Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এক মতাদর্শগত বিশ্বাসের উজ্জ্বল শিখা

নন্দন রায়

 


বারামুল্লা লোকসভা আসনটি যে রশিদ জিতে নিয়েছেন, এটা মোটেই বড় কিছু ঘটনা নয়, বড় ঘটনা হল যেভাবে ও যাদেরকে হারিয়ে তিনি জয়লাভ করেছেন। তিনি কেবলমাত্র এক রুদ্ধ আবেগের অর্গলমুখ খুলে দেওয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন না, কাশ্মিরের জনসমষ্টির বৃহদংশের মনোভাবেরও প্রতিনিধিত্ব করেন— বলাবাহুল্য, সেই মনোভাব গভীরভাবে এবং মৌলিকভাবে ভারতরাষ্ট্র-বিরোধী। বিজেপির শত ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও এ কথা কাশ্মিরের কোলের শিশুটিও জানে যে ২০১৯-এর ৫ আগস্টের আগের থেকে এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ এবং তা এতটাই যে গোটা কাশ্মিরের একটি আসনেও বিজেপি প্রার্থী দিতে ভয় পেয়েছে

 

রশিদ খান নামের এক ভূতের প্রচ্ছায়া গোটা কাশ্মির উপত্যকাকে আবৃত করে ফেলেছে। কিন্তু এই প্রচ্ছায়া কোনও হিংস্র রক্তপাতময় মৃত্যুমিছিলের পুনরাবির্ভাবের কারণে নয় যে, মানুষকে আবার কার্ফু ও কাঁটাতারের বেড়ায় ঘরবন্দি করে মিলিটারি বুটের ত্রস্ত পদচারণা এবং অটোমেটিক রাইফেলের মুহুর্মুহু অগ্নিবর্ষণের মধ্যে আতঙ্কিত প্রহর কাটাতে হবে। এ এক উজ্জ্বল বিশ্বাসের জায়মান প্রহর যখন আব্দুল রশিদ শেখ, যিনি অধিক পরিচিত ইঞ্জিনিয়ার রশিদ নামে, যিনি উত্তর কাশ্মিরের বারামুল্লা লোকসভা কেন্দ্র থেকে একজন নির্দল প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করে সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এটা কোনও চিন্তার ব্যাপার নয় যে তিনি জেলে বসেই নির্বাচিত হয়েছেন। এটাও কোনও চিন্তার ব্যাপার নয় যে এখন তিনি ইউএপিএ আইনে তিহার জেলে বন্দি এবং বাঘে ছুঁলে যেমন আঠেরো ঘা, তেমনই, ইউএপিএ-তে একবার গ্রেফতার হলে জামিন পাওয়া ব্যতিক্রম। যেমন উমর খালিদের জেলবাস পাঁচ বছর হয়ে গেল। ইঞ্জিনিয়ার রশিদ সম্ভবত পাঁচ-ছ বছরের বেশিই বন্দি। রশিদের নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা খুবই আশ্চর্য ঘটনা, কারণ আগে নির্দল প্রার্থী কিছু জয়ী হতেন, এখন তা অতি বিরল। এবারের নির্বাচনে মাত্র আর একজনই নির্দল হিসেবে হয়েছেন— ভীম আর্মির প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রশেখর আজাদ। তবে রশিদের সঙ্গে আর কারও তুলনাই চলে না। এক তো জেলে বন্দি থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তিনি আক্ষরিক অর্থেই কপর্দকহীন। কীভাবে যে মনোনয়নের টাকা তিনি জোগাড় করেছেন তা জানেন তিনি আর ঈশ্বর। প্রচার যা হয়েছে তা লোকের মুখে মুখে, তা-ও শুধু এই খবরটুকু যে ‘আমাদের’ ইঞ্জিনিয়ার রশিদ বারামুল্লা থেকে ক্যান্ডিডেট হয়েছেন। শুধুএইটুকু খবর বোবা কাশ্মিরের অন্তরে অন্তরে এক ভিন্নতর আদর্শের মশাল জ্বালিয়ে দিল। বারামুল্লা সযতনে গোপনে নিজের হৃদয়ে তাকে স্থাপিত করল। কোনও জলুস বেরোল না, কোনও স্লোগান উচ্চারিত হল না, শুধু মনের গোপনে জ্বলে উঠল এক অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি, যে অভ্যুত্থানে কার্বাইন গর্জে ওঠে না, যে অভ্যুত্থান সঙ্ঘটিত হয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে, নির্বাচনী ব্যবস্থার ফল্ট লাইনকে আশ্রয় করে। যে আবেগ ও বিশ্বাসকে এই অভ্যুত্থান আশ্রয় করে সঙ্ঘটিত হয়েছে সেই আদর্শকে কয়েদ করা যায় না।

বারামুল্লা লোকসভা আসনটি যে রশিদ জিতে নিয়েছেন, এটা মোটেই বড় কিছু ঘটনা নয়, বড় ঘটনা হল যেভাবে ও যাদেরকে হারিয়ে তিনি জয়লাভ করেছেন। সংসদে যাওয়ার পথে তিনি হারিয়েছেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যিনি আগামী সম্ভাব্য নির্বাচনের পরে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আশা পোষণ করেন সেই ওমর আবদুল্লাকে এবং রশিদের প্রাক্তন রাজনৈতিক গুরু ও পিপলস কনফারেন্সের নেতা সাজ্জাদ গণি লোনকে— প্রথমজনকে দু-লক্ষ ভোটে এবং দ্বিতীয়জনকে তিন লক্ষ ভোটে। মেহবুবা মুফতির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী তো ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। রশিদের এই বিজয়ের নির্গলিতার্থ বুঝতে আঞ্চলিক দলগুলি নিশ্চয়ই ভুল করেনি। যদিও তাদের নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন না, তবু যৎকিঞ্চিৎ যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে আঞ্চলিক দলগুলির নেতৃত্বের শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে এই কথা ভেবে যে আসন্ন সম্ভাব্য বিধানসভা ভোটে রশিদের বিজয়ের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

ইঞ্জিনিয়ার রশিদ কেবলমাত্র এক রুদ্ধ আবেগের অর্গলমুখ খুলে দেওয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন না, কাশ্মিরের জনসমষ্টির বৃহদংশের মনোভাবেরও প্রতিনিধিত্ব করেন— বলাবাহুল্য, সেই মনোভাব গভীরভাবে এবং মৌলিকভাবে ভারতরাষ্ট্র-বিরোধী। বিজেপির শত ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও এ কথা কাশ্মিরের কোলের শিশুটিও জানে যে ২০১৯-এর ৫ আগস্টের আগের থেকে এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ এবং তা এতটাই যে গোটা কাশ্মিরের একটি আসনেও বিজেপি প্রার্থী দিতে ভয় পেয়েছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে কাশ্মিরে বিপুল হারে ভোট পড়ায় মোদি-শাহ বুক বাজিয়ে বলে বেড়াচ্ছিলেন যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কারণেই কাশ্মিরে শান্তি ফিরে এসেছে— সেটা যে কত বড় মিথ্যা সে-কথা মোদি-শাহের চেয়ে বেশি ভাল আর কেঊ জানেন না। শুধু বারামুল্লা নয়, গোটা কাশ্মিরে বিপুল হারে ভোট পড়ার কারণ হল মর্যাদা হারানো, আত্মসম্মান হারানো, অত্যাচারিত কাশ্মিরের সেই ফুটন্ত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ যা অনুক্ত কন্ঠে ইঞ্জিনিয়ার রশিদের স্লোগানের অনুরণন তোলে, ‘জেল কা বদলা ভোট সে লেঙ্গে’।

খুব সংক্ষেপে বললে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাস অনুসরণ করলে দেখা যায় যে যদিও ভারতের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্তিকরণ চুক্তির পর থেকে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই রাজ্যের বিশেষ মর্যাদার বিষয়টিকে ভারত সরকার মেনে চলছিল, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে গত শতকের সত্তর-এর দশকের পর থেকে (যখন থেকে হিন্দুত্ববাদীরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং জাতীয় কংগ্রেসের দেশজোড়া প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করেছিল) এই ‘বিশেষ মর্যাদার’ অন্তর্গত বিষয়গুলি নিয়ে দিল্লির সরকার অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করতে শুরু করে। এর সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হিসেবে যোগ হয় পাল্টা অসহিষ্ণুতার প্রকাশ, সীমান্তপারের উস্কানি। সবমিলিয়ে ৩৭০ অনুচ্ছেদ আরও লঘু করা হল, সন্ত্রাসবাদের জন্ম হল, অবশেষে নব্বই-এর দশকে ফেটে পড়ল ব্যাপক সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাস দমনের জন্য পুলিশ ও সামরিক বাহিনির বেলাগাম পীড়ন এবং অত্যাচার। ইঞ্জিনিয়ার রশিদ সেই সময়কার দিনলিপি বিভিন্ন উর্দু পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে লিখে রেখেছেন। হিন্দুত্ববাদীরা প্রথম দিন থেকেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পক্ষে সওয়াল করে এসেছে। তারা যেমন একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে, অন্যদিকে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের বিচিত্রতা এবং সূক্ষ্মতা বোঝার প্রশ্নে পণ্ডিত নেহরুর মতো জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি তাদের ছিল না এবং তা আয়ত্ত করার চেষ্টাও তারা করেনি। এটা তাদের রাজনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির দীনতা। ফলে দিল্লির ক্ষমতায় এসে তারা যে ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলোপ এবং কাশ্মিরিদের আরও অপমান করতে রাজ্যটিকে দুটি ইউনিয়ন টেরিটরিতে বিভক্ত করে দেবে এতে আশ্চর্য হওয়ার খুব বেশি কিছু নেই। কেবলমাত্র কংগ্রেস, ডিএমকে ও বামপন্থীