সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চেনা চেহারা বদলে যাওয়ার ফলে নদীগুলো তাদের গতি-চরিত্র যেমন বদলাতে বাধ্য হয়েছে তেমনই তাদের নিয়ে আমাদের বর্ধমান অবহেলা নদীগুলোর প্রবাহ-বৈশিষ্ট্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। নদীকে জড়িয়েই মানুষের তথা মানুষের সভ্যতার গৌরবময় বিকাশ। অথচ নদীর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। পৃথিবীর জনসংখ্যা যত বেড়েছে ততই স্বল্প থেকে স্বল্পতর হয়েছে পেয় জলের ভাণ্ডার। মানুষের বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা নদীর অস্তিত্বকে আরও আরও সঙ্কটাপন্ন করেছে
সকালবেলা বাড়ির একান্ত পরিজনদের বাদ দিয়ে যে মানুষটির মুখ দেখে আমার দিন শুরু হয় তার নাম ভোলা। শক্তপোক্ত, বলিষ্ঠ চেহারা তার, অথচ বেশ নরম মনের মানুষ। রবিবার বাদে সপ্তাহের বাকি ছ-দিন হুইসল বাজিয়ে পাড়ার এ-গলি সে-গলি, এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঘুরে ঘুরে প্রতিদিনের গৃহস্থালি বর্জ্য ময়লা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। অধিকাংশ দিন ওর সঙ্গে টুকটাক নানা বিষয়ে প্রভাতী আলাপচারিতা বেশ জমে ওঠে। আজ সকালেই যেমন এসে বলে—
“কাকু! নলের কলে আজ আর জল পাবে না।”
ভোলার কথা শুনে আমার প্রতিবেশী স্বপনদা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বলে— “এই চাঁদিফাটা গরমে যদি ঠিকঠাক জল না পাই তাহলে বাপু নারায়ণের কী হাল হবে তা ভেবে দেখেছিস?” ভোলার এমন ভবিষ্যদ্বাণী শুনে মনে মনে বেশ কাতর হয়ে পড়ি। ময়লার বালতি দুখানি ভোলার হাতে তুলে দিতে দিতে খানিকটা ত্রস্ত কণ্ঠে বলি— “তা ভোলা, নলে ভাল জল আসবে না কেন?” ব্যস্ত হাতে বালতির আবর্জনা গাড়ির নির্দিষ্ট অংশে ঢালতে ঢালতে ভোলা বেশ চড়া সুরে উত্তর দেয়— “আরে বাপু, গঙ্গায় জল নেই।” কোনওরকমে এই কথা কটি উগড়ে দিয়ে হুইসল বাজিয়ে ভোলা চিত্রপট থেকে সরে যায়। আমিও উদ্বিগ্ন হয়ে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই। নদীতে জল নেই-নদীতে জল নেই জপ করতে থাকি নিজের মনে।
জল নেই নদীতে
আশা ভোঁসলের সেই বিখ্যাত গানের প্রথম কলিটিকে স্মরণ করুন— ফুলে গন্ধ নেই, এ তো ভাবতেও পারি না। এই লাইনটির অনুরণনে বলি— গাঙে জল নেই! এ তো ভাবতেই পারি না। গন্ধ ছাড়া ফুল, আর জল ছাড়া গাং আবার হয় নাকি? বাপু রে, হয় হয়। তোমরা জানতি পারো না। এই কলিকালের ধরার আঙিনায় সব হয়।
কেবলমাত্র আমাদের দেশে নয়, সাম্প্রতিককালে সমগ্র পৃথিবী জুড়েই এমন একটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা লক্ষ করেছেন গবেষকরা। আসলে নদীতে বহমান জলের জোগানে টান পড়লেই নদী আস্তে আস্তে ক্ষীণতোয়া হতে শুরু করে, আর তারপর তার মূল প্রবাহটি জলশূন্য হয়ে একসময় শুকিয়ে যায়। পৃথিবীর সমস্ত নদীকে তার প্রবহমানতার বৈশিষ্ট্য অনুসারে দুটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেছেন নদীবিজ্ঞানীরা। যেসব নদীতে সারাবছরই পরিমিত জলের জোগান বজায় থাকে তারা হল চিরপ্রবাহী বা নিত্যবহ নদী। আমাদের দেশের গঙ্গা, চিনের হোয়াংহো এই ধরনের নদী। লক্ষ করে দেখা গেছে যে হিমবাহের বরফগলা জল এবং অববাহিকার বৃষ্টির জল যেসব নদীর মূল ধারায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছয় তারা সকলেই নিত্যবহ। অন্যদিকে অবস্থানগত কারণে যেসব নদী বরফগলা জলের জোগান থেকে বঞ্চিত, প্রবহনধারা বজায় রাখতে একান্তভাবেই বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভরশীল তারা অনিত্যবহ চরিত্রের। ভারতের উপদ্বীপীয় মালভূমির উচ্চাবচ তরঙ্গায়িত ভূমিরূপের ওপরে বয়ে চলা সব নদীই এই শ্রেণির।
বর্ষার জলের ভরসায় এরা ফুলেফেঁপে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলেও গ্রীষ্ম ও শীতকালে তাদের রবিঠাকুরের এঁকেবেঁকে চলা ছোট নদীর দশা।
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নদীর জলস্তর ওঠানামা করে। বর্ষায় জলের মাত্রা বেড়ে যায়। কখনও কখনও অতিরিক্ত পরিমাণে বৃষ্টি হলে তা নদীখাত উপচিয়ে পাশের জমিতে ছড়িয়ে পড়ে বন্যার সৃষ্টি করে। নদীর নাব্যতা কমে গেলে নদী নির্ভর ক্রিয়াকলাপ ব্যাহত হয়। অথচ যুগ যুগ ধরে নদীকে আপন মনে করেই মানুষ নদী অববাহিকায় বসতি স্থাপন করেছে, গড়ে তুলেছে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার গৌরবময় উত্তরাধিকার।
এই কারণেই নদীতে জলের জোগানে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় আজ বিশ্ব জুড়ে হাহাকার রব উঠেছে। জলের চিরায়ত জোগানে কেন এমন টান পড়েছে, তার সম্ভাব্য কারণগুলো খতিয়ে দেখা যাক্।
উধাও জলের উপাখ্যান
নদী শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। বেশ মনে পড়ে, সপ্তগ্রামে ঘুরতে গিয়ে এক ডাঙাজমির ওপর একঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশের মাথায় ঝোলানো এক বিবর্ণ সাইনবোর্ডের ওপরের লেখা দেখে খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। কী লেখা ছিল সেখানে? লেখা ছিল— সরস্বতী নদী। শুকনো খটখটে জমিতে খান কয়েক চতুষ্পদ ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছিল। অথচ এক সময় সপ্তগ্রাম ছিল এক ব্যস্ত নদীবন্দর। মূল নদীর নিম্ন অববাহিকায় নদী বারংবার গতিপথ পরিবর্তন করে, ফলে বহু শাখানদী প্রয়োজনীয় জলের জোগানের অভাবে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় বা মজে যায়। নদীর এমন স্বাভাবিক প্রবণতাকে বাদ দিলে অন্য যেসব কারণে একটি নদী শুকিয়ে যায় তাদের দুটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেছেন নদীবিজ্ঞানীরা। প্রথমত, আবহিক কারণ অর্থাৎ আবহাওয়া তথা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটলে নদীর প্রবহমানতার ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, ফলে নদীর জলস্তর কমতে কমতে একসময় শুকিয়ে যায়। আর দ্বিতীয় কারণগুলো হল ব্যবহারিক কারণ। এই দুই কারণ নিয়েই আলোচনার প্রয়োজন আছে।
নদী শুকিয়ে যাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে আবহাওয়া বদলের বিষয়টি ইদানিং বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আলোচনায় উঠে এসেছে। নদীর প্রবহমানতা নির্ভর করে বছরভর পর্যাপ্ত জলের জোগানের ওপর; জলের জোগান নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর; বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও পর্যাপ্ততা নির্ভর করে আবহিক উপাদানগুলোর কার্যকারণ ভারসাম্য তথা স্থিতাবস্থার ওপর। আর এই স্থিতাবস্থাকে প্রভাবিত করার পেছনে বহু আলোচিত গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব-উষ্ণায়নের খুব বড়সড় প্রভাব রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথিবীর গ্যাসীয় বাতাবরণের শৃঙ্খলায় পরিবর্তন আনতে মানুষের খবরদারি কতটা দায়ী সেই বিতর্কে না জড়িয়েও বলা যায় যে পৃথিবী ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। এর দরুণ বিপন্নতার শিকার হচ্ছে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্থিব তন্ত্র— পৃথিবীর তাপ বাজেট এবং পৃথিবীর জলচক্র। এখানে মনে রাখা দরকার যে একটির পরিবর্তন অন্যটির শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত, বিপর্যস্ত করে। আমাদের পৃথিবীর ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে এবং এর ফলে জলের ভাণ্ডার ক্রমশ কমছে। পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে জলের বাষ্পীভবনের মাত্রা, কমছে জলস্তর। পরীক্ষাসূত্রে জানা গিয়েছে যে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই হ্রাসের পরিমাণ গড়পড়তা ৪০-৫০ শতাংশ। বৃষ্টিহীন খরা পরিস্থিতির স্থায়িত্ব যত দীর্ঘায়িত হবে ততই জলস্তর নেমে যাবার প্রবণতা বাড়বে। যেসব নদী একান্তভাবেই বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভরশীল তাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা আরও আরও গভীর হবে এবং একসময় তা হয়তো একদম শুকিয়ে যাবে। ভারতের উপদ্বীপীয় মালভূমির নদীগুলোতে এই সমস্যা প্রকট।
খুব সম্প্রতি সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে উপদ্বীপীয় মালভূমির কমপক্ষে ১৩টি নদী বৃষ্টিহীন শুখা পরিস্থিতির কারণে একদম শুকিয়ে গেছে। এই নদীগুলো মহানদী ও পেন্নারের মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত। ভারতের মানচিত্রে এই নদীগুলোকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া না গেলেও স্থানীয় মানুষদের জীবনে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই নদীগুলো হল— ঋষিকুল্য, বাহুদা, বংশধারা, নাগভালি, সারদা, বরাহ, তাণ্ডব, এলুরু, গুন্ডলাকাম্মা, তাম্মিলেরু, মুসি, পালেরু এবং মুন্নেরু। পূর্ববাহিনি এই নদীগুলো অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও ওড়িশা রাজ্যের ৮৬,৬৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। মূলত বৃষ্টির জলদ্বারা পরিপুষ্ট এই নদীগুলো বর্তমানে খরাজনিত শুষ্কতার কারণে জলহীন।
বিগত বছরের স্বল্প বৃষ্টিপাতের কারণে এই নদীগুলোতে জলের ভাণ্ডার নিঃশেষিত প্রায়। পাশাপাশি অস্বাভাবিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টি কেবলমাত্র এ-দেশেই সীমাবদ্ধ রয়েছে এমন নয় কখনওই, গোটা পৃথিবী জুড়েই এই সমস্যা এখন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জলবায়ুর চেনা চরিত্র বদলে যাওয়ার ফলে পার্বত্য হিমবাহগুলোর অস্তিত্বও আজ সঙ্কটাপন্ন। অথচ হিমবাহকে বলা হয় প্রাকৃতিক জলাধার। পৃথিবীর পেয় জলের একটা বড় অংশ হিমবাহের বরফস্তূপে গচ্ছিত থাকে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিমবাহগুলো নদীর জলের হ্রাস-বৃদ্ধির প্রাকৃতিক ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে নদীর গতিধারায় বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। হিমালয়ের কথাই ধরা যাক। উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় হিমবাহগুলো তাদের আগের অবস্থান থেকে ক্রমশ পিছু হটছে। ভারতের উত্তরভাগের নদীগুলো এই হিমবাহের বরফগলা জলের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহের পিছিয়ে যাওয়া গঙ্গা-সহ অন্যান্য নদীর জলস্তরের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।
