সুব্রত রায়
যে কোনও কল্যাণকামী রাষ্ট্রে স্বাস্থ্যের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হওয়া উচিত। আজ পৃথিবীর প্রায় ৫০টি দেশে জনগণের সকলের জন্য সরকারি খরচে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশের সরকার সম্পূর্ণ উলটো পথে হাঁটছে। দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যবঞ্চিত রেখে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাকে মদত দিয়ে চলেছে আর রামদেবের মতো ধুরন্ধর, সুযোগসন্ধানী ও প্রতারক ব্যক্তিদেরকে সুযোগ করে দিচ্ছে দেদার মুনাফা লোটার
What about all the faceless people who have consumed these Patanjali medicines stated to cure diseases which cannot be cured?
—সুপ্রিম কোর্ট
সুপ্রিম কোর্টের উপরিউক্ত সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ যে মামলাটির প্রেক্ষিতে, তা দায়ের করা হয়েছিল ২০২২ সালে। এর কেন্দ্রে ছিল রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলির দেওয়া একটি বিজ্ঞাপন, যার শিরোনাম এরকম: “অ্যালোপ্যাথির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুল ধারণা: ফার্মা ও মেডিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির প্রচার করা ভ্রান্ত ধারণার হাত থেকে নিজে বাঁচুন ও দেশকে বাঁচান।” বিজ্ঞাপনে আধুনিক চিকিৎসাকে গালমন্দ করার পাশাপাশি এও দাবি করা হয় যে, পতঞ্জলি উৎপাদিত আয়ুর্বেদ ওষুধের সাহায্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড গ্রন্থিজনিত সমস্যা, লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস ও হাঁপানি রোগ নিরাময় হয়। লক্ষণীয় যে, ভারতীয় ওষুধ আইনের ‘শিডিউল-জে’ অনুযায়ী ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও লিভারের অসুখ সারানোর দাবি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। স্পষ্টত, এ-বিজ্ঞাপনে ওষুধ আইন লঙ্ঘিত হয়েছিল। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের তরফে দায়ের করা এই মামলায় ২০২৩ সালে আদালত রামদেবের সংস্থাকে ১ কোটি টাকা জরিমানার হুঁশিয়ারি দেয়। কিন্তু এই সতর্কবার্তাকেও কিছুমাত্র আমল না দিয়ে পতঞ্জলি তাঁর প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালিয়ে যেতে থাকে।
বলা বাহুল্য, রামদেবের তরফে এ-জাতীয় কাজকর্ম আদৌ কোনও নতুন ব্যাপার নয়। অতীতে তাঁর ইউটিউব চ্যানেল ও ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ভিডিওয় তিনি ভেষজ ওষুধের সাহায্যে ক্যানসার সারানোর দাবি করেছিলেন। টিভি চ্যানেলে একাধিকবার তিনি যোগ ও আযুর্বেদের সাহায্যে এইডস সারানো যায় বলে মন্তব্য করেছেন। ২০১৫ সালে দিল্লিতে ডেঙ্গুর প্রকোপে মৃত্যু ঘটলে তিনি গুলঞ্চ, পেঁপেপাতা, অ্যালো ভেরা ইত্যাদির সাহায্যে ওই রোগ সারানোর ‘গ্যারান্টি’ দেন। রামদেব সমকামিতাকেও এক ধরনের রোগ বলে মনে করেন, এও নাকি তাঁর ওষুধের সাহায্যে নিরাময় করা সম্ভব। এমনকি, তিনি তাঁর যোগের সাহায্যে শিল্পকারখানায় ধরনা-হরতাল ‘রোগ’ও নাকি সারিয়ে তুলতে পারেন! শেষোক্ত এই তথ্যটি আপাতভাবে মজাদার শোনালেও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়, পতঞ্জলির শ্রমিকরা তা হাড়ে হাড়ে জানেন।
অতিমারিকালীন ঘোলাটে সময়ে রামদেবের এই মিথ্যাচারিতা তুঙ্গে পৌঁছয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন কোভিডের ‘ডেলটা’ প্রকরণের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে, তখন তিনি ‘কোভিড-১৯ এর প্রথম তথ্যপ্রমাণ-নির্ভর ওষুধ’ আবিষ্কারের দাবি করে বসেন। পতঞ্জলি উৎপাদিত এই ‘করোনিল’ নাকি ফার্মাসিউটিক্যাল সামগ্রী হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে, এবং তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস’ (জিএমপি)-এর নিয়মকানুন মেনে উৎপাদিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, জিএমপি কখনওই কার্যকারিতার সার্টিফিকেট নয়, এবং, এই বার্তার মাধ্যমে চিকিৎসা গবেষণা সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষদের প্রভাবিত করতে চাইলেও জেনে রাখা দরকার যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের কোনও ভেষজ ওষুধকে কখনওই কোভিডের ওষুধ হিসেবে মান্যতা দেয়নি। ফার্মাসিউটিক্যাল সামগ্রী বলতে যা বোঝায়, এটি তাও ছিল না। এ ছিল যোগগুরুর নির্ভেজাল মিথ্যাচার এবং ‘করোনিল’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মঞ্চে রামদেবের সঙ্গে হাজির থেকে লজ্জাজনকভাবে এর শরিক ছিলেন খোদ আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনও।
১৬ এপ্রিল ২০২৪-এ রায় ঘোষণা করতে গিয়ে উপর্যুপরি আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত রামদেব ও তাঁর পতঞ্জলি সংস্থার তরফে কোনও মৌখিক ক্ষমাপ্রার্থনা সুপ্রিম কোর্ট মঞ্জুর করেনি, বরং বিচারপতিরা স্পষ্ট ভাষায় একে ‘জাতীয় প্রতারণা’ বলে চিহ্নিত করেছেন ও অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে “তোমাদের ফেঁড়ে ফেলব” জাতীয় কঠোর মন্তব্যও করেছেন। রামদেব বাধ্য হয়েছেন ৬৭টি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে অপরাধ কবুল করতে। কিন্তু এতেও বিচারপতিরা সন্তুষ্ট হননি। ২৩ এপ্রিল ২০২৪-এর শুনানিতে তাঁরা প্রতিটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই কবুলনামার আসল চেহারা দেখে যাচাই করতে চেয়েছেন যে, ওই স্বীকারোক্তি কতখানি আন্তরিক। এর ফলে রামদেবকে পুনরায় বড় আকারে স্বীকারোক্তি প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হয়। একই সঙ্গে, বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, কখনও প্রত্যক্ষভাবে এবং কখনও চোখ বুজিয়ে রেখে অপরাধে পরোক্ষ মদত দেওয়ার দায়ে দেশের সরকার ও স্বাস্থ্যমন্ত্রককেও আদালত ছাড়েনি। তারাও অভিযুক্ত হয়েছে। দেশের বিকল্প চিকিৎসা মন্ত্রক ‘আয়ুষ’কে ওষুধ ও প্রসাধনী আইন, ১৯৪৫-এর ১৭০ নম্বর ধারাটি ছেঁটে ফেলার জন্য আদালত তীব্রভাবে সমালোচনা করেছে। উক্ত ধারাটি আয়ুর্বেদ, সিদ্ধা ও য়ুনানি চিকিৎসার আপত্তিকর বিজ্ঞাপন মোকাবিলায় ব্যবহৃত হত।
কাজেই, স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে যে, রামদেবের অপরাধ কেবল ব্যক্তিগত স্তরে সংঘটিত কোনও মন্দ বাণিজ্যিক অভিপ্রায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের স্বাস্থ্যনীতিও এতে প্রবলভাবে জড়িত। কিন্তু এ-নিয়ে বিস্তারে যাওয়ার আগে আমরা উদ্দীষ্ট ব্যক্তিটির ‘রামদেব’ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার দিকে একটুখানি চোখ ফেরাব।
রামদেব, একটি প্রপঞ্চের উত্থান
রামকিষাণ যাদব ও তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর বালকৃষ্ণ সুবেদি ১৯৯০-র দশকেও হরিদ্বারের পথে পথে বাইসাইকেল চেপে চ্যবনপ্রাশ ফেরি করে বেড়াতেন। এর দু-দশকের মধ্যেই তাঁরা দেশের অন্যতম ধনীদের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেন। এই অবিশ্বাস্য উত্থানের কাহিনি অবশ্যই চমকপ্রদ, যোগ আর আয়ুর্বেদকে পাথেয় করে তা সম্ভব হলেও, এগুলিই একমাত্র বিষয় ছিল না। এই কাহিনির রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে কত রকমের শঠতা, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যাচার, নৃশংস অপরাধ আর রাজনৈতিক কদর্যতা ঢুকে আছে, খুব কম ভারতবাসীই তার খবর রাখে!
হরিয়ানার এক গণ্ডগ্রামে এক হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে রামকিষাণ যাদব ওরফে রামদেবের জন্ম। তারিখ অজ্ঞাত। জন্মসাল নিয়ে ধন্দটা খোদ রামদেবেরই তৈরি। তাঁর অনুমোদিত জীবনীকার সন্দীপ দেবও তা জানতে ও জানাতে পারেননি। শঙ্কর দেব মহারাজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করার দিনটিকেই রামদেব নিজের জন্মদিন বলে দেখাতে চান। অথচ আশ্চর্যের কথা হল, তাঁর হরিদ্বারের আশ্রম থেকেই ২০০৭ সালে শঙ্কর দেব রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান এবং এই অন্তর্ধানের খবর পেয়েও ওই সময়ে আমেরিকায় যোগশিবির আয়োজনে ব্যস্ত রামদেব দেশে ফিরে আসার জন্য কোনও প্রয়োজন বোধ করেননি। পরে জনসত্তা-র সাংবাদিকের কাছে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন যে, শঙ্কর দেব বেঁচে ছিলেন না— এ-কথা জানতেন বলেই নাকি তিনি দেশে ফেরেননি। এবার ততোধিক আশ্চর্য হওয়ার পালা— মৃত্যুর এই তথ্য তিনি জানলেন কীভাবে, যা তদন্তকারীরাও জানতে পারেননি এখনও!
