সায়ন্তন দত্ত
হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল দ্বারা সম্প্রচারিত আদর্শ যেমন মনে করে, কোনও এক কালে, ইসলাম আসার আগে এই ‘কাল্পনিক’, গৌরবান্বিত অতীত ছিল— তাদের লক্ষ্য হবে আবার সেই অতীতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। একইভাবে, পশ্চিমবাংলার এই চিত্রপরিচালকেরা তাঁদের কাজে মনে করিয়ে দেন— একসময় বাংলা সিনেমার এই মসিহারা যেমন রক্তমাংসে ঘুরে বেড়াতেন— এই তো রুপোলী পর্দার জাদুতে তাঁরা আবার ফেরত আসছেন। যতই তাঁরা রাজনৈতিক দিক থেকে, ছবির বিষয়বস্তুর নিরিখেও দক্ষিণপন্থার বিরোধিতা করুন, তাঁদের ছবির আঙ্গিক নস্টালজিয়ায় মুড়ে দক্ষিণপন্থী হয়ে যায়, স্পর্শযোগ্য সেই অতীত তাঁদের কাছে সুখী আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে
২০২৪ সালের মে মাস— দেশব্যাপী লোকসভা নির্বাচন ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জন্য জরুরি আরেক কারণে। অবশ্য আগের বাক্যের ‘পশ্চিমবঙ্গের’ এবং ‘বাঙালি’ শব্দদ্বয়ের মাঝে ‘সংস্কৃতিমনস্ক’, কিংবা ‘সিনেপ্রেমী’ ইত্যাদি বিশেষণ জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। মৃণাল সেন, বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই চিত্রপরিচালক, ২০২৪ সালের এই মে মাসে, যখন সারা দেশ আরও বেশি করে দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকছে, তখনই একশো বছরে পা দিলেন। তাঁর জন্মশতবর্ষের মাসেই দেশজোড়া লোকসভা নির্বাচন এবং ক্ষমতাসীন উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা নিশ্চয়ই সমাপতন— মৃণাল সেন নিশ্চয়ই আজকের সময় হিসেব করে একশো বছর আগে জন্মাননি। কিন্তু প্রথম জীবনে বামপন্থী রাজনীতির সক্রিয় সাংস্কৃতিক কর্মী, এবং পরবর্তীকালে মৃত্যু অবধি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সংলাপে থাকা এই চলচ্চিত্রকারের জন্মশতবর্ষ আর দেশজোড়া দক্ষিণপন্থী আগ্রাসন পাশাপাশি এক টাইমলাইনে বসিয়ে নিছক হাহুতাশ করলে আমরা বড় ভুল করব।
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমা অবশ্য কোনওমতেই সেই ভুলের বশবর্তী হয়ে চোখ বুজে বসে নেই— তারা মহোৎসাহে মৃণাল সেনের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে চাইছে। এই অবধি লেখাটি পড়েছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সানন্দে নিরুৎসাহী (ইংরেজিতে যাকে বলে ব্লিসফুলি ইগনোরেন্ট) এমন কেউ যদি থেকে থাকেন (এই দুইয়ের মিশ্রণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব)— তাঁর নিশ্চয়ই মনে হবে, এই রাজ্যের চলচ্চিত্রজগৎ নিশ্চয়ই মৃণাল সেন বিষয়ক আলোচনাসভা, লেখালেখি, তাঁর ছবির রেস্টোরেশন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত আছে। বস্তুত আলোচনাসভা, পত্রপত্রিকা, বইটই নিশ্চয়ই বেরোচ্ছে, কিন্তু তাতে চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত কেউ আছেন বলে খুব একটা শোনা যাচ্ছে না। আর রেস্টোরেশন, আর্কাইভ নির্মাণ— এইসব কাজে বাঙালিরা কোনওকালেই খুব একটা উৎসাহী নয়— বাংলা ছবির প্রিন্ট গুদামে পড়ে থেকে, আগুনে পুড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়, ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা প্রবীণ টেকনিশিয়ানরা শেষজীবনে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেন, তাঁদের কথাবার্তার ডকুমেন্টেশনের অভাবে ইতিহাস হারিয়ে যায়— এসব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রজগতের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। তাঁরা এক বিচিত্র উপায়ে মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর উপায় খুঁজে নিয়েছেন।
২০২৪ সালের মে মাস— এই সময়েই, মৃণাল সেনের জন্মদিনের ঠিক আগে, প্রেক্ষাগৃহে (চারদিনের জন্য) এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে একইসঙ্গে মুক্তি পেয়েছে অঞ্জন দত্ত নির্মিত চালচিত্র এখন (২০২৪)। এ-ছবিতে মৃণাল সেনের ভূমিকায় অঞ্জন দত্ত স্বয়ং অভিনয় করেছেন— ছবিটিও ব্যক্তি অঞ্জনের সঙ্গে মৃণাল সেনের সম্পর্ক গড়ে ওঠার মুহূর্তটি নিয়ে। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সৃজিৎ মুখার্জির আসন্ন পদাতিক (২০২৪) ছবির টিজার এসে গেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সুদক্ষ অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী মৃণাল সেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। টিজার দেখে যতটুকু বোঝা যায়, এই ছবিতে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত রক্তমাংসের মৃণাল সেন চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।[1] একই সঙ্গে বোঝা যায় মৃণাল সেনের আত্মজীবনী, বেশ কিছু ফটোগ্রাফের হুবহু নকল করে কিছু দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে, যা উৎসকে প্রায় ফটোকপির মতো পুনর্নির্মাণ করে।
কিছুদিন আগে কৌশিক গাঙ্গুলি মৃণালের খারিজ (১৯৮২) ছবির স্মৃতি উসকে বানিয়েছেন পালান (২০২৩)। আরও কিছুদিন আগে, সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে একইভাবে নির্মিত হয়েছে অনীক দত্তের অপরাজিত (২০২২)— যে ছবিরও প্রধান ইউএসপি ছিল জিতু কামালের অভিনয়ে পর্দায়ে উপস্থিত প্রায় আসল (ফটোকপি) ‘সত্যজিৎ’। উত্তমকুমারকে নিয়ে নির্মিত অতনু বোসের ছবি অচেনা উত্তম (২০২২), সেখানেও ছিল এই ফটোকপির লজিক। কিছুদিনের মধ্যেই আসতে চলেছে ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষ। কমলেশ্বর ইতিমধ্যেই তাঁর মেঘে ঢাকা তারা (২০১৩)–য় ঋত্বিকের বায়োপিক বানিয়েছেন, যদিও সেখানে এই ফটোকপির যুক্তি পরিহার করা হয়েছিল। ঋত্বিকের শতবর্ষে নিশ্চয়ই আবারও নতুন কিছু ছবি আসবে— এহেন শ্রদ্ধার্ঘ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্রকারদের আর মুক্তি নেই বলেই মনে হয়।
দুই.
