বলুন ভ্যানচালকের সঙ্গে রিক্সাচালকের সমস্যার বিস্তর ফারাক। তাহলে এরা কী করে একটি ইউনিয়নে সংঘবদ্ধ হবে? কথা শুনে বুঝেছিলাম বাইরে থেকে ইমপোর্টেড নেতা সংগঠনে কিছু সার্ভিস দিতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। হারাধনদা বলেছিলেন— আপনি, আপনার আত্মীয়স্বজন, আপনার বন্ধুবান্ধব, কেউ একজনও কি রিক্সা চালায়? তাহলে আপনি কীভাবে আমাদের সমস্যা বুঝবেন?

কমল এবং ইন্দ্রজিৎরাই শ্রমজীবী সংগঠনে, শ্রমিকশ্রেণির পার্টিতে জাঁকিয়ে বসে। একটি বিপ্লবী তত্ত্ব এদের হাতে পড়ে সংশোধনবাদী বিপ্লববিরোধী তত্ত্বে পরিণত হতে পারে এবং হয়েছিল। সামাজিক পুঁজি, সামাজিক শ্রম, কিন্তু মালিকানাটি ব্যক্তিগত। এমন একটি ব্যবস্থা খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিল। আদর্শ ও সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতার মরাল ইনসেনটিভ দিয়ে মানুষকে যৌথ খামারের আত্মত্যাগে সামিল করা হল। কিন্তু আত্মত্যাগের ফসলটি উঠল ব্যক্তিগত খামারে। এই অবস্থা চলা সম্ভব ছিল না। কমল এবং ইন্দ্রজিৎরা আগেই সমাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি ভেঙেছিল, ফলে লেনিনের মূর্তি ভাঙাটা ছিল সময়ের অপেক্ষা।