জন্মসালের মতো কিংবা তাঁর মুখের কাটা দাগটার মতো তাঁর শৈশব-কৈশোরের অনেকটাই রহস্যে মোড়া— বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী কাহিনির সমাগমে সত্যের নাগাল পাওয়া দুষ্কর। কৈশোরে দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবনী থেকে প্রাচীন ভারতের ‘সুবর্ণযুগ’-এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সরকারি স্কুল ছেড়ে গুরুকুলের পথে যাত্রা করেন, সেখানে বালকৃষ্ণের সঙ্গে এক দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়। তারপর তাঁরা একত্রে হরিদ্বারে চলে আসেন, যেখানে করমবীর নামক এক যুবকের সঙ্গে তাঁদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। করমবীর মিরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে স্নাতক হয়ে হরিদ্বারে গুরুকুল কাংড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ, প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও বেদ চর্চা করছিলেন। আজন্ম আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত রামদেব তাঁর কাছ থেকেই যোগের নানা শারীরিক কৌশল আয়ত্ত করেন। আজকে যোগ নিয়ে রামদেবের যে দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতবাসী পরিচিত, তা অনেকাংশে করমবীরেরই গড়ে দেওয়া। এই যুবকের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সুবাদেই রামদেব ১৯৯৫ সালে শঙ্কর দেবের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে কৃপালু বাগ আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডে সামিল হন। তারপর একে একে বোর্ডের অন্য সদস্যদের সরিয়ে তাঁরা নিজেরাই আশ্রম তথা দিব্য যোগ মন্দিরের সর্বেসর্বা হয়ে বসেন। এরপর রামদেব-বালকৃষ্ণ জুটি করমবীরের আরেক বন্ধু এনপি সিংহ তথা স্বামী যোগানন্দের কবিরাজি ওষুধ বানানোর লাইসেন্সকে কাজে লাগিয়ে ওষুধের কারখানা শুরু করেন। ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই লাইসেন্স ব্যবহার করেই দিব্য ফার্মেসির উৎপাদন চলত। উল্লেখ্য যে, ২০০৪ সালে যোগানন্দ নিজের বাসগৃহে নৃশংসভাবে খুন হন, যার কিনারা আজও হয়নি। করমবীরও কোনও অজ্ঞাত কারণে ২০০৫ সালে নিঃশব্দে আশ্রম ছেড়ে চলে যান।
বালকৃষ্ণ প্রধানত ওষুধের উৎপাদন সামলাতেন আর রামদেব ব্যক্তিগত যোগাযোগের বিভিন্ন সূত্র কাজে লাগিয়ে যোগ শিবিরের আয়োজন করায় মনোনিবেশ করেন। যোগচর্চার শারীরিক কসরতের এক ‘ইনস্ট্যান্ট’ রূপ নির্মাণ করে রামদেব বিভিন্ন শিবিরে স্বল্পায়াসে সুস্বাস্থ্য ও রোগ নিরাময়ের ‘গ্যারান্টি’ দিতে শুরু করেন। শিবিরে স্বাস্থ্য পরামর্শ পাওয়া যেত বিনামূল্যে, কিন্তু প্রত্যেককে অন্তত হাজার দেড়েক টাকার ওষুধ কিনতে হত। মোটের ওপর, আজকেও চিকিৎসা ও ওষুধ বিক্রয়ের একই মডেল পতঞ্জলি বজায় রেখেছে। ক্রমশ তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে এমন এক সুযোগ আসে, যা না এলে রামদেব দেশের কোনায় কোনায় এতটা পরিচিত হয়ে উঠতে পারতেন না। এ ছিল ধর্মীয় টিভি চ্যানেলের আত্মপ্রকাশের যুগ। বিভিন্ন বাবাজি-মাতাজিরা ওইসব চ্যানেলে ‘টাইম-স্লট’ কিনে চুটিয়ে আত্মপ্রচার শুরু করেন। রামদেব প্রথমে ‘সংস্কার’ ও পরে ‘আস্থা’ চ্যানেলে যোগ প্রদর্শন করতে থাকেন। তাঁর কথা বলার প্রত্যয়ী ভঙ্গি, শ্বাসবায়ু টেনে ধরে পেট সঙ্কোচনকারী ‘নৌলিক্রিয়া’, ঘাড়ে পা-পেঁচিয়ে রাখার অননুকরণীয় কৌশল ইত্যাদি সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্রমশ তিনি ভারতীয় সমাজে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি যে, টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট বা টিআরপি-র দিক থেকে কপিল শর্মার কমেডি শো-এ তাঁর উপস্থিতির এপিসোডটি সলমন ও শাহরুখ খানদ্বয়ের জোড়া আতিথ্যে ঝলমলে বিগ বস এপিসোডকেও ছাপিয়ে যায়! ভোরবেলা টিভি চালিয়ে তামাম ভারতবাসী মেতে ওঠে যোগচর্চায়। এরই প্রভাবে ওই সময়ে রাস্তাঘাটে অত্যুৎসাহীদের আঙুলে আঙুল ঘষার দৃশ্য অনেকেরই মনে পড়বে। রামদেব শিখিয়েছিলেন যে, এভাবে রক্তচলাচল বাড়িয়ে নাকি হার্টকে ভাল রাখা যায়, হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমে!
টিভি পর্দার স্টার ইমেজকে কাজে লাগিয়ে রামদেবের দিব্য যোগ ফার্মেসির কারবারও ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। একই সঙ্গে, ধুরন্ধর রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরাও হরিদ্বারে নতুন শক্তির উত্থানের গন্ধ পেতে শুরু করেন। ২০০৪-০৫ সালে দিব্য ফার্মেসির বিরুদ্ধে প্রথমবার কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে এবং, একই সঙ্গে, রামদেবকে বাঁচানোর জন্য রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্বও অনুভূত হয়। আয়কর দপ্তর দিব্য ফার্মেসিতে খানাতল্লাশি চালায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে রামদেব ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান, কেবল আয়কর দফতরের তদন্তকারী অফিসার জিতেন্দর রানা চাকরি থেকে অগ্রিম অবসর নিতে বাধ্য হন!
কমলারঙা পোশাক পরিহিত অর্ধনগ্ন ফকিরবেশী মানুষটি কৃপালু বাগ আশ্রমে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শঙ্কর দেবের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে একরকম সংসারত্যাগী হয়েছিলেন বটে, কিন্তু বিষয়চিন্তা ত্যাগ করেননি কখনও। একটু গুছিয়ে বসার পর থেকেই ভ্রাতা রাম ভরতের হাতে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আর্থিক বিষয়ের দেখভালের দায়িত্ব অর্পণ করেন, আজও তিনি ওই দায়িত্বে বহাল আছেন। রামদেব নিজের ভ্রাতা ও ভগিনীর জন্য আলাদা আলাদা বাড়ি ক্রয় করেন, পরিবারের অন্যান্যদের জন্যও নানাবিধ ব্যবস্থা করা হয়। দিব্য মন্দির ট্রাস্টের এই ‘ভাইভাতিজাকরণ’ খোদ শঙ্কর দেবকে বিরক্ত করেছিল, করমবীরও খুশি ছিলেন না। অথবা ধরুন, যোগ শিবিরের কথা। গোড়ার দিকে রামদেবের শিবিরে বিনামূল্যে যে কেউই যোগ দিতে পারতেন, পরে এতে যোগদানের জন্য অনেকখানি গাঁটের কড়ি খসাতে হত। টিকিটের মূল্য ধার্য করা হয়েছিল ৫০০ থেকে ২১০০ টাকা। যত বেশি দামের টিকিট, তত বেশি বাবা রামদেবের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ। যোগকেন্দ্রের আজীবন সদস্যপদের জন্য ধার্য করা হয়েছিল ১ লক্ষ টাকার অনুদান, পৃষ্ঠপোষক সদস্যপদের জন্য দিতে হত আড়াই লাখ টাকা।
শ্রমিক শোষণের ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার! ২০০৫ সালের মার্চ মাসে ফার্মেসির ৪০০ জন শ্রমিকের মধ্যে ১১৩ জন কর্মবিরতিতে যোগ দেন। এই শ্রমিকরা অধিকাংশই ছিলেন মহিলা শ্রমিক এবং তাঁরা কষ্টেসৃষ্টে মাসিক ১২০০ টাকা রোজগার করতেন।[1] শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে কর্মবিরতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শ্রমিক সংগঠন সিআইটিইউ-এর সহায়তায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপুটস্ অ্যাক্ট অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের করা হয়। ফার্মেসি সিআইটিইউ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় বসে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এ ছিল রোগমুক্তির প্রতিশ্রুতির মতোই ফাঁপা ও দুরভিসন্ধিতে ঠাসা; আন্দোলনরত শ্রমিকদের কেবল কাজে যোগদানে বাধাদানই নয়, তাঁদের ৪৬ জনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়। অতঃপর চাকরি খোয়ানো শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকজন কারখানায় ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত কিছু কাঁচামালের নমুনা গোপনে বাইরে নিয়ে আসেন। অনেকের স্মরণে থাকবে যে, ওইসব নমুনা ও বরখাস্ত শ্রমিকদের বক্তব্যের ভিত্তিতে সিপিআইএম নেত্রী বৃন্দা কারাত অভিযোগ করেছিলেন যে, ওষুধ তৈরিতে বনবিড়ালের জননাঙ্গ, হরিণের শিং, এমনকি নরকরোটির গুঁড়ো মেশানো হচ্ছে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আয়ুষ-এর উদ্যোগে সংঘটিত ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় সংগৃহীত নমুনার মধ্যে মানুষ ও অন্যান্য পশুর ডিএনএ-র অস্তিত্ব ধরা পড়ে। কিন্তু অন্তিম রিপোর্টে আয়ুষ জানায় যে, আয়ুর্বেদিক ওষুধে এগুলি থাকতেই পারে। তবে তারা ফার্মেসিকে লাইসেন্স ও লেবেলিংজনিত ত্রুটির কারণে অভিযুক্ত করে। রামদেব এ নিয়ে যে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে নমুনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় এবং বৃন্দা কারাতকে বহুজাতিক কোম্পানির দালাল বলে গালমন্দ করা হয়। এই সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা আমরা দেখতে পাই। বৃন্দা কারাতের তোলা প্রশ্নটা অকস্মাৎ আড়লে চলে যায় এবং ঘটনাকে ঘিরে নানাবিধ রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়ে যায়। এই তরজায় রামদেবের হয়ে বিজেপি, শিবসেনা, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি, মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি, লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল খোলাখুলি মাঠে নেমে পড়ে। রামদেবের উত্থানের পেছনে রাজ্যের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী এনডি তেওয়ারি অতীতে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন, তিনি রামদেবের ওষুধপত্তরও খেতেন। কাজেই, তিনি কেন্দ্রের জোটসঙ্গী রাজনৈতিক দলের বৃন্দা কারাতের মতো এক ‘হেভিওয়েট’ নেত্রীর অনুরোধেও রামদেবের কারখানার শ্রমিকদের অভিযোগ নিয়ে কোনও পুলিশি তদন্ত করতেই রাজি হননি।
রামদেব প্রকৃতই সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি, নিজের স্বার্থের অনুকূলে রাজনীতিকদের ব্যবহার করার ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ২০০৭ সালে পতঞ্জলি যোগপীঠের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষ্যে দেশের ১৫ জন মুখ্যমন্ত্রী হাজির ছিলেন। জন্মস্থান হরিয়ানায় যোগ ও আয়ুর্বেদকে ছাপিয়ে তাঁর আরও একটা পরিচয় আছে, তিনি সেখানে ‘রিয়েল এস্টেট মোগল’ হিসেবে খ্যাত। ২০২৩ সালে সরকার জল-জঙ্গলের সংরক্ষণ বিষয়ক আইনকে শিথিল করে তোলার মাধ্যমে জমি-হাঙ্গরদের জন্য যে সুযোগ করে দিয়েছে, তারই ফায়দা তুলে পতঞ্জলি বেনামে বিভিন্ন ‘শেল কোম্পানি’র মাধ্যমে আরাবল্লি বনভূমি এলাকার জমি কিনে নিচ্ছে। এইসব কোম্পানিতে টাকা জোগানোর মাধ্যমে পতঞ্জলি আয়কর ফাঁকি দেওয়ারও এক মোক্ষম উপায় বার করেছে। পতঞ্জলির এসব কারবারে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত দিয়ে এসেছে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তো সর্বজনবিদিত। ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে থেকে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখার বাসনা প্রকাশ করেছেন একাধিকবার। সঙ্ঘ পরিবারের সুরে সুর মিলিয়ে, এমনকি, তার চেয়েও উগ্রতার সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ভারতে বাস করে ভারতমাতার নামে জয়ধ্বনি দিতে অস্বীকার করলে মুণ্ডচ্ছেদ করা উচিত! প্রতিদানে বিজেপি সরকারও তাঁকে অনেক কিছু দিয়েছে। ‘ফেমা’ আইন লঙ্ঘনের দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে, সর্বক্ষণের জন্য জ়েড-ক্যাটেগরি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে,[2] শঙ্কর দেবের রহস্যজনক অন্তর্ধানের তদন্তও বন্ধ করে দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখনও পর্যন্ত জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে পতঞ্জলি ৪৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় পেয়েছে, যা অভাবনীয়। নীতিন গড়কড়ি তো যোগাশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দামানে একটা গোটা দ্বীপই দিতে চেয়েছিলেন! এছাড়াও, বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হল, ২০১৬ সালে আয়কর আইনে প্রয়োজনীয় বদল এনে যোগ-কে ‘দাতব্য পরিষেবা’-র তালিকাভুক্ত করা, যা রামদেবের সম্পদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে।
টিভিতে জনপ্রিয়তার সূত্র ধরে রামদেবের সঙ্গে ‘আজাদি বাঁচাও আন্দোলন’-খ্যাত রাজীব দীক্ষিতের সখ্যতার সূত্রপাত হয়। ওই আন্দোলনের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি ও পশ্চিমি সংস্কৃতির হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করা। কিন্তু দীক্ষিত ব্যক্তিগত দুর্নীতির অভিযোগে এই আন্দোলনে ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে উঠছিলেন, তিনি অবস্থা পরিবর্তনের আশায় রামদেবকে আশ্রয় করেন। অন্যদিকে, রামদেব তাঁর ব্যবসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য দীক্ষিতের ‘স্বদেশি’ ন্যারেটিভকে গ্রহণ করেন। রহস্যজনক মৃত্যুর আগে অবধি রামদেব আয়োজিত প্রচুর যোগশিবিরে রাজীব দীক্ষিত স্বশরীরে হাজির থেকেছেন। দীক্ষিতের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে রামদেব ২০১০ সালে ‘ভারত স্বাভিমান’ নামক নিজস্ব রাজনৈতিক দল তৈরির কথা ঘোষণা করেন এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ৫৪৩টি লোকসভা আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানান। কিন্তু দুটি ঘটনার অভিঘাতে তাঁর ওই আকাঙ্খার অকালমৃত্যু ঘটে। প্রথমত, ওই বছরের নভেম্বর মাসে রাজীব দীক্ষিতের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে, যার সঙ্গে রামদেবের নাম জড়িয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, লোকপাল বিল নিয়ে আন্না হাজারে ও ‘ইন্ডিয়া এগেইনস্ট কোরাপশন’-এর সঙ্গে প্রথমে রামদেব যুক্ত হলেও নিজস্ব রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য নির্মাণের তাড়নায় ক্রমশ রামদেবের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বেড়ে ওঠে এবং ২০১১ সালের জুন মাসের গোড়ায় দিল্লির রামলীলা ময়দানে নিজস্ব অনশন প্রকল্পে সরকারি ধরপাকড় থেকে বাঁচতে সাদা সালোয়ার-কামিজ পরে মহিলার ছদ্মবেশ গ্রহণ করেও গ্রেফতারি এড়াতে ব্যর্থ হন এবং গোটা দেশে হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠেন।
২০০৫ সালে রামদেব-বালকৃষ্ণ জুটি পতঞ্জলি যোগপীঠ ও ২০০৬ সালে পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ প্রাইভেট লিমিটেড স্থাপন করেন। কিন্তু তাঁদের ‘বিলিওনেয়ার’-এ পরিণত হওয়ার সূত্রপাত আরও কয়েক বছর পরে, ২০০৯ সালে হরিদ্বারে পতঞ্জলি ফুড অ্যান্ড হার্বাল পার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, যেখানে গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী ও ভোজ্যপণ্য বড় আকারে উৎপাদন করা শুরু হয়। দাবি করা হয় যে, এর প্রতিটি ঊৎপাদনই ‘খাঁটি’ এবং সেগুলি ‘আযুর্বেদসম্মতভাবে’ উৎপাদিত হয়েছে। ওইসব পণ্য বিক্রয়ের জন্য তিনি দীক্ষিতের ‘স্বদেশি’ ন্যারেটিভকে কাজে লাগাতে শুরু করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ভারতবাসীর গো-আবেগে সুড়সুড়ি দিতে রামদেবের কারখানায় গোময় দিয়ে সাবান ও গোমূত্রের সাহায্যে মেঝে জীবাণুমুক্ত করার উপযোগী তরল প্রস্তুত হতে থাকে। ইতিমধ্যে তিনি ‘আস্থা’ ও ‘সংস্কার’ চ্যানেল দুটির স্বত্বাধিকারীতে পরিণত হয়েছেন এবং দিবারাত্র তা ব্যবহার করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে ‘শীর্ষাসন’ করিয়ে ছাড়ার হুমকি বর্ষণ শুরু করে দিয়েছেন। বিজ্ঞাপনে খরচ করার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে তাঁর দ্বিধা থাকলেও অচিরেই তিনি মত বদল করেন এবং দেশের তাবৎ প্রথম সারির সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে ‘রামদেবীয় স্বদেশিয়ানা’ ছড়িয়ে যেতে থাকে। তিনি আক্রমণাত্মক ভাষায় বিদেশি কোম্পানিদের তুলোধোনা করতে থাকেন, তাদের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তুলনা করেন, যারা দেশকে লুঠ করছে ও যাদের প্রতিটি সামগ্রীই হল ‘স্লো পয়জন’। কার্যত, আমজনতার কাছে বিদেশি কোম্পানি উৎপাদিত সামগ্রী বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি আয়ুর্বেদের হয়ে আধুনিক চিকিৎসাকে আক্রমণ করাও তাঁর নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হয়ে ওঠে। একটি মজার তথ্য হল, তিনি ভারতীয় নারীর জন্য বিদেশি ‘টাইট-ফিট’ জিনস-এর বিপরীতে বিশেষভাবে নির্মিত ‘স্বদেশি জিনস’ বাজারে এনেছিলেন, ঢিলেঢালা অথচ ‘ট্রেন্ডি’ পোষাকে ভারতীয় নারীর ‘সনাতনত্ব’ বজায় রাখার চেষ্টা হিসেবে। যাই হোক, বাণিজ্যিক কৌশল হিসেবে স্বদেশিয়ানায় ভর করার পর রামদেবকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি। ২০১৭ সালে অ্যাসোচেম-টেকসাই রিসার্চ পতঞ্জলিকে ভারতীয় এফএমসিজি (ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস) বাজারের সবচেয়ে সংহতিনাশক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। বর্তমানে পতঞ্জলির বার্ষিক টার্নওভারের মাপটা হল ৩১,০০০ কোটি টাকা। আগামী ৫ বছরের মধ্যে এটাকে ১ লক্ষ কোটি টাকায় পরিণত করা হল পতঞ্জলির ঘোষিত লক্ষ্য।