সৃজিৎ মুখার্জি, কৌশিক গাঙ্গুলি, অঞ্জন দত্ত, অনীক দত্ত— ইত্যাদিদের এই ছবিগুলিকে চলচ্চিত্রবেত্তারা কখনও আর্বান পপুলার[2], কখনও নিও-ভদ্রলোকের[3] ছবি নামে অভিহিত করেছেন। আশির দশকে এতদিনকার মূলধারা এবং সমান্তরাল ধারার বাংলা ছবির একযোগে প্রায় মৃত্যুর পর ধুঁকতে থাকা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অর্থনৈতিক চাবিকাঠি একদিকে যদি নিয়ে নেয় স্বপন সাহা-ধর্মী বাবা কেন চাকর (১৯৯৮)-টাইপ বাংলা ছবি, অন্যদিকে ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন ইত্যাদিরা বিগত শতকের একধরনের প্রেস্টিজিয়াস বাংলা ছবির (পড়ুন সত্যজিতের) পুনরুত্থানের চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু নব্বই দশকের নব্যউদারবাদী অর্থনীতির নতুন ধরনের শহুরে কনজিউমার-দর্শককে খুশি করতে গিয়ে তাঁদের ছবি অচিরেই ঢুকে পড়ে উচ্চবিত্তের ড্রয়িংরুমে— সম্পর্কের টানাপোড়েন হয়ে ওঠে ছবির একমাত্র বিষয়। বাংলা ছবির ইতিহাসে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের ধারা, যেখানে মৃণাল সেন প্রতিনিধিস্বরূপ— সেই ধারাটি প্রায় সযত্নে লোপ পেয়ে যায়। পড়ে থাকে শপিংমলমুখী নতুন বাঙালির নতুন ‘আর্ট’ ছবি, যারই পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেন সৃজিৎ, কৌশিক, কিছুটা অঞ্জন (তিনি দুই প্রজন্ম জুড়েই আছেন)।
বলা বাহুল্য, গত এক দেড় দশকে এই ধারার ছবি তার চেহারার অনেক কিছুই বদলে ফেলেছে। যেমন আগের অনুচ্ছেদে ছবির ‘বিষয়’ এবং ‘সেটিং’ সংক্রান্ত যে অভিযোগটি করা হল, সেটিই সৃজিতের সাম্প্রতিকতম অধিকাংশ ছবির ক্ষেত্রেই খাটে না। জাতিস্মর (২০১৪), রাজকাহিনী (২০১৫), জুলফিকার (২০১৬), উমা (২০১৮), দ্বিতীয় পুরুষ (২০২০), এক্স=প্রেম (২০২২), হাল আমলের অতি উত্তম (২০২৪)— কোনওটিই সেই অর্থে উচ্চবিত্ত বাঙালির ড্রয়িংরুমের ক্রাইসিস নয়। কৌশিক, অঞ্জন, মৈনাক ভৌমিক— এরা প্রত্যেকেই বিষয়বৈচিত্র্যে নিজেদের পাল্টেছেন। অনীক দত্তের প্রথমদিককার দুটি ছবি তো বিষয় হিসেবে আক্ষরিক অর্থেই বিচিত্র— ভূতের ভবিষ্যৎ (২০১২) এবং আশ্চর্য প্রদীপ (২০১৩)।
সংস্কৃতি দ্বারা নির্ধারিত বাংলা ফিল্মের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর— সত্যজিৎ,ঋত্বিক, মৃণাল— এই তিনমূর্তির জন্মশতবর্ষ আসার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল, এই ফিল্মমেকারদের একটা বড় অংশ এঁদের নিয়ে ছবি করার কথা ঘোষণা করলেন। উল্লেখযোগ্য, নতুন এই চলচ্চিত্রকারদের ছবিগুলি, যা নিয়ে এই লেখা শুরু করেছি, এবং এঁদের আগের ছবি, যা এক্ষুনি আলোচিত হল— এই সব নিয়েই পশ্চিমবাংলার শহুরে দর্শকের একটা বড় অংশ খুবই তৃপ্ত। নব্যউদারবাদী অর্থনীতিতে পুষ্ট এই মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শকের কাছে এই ‘আরবান পপুলার’ গোত্রের বাংলা ছবি ক্রমশই প্রেসটিজিয়াস বাংলা ছবির সংজ্ঞা হিসেবে, এবং একই সঙ্গে অতীতের সংস্কৃতি এবং সিনেমা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করার প্রায় একমাত্র মানদণ্ড হয়ে উঠছে।
যেহেতু বারবার প্রেসটিজের প্রশ্ন আসছে— কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, যাঁদের ছবির উত্তরসূরি হিসেবে এই ছবিগুলি এবং তাঁদের নির্মাতারা নিজেদেরকে দাবি করছেন, তাঁদের ছবি সেই সময়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় অত্যন্ত জরুরি ভূমিকা নিয়েছিল। এই ছবিগুলির আন্তর্জাতিক আঙিনায় কি সমরূপ সাড়া রয়েছে? বা নিদেনপক্ষে, তাঁরা কেউ কি ছবির মানের দিক থেকে সমমানের ছবি বানাবার কাজে পারদর্শী?
শিল্পীর কোনও শিল্পকর্মের মান, তাঁর কাজের শিল্পগুণের রকমফের যেকোনও রসশাস্ত্রের মতোই চলচ্চিত্রবিদ্যারও অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কিন্তু তাত্ত্বিক পরিকাঠামোয় ছবির শিল্পগুণের বিচার এই মুহূর্তে এই প্রবন্ধে করতে গেলে অধিকাংশ পাঠকের কাছেই তা দুরূহ ঠেকবে— তাই আমরা একটা সোজা হিসেব করার চেষ্টা করি। আমরা জানি, ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী ছবিটি ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছিল। তার পর থেকে সত্যজিৎ এবং মৃণাল সেনের একাধিক ছবি আন্তর্জাতিক ছবির শীর্ষতম বিন্দু— অর্থাৎ বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নিয়মিত প্রদর্শিত হয়েছে এবং পুরষ্কার জিতেছে। বলা বাহুল্য— এইটিই শুধুমাত্র ছবির ভাল-খারাপের মানদণ্ড নয়— ঋত্বিক কুমার ঘটকের ছবিই কোনওদিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সান্নিধ্য পায়নি— তাই একে দিয়েই কেবলমাত্র ছবির মান বিচার হয় না। যেকোনও পুঁজিবাদী বাজারের মতো এই বাজারেও অনেক শিল্পবহির্ভূত শর্ত থাকে। কিন্তু মজার বিষয়, এই ফিল্মমেকারদের সমসাময়িক বেশ কিছু দক্ষিণ এশীয় (যাঁর মধ্যে ভারতীয়রা অনেকে রয়েছেন) ছবি আন্তর্জাতিক ছবির আঙিনায় জরুরি জায়গা করে নিয়েছে। যে মুহূর্তে এই লেখাটি লিখছি, অর্থাৎ ২০২৪ সালের মে মাস— সেই সময় লোকসভা নির্বাচন এবং মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষ ছাড়াও ফ্রান্সে কান চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এবং প্রায় তিন দশকের খরা কাটিয়ে উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে পায়েল কাপাডিয়া-র ছবি অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট (২০২৪)। তরুণ এই চিত্রনির্মাতার একটি তথ্যচিত্র ২০২১ সালে এই ফেস্টিভ্যালেই শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্রের পুরস্কার পায়। শৌনক সেন পরিচালিত অল দ্যাট ব্রিদস (২০২২) নামের তথ্যচিত্র কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন আই’, সানডেন্স চলচ্চিত্র উৎসবে তথ্যচিত্র বিভাগে গ্র্যান্ড জুরি প্রাইজ পায়। আমরা জানি, এঁরা ছাড়াও একগুচ্ছ ভারতীয় চিত্রনির্মাতা দেশবিদেশের প্রথম সারির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন— যাঁদের মধ্যে আছেন গুরবিন্দর সিং, সানাল কুমার শশীধরণ, অচল মিশ্র, প্রমুখরা। আর যদি বাংলা ছবির দিকেও তাকাই— কাঁটাতারের ওপারের বাংলা ছবি, বাংলাদেশের ছবি— রেহানা মারিয়াম নূর (২০২১) দুই বছর আগেকার কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভাল ছবি করে চলেছেন রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত, রুবাইত হোসেন প্রমুখ একগুচ্ছ চিত্রপরিচালক। এপার বাংলাতেও গত বছরেই লুব্ধক চ্যাটার্জির ছবি লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় স্থান পায়।
তালিকাটি আরও লম্বা হতে পারে— কিন্তু এত চিত্রপরিচালক এবং চলচ্চিত্র উৎসবের নাম উল্লেখ করার কারণ এটুকুই— ছবির গুণগত মানের দিক থেকে সৃজিৎ-কৌশিক-অঞ্জনরা যে এই ছবিগুলোর তুলনায় বিশেষ সুবিধে করতে পারছেন না, তার হাতেনাতে প্রমাণ দেওয়া। ‘আর্বান পপুলার’ গোত্রের ছবিগুলি বেশিটাই ক্রাফটের দিক থেকে দুর্বল হওয়া, ফিল্মের প্রাথমিক গ্রামার— পাশাপাশি যুক্ত হওয়া পাঁচটি শট দেখে চোখে লাগা, প্রাথমিক স্তরের বেসিক কন্টিনিউটি নির্মাণ করতেও কীভাবে অস্বচ্ছন্দ হয়, তা নিয়ে একাধিক লেখায় আমি নিজেই অভিযোগ করেছি। এই লেখায় আর সেই একই কথা বলব না— বরং এঁদের অতীত নির্মাণের এই নতুন ঝোঁক নিয়েই দু-চার কথা ভাবার চেষ্টা করব।
তিন.
চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক ও ভাষ্যকার অনিন্দ্য সেনগুপ্ত তাঁর বাংলা ছবি নিয়ে এক প্রবন্ধে (যা লেখার শুরুতেই উদ্ধৃত করা আছে) দেখিয়েছিলেন, কীভাবে এই আর্বান পপুলার ছবিই পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন বাংলা ছবির অল্টারনেটিভ ধারাটিকে (যেখান থেকে স্বাধীন ছবি, ভিন্নধারার ছবি হতে পারত) আত্মসাৎ করে নিতে চায়। তাঁর যুক্তি ছিল, এই গোত্রের ছবিগুলি মূলধারার কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করে এবং অল্টারনেটিভ ছবির আপাত বৈশিষ্ট্য নিজের শরীরে ধারণ করে এমন এক অনড় পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে বিকল্প ধারার সংজ্ঞাটাই সমকালীন পরিস্থিতিতে গুলিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই যুক্তিকেই খানিক সম্প্রসারণ করে এই লেখায় আমি দেখাতে চাইব, অনড় হয়ে ওঠা এই ফিল্মগুলি আঙ্গিক এবং বিষয়— দুইয়ের দিকেই আশ্রয় নেয় নস্টালজিক অতীতচারণের মধ্যে— ফলস্বরূপ অতীতবিলাসী একধরনের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে এরা ক্রমশ হেলে পড়তে থাকে।
আমরা এ লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, সত্যজিৎ ঋত্বিক মৃণালের জন্মশতবর্ষে হঠাৎ করে এই চিত্রপরিচালকেরা এঁদের রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে পুনর্নিমাণ করে ছবি বানাতে শুরু করলেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, যাঁদের কাজ এঁরা মনে করাতে চাইছেন, তাঁরা কি নিজেরা অতীত নিয়ে ছবি করেননি? অবশ্যই করেছেন— সত্যজিৎ করেছেন চারুলতা (১৯৬৪), দেবী (১৯৬০), শতরঞ্জ কি খিলাড়ী (১৯৭৭), মৃণাল করেছেন বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০)। কিন্তু আমরা এখানে শুধুমাত্র অতীতকে মনে করানো নয়, বরং অতীতের সুখস্মৃতিতে নিশ্চিন্তে থাকাকে চিহ্নিত করতে চাইছি। তর্ক করতে চাইছি, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবির স্থবির, অনড় ডোবায় এই ছবিগুলি ক্রমশ অতীতের গরিমা মনে করিয়ে দিয়ে অতীতকে আঁকড়ে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকতে চাইছে, চাইছে নিরাপদ, নিশ্চিন্ত আশ্রয়কে। অতীতকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে, যুক্তির সাহায্যে, কিংবা আখ্যানের রূপ ধরে মনে করা, আর অতীতকে নস্টালজিয়ার মাধ্যমে আশ্রয় হিসেবে, পালিয়ে যাওয়া হিসেবে মনে করার একটি জরুরি পার্থক্য রয়েছে। অতীত মনে করানো একাধিক ছবি, ধরা যাক দেবী কিংবা শতরঞ্জ কি খিলাড়ী অতীতের নানান কনফ্লিক্ট এবং সামাজিক পটপরিবর্তনকে বর্তমানের লেন্স দিয়ে দেখতে চায়। বিংশ শতকের আধুনিকমনস্কতা ছাড়া এই ছবিগুলো বানানোই সম্ভব না। এই ছবির অতীত কোনও নিরাপদ আশ্রয়স্থল নয়— বরং নির্মিত অতীত এখানে সমকালকে বুঝে নেওয়ার জোরালো জিজ্ঞাসা। অন্যদিকে সৃজিৎ, অনীক, অঞ্জনের ছবি ক্রমশই দ্বিতীয় স্তরে, নস্টালজিয়ার স্তরে সেঁধিয়ে গেছে— তাঁদের ছবির অতীতে অনড় পরিবেশে প্রায় মসিহা হিসেবে আবির্ভাব ঘটিছে সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের মতো সাংস্কৃতিক আইকনদের। প্রায় সুপারহিরো ফরম্যাটে বানানো ছবির পর ছবি হয়ে উঠছে এক ধরনের ‘হেগিওগ্রাফি’— অঞ্জনের ছবিতে তরুণ অভিনেতা প্রবীণ পরিচালককে প্রশ্নে বিদ্ধ করলেও তা এই ‘সবার উপরে মসিহা সত্য’ মার্কা রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। আর নস্টালজিয়ার নিয়মই হচ্ছে ধসে পড়া বর্তমানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া— ফলস্বরূপ একদিকে নির্মিত হচ্ছে ঐতিহ্যপূর্ণ অতীত আর অন্যদিকে বর্তমানের সঙ্কটকে সুন্দর করে সেলোফেনে মুড়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কী সেই সঙ্কট, তা আর নতুন করে এই লেখায় না হয় নাই বললাম।[4]
অতীত যখনই নিরাপত্তায় মুড়ে, ঝকঝকে ইমেজে, নস্টালজিয়া চুঁইয়ে পড়ে নির্মাণ করা হয়, তখনই শিল্পের আঙ্গিকের রাজনীতি দক্ষিণপন্থী হয়ে যেতে বাধ্য। শিবাজী বন্দোপাধ্যায় ঋত্বিক ঘটিকের একটি গল্পের সূত্র ধরে দেখিয়েছিলেন, অতীত নির্মাণের দুটি কনসেপ্ট রয়েছে।[5] একদিকে যদি হয় ‘স্মরণ’— অতীতের নির্মাণ, সুখকর আশ্রয়স্থল এবং নস্টালজিয়া— অন্যদিকে ‘প্রতিস্মরণ’— সক্রিয়ভাবে সেই স্মরণপন্থাকে আঘাত করা, নস্টালজিয়ার মেদুরতাকে বুঝতে না দেওয়া। যখনই মনে হচ্ছে এই বুঝি কল্পিত সেই অতীত আমাদের হাতে এসে গেছে, এই বুঝি নির্মিত হয়ে গেল সেকালের সেই স্বর্ণযুগ— সেই মুহূর্তে তাকে আক্রমণ করে বলা— না, অতীতের পূনর্নিমাণ হতে পারে না, মাঝখানে যে ইতিহাসের ছেদ পড়ে গেছে, তার হিসেব কে রাখবে? প্রতি যুগ যে আসলে প্রতি যুগের থেকে বিচ্ছিন্ন, প্রতি দশক যে আসলে প্রতি দশকের থেকে বিচ্ছিন্ন— ইতিহাসের কোনও একটানা, বিচ্ছেদহীন পরিকল্প বলে কিছু হয় না— ঋত্বিক ঘটকের সারা জীবনের কাজ সেই দিকে ইঙ্গিত দিয়ে গেছে, সক্রিয়ভাবে স্মরণকে আক্রমণ করতে চেয়েছে প্রতিস্মরণের মাধ্যমে।
স্মরণকে যদি নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া হয় তখনই জন্ম হয় অতীতকে রোম্যান্টিসাইজ করে পুরনো সময়ে ফিরে যাওয়ার কাল্পনিক প্রচেষ্টা। এই লেখার শুরু থেকে লোকসভা নির্বাচনের কথা, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কথা শুধুমাত্র কাকতালীয় সমাপতন বলেই উল্লেখ করা হয়নি। দক্ষিণপন্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই গরিমাময় অতীতকে মনে করানো, তার কোলে ফিরে গিয়ে শান্তিতে জীবনযাপন করার চেষ্টা। ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল দ্বারা সম্প্রচারিত আদর্শ যেমন মনে করে, কোনও এক কালে, ইসলাম আসার আগে এই ‘কাল্পনিক’, গৌরবান্বিত অতীত ছিল— তাদের লক্ষ্য হবে আবার সেই অতীতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। একইভাবে, পশ্চিমবাংলার এই চিত্রপরিচালকেরা তাঁদের কাজে মনে করিয়ে দেন— একসময় বাংলা সিনেমার এই মসিহারা যেমন রক্তমাংসে ঘুরে বেড়াতেন— এই তো রুপোলী পর্দার জাদুতে তাঁরা আবার ফেরত আসছেন। যতই তাঁরা রাজনৈতিক দিক থেকে, ছবির বিষয়বস্তুর নিরিখেও দক্ষিণপন্থার বিরোধিতা করুন, তাঁদের ছবির আঙ্গিক নস্টালজিয়ায় মুড়ে দক্ষিণপন্থী হয়ে যায়, স্পর্শযোগ্য সেই অতীত তাঁদের কাছে সুখী আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।
চার.
প্রবন্ধের শেষে ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ মার্কা নিদান দেওয়ার কোনও ইচ্ছে আমার নেই।
ইতিমধ্যেই বাংলা তথা ভারতবর্ষের বহু তরুণ চিত্রপরিচালক নিজেদের মতো করে এঁদের প্রায় ইগনোর করে ছবি বানাচ্ছেন। সাম্প্রতিক কালের একাধিক ভারতীয় এবং বাংলা ছবিতে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু তাঁদের ছবি— এতক্ষণের আলোচিত ছবির বাংলাবাজারে দাদাগিরিসুলভ দখলের জন্য কখনওই থিয়েটার হলে মুক্তি পাবে না, কখনওই বৃহত্তর দর্শকের কাছে পৌঁছবে না যা কাঙ্খিত। এই চিত্রপরিচালকদের মতো দর্শকও যদি কোনওদিন এই গোত্রের ছবিকে ইগনোর করতে পারেন, তবেই বোধহয় এই অনড় জলাভূমি থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবির কোনওপ্রকার মুক্তির আশা জাগতে পারে।
[1] অঞ্জন দত্তের ছবিটি কোনও বিচিত্র দুর্বোধ্য কারণে সমসাময়িক কলকাতার প্রেক্ষিতে বানানো, অথচ বইতে সই করার সময় চরিত্ররা তারিখ লেখে ১৯৮৭। অর্থাৎ কিনা, ইনডোরে স্মার্টফোনহীন, পাজামা-পাঞ্জাবি, অ্যানালগ ক্যামেরার আশির দশক, আউটডোর লোকেশনে নীলহলুদ বাস, অনলাইন ডেলিভারি, রাস্তায় সমকালীন শার্ট-প্যান্ট পরিহিত মানুষজন।
[2] সেনগুপ্ত, অনিন্দ্য। বাংলা ছবির সম্ভাব্য সঙ্কট: সমসাময়িক সিনেমা নিয়ে কিছু প্রশ্ন। অনীক। ২০১৬।
[3] বিশ্বাস, মৈনাক। নিও-ভদ্রলোক দর্পণ। বারোমাস।
[4] দত্ত, সায়ন্তন। অনীক দত্ত’র অপরাজিত, অথবা রাংতায় মোড়া সিনেমার অসুখ। সাবজিঁয়ার খোঁজে…। মে ১৪, ২০২২।
[5] বন্দোপাধ্যায়, শিবাজী। “ঋত্বিক ঘটক-এর নাগরিক: নির্বাস বিরহী যক্ষ্ম”, আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার বইতে সঙ্কলিত।