Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাংলাদেশের চলমান কোটা-বিরোধী আন্দোলন

শরিফুস সালেকিন সাহান

 


জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া প্রত্যেকেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নতুন করে বানিয়ে ফায়দা লুটেছেন, হাসিনার সময়ে এসে সেটা আরও বেড়েছে, এখন আড়াই লাখের বেশি। জিয়া, এরশাদ বা খালেদা জিয়ার রাজত্বে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হত, ওই পরিচয় প্রকাশ হলে চাকরি জুটত না। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া হত সামান্য এবং সেখানেও চরম দুর্নীতি ছিল। হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ২০,০০০ টাকা ভাতা দিচ্ছেন, ঘর বানিয়ে দিচ্ছেন। এবং এখন মুক্তিযোদ্ধারা সগর্বে পরিচয় দেন। তবে, হাসিনার এক মন্ত্রীর বয়স ৫৯ এবং তিনিও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারী— সুতরাং তা ভুয়া। কিন্তু হাসিনা নীরব। এরকম অজস্র ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কারণে কোটায় অন্যের সন্তানকে চাকরি বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি একটা লজ্জার বিষয় হয়ে গেছে

 

১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সামান্য কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই রাষ্ট্রীয় তালিকায় নাম তোলেননি (আমার পিতা তাঁদের মধ্যে একজন)। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, চার নেতাকে হত্যা ইত্যাদির পর জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধকেই তাঁর প্রধান শ্ত্রু বানিয়ে কাজ শুরু করেন, রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে, নিষিদ্ধ রাজাকারদের দল গোলাম আজমের জামাত-ই-ইসলামিকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়ে, স্ংবিধানের বারোটা বাজিয়ে। সেই তখন থেকেই জামাত তথা রাজাকাররা ক্ষমতার ক্ষীর খেয়ে আসছে আর এখন তারা দেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর। ২০১১-তে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না আসতে পারলে জামাত-ই দেশের প্রধানতম অর্থনৈতিক শক্তি থাকত। শেখ হাসিনা প্রশাসনে থাকা জামাতিদের বহিষ্কার করতে পারেননি, তবে নতুন করে প্রবেশে যথাসম্ভব বাধা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামিপন্থীদের আনার চেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা আরোপ করেন। কিন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের বয়সও আর নেই। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের ৩০ শতাংশ কোটা দিতে চান। এই নিয়েই গোল বেধেছে। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ছিল ৬০-৬২,০০০ (অনেকেই নাম তোলেননি) জন। তারপর জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া প্রত্যেকেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নতুন করে বানিয়ে ফায়দা লুটেছেন, হাসিনার সময়ে এসে সেটা আরও বেড়েছে, এখন আড়াই লাখের বেশি। জিয়া, এরশাদ বা খালেদা জিয়ার রাজত্বে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হত, ওই পরিচয় প্রকাশ হলে চাকরি জুটত না। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া হত সামান্য এবং সেখানেও চরম দুর্নীতি ছিল। হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ২০,০০০ টাকা ভাতা দিচ্ছেন, ঘর বানিয়ে দিচ্ছেন। এবং এখন মুক্তিযোদ্ধারা সগর্বে পরিচয় দেন। তবে, হাসিনার এক মন্ত্রীর বয়স ৫৯ এবং তিনিও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারী— সুতরাং তা ভুয়া। কিন্তু হাসিনা নীরব। এরকম অজস্র ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কারণে কোটায় অন্যের সন্তানকে চাকরি বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি একটা লজ্জার বিষয় হয়ে গেছে। জামাত, বিএনপি এবং তাদের সাথী হেফাজত মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার ঘোর বিরোধী এবং তারা আওয়ামি লিগের নেতাদের চুরিচামারি, খাদ্যের অস্বাভাবিক দাম, ভারতকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া, গঙ্গা-তিস্তা ইত্যাদি সহ ৫৪ নদীর পানি, সীমান্তে হত্যা, ভারতে মুসলমান নির্যাতন ইত্যাদি নানা কারণে ক্ষুব্ধ। এরা দেশের সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে এই কোটা-বিরোধী আন্দোলনের পেছনে ব্যবহারের চেষ্টায় আছে।

সাধারণ মানুষ এখনও নীরব, কিন্তু ছাত্ররা আন্দোলনে জড়িয়েছে। কারণ কী? আওয়ামি লিগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলিগ। ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ-বিরোধী গণআন্দোলনে এদের গৌরবোজ্জ্বল ভুমিকা আছে। তবে এখন এদের ভেতরে শিবিরের (জামাতের ছাত্র সংগঠন) ছেলেরা ঢুকে নেতা বনে গেছে, খোদ আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ— কুখ্যাত রাজাকারের পুত্রকে সাংসদ বানিয়েছেন। শেখ হাসিনার কন্যা পুতুলের শ্বশুর একজন রাজাকার। এই অবস্থায় কোটা-বিরোধী আন্দোলন সহিংস হয়েছে কারণ যেসব শিবিরের ক্যাডার ছাত্রলিগে ছিল, তারা গণহারে পদত্যাগ করেছে। কাজেই আওয়ামি লিগ তার নেতাকর্মীদের জীবন-জীবিকা রক্ষায় সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করবেই— আওয়ামির পতন ঘটলে ৪৮ ঘন্টায় সমস্ত আওয়ামি নেতা, শাহবাগ আন্দোলনের নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে জামাত শিবির— এটা তাদের ঘোষিত ইশতেহার।

 

ভবিষ্যৎ কী?

গতকাল থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল কলেজ বন্ধ, ছাত্রদের হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গতকাল যে গোলাগুলির ভিডিও চারদিকে ছড়িয়েছে সেটা ওই হোস্টেল খালি করার সময়কার। প্রতিবাদে আজ গোটা দেশে কমপ্লিট শাট ডাউনের ডাক দিয়েছে। এখন অবধি সেই ডাকে সেরকম উত্তাল সাড়া নেই। গতকালও জামাত শিবির তাদের ট্রেডমার্ক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, একজন হতদরিদ্র মানুষ নিহত। অতীতের মতো এবারেও হয়তো বাসে-ট্রেনে আগুন, মানুষ পোড়ানো এসব করতে পারে, রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে ট্রেনগুলিকে দুর্ঘটনায় ফেলতে পারে।

তবে মূল সমস্যা শুধুই জামাত শিবিরের ধ্বংসযজ্ঞ নয়। আওয়ামি লিগ তথা হাসিনার এই ১৫ বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে, কম ঋণগ্রস্ত দেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগ্রস্ত দেশ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমছে। ধারণা করা হচ্ছে সেপ্টেম্বর নাগাদ আকু-র পেমেন্ট নিয়ে সমস্যা হতে পারে বা বিদেশি ঋণের কিস্তি দেওয়া না-ও হতে পারে। চিন থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছিল, চিন রাজি ছিল। কিন্ত তিস্তা প্রকল্প ভারতকে দেওয়াতে চিন সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়েছে। ব্যাঙ্কগুলি এমনভাবে লুটপাট হয়েছে যে মতিঝিলের ব্যাঙ্কপাড়ায় এখন শুধুই লুটের গল্প, নতুন বিনিয়োগ নেই। ভারত আমেরিকা জাপান এবং ইউরোপীয়দের চাপের পরেও শেখ হাসিনা চিন এবং পশ্চিমাদের মাঝে যে ভারসাম্য রক্ষার নীতি নিয়ে চলেছিলেন সেটি বাদ দিয়েছেন। যার প্রাথমিক প্রকাশ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রায় বিনা মাশুলে ভারতের রেল করিডর, তিস্তা প্রকল্প ভারতকেই দেওয়ার সিদ্ধান্ত, ভারত থেকে মিলিটারি হার্ডওয়ার কেনাকাটা ইত্যাদি। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে চিন আবারও বিএনপি, জামাত, হেফাজতকে সাহায্য করবে। ওদিকে ইইউ ও আমেরিকায় পোশাক রফতানি এবং মূল্য দ্রুত কমে যাচ্ছে। অনেক কারখানা বন্ধ হতে পারে। ফলে সেপ্টেম্বরের পর শুকনো মৌসুমে আর্থিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে। ভারত বা আমেরিকা অনেক বড় বড় আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ যেটা, সেই ৫-১০ বিলিয়ন ডলার দিতে পারবে না। আজকের ছাত্রদের এই আন্দোলন হচ্ছে সেপ্টেম্বরের আন্দোলনের প্রিকুয়েল।

আওয়ামি লিগ কি টিকবে? অতীতে শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় বড় বড় ধ্বংসাত্মক আন্দোলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কোভিড অতিমারি ইত্যাদি সামলেছে বাংলাদেশ। এবারেও হয়তো পারবে। তবে অতীতে শেখ হাসিনা দেশের মানুষের প্রচুর সমর্থন এবং শ্রদ্ধা পেয়েছেন— এবারে সেটি কম। আওয়ামি না থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কী হবে? এটি খুব জটিল প্রশ্ন। খোদ আওয়ামি লিগেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং পরিচিত নেতা নেই। বিএনপির অবস্থা তথৈবচ এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার, দুর্নীতির মামলায় তারেক জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত। জামাতের কোনও জনসমর্থন নেই। বামেদের অবস্থা শোচনীয়। হেফাজতের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। সম্ভবত হেফাজত ও বাম মিলিতভাবে কিছু পোস্টার বয়কে সামনে রেখে সেনাশাসন ফিরিয়ে আনবে। যদি তাই হয়, তবে সেটির স্থায়িত্ব কম হতে পারে। কারণ ভারতের অনুগত না হলে তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। অর্থনৈতিক এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা যেভাবে চিন ভারত রাশিয়া জাপান সবাইকে নিয়ে চলতে পেরেছেন, সেটি আর সম্ভব হবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে অস্থিরতা মানেই ভারতের সেভেন সিস্টারসে আগুন। কাজেই এমনও হতে পারে সেনাসমর্থিত শাসকদের ভারত খুবই সহযোগিতা করবে। সুতরাং আপাতত ছাত্রদের কোটা-বিরোধী আন্দোলনের ট্রেলার দেখতে থাকুন, কিছু মৃত্যু, আগুন, মাঝেসাঝে প্রতিবাদী গান, কবিতা, বক্তৃতা— এ সবই সুপারহিট সিনেমার ট্রেলারেরই অংশ!