অবশ্য, বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে নানান হুঙ্কার এবং তাদের উৎপাদিত সামগ্রীর বিপ্রতীপে রামদেব পতঞ্জলির হয়ে যে যে গুণমানের অঙ্গীকার করেছিলেন তার অন্তঃসারশূন্যতা অল্পকালের মধ্যেই প্রকাশিত হতে শুরু করে। ২০১২ সালেই পতঞ্জলির সরষের তেল, নুন, বেসন, মধু ও আনারসের জ্যাম উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুর ল্যাবরেটরিতে নিম্নমানের বলে সাব্যস্ত হয়। ২০১৫-১৬ সালে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এএসসিআই বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে ও প্যাকেটের লেবেলে মিথ্যাচার করার জন্য পতঞ্জলির ৩৩টি বিজ্ঞাপনের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।[3] ‘দিব্য মুক্তা বটি’ ও ‘দিব্য মধুনাশিনী বটি’-র বিজ্ঞাপনে ১ কোটি মানুষের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর দাবি করা হয়েছে, কিংবা ‘দন্ত কান্তি’ টুথপেস্টের মোড়কের গায়ে লেখা আছে যে, এ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার সবটাই শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে দান করা হয়, ‘কাচ্চি ঘানি সরষের তেল’-এর বিজ্ঞাপনে অধিকাংশ কোম্পানির সরষের তেলকেই পাম তেল দ্বারা দূষিত বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনে ও উৎপাদিত সামগ্রীর মোড়কে পতঞ্জলির মিথ্যাচারের এরকম ভুরি ভুরি নমুনা ছড়িয়ে আছে। আদালতে এখন তাঁকে এর শাস্তি হিসেবে জরিমানা ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হচ্ছে, ক্রেতাদের কাছেও কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। ভারতীয় ক্রেতার কাছে এসবের অভিঘাত কীভাবে পৌঁছয়, তা আগামী দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এতদ্সত্ত্বেও, যোগ ও আয়ুর্বেদকে তিনি যেভাবে বাণিজ্যসফল করে তুলেছেন তা যেমন তুলনারহিত, তেমনি যোগ ও আয়ুর্বেদের কাঁধে ভর করে তিনি যে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তা-ও অবিশ্বাস্য। রামদেবের এই সাফল্যের পেছনে শঠতা, মিথ্যাচার, রাজনৈতিক দুর্নীতি ইত্যাদি নানাভাবে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি যোগবিষয়ক বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও আয়ুর্বেদ সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় নীতি অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল, এগুলি অনুকূল না থাকলে তাঁর পক্ষে এতদূর পৌঁছনো সম্ভব হত না। বর্তমান রচনায় আমরা এই বিষয়টির ওপরেই জোর দিয়েছি।
ভারতীয় যোগের ‘ঘর ওয়াপসি’
প্রাচীন ভারতে যোগ ছিল এক বিশেষ ধর্মীয় আচরণ। উপনিষদে এ ছিল ‘আত্মানুসন্ধান’ ও ‘চরম সত্যে’ পৌঁছনোর উপায়। পতঞ্জলি রচিত যোগসূত্র (আনুমানিক খ্রি. ২য় শতক)-এ ‘যোগ’-এর অর্থ ছিল ‘পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হওয়া’। যোগসূত্র-এর চারটি অধ্যায়: সমাধিপাদ, সাধনপাদ, বিভূতিপাদ ও কৈবল্যপাদ। এর মধ্যে কেবলমাত্র সাধনপাদে ‘অষ্টাঙ্গ যোগ’-এর কথা আছে, আসন ও প্রাণায়াম যার দুটি অংশমাত্র। বস্তুত, দ্বাদশ শতকের আগে আসন ও প্রাণায়াম চর্চা যোগীদের কাছে অতখানি গুরুত্ব পেত না। যোগের শারীরিক কসরত ও শ্বাসবায়ু গ্রহণ-নির্গমনের এই অংশটুকু, যাকে ‘হঠযোগ’ বলা হয়ে থাকে, তাকে যোগচর্চার কেন্দ্রীয় বিষয় করে তুলেছিলেন স্বাত্মারাম, তাঁর হঠযোগপ্রদীপিকা (আনুমানিক ১৪৫০ খ্রি.) গ্রন্থে। তবে আসন ও প্রাণায়াম হঠযোগের প্রধান দুটি অঙ্গ হলেও প্রাচীন ভারতে কখনওই তা রোগ নিরাময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। আয়ুর্বেদেও কখনওই রোগ নিরাময়ের উপায় হিসেবে যোগের কথা আসেনি। যোগের সঙ্গে স্বাস্থ্যের এই যোগাযোগ ঘটে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে। স্বামী কুবলয়ানন্দ ওরফে জগন্নাথ গুণে (১৮৮৩-১৯৬৬) এবং শ্রী যোগেন্দ্র ওরফে মানিভাই হরিভাই দেশাই (১৮৯৭-১৯৮৯) এর সূত্রপাত করেন। তাঁরা প্রাচীন ভারতীয় এক ধর্মীয় আচরণের সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্বাস্থ্য ও রোগ নিরাময়ের ভাবনা জুড়ে দেন।
ঊনবিংশ-বিংশ শতকে আমেরিকায় প্রাচ্য-আধ্যাত্মিকতা নিয়ে যে উৎসাহের জোয়ার আসে, তারই প্রভাবে সেখানে একের পর এক ভারতীয় গুরু আশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে প্রণীত মার্কিন অভিবাসন আইনের নমনীয়তা এই প্রবণতাকে বিপুলভাবে উৎসাহিত করে। ভারতীয় যোগগুরুরাও ‘ভাগ্যান্বেষণে’ ওই দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। সেখানে তাঁরা প্রতিটি যোগাসনের সঙ্গে সুস্বাস্থ্যের ফিরিস্তি জুড়ে দিতে শুরু করেন। কালক্রমে ও-দেশে গড়ে ওঠে যোগের এক বিরাট বাজার, ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের উপনিষদীয় উপায় থেকে তা হয়ে ওঠে ওয়ালমার্ট সামগ্রী। বিভিন্ন যোগগুরুর আখড়ায় যোগের রকমারি প্যাকেজিং-এর ব্যবস্থা হয়— ‘ক্রিয়া যোগ’ (পরমহংস যোগানন্দ), ‘কুণ্ডলিনী যোগ’ (স্বামী মুক্তানন্দ), ‘ইন্টিগ্রাল যোগ’ (স্বামী সচ্চিদানন্দ), ‘আয়াঙ্গার যোগ’ (বিকেএস আয়াঙ্গার), ‘ফ্লো যোগ’ (অমৃত দেশাই), ‘পাওয়ার যোগ’ (কে পট্টভী জইস), ‘হট যোগ’ (বিক্রম চৌধুরী); এমনকি, ‘ন্যুড যোগ’-এরও ব্যবস্থা রাখেন কেউ কেউ। যোগানুরক্তের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরাও— বিটল্স, ইহুদি মেনুহিন, মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা, লেডি গাগা, এলভিস প্রেসলি, অ্যালেন গিনস্বার্গ, ডেভিড বেকহ্যাম, স্টিভ জোবস, রবিশঙ্কর।
মার্কিন দুনিয়ার এই সাফল্যের ঢেউ ভারতেও এসে পৌঁছয়। রামদেবের মতো সুযোগসন্ধানীদের কাছে এ ছিল ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্ত এক সুবর্ণ সুযোগ। বাড়তি হিসেবে, অধ্যাত্মচর্চায় একশো শতাংশ নিবেদিতপ্রাণ টেলিভিশন চ্যানেলও সময় মাহাত্ম্যে তাঁর সহায়ক হয়। যোগশিবিরের মাধ্যমে তিনি যতজনের কাছে পৌঁছতে পারেতেন, তা নিমেষে কয়েক হাজার গুণ বেড়ে যায়। তিনি তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে এটাও বুঝে নেন যে, ভারতে একে জনপ্রিয় করে তুলতে হলে যোগকে আরও সহজসরল করে তোলা দরকার। রামদেব তাঁর ভক্তদের জন্য যোগের এমন এক ‘ইনস্ট্যান্ট’ রূপ নিয়ে হাজির হন, যা সহজ ও সংক্ষিপ্ত, অথচ দ্রুত রোগ নিরাময়ের প্রতিশ্রুতিতে মুখর। দর্শক দেখলেন সন্ন্যাসীর বেশভূষায় সজ্জিত এক হ্যামলিনের বাঁশিওলা তাঁদের নিয়ে চলেছেন এমন এক স্বর্গীয় দুনিয়ায়, যেখানে বিরাজ করছে চিরযৌবন আর স্বাস্থ্যের লাবণ্য। রুপোলি চুল যেখানে চকিতে কালো হয়ে ওঠে, দুরারোগ্য ব্যাধি অক্লেশে নির্মূল হয়, হৃদযন্ত্র উচ্চরক্তচাপ ঝেড়ে ফেলে সঠিক ছন্দে স্পন্দিত হতে শুরু করে। বস্তুত, ২০০১ সালে ‘সংস্কার’ চ্যানেলে ভোর ৬টা ৪৫ থেকে শুরু হওয়া ২২-মিনিটের যোগ-সম্প্রচার ভারতের আমজনতাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। সাধারণের নিত্যকার বাক্যালাপে ‘যোগ’ ও ‘প্রাণায়াম’ শব্দ দুটি ফ্যাশনদুরস্ত শব্দে পরিণত হয়। ‘নিজের স্বাস্থ্য নিজের হাতে’ তুলে দেওয়ার পাশাপাশি সুকৌশলে এর সঙ্গে রামদেব যুক্ত করে দেন ঘরোয়া উপাদাননির্ভর নানা ভেষজ টোটকা ও পতঞ্জলির তৈরি নানা ভেষজ দাওয়াই। এভাবে, যোগের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় আমজনতার আরেক শ্লাঘার বস্তু আয়ুর্বেদ।
আয়ুর্বেদ, অথবা ‘ভারতের জাতীয় প্রেস্টিজ়’
২০০৬ সালে উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের আমলকি চাষিরা বিপদে পড়ে রামদেবের শরণাপন্ন হন, আকস্মিক ঝড়বৃষ্টিতে তাঁদের প্রচুর আমলকি নষ্ট হয়েছে। রামদেব কালক্ষেপ না করে সেগুলো সস্তায় কিনে নেন এবং পঞ্জাবের এক সংস্থায় পাঠিয়ে এর রস বানানোর ব্যবস্থা করেন। যোগশিবির ও টেলিভিশন চ্যানেলকে কাজে লাগিয়ে অতঃপর তিনি লাগাতার আমলকি রসের নানা ‘সুফল’ প্রচার করতে লেগে যান। আমলকির জ্যাম-জেলি না বানিয়ে এর রস উৎপাদনের বাণিজ্যিক ভাবনাটিকে বেশ আনকোরাই বলতে হবে। কিন্তু ভক্তদের প্রভাবিত করার ব্যাপারে রামদেবের আত্মবিশ্বাস তাঁকে মোটেও হতাশ করেনি, বরং অচিরেই তিনি স্ব-উদ্ভাবিত ‘আমলা জুস’-এর বাণিজ্যিক মুখপাত্রে পরিণত হন। বস্তুত, যোগের পাশাপাশি বাণিজ্যসফল বাবার ‘স্বদেশি’ ন্যারেটিভের অন্যতম উপাদান হল আয়ুর্বেদ, আরেক প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান, যাকে রাষ্ট্র কেবল অতীতের গৌরবজনক ভূমিকার জন্যই নয় আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগেও অপরিহার্য বলে ক্রমাগত তুলে ধরতে চাইছে। আর, কেই বা না-জানে, ভেষজ মানেই ‘আয়ুর্বেদ’, ভেষজ মানেই ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন’, ভেষজ মানেই ‘প্রাকৃতিক’ অর্থাৎ ‘কেমিক্যাল-বিহীন’, ভেষজ মানেই ‘সুস্বাস্থ্য’ ও ‘রোগ নিরাময়ের গ্যারান্টি’! কাজেই, ‘আমলা জুস’-এর মারকাটারি সাফল্য আটকাচ্ছে কে!
যেহেতু আমাদের আদিম পূর্বপুরুষরা প্রকৃতির মধ্যেই রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেছিলেন, যে-কোনও দেশেরই প্রাচীন চিকিৎসা ঐতিহ্যের মধ্যে ভেষজ চিকিৎসাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আজকের পরিচিত ভেষজগুলির মধ্যে অনেকগুলির ব্যবহারই সুদূর প্রস্তরযুগ থেকে চলে আসছে। স্বভাবত, আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই গৌরবময় উত্তরাধিকার বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের চিকিৎসা-সংস্কৃতিতে কোনও না কোনওভাবে উপস্থিত আছে। আমাদের দেশে এক সময় বায়ু-পিত্ত-কফের ভারসাম্যহীনতাকে রোগের কারণ বলে ভাবা হত এবং এই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য ভেষজকে নানাভাবে ব্যবহার করা হত। এই পদ্ধতিরই নাম আয়ুর্বেদ। এখানে বলে রাখা দরকার যে, রামদেব যখন তাঁর কোম্পানি উৎপাদিত বিস্কুট, নুডলস ও কর্নফ্লাওয়ারকেও ‘আয়ুর্বেদিক’ বলে ঘোষণা করেন, তখন কিন্তু তিনি আমজনতাকে বিভ্রান্ত করার জন্যই করেন। গম বা গম-জাতীয় দানাশস্য বা ভেষজ উপাদান মানেই ‘আয়ুর্বেদ’ নয়। আয়ুর্বেদের পদ্ধতি ও নীতিমালা না মানলে তাকে কখনই ‘আয়ুর্বেদিক’ বলা যায় না। প্রাচীন ভারতে অথর্ববেদের যুগে রোগের কারণ ও নিরাময়ের জন্য যে অলৌকিকতা ও মন্ত্রতন্ত্র-নির্ভরতা ছিল, আয়ুর্বেদের বস্তুবাদী চিন্তা তাকে অনেকাংশে প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছিল। আয়ুর্বেদে রোগের কারণ ও তা থেকে মুক্তির জন্য প্রকৃতির ওপরেই নির্ভর করা হত। কিন্তু প্রাচীন এই বিদ্যাকে আর কোনওভাবেই যুগোপযোগী করে তোলা সম্ভব নয়, এর সদর্থক অংশটুকু ইতিমধ্যেই আধুনিক চিকিৎসার মধ্যে মিশে গেছে।
১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা-আটা অধিবেশনে অন্য অনেক দেশের মতো ভারতও তার নাগরিকদের জন্য ‘২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু এজন্য স্বাস্থ্যকাঠামোর প্রয়োজনীয় উন্নতিসাধন না করে করে তথাকথিত ‘বিকল্প চিকিৎসা’কে গুরুত্ব দিতে থাকে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ, যা কালের নিয়মে পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল, তার পালে আবার হাওয়া লাগতে শুরু করে। ১৯৯৫ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যণ মন্ত্রকের অধীনে আয়ুর্বেদ, যোগ, য়ুনানি, সিদ্ধা, নেচারোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথির জন্য একটি পৃথক বিভাগ চালু করা হয়। এই চিকিৎসা পদ্ধতিগুলির ইংরেজি আদ্যক্ষর নিয়ে ২০০২ সালে গঠিত হয় ‘আয়ুষ’, যাকে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ২০১৪ সালে উগ্র হিন্দুত্ববাদী তথা জাতীয়তাবাদী সরকারের উদ্যোগে ‘আয়ুষ’-এর স্বতন্ত্র মন্ত্রক গঠিত হয়। এভাবে, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে আয়ুর্বেদ ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য পরিষেবায় জাঁকিয়ে বসে ও দেশের ভেষজ শিল্প ফুলেফেঁপে ওঠে। ভেষজ সামগ্রী রপ্তানি করে বিদেশি মুদ্রা অর্জন সামগ্রিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। উপরন্তু, হিন্দুত্বের গরিমার অংশ হিসেবে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান রূপেও একে মহিমান্বিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০২০ সালে সরকার কোবরেজদের কিছু সার্জারি করারও অনুমোদন দেয়। আয়ুর্বেদ হয়ে ওঠে ভারতের জাতীয় প্রেস্টিজ়। ভেষজ সামগ্রীর গুণমান নিয়ন্ত্রণ ও অপ্রমাণিত দাবির বাড়বাড়ন্ত ঠেকানোর জন্য অবশ্য কোনও বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এই প্রসঙ্গে দু-এক কথা বলে নেওয়া দরকার।
আয়ুর্বেদ ও ভেষজ পদার্থের নিজস্ব প্রকৃতির কারণেই, এর কার্যকারিতা নির্ণয় ও গুণমান নিয়ন্ত্রণ এক কঠিন সমস্যা। রামদেব-বালকৃষ্ণ জুটি হরিদ্বারের দ্বারে দ্বারে যে চ্যবনপ্রাশ ফেরি করে বেড়াতেন, বিষয়টি বোঝার জন্য তার কথাই ধরা যাক। ‘চ্যবনপ্রাশ’ নামক কোবরেজি ‘টনিক’-এ কমবেশি ৪০টি গাছগাছড়ার নির্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ব্যবহারকারীরা জানেন যে, বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রস্তুত চ্যবনপ্রাশ স্বাদে-গন্ধে হুবহু এক হয় না, কারণ এগুলিতে গাছগাছড়ার যেমন ভিন্নতা থাকে তেমনি তাদের পরিমাণেও তারতম্য থাকে। আর একটু গভীরে গিয়ে রসায়নের দিক থেকে ভাবলে দেখতে পাব, চ্যবনপ্রাশের মধ্যে উপাদান হিসেবে উপস্থিত রয়েছে অন্তত কয়েক হাজার রাসায়নিক পদার্থ। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে, এই রাসায়নিকগুলির মধ্যে এক বা একাধিক উপাদান সুস্বাস্থ্যের সহায়ক বা কোনও নির্দিষ্ট রোগ সারানোর উপযোগী, তাদের চিহ্নিত করা সহজ নয়। উপরন্তু, চ্যবনপ্রাশে উপস্থিত অন্যান্য পদার্থগুলির শারীরিক প্রভাব আমাদের জানা নেই; অর্থাৎ তাদেরকে শরীরে গ্রহণ করলে বাড়তি কোনও লাভ হচ্ছে কিনা তা যেমন অজানা, তেমনি অনির্ণীত ঝুঁকিও রয়ে যাচ্ছে। কাজেই, ওইসব বাড়তি পদার্থগুলি অবাঞ্ছিত। এরপর, আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার ধরনধারণ মেনে এগোতে হলে গবেষককে ‘সক্রিয় উপাদান’গুলি কোন প্রক্রিয়ায় শরীরে ইতিবাচক ফলাফল এনে দিচ্ছে, তার ক্রিয়াপদ্ধতির হদিশ দিতে হবে ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা হাজির করতে হবে। এসব কারণেই ভেষজ পদার্থ নিয়ে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক গবেষণা অত্যন্ত সমস্যাসঙ্কুল। একই সঙ্গে, আয়ুর্বেদীয় সামগ্রীর গুণমান নির্ণয়ের কাজটিও ততখানিই দুঃসাধ্য। ভারতে আয়ুর্বেদীয় ওষুধের গুণমান নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ ও প্রসাধনী আইন, ১৯৪০-এর সংশ্লিষ্ট ধারাগুলিতে যা যা বলা আছে, তা আধুনিক ওষুধের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলির সঙ্গে তুল্যমূল্য। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল এবং ভেষজ ওষুধের নিজস্ব প্রকৃতির কারণে তা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়সাধ্য ও সময়সাপেক্ষও বটে। এক-একটি গাছগাছড়াকে অবিকৃত অবস্থায় হয়তো চেনা সম্ভব, কিন্তু একাধিক গাছগাছড়াকে পেষাই করে মিশিয়ে দিলে, তাদের আলাদা করে শনাক্ত করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কাজেই, ওষুধে যদি এক গাছের বদলে অন্য গাছের ভেজাল দেওয়া হয়, তা ধরতে গেলে কয়েকশো রাসায়নিক পরীক্ষা করতে হতে পারে। কাজেই, রামদেবদের পোয়া বারো! এর বিপরীতে আমরা আধুনিক ওষুধের দিকে তাকালে দেখতে পাব যে, অধিকাংশ আধুনিক ওষুধে একটি মাত্র (অল্প সংখ্যক কম্বিনেশন ড্রাগগুলিতে অতিরিক্ত আরও দু-একটা) সক্রিয় রাসায়নিক উপস্থিত থাকে (বাকিগুলি নিষ্ক্রিয় পদার্থ), কাজেই শনাক্তকরণ এবং তার গুণমান নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক সহজ।
এবার আসি আসল কথায়। এতে কোন রোগ কীভাবে সারছে, তা প্রমাণ হচ্ছে কীভাবে? আধুনিক ওষুধের ক্ষেত্রে যেমন দীর্ঘকালীন পরীক্ষানিরীক্ষার নানাবিধ ধাপ পেরিয়ে একটি রাসায়নিককে ওষুধ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হয় এবং পরীক্ষিত রাসায়নিকদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র এই প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হয়, আয়ুর্বেদের ক্ষেত্রেও তেমন কোনও ব্যবস্থা আছে কি? এর স্পষ্ট উত্তর হল, না; আয়ুর্বেদের ক্ষেত্রে এসবের কোনও বালাই নেই। ‘আধুনিক’ হয়ে ওঠবার তাড়নায় কিছু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা ইদানীং হচ্ছে বটে, তবে তার পরিমাণ যেমন যৎসামান্য, তাদের গুণমানও তথৈবচ। তাহলে, নতুন নতুন রোগ সারানোর দাবিগুলিই বা আসছে কীভাবে? জলের মতো সোজা! ধরা যাক, আয়ুর্বেদের কোনও গ্রন্থে তিনটি গাছপালার মিশ্রণকে জ্বরনাশক ওষুধ বলে লেখা আছে এবং মৃগী সারানোর জন্য অন্য চারটি গাছের উল্লেখ আছে। এবার এই গাছগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে বা সবগুলিকে ইচ্ছেমতন এলোমেলোভাবে মিশিয়ে দিয়ে নতুন যে কোনও মনগড়া রোগের ওষুধ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কোনও আইনে আটকাবে না! কাজেই, আজ পর্যন্ত কোনও ভেষজ ওষুধের বন্ধ্যাত্ব সারানোর ক্ষমতা প্রমাণিত না হলেও, পতঞ্জলির ‘পুত্রজীবক বীজ’ বেচতে কোনও বাধা নেই।
করোনাকালে বুদ্ধিনাশ: আয়ুষ অপেরার কুনাট্য ও ‘করোনিল’ কাণ্ড
অতিমারি চলাকালীন কোভিড-১৯ এর টিকা যতদিন আবিষ্কার হয়নি, ততদিন গোটা বিশ্বেই ভেষজ বাজারে এক অভূতপূর্ব জোয়ার এসেছিল, এবং তা এসেছিল শরীরের ‘ইমিউনিটি বুস্টিং’-এর নামে। ভারতের আয়ুষ দফতর অবশ্য ওইটুকুতেই আটকে ছিল না। এ-দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগেই তারা হোমিওপ্যাথিক ‘আর্সেনিকাম অ্যালবাম’-কে রোগটির প্রতিষেধক হিসেবে ঘোষণা করে। অবশ্য সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে থাকলে তারা অস্বস্তিতে পড়ে যায় এবং একটি অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গোটা আয়ুষ দফতরটাই ‘লকডাউন’-এ চলে যায়! কিন্তু কিছুকালের মধ্যে পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। অতীতে গোমূত্রের গুণগান করে যথেষ্ট ‘সুনাম’ অর্জন করা শ্রীপাদ নায়েক, যিনি আয়ুষ দফতরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন, দেশের বিকল্প চিকিৎসকদের কাছ থেকে এ-ব্যাপারে পরামর্শ আহ্বান করেন। কিছুদিনের মধ্যেই কোবরেজ-হেকিম-হোমিওপ্যাথদের আজগুবি সমস্ত দাবিতে মন্ত্রীমশাইয়ের ঝুলি উপচে পড়ে। ব্রিটেনের রাজকুমার নাকি হোমিওপ্যাথি ব্যবহার করে সংক্রমণমুক্ত হয়েছেন, এমন দাবিও করে বসেন কেউ কেউ, অচিরেই যা মিথ্যে বলে প্রতিপন্ন হয়।
অবশেষে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অনেক অঙ্ক কষার পর আয়ুষ দফতর কোভিড চিকিৎসার এক ‘প্রোটোকল’ নির্মাণ করে ‘ইমিউনিটি বুস্টিং’-এর সনাতন চাতুরির দুনিয়ায় ফিরে যায়। চ্যবনপ্রাশ, ‘হার্বাল টি’, হলুদগুঁড়ো মিশ্রিত দুধ সেবন আর নাকের ফুটোয় তৈলমর্দন এবং নারকেল-তিল তেলের সাহায্যে কুলকুচি করার নিদান— এতেই নাকি ‘বুস্ট’ হবে আমজনতার ইমিউনিটি! খোদ প্রধানমন্ত্রী এ-ব্যাপারে অত্যুৎসাহীর ভূমিকা পালন করে দেশবাসীকে ‘বুস্টিং’-এর পবিত্র কর্তব্যটি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রাষ্ট্রের এহেন কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে হাতুড়েপনা তুঙ্গে পৌঁছয় এবং বিজ্ঞাপনে অহরহ অদ্ভুত সব দাবি প্রকাশিত হতে শুরু করে। ফার্মাকোভিজিল্যান্স সেন্টার ফর আয়ুর্বেদ, সিদ্ধা, য়ুনানি অ্যান্ড হোমিওপ্যাথি ২০১৮ থেকে ২০২১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত এরকম ১৮,৮১২টি আপত্তিকর বিজ্ঞাপন পেয়েছে বলে জানিয়েছে। এর অধিকাংশই অতিমারিকালীন ঘটনা। আয়ুষ দফতর মুখে এগুলি নিয়ন্ত্রণের কথা ঘোষণা করলেও, কার্যত, অবস্থার বিশেষ বদল ঘটে না। ইতিমধ্যে দেশের বিজ্ঞানীমহল ‘আর্সেনিকাম’ নিয়ে আয়ুষ-এর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এর সাফাই হিসেবে আয়ুষ মন্ত্রকের সেক্রেটারি রাজেশ কোটেচা একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেন, যাতে পুরনো বিজ্ঞপ্তিটির সামান্য রদবদল ঘটিয়ে দুটি সংযোজনী জুড়ে কার্যত নতুন বোতলে পুরনো মদ পরিবেশন করা হয়। এতে দেশবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারে যে, কোবরেজি-হেকিমি-হোমিওপ্যাথি সবেতেই নাকি কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার উপায় আছে! এইসব কাণ্ডে উৎসাহিত হয়ে দেশের কোনায় কোনায় রাজনৈতিক মদতে ‘আর্সেনিকাম’ বিলিবাঁটোয়ারা শুরু হয়ে যায়।
আয়ুষ দফতরের কুনাট্যের আরও কিছু অবশিষ্ট ছিল! তারা কোভিডে বিকল্প চিকিৎসার কার্যকারিতা খতিয়ে দেখতে ও কোভিড নিয়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ, কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ, ডিপার্টমেন্ট অব বায়োটেকনোলজি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আয়ুষ চিকিৎসকদের যুক্ত করে এক টাস্ক ফোর্স গঠন করে। টাস্ক ফোর্স কোভিড নিয়ে বিকল্প চিকিৎসা গবেষণার এক ‘অত্যাশ্চর্য’ প্রোটোকল সামনে আনে। এই প্রোটোকলে দেখা যায় যে, গবেষণার জন্য ক্লিনিক্যাল রেজিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-য় নথিভুক্তিকরণের কোনও প্রয়োজন নেই, আবশ্যিক নয় কোনও ‘পিয়ার রিভিয়্যুড জার্নাল’-এও সেগুলি প্রকাশ করা। কাজেই, এই তথাকথিত গবেষণাগুলির মান সহজেই অনুমেয়। স্বভাবত, কিছুদিনের মধ্যে সংবাদমাধ্যমে এরকম সব ‘গবেষণা’-র ‘ইতিবাচক’ ফলাফল প্রকাশ পেতে শুরু করে। পতঞ্জলির ‘করোনিল-গবেষণা’-র প্রকৃত চরিত্র বোঝবার জন্য আয়ুষ দফতরের এই কুনাট্যগুলোকে জানা দরকার।
২০২০ সালের জুন মাসে ‘করোনিল’ নামের এক ভেষজ সামগ্রীকে রামদেব ও তার কোম্পানি কোভিড-১৯ এর ‘ওষুধ’ বলে দাবি করে। ‘করোনিল’-এর প্যাকেটের উপাদান তিনটি: (১) স্বসারি রস বটিকা (এক ডজনেরও অধিক গাছপালার নির্যাস), (২) গুলঞ্চ, অশ্বগন্ধা ও তুলসীর মিশ্রণ, এবং, (৩) নাসারন্ধ্রে দেওয়ার ভেষজ তেল। আয়ুষ দফতরকে দেওয়া প্রমাণস্বরূপ যে দুটি গবেষণাপত্রের নমুনা পতঞ্জলি পেশ করে তার একটিতে ইঁদুরের ওপর কৃত্রিমভাবে অ্যালার্জি সৃষ্টি করে ‘স্বসারি বটিকা’ প্রয়োগের ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে, এবং অন্যটিতে ‘কমপিউটার সিমুলেশন’-এর সাহায্যে প্রমাণের চেষ্টা হয় কীভাবে গুলঞ্চ মানবশরীরে থাকা এসিই গ্রাহক ও ভাইরাসের দেহস্থিত স্পাইক প্রোটিনের মধ্যেকার স্থিরতড়িৎজনিত মিথষ্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় (সংক্রমণের জন্য এই মিথষ্ক্রিয়া জরুরি)। দুটি তথাকথিত গবেষণার কোনওটিই ‘পিয়্যার রিভিয়্যু’-কৃত গবেষণা নয়। প্রথমটির সঙ্গে কোভিড ১৯-এর সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই এবং দ্বিতীয়টি কোনও ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা নয়, ‘কমপিউটার সিম্যুলেশন’ মাত্র। কাজেই, কোভিড ১৯-এর ‘ওষুধ’ হিসেবে উপরিউক্ত কোনও গবেষণাই কার্যকারিতার প্রমাণ দিচ্ছে না। এ নিয়ে চাপানউতোর শুরু হলে উত্তরাখণ্ড সরকারের আয়ুর্বেদ দফতর জানিয়ে দেয় যে, ‘করোনিল’-কে ‘ইমিউনিটি বুস্টার’ হিসাবে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, কোভিড ১৯-এর ‘ওষুধ’ হিসেবে নয়। প্রকারান্তরে রামদেবকে ঠগবাজ প্রতিপন্ন করে কিঞ্চিৎ চমক-সহ তারা আরও জানায় যে, ‘করোনিল’-কে কোভিড ১৯-এর ‘ওষুধ’ হিসেবে ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য আবেদন করাই হয়নি। অতঃপর কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে ‘ওষুধ’ হিসেবে এর বিক্রয় বন্ধ হয়ে যায়, তবে ‘ইমিউনিটি বুস্টার’ হিসেবে এর বিক্রিবাটা অবাধে চলতে থাকে।
কিন্তু এত অল্পে রামদেব সন্তুষ্ট ছিলেন না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘করোনিল’-কে কোভিড ১৯-এর ‘ওষুধ’ হিসেবে পুনরায় সামনে আনা হয়। এবার রামদেব এই উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী-সহ অন্য এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়কড়িকে পাশে বসিয়ে রীতিমতন ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন করে ফেলেন। প্রমাণ হিসেবে যে গবেষণাটি তুলে ধরা হয়, তা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ‘ফাইটোমেডিসিন’ নামক জার্নালে। এ এক বিচিত্র গবেষণাপত্র! মাত্র ৯৫ জন লক্ষণবিহীন করোনা সংক্রামিত রোগীর মধ্যে ৪৫ জনের ওপর ‘করোনিল’-এর প্রভাব দেখা হয়েছে, ৫০ জন ‘প্লাসিবো’-র বিপরীতে। দুটি দলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের বয়সের গড় যথাক্রমে ৩৩ ও ৩৫ বছর। ৫৫ বছরের থেকে বেশি বয়সী ব্যক্তি ছিলেন মাত্র ৪ জন, অথচ অতিমারিতে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে ছিলেন এই বয়ঃসীমার লোকজনই। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে কম, মাত্র ১৮ জন। আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে সংক্রমণ পরীক্ষা করা হয়েছে, কোনও ‘ভাইরাল লোড’ মাপা হয়নি। কাজেই, কে কখন সংক্রামিত হয়েছে, তার কোনও হিসেব ছিল না। অর্থাৎ অংশগ্রহণকারীদের সংক্রমণের তীব্রতার তুলনা না করেই আরটি-পিসিআর করে কেবল সংক্রমণ আছে কিনা তা দেখা হয়েছে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্যও পর্যাপ্ত নয়। এমনকি, দুটি দলের ফলাফলের পার্থক্যের হিসেবেও যথেষ্ট গরমিল আছে, ভাষার কারিকুরিতে ২০ শতাংশ ফারাক হয়ে উঠেছে ৪০ শতাংশ। এরকম একটি ত্রুটিপূর্ণ গবেষণার ভিত্তিতে ‘করোনিল’-কে ছাড়পত্র দেওয়া হয় এবং প্রকারান্তরে দেশের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীও রামদেবের এই প্রতারণাপূর্ণ কারবারের অংশীদার হয়ে ওঠেন।
আয়ুষ দফতরের নিজস্ব কাজকর্মের দিকে তাকালে করোনিল-কাণ্ড চমৎকারভাবে বোধগম্য হয়ে ওঠে। প্রায় চার দশক আগে ম্যালেরিয়া চিকিৎসার জন্য ‘আয়ুষ-৬৪’ নামক একটা ভেষজ মিশ্রণ প্রস্তুত করা হয়েছিল, যার মূল উপাদান সপ্তপর্ণা, কুটকী, চিরতা ও কুবেরক্ষা নামের চারটি গাছগাছড়ার বিভিন্ন অংশ। ১৯৮১ সালে সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন আয়ুর্বেদিক সায়েন্সেস (সিসিআরএএস) মাত্র ৫৫ জন ম্যালেরিয়া রোগীর ওপরে ‘আয়ুষ-৬৪’ নিয়ে এক কন্ট্রোলবিহীন গবেষণা করে, রোগীদের ওপর ওষুধের কেবলমাত্র স্বল্পকালীন প্রভাব দেখা হয় এবং, এমনকি, কোনও ‘প্যারাসাইট কাউন্ট’ও করা হয় না। এই ত্রুটিপূর্ণ ও নিম্নমানের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এরপর থেকে ‘আয়ুষ-৬৪’-কে ‘গোদি মিডিয়া’-র সাহায্যে ‘ম্যালেরিয়ার অত্যাশ্চর্য ওষুধ’ হিসেবে তুলে ধরা হতে থাকে। কিছুকালের মধ্যেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যালেরিয়া রিসার্চ-এর উদ্যোগে ম্যালেরিয়ার প্রামাণ্য চিকিৎসার বিপরীতে রেখে সংঘটিত অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রামাণ্য চিকিৎসার তুলনায় ‘আয়ুষ-৬৪’ আদৌ কার্যকর নয়। অতিমারি চলাকালীন আয়ুষ দফতর একে কোভিড ১৯-এর প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করার ভাবনা থেকে পুনরায় পরীক্ষায় নামায়। অনেকগুলি ‘প্রি-প্রিন্ট’ গবেষণার শেষে ২০২২ সালে জার্নাল অব আয়ুর্বেদ অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ মেডিসিন-এ প্রকাশিত হয় যে গবেষণাটি, তাতে দেখা যায় মাত্র ৭৪ জন মৃদু লক্ষণবিশিষ্ট কোভিড-রোগীকে দু-ভাগে ভাগ করে ৩৭ জনের ওপরে প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি ‘আয়ুষ-৬৪’ প্রয়োগ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে অন্য ৩৭ জনকে কেবল প্রচলিত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখানে প্লাসিবোর সঙ্গে সরাসরি তুলনা না করে ‘ক+খ বনাম খ মডেল’-এ পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এই মডেলের সুবিধে হল এতে কখনই ‘নেগেটিভ’ ফলাফল আসে না, যদি না একান্তই রোগীর ওপর ‘ক’ কোনও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। উপরন্তু, ‘ক’ চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত প্লাসিবো ক্রিয়া সরাসরি ফলাফলে যুক্ত হয়ে যায় এবং ‘ক’-এর কার্যকারিতার সপক্ষে ‘পজিটিভ’ ফলাফল দর্শায়। বিকল্প চিকিৎসা গবেষণার অনেকরকম চাতুরির মধ্যে ‘ক+খ বনাম খ মডেল’ অন্যতম। আয়ুষ দফতর ‘আয়ুষ-৬৪’-র ক্ষেত্রে সেই চাতুরিরই আশ্রয় নিয়েছে।
ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) ও ডঃ রেড্ডি’স ল্যাবরেটরির যৌথ গবেষণার ‘ফসল’ ২-ডিঅক্সি-ডি-গ্লুকোজ বা সংক্ষেপে ২-ডিজি সম্পর্কিত কাহিনিও উপরের কাহিনিগুলির সঙ্গে তুলনীয়। এই রাসায়নিকটির ওপর গবেষণা চলছে ১৯৫৬ সাল থেকে, অথচ এখনও পর্যন্ত কোনও রোগের কার্যকর ওষুধ হিসেবে তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া কোভিড-১৯ রোগীদের শ্বাসকষ্টে অক্সিজেনের চাহিদা কমায় বলে একে ছাড়পত্র দিলেও মানবশরীরে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনও পাকাপোক্ত তথ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান দুটি এখনও পেশ করেনি। যতটুকু তথ্য জানা গেছে, তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। এর কর্মপদ্ধতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে, কিন্তু মানবশরীরে পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানা যায়নি। দৈনিক যে মাত্রায় তা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, তার নিরাপত্তা নিয়েও সুগভীর প্রশ্ন আছে। অর্থাৎ, অতিমারিকালে বিকল্প চিকিৎসার পাশাপাশি এদেশের আধুনিক চিকিৎসা গবেষণার পরিস্থিতিও ছিল যথেষ্ট উদ্বেগজনক। রামদেব-বালকৃষ্ণ জুটি দেশের ওষুধ গবেষণার এই শোচনীয় হালকে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছেন মাত্র।
রামদেব: জনবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির এক বিষময় ফল
সকলেরই মনে পড়বে যে, আমাদের দেশের সরকার প্রথমে কোভিড-টিকার দায় সাধারণ মানুষের ঘাড়েই চাপানোর বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল, খোলা বাজার টিকার দামও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। পরে পরিস্থিতি তাদের অন্যরকম করতে বাধ্য করে। জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ এখানে পাওয়া যায়। আমরা দেখতে পাই, ভারতে স্বীকৃত বিকল্প চিকিৎসাগুলির মধ্যে যোগ ও আয়ুর্বেদের নামে যথেচ্ছ জাতীয়তাবাদী হুজুগ তৈরি করা হয়েছে ও হচ্ছে; কিন্তু হোমিওপ্যাথি ও হেকিমির জন্ম তো এদেশে হয়নি, এদেরকে তোল্লাই দেবার কারণ কী? সরকার স্বাস্থ্যখাতে খরচ বিপুলভাবে কমিয়ে আনলেও আশ্চর্যজনকভাবে বিকল্প চিকিৎসার পেছনে ব্যয়বরাদ্দ নিরন্তর বাড়ছে। এজন্য আজ যে বছরে প্রায় ৩,৫০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়, কী তার উদ্দেশ্য? একদিকে সরকারি স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প ঘোষণা করার মাধ্যমে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে, জনগণের চিকিৎসা কেনার পয়সা নেই, অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানিকে বেশি বেশি মুনাফা করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। ইলেকটোরাল বন্ডের কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর তা আরও বেশি উন্মুক্ত হয়ে গেছে। শাসকরা কেন আমজনতাকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে জলপড়া-তেলপড়া, কপালভাতি, কোবরেজি পাচন, হেকিমি দাওয়াই আর হোমিওপ্যাথির গুলির দিকে? একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, কার্যকারিতার প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও বিকল্প চিকিৎসাকে জনপ্রিয় করার এই যে রাষ্ট্রীয় তাগিদ, গোপনে তার পেছনে কাজ করছে জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার মতলব। আলমা-আটা আজ অতীত! রাষ্ট্র চায় সকলের জন্য সমমানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পাবার মৌলিক দাবিটি চলে যাক পেছনের সারিতে। বিকল্প চিকিৎসা হয়ে উঠুক চিকিৎসাবঞ্চিত জনগণের চুষিকাঠি!
এই জনবিরোধী স্বাস্থ্যব্যবস্থারই উপজাত হলেন রামদেবের মতো সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিরা, যাঁরা দেশের মানুষের জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগিয়ে এবং মিথ্যা আশ্বাস ও বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনে তাদেরকে প্রতারিত করে বিপুল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসেন। রামদেবের দিব্য ফার্মেসির ওয়েবসাইটে ১৪০টি রোগ নিরাময়ের ‘অব্যর্থ’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে। এই রোগগুলির মধ্যে রয়েছে এইডস, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, মৃগী, জন্মদানে অক্ষমতার মতো রোগের নাম, ওষুধ আইন অনুযায়ী যে রোগগুলি সারানোর দাবিই করা যায় না। ফার্মেসি অবশ্য সর্বদাই চিকিৎসিত রোগীদের থেকে ‘লিগ্যাল ডিসক্লেইমার’-এর সইসাবুদ করিয়ে নেয়, যাতে ভবিষ্যতে কোনও আইনি ঝামেলায় না জড়াতে হয়। কেবল রামদেবই নন, বিকল্প চিকিৎসার তরফে এরকম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা আকছার ঘটছে। ‘গ্যারান্টিযুক্ত চিকিৎসা’, ‘১০০% নিরাপদ’, ‘স্থায়ী নিরাময়’, ‘১০০% হার্বাল’, ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন’ ইত্যাদি ট্যাগ ব্যবহার করে দেশব্যাপী বিকল্প চিকিৎসা কারবারীরা চুটিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ কার্যত শূন্য।
যে কোনও কল্যাণকামী রাষ্ট্রে স্বাস্থ্যের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হওয়া উচিত। আজ পৃথিবীর প্রায় ৫০টি দেশে জনগণের সকলের জন্য সরকারি খরচে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশের সরকার সম্পূর্ণ উলটো পথে হাঁটছে। দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যবঞ্চিত রেখে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাকে মদত দিয়ে চলেছে আর রামদেবের মতো ধুরন্ধর, সুযোগসন্ধানী ও প্রতারক ব্যক্তিদেরকে সুযোগ করে দিচ্ছে দেদার মুনাফা লোটার। যে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের দায়ের করা মামলার জেরে রামদেব ও পতঞ্জলির এই বিরাট অনিয়ম সামনে এসেছে, সেই সংগঠনও কি জনতার প্রতি আদৌ দায়বদ্ধ? যদি সেরকম হত, তাহলে তারা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যকে দেদার ‘সার্টিফিকেট’ বিলোত না। ডেটল সাবান, ট্রপিকানা ফ্রুট জুস, কোয়াকার ওট্স্, কেন্ট ওয়াটার পিউরিফায়ার, এমনকি ক্রম্পটন গ্রিভসের এলইডি বালবের মোড়ক— সবই আইএমএ-র লোগোতে ঝলমল করছে কীভাবে! ভারতের ওষুধ বাজারে কেন এত অবৈজ্ঞানিক ও নিষিদ্ধ ওষুধের ছড়াছড়ি? কেন প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম মাত্রাছাড়া বেড়েই চলেছে? সাধারণের স্বাস্থ্য কেন আজ বহুজাতিকের সবচেয়ে লোভনীয় বাজার? কেন সরকারি হাসপাতালগুলির শোচনীয় অবস্থা? কেন চিকিৎসা কিনতে গিয়ে দেশের একটা বড় অংশের মানুষকে নেমে যেতে হচ্ছে দারিদ্র্যসীমার নিচে? এই মুহূর্তে ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলই বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে না। তাই, পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে হবে সাধারণ মানুষকেই। দেশের শীর্ষ আদালত কেবল হিমশৈলের চূড়াটুকু দেখিয়েছে। এবার আমাদের জেগে ওঠার পালা।
তথ্যপঞ্জী:
- Pathak-Narain, Priyanka. Godman to Tycoon: The Untold Story of Baba Ramdev. Juggernaut. New Delhi. 2017.
- Deka, Kaushik. The Baba Ramdev Phenomenon: From Moksha to Market. Rupa. New Delhi. 2017.
- Deo, Sandeep. Yoga Guru to Swadeshi Warrior: The True Story of Baba Ramdev. Bloomsbury. New Delhi. 2017.
- Borana, Ronak. India’s Drug Regulator Has Approved DRDO’s New COVID Drug on Missing Evidence. The Wire Science. May 12, 2021.
- Pulla, Priyanka. ‘A fraud on the nation’: critics blast Indian government’s promotion of traditional medicine for COVID-19. Science. DOI: 10.1126/science.abf2671. Oct 15, 2020.
- Mittal, Shivani. The inefficacy of AYUSH-64, the anti-malarial Ayurvedic drug developed by Ministry of AYUSH. AltNews. Jan 29, 2019.
- Menon, Shruti. Coronavirus: The misleading claims about an Indian remedy. BBC. Mar 02, 2021.
- Tatwavedi, Dharamveer. The Broken Science in Patanjali’s Coronil Study. The Wire Science. Feb 26, 2021.
- Khosla, Varuni. Mamaearth parent, Patanjali Ayurved, Firstcry among major ad violators in FY24. LiveMint. May 22, 2024.
- Pandit, Shivanand. ‘Taken India For A Ride’: Why Supreme Court’s Order Against Patanjali Is A Significant Step. The Wire. Mar 14, 2024.
- Deka, Kaushik. Power yogi: The empire of Baba Ramdev. India Today. Feb 29, 2024.
- Jalihal, Shreegireesh & Tapasya. Patanjali Group spawned dubious shell companies for lucrative real estate business. The Reporters’ Collective. Nov 22, 2023.
- Bhatia, Rahul & Lasseter, Tom. Ramdev’s Company Got $46 Million In Discounts For Land Acquisitions Since Modi Came To Power: Reuters. The Huffington Post. May 24, 2017.
- Singh, Brijesh & Gopal, R.K. Demystifying the Brand Patanjali — A Case on Growth Strategies of Patanjali Ayurved Ltd. PES Business Review. June 2016.
- Guidelines to restrict Ayush products of medicinal use. Press Information Bureau. Mar 22, 2022.
- Sarmah, Dibyojyoti. Indian Herbal Drug Industry: Prospects and Current Scenario. Curr Trends Pharm Res. 2022. 9 (1): 162-178.
- Sinha, Dr. Rohit. Misleading Advertisements In India: A Critical Study On Violation Of Consumer’s Right By Patanjali Ayurved Limited. International Multidisciplinary Journal Deliberative Research. Oct-Dec 2017.
- Rajagopal, Krishnadas. Patanjali case: Is your apology as big and expensive as your front page advertisements? SC asks Patanjali, Ramdev. The Hindu. Apr 24, 2024.
- Patanjali saga: Ayush ministry issues warning on misleading ads to traditional drugmakers. Business Today. Apr 27, 2024.
- From fruit juice to oats, soaps to bulbs, Indian Medical Association endorses products in exchange for huge money: Details. OpIndia. May 27, 2021.
- রায়, সুব্রত। ভারতীয় যোগের পশ্চিমায়ন। একুশ শতকের যুক্তিবাদী। বিশেষ সংখ্যা, ২০১৭: ৪-২২।
- রায়, সুব্রত। ইমিউনিটিতে ঠেলা মারে কীসে: করোনা ও রাষ্ট্রের আয়ুষ ‘দাওয়াই’। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। আগস্ট ১, ২০২০।
[1] উত্তরাখণ্ড সরকারের ধার্য করা ন্যূনতম মজুরি তখন ছিল মাসিক ১৭৪০ টাকা।
[2] কেবল রামদেবের জন্যই নয়, হরিদ্বারের যোগাশ্রম ও ফুডপার্কের জন্যও প্যারামিলিটারি নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে।
[3] রামদেব সরোষে এই স্বশাসিত সংস্থাকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে তোপ দেগেছিলেন।