সৌমিত্র দস্তিদার
গণতন্ত্রের যাবতীয় স্তম্ভ ও পরিকাঠামো এই ক-বছরে বাংলাদেশ থেকে মুছে গেছে। গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে যা হয় তা পুরোপুরি প্রহসন। ছ-মাস আগের শেষ নির্বাচনে ভোট পড়েছে খুব বেশি হলে ১৫ শতাংশ। ফলে দেশের জনগণের রায় শেখ হাসিনার পক্ষে না বিপক্ষে— তা ইতিমধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয়। বাকস্বাধীনতা বাংলাদেশে আছে এ কথা অতি বড় আওয়ামি লিগ সমর্থকরাও আর বলবেন না। তার ওপর আছে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি। দেশের সমস্ত বড় আর্থিক ঘোটালার পেছনে রয়েছে আওয়ামি লিগ। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে একদা রক্ষীবাহিনির জায়গা নিয়েছে আওয়ামি লিগের ছাত্র শাখা ছাত্র লিগ। জমিদস্যু ক্রমশ বাড়ছে। সবই হচ্ছে শাসক দলের মদতে। এটা তো ঠিক যে ছাত্রবিক্ষোভ এখন সামগ্রিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভের চেহারা নিয়েছে। স্লোগান উঠেছে, স্টেপ ডাউন হাসিনা। শেখ হাসিনাকে যাঁরা এখনও ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের মহান প্রতীক বলে মনে করেন, তাঁরা মোটেও ঠিকঠাক বাংলাদেশকে চেনেন না
মাঝেমধ্যেই লিখতাম, যখন বাংলাদেশে থাকি, তখন কলকাতার জন্য মন খারাপ লাগে। আবার কলকাতায় থাকলে ওপারের জন্য মন কেমন করে। কলকাতা তো আমার নিজের শহর। এখানে জন্মেছি। বড় হয়েছি। লেখাপড়া, ছবি করতে শেখা, সবই তো এই শহরে। ফলে কখনও-সখনও নিন্দেমন্দ করলেও এই শহরের ওপর আমার টান যাওয়ার নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো মাত্র কয়েক বছর ধরে। আট-ন বছর হবে। কিন্তু কেন জানি না ওই দেশটাকে কখন, কীভাবে যেন ভালবেসে ফেলেছি। ও দেশের গ্রাম, শহর, মফস্বলের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি শীত-গ্রীষ্ম, বর্ষার দিনে। তাই বাংলাদেশ যন্ত্রণা পেলে আমারও ভাল লাগে না। এখন এই রাতে বসে লিখতে লিখতে চোখ বন্ধ করলেই আমি যেন জানা অজানা নদীর ডাক শুনতে পাচ্ছি। নদী ডাকে, আয় আয়, নিশির ডাকের মতোই মোহগ্রস্ত হয়ে আমি ছুটে চলি।
আমার সেই প্রিয় বাংলাদেশের বুক থেকে এখন রক্ত ঝরছে। প্রথমেই বলি, ১৯৬৯, ১৯৭১, আর ২০২৪— এই তিনটে সাল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে বড় গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, বারবার দেশের শাসক বদলে বদলে গেছে, শোষণ বদলায়নি। আয়ুব, ইয়াহিয়া এবং আজকের শাসকদের তফাত বুঝতে কষ্ট হয়। ঊনসত্তরের গণঅভুত্থানে শহিদ আসাদুজ্জামান আর এই জুলাই মাসের বর্ষার দুপুরে পুলিশের গুলিতে শহিদ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদির আর্তনাদ এক হয়ে কানে বাজে।
এই লেখা যখন লিখছি, তার কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালু করা হয়েছে, তাও পূর্ণশক্তিতে নয়। কেউ কেউ দেখলাম লিখেছেন, শান্তি ফিরছে দেশে। শান্ত হয়ে আসছে চতুর্দিক। এর চেয়ে আনন্দের খবর তো কিছু হয় না। কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন ব্যথা করছে। গত কয়েকদিন ধরে কয়েক-শো প্রাণ যে চলে গেল, ভেসে গেল কত পরিবার। তার কী হবে!! সে ক্ষতি ও সে ক্ষত পূরণ করবে কে!
বিদেশের নানা জায়গা থেকে পাওয়া কত কত ছবি, ভিডিও দেখতে দেখতে অবশ লাগছে। এই কি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ছবি! শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন। সেই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেই শেখ হাসিনার সরকার তা দমন করতে যে পন্থা অবলম্বন করলেন তা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে রয়ে যাবে। হতে পারে এ যাত্রায় পার পেয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ভারতের জনগণের একাংশের ফেসবুক পোস্টে যাই লেখা হোক না কেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের দেশের জনগণের চোখে সারা জীবনের মতো খলনায়ক হয়েই রয়ে যাবেন। একটা ছাত্র আন্দোলন দমন করতে যেভাবে মিলিটারি নামিয়ে, রাস্তায় ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া বাহিনি দিয়ে নিরীহ জনগণকে সন্ত্রস্ত করে রাখা হল, রাষ্ট্রীয় হত্যালীলা চলল দেশের সর্বত্র, এবং শেষমেশ কার্ফু জারি করে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে সারা দুনিয়ার থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করতে হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারকে, তা আর যাই হোক, সুষ্ঠু শাসনের লক্ষ্মণ নয়।
এবারের আন্দোলন অনেক মুখোশধারী প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের পুরোপুরি বেআব্রু করে দিল। প্রশ্ন তুলে দিল বাংলাদেশের বামেদের ভূমিকা নিয়েও। যেমন ঢাকায় মিলিটারি বা ট্যাঙ্ক নামানোর সরকারি সিদ্ধান্তের পিছনে মূল পরামর্শদাতা শুনলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন। মওলানা ভাসানির একদা-ঘনিষ্ঠ রাশেদ খান মেনন; সেই মেননভাই, ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কুশীলব; সেই মেননভাই, যিনি রাজপথে একদা স্লোগান তুলতেন, জাতির পিতা মওলানা ভাসানি; সেই রাশেদ খান মেনন, যিনি একদিন আওয়াজ তুলেছিলেন গোলটেবিল না রাজপথ…। সেই তিনিই আজ নতুন প্রজন্মের অধিকাংশের কাছেই সরকারের পয়সায় হজে যাওয়া হাজি মেনন মাত্র। পুরনো মেনন কবে কীভাবে বিক্রি হয়ে গেলেন কে জানে!! সাগিনা মাহাতো তো শুধু সিনেমার পর্দায় জন্মায় না।
অথচ সেই পুরনো রাশেদ খান মেনন থাকলে আজ বলতেই পারতেন যে আপাতত শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে অন্তর্বর্তীকালীন এক সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। বিরোধী দল তাতে সাড়া না দিলে অন্য বিকল্পের কথা ভাবা যেত। এই কদিন ধরে সমানে বিভিন্ন মিডিয়ায় ঠারেঠোরে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে হাসিনা চলে গেলে বিএনপি, জামাত চলে আসবে। পশ্চিমবঙ্গের সিপিআইএম মোটের ওপর এই ন্যারেটিভের কট্টর সমর্থক। মাটির সঙ্গে কিছুমাত্র সম্পর্ক না থাকলে যা হয় আর কি। যে আওয়ামি লিগের মধ্যে তারা গণতন্ত্রের খোঁজ করে গদগদ বন্দনায় সতত ব্যস্ত থাকেন, তাদের জানা উচিত যে শুধু শেখ হাসিনা নন, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গড়ে তোলা রক্ষীবাহিনির বড় কাজ ছিল সারা দেশে বাম কর্মী-সমর্থকদের মারা। শেখসাহেব নিজে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সবচেয়ে ঘৃণ্য রাজাকার আলবদরদের মাফ করে দিয়ে মহান হয়েছিলেন। তাঁর এই কাজের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ ও কিছু আওয়ামি লিগ নেতারাও। তাঁদের কাছে মনে হয়েছিল গোলাম আজমের মতো লোককে মাফ করা দেশের মানুষের সঙ্গে অন্যায় করা। কিন্তু সে সময় রাজাকারদের মাফ করা হল। পাশাপাশি ওই একই সময় বামশক্তিকে খতম করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করল আওয়ামি লিগ সরকার। বলা হল নকশাল দেখামাত্র গুলি করো। এই স্বৈরতান্ত্রিক আদেশের বিরোধিতা করে ছিলেন একমাত্র মওলানা ভাসানি। আজকের শেখ হাসিনার রাজনীতি বুঝতে গেলে পুরনো ইতিহাসকে আরেকবার সামনে আনতে হবে। সরকারি নীতি ও কাজের বিরোধিতা করলেই কথায় কথায় শেখ হাসিনা যেভাবে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত রাজাকার, জামাতি বলে চিহ্নিত করেন, তা অমার্জনীয়। তুলনীয় যে ঠিক এইভাবেই আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরুদ্ধমতাবলম্বীদের মধ্যে টুকরে টুকরে গ্যাং, আন্দোলনজীবী বা আরবান নকশালের ভূত দেখেন। অথচ বেশিদিন আগের কথা নয়, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও আওয়ামি লিগের সঙ্গে জামাতের জোট ছিল। তাহলে ৯৬-এর জামাত আর ২০২৪-এর জামাত কি আলাদা হয়ে গেছে! তারও আগে জামাত নেতা গোলাম আজমের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকের ছবি তো এখনও পুরনো খবরের কাগজের পাতা ঘাঁটলে যে কেউই দেখে নিতে পারেন।
গণতন্ত্রের যাবতীয় স্তম্ভ ও পরিকাঠামো এই ক-বছরে বাংলাদেশ থেকে মুছে গেছে। গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন হয় না। নির্বাচনের নামে যা হয় তা পুরোপুরি প্রহসন। ছ-মাস আগের শেষ নির্বাচনে ভোট পড়েছে খুব বেশি হলে ১৫ শতাংশ। ফলে দেশের জনগণের রায় শেখ হাসিনার পক্ষে না বিপক্ষে— তা ইতিমধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয়। বাকস্বাধীনতা বাংলাদেশে আছে এ কথা অতি বড় আওয়ামি লিগ সমর্থকরাও আর বলবেন না। তার ওপর আছে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি। দেশের সমস্ত বড় আর্থিক ঘোটালার পেছনে রয়েছে আওয়ামি লিগ। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। শিল্প বলতে মূলত গার্মেন্টস, যার বাজার আর আগের মতো নেই। সেখানেও শ্রমিকশোষণ ভয়ঙ্কর। শিল্প-নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। রানা প্লাজা ও একাধিক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের প্রাণহানি নিত্যদিনের ঘটনা। সরকারের আয়ের বড় উৎস রেমিটেন্স। ঋণ করে পরিকাঠামোর চাকচিক্য নিঃসন্দেহে বেড়েছে। কিন্তু ঋণ শোধ হবে কীভাবে তার কোনও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে একদা রক্ষীবাহিনির জায়গা নিয়েছে আওয়ামি লিগের ছাত্র শাখা ছাত্র লিগ। জমিদস্যু ক্রমশ বাড়ছে। সবই হচ্ছে শাসক দলের মদতে। একাধিক জনবিরোধী ইস্যু অথচ বামশক্তি ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে। গণতন্ত্রের পরিসর না থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বৈরতন্ত্র সে জায়গা নেবে। পাশাপাশি দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটবে। ফলে তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, এবারের ছাত্র আন্দোলনের রাশ জামাত, বিএনপির হাতে চলে গেছিল বলেই হাসিনা সরকারকে রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামিয়ে বিদ্রোহীদের দমনের নামে নিরীহ ছাত্রদের মারতে হল, সেখানেও প্রশ্ন উঠবে তাহলে জনতার বড় অংশটাই কি হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে দলে দলে জামাতের দিকে ঢলে পড়ল? এটা তো ঠিক যে ছাত্রবিক্ষোভ এখন সামগ্রিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভের চেহারা নিয়েছে। স্লোগান উঠেছে, স্টেপ ডাউন হাসিনা। তার প্রেক্ষিত তো আর একদিনে জন্ম নেয়নি। গুমখুন, ক্রসফায়ার, বিরোধী হলেই তাকে জেলে পোরা, দিনের পর দিন একের পর এক অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের ফলে বীতশ্রদ্ধ সাধারণ জনতার ক্ষোভ কোটা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ফেটে পড়েছে। শেখ হাসিনাকে যাঁরা এখনও ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের মহান প্রতীক বলে মনে করেন, তাঁরা মোটেও ঠিকঠাক বাংলাদেশকে চেনেন না।
আর বাংলাদেশকে ঠিকঠাক চেনেন না বলেই সুপ্রিম কোর্টের কোটা সংরক্ষণের প্রসঙ্গে রায় শুনে উল্লসিত হচ্ছেন। অনেক বামপন্থী বন্ধুরাও বলছেন, যে কোর্ট বলে দিয়েছে যা বলার তারপর আর আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই। তেলেঙ্গানা, তেভাগা, নকশালবাড়ি— আমাদের দেশের প্রতিটি আন্দোলন থেকে পিছু হটতে গিয়ে যে ধরনের ছলছুতোর আশ্রয় নিয়ে সংসদীয় বামেরা গণসংগ্রাম থেকে রিট্রিট করেছে, এই বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাদের চিন্তাভাবনা একই। সুপ্রিম কোর্ট নারী বা আদিবাসী কোটা বাতিল করল কেন, কোন যুক্তিতে, এসব অপ্রাসঙ্গিক কথাতেই যাব না। কারণ কাগজেকলমে আদালতের স্বশাসন থাকলেও বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা অলীক কল্পনা মাত্র। এই রায় ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাকওয়ার্ড-এর মতোই পুরো সরকারের পরিকল্পনামাফিক। কোর্ট এই রায়ের ক্ষেত্রেও সরকার নিয়োজিত পুতুলের মতো কাজ করেছে। তার প্রমাণ রায়টি নিজেই। আদালতের রায় ভাল করে পড়লেই দেখা যাবে একদম শেষে বলা আছে, পরে যে-কোনও সময় সরকার যাবতীয় কোটা সংস্কারের রায় পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। অর্থাৎ সরকার আপাতত ব্যাপারটা ধামাচাপা দিলেন বটে, তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা আবার এই কোটার কুমিরকে ঝোলা থেকে বার করতে পারেন, ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন। এতগুলি যুবকের মৃত্যুর পরেও তাঁদের সদিচ্ছা জাগ্রত হল না। আমরা, যারা বাংলাদেশে থাকি না, কিন্তু দেশটিকে ভালবাসি, তারাও দমবন্ধ করে উদ্বিগ্ন হয়ে রইলাম আবার পরিস্থিতি কখন অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
*মতামত ব্যক্তিগত