গোটা ইউরোপ জুড়ে চলছে উষ্ণতার দাপাদাপি। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে ইউরোপ মহাদেশে উষ্ণতা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। এর ফলে মহাদেশের জলবায়ুর ভারসাম্যের এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে অদূর ভবিষ্যতে মহাদেশের নদী নির্গম ব্যবস্থায় গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে হিমালয়ের মতো আল্পসের হিমবাহগুলো তাদের আগের আকৃতির প্রায় ১০ শতাংশ খুইয়েছে বিগত মাত্র দু-বছরে। দক্ষিণ ইউরোপের নদীগুলো যেমন ইতালির পো, জার্মানির রাইন, ফ্রান্সের লিয়ঁ, আন্তর্জাতিক নদী দানিয়ুব— সব এই মুহূর্তে জলসঙ্কটের সম্মুখীন। এই তালিকা ক্রমশই বাড়ছে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চেনা চেহারা বদলে যাওয়ার ফলে নদীগুলো তাদের গতি-চরিত্র যেমন বদলাতে বাধ্য হয়েছে তেমনই তাদের নিয়ে আমাদের বর্ধমান অবহেলা নদীগুলোর প্রবাহ-বৈশিষ্ট্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। নদীকে জড়িয়েই মানুষের তথা মানুষের সভ্যতার গৌরবময় বিকাশ। অথচ নদীর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। পৃথিবীর জনসংখ্যা যত বেড়েছে ততই স্বল্প থেকে স্বল্পতর হয়েছে পেয় জলের ভাণ্ডার। মানুষের বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা নদীর অস্তিত্বকে আরও আরও সঙ্কটাপন্ন করেছে। কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নগরায়ন, নাগরিক পরিষেবা সবকিছুই নদী তথা নদীর জলের ওপর নির্ভরশীল। নদীর ওপর যথেচ্ছ বাঁধ নির্মাণ, নদীধারা থেকে খাল কেটে সেচের ব্যবস্থা করা, নাগরিক জলপরিষেবা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য যথেচ্ছভাবে নদীর জলকে কাজে লাগানো— এই সবই নদীপ্রবাহকে প্রভাবিত করছে। আমাদের নদীজল ব্যবস্থাপনা একেবারেই সুষম যাপনের অনুকূল নয়। যতদিন যাবে ততই বাড়বে নদীকে নিয়ে মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা। শুকিয়ে যাবে সভ্যতার প্রাণধারা।
বলতে বা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই নির্মম সত্য যে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নদীগুলো চূড়ান্ত অবহেলার শিকার। আমাদের দেশের কথাই ধরা যাক। আর্যাবর্তের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাণধারা গঙ্গানদী আজ দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ পয়ঃপ্রণালীতে পরিণত হয়েছে। নদীর দুই ধারে গড়ে ওঠা জনপদের বিপুল পরিমাণ বর্জ্য বহন করতে করতে নদী আজ বিপন্নতার শিকার। অথচ গঙ্গা-আরতি, গঙ্গাপূজা সবই চলছে। নদীর কান্নার শব্দ আমাদের কানে যায় না বা পৌঁছলেও তাকে আমরা উপেক্ষা করতেই অভ্যস্ত। নদীর জল দূষিত হওয়ার অর্থই হল তা অব্যবহার্য হয়ে পড়া। এমন নদী আমাদের কোন কাজে লাগে?
নদীর জল যদি মানুষের কাজে না আসে, নদীর জল যদি পাপীদের পাপ ধুতে ধুতে ময়লা হয়ে যায় তাহলে সেই নদী যে শারীরিকভাবে অসুস্থ, শুখা হয়ে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আজ ভারত-সহ পৃথিবীর বহু নদী এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। অসচেতন, অজ্ঞ মানুষ নিয়তই প্রকৃতিকে শোষণ করতে অভ্যস্ত, নদী তার থেকে মুক্ত থাকতে পারে?
আসলে নদী মানে তো নিছকই একটা জলধারা নয়, নদী হল একটা অনন্য যাপন। এই যাপন কি কেবলই তার পরিবাহী অঞ্চলের মানুষের? কখনওই নয়। নদীকে জড়িয়েই যেমন মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম, সংস্কৃতি, সোহাগ, বিরাগের নানান রংবেরঙের উদযাপন, তেমনই যে নদীর ওপর নির্ভরশীল পাখপাখালি, গাছগাছালিরা। তাই নদী শুকিয়ে যাওয়া মানেই হল জীবনের বর্ণময় উৎসবের আলো নিভে যাওয়া। মনে রাখতে হবে এমন উৎসবের আঙিনা সেজে উঠেছে কোনও সুদূর অতীতে, পৃথিবীর ফেলে আসা সময়ে। আমরা মানুষেরা যে সেদিনের অতিথি এই ধরিত্রীর আঙিনায়। মান আর হুঁশের গরিমায় আমরা আমাদের নিবিড় নদীযাপনকে বিস্মৃত হয়েছি। আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা যে এক সামূহিক যাপনেরই অংশ তা আমরা মনেই রাখিনি। নদীর বিচরণভূমির দখলদারিতে মেতে উঠেছি, নদীশাসনের নামে যথেচ্ছভাবে শৃঙ্খলিত করেছি নদীর ছন্দোময় সর্পিল চলনকে, উজান আগলে নিঃস্ব করছি ভাটির জমিন। আজ যখন প্রকৃতির ভয়ঙ্কর অনুদার রোষানলে জ্বলছে ধরিত্রীর মাঠময়দান খালবিল, তখন নদীর শুকিয়ে যাওয়া নিয়ে হাহুতাশ করছি। সেই বিলাপও যে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত নয়। তাই নদীর হাহাকার নদীর জলেই বুঝি নীরবে মিশে থাকে বুকচাপা কান্না হয়ে। সেই কান্না কি আমাদের কানে পৌঁছায়?
ভোলারামের বচন
আজ শেষ করব ভোলারামের কথার প্রসঙ্গের রেশ ধরে। সে জানে, আমাদের পৌরসভার ওয়ার্ডগুলোতে যে জল সরবরাহ করা হয়ে থাকে তা পাইপ-পথে গঙ্গা থেকে নিয়ে আসা হয়। এমন গরমে নদীর জলস্তর দ্রুত নামছে। নদীর বুকে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। এর ফলে নদীর প্রবাহী অংশের বিস্তৃতিও কমছে লক্ষণীয়ভাবে। পৌরসভার আশঙ্কা, গঙ্গাবক্ষে নতুন ইনটেক পয়েন্ট ঠিক করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বর্তমান ইনটেক পয়েন্টের বদলে নতুন স্থান নির্বাচন শুধু সময়সাপেক্ষ নয়, যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষও বটে। তাহলে…?
শোকসংবাদ
গভীর দুঃখের সঙ্গে কর্নাটকের কোডাগু অঞ্চলের অধিবাসীদের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি যে আমাদের জেলার অতিপরিচিত স্রোতস্বিনী লক্ষণ তীর্থ তীব্র দাবদাহের কারণে একদম শুকিয়ে গেছে। আজ আমাদের জীবন বিপন্ন। আসুন আমরা আমাদের শোক জ্ঞাপন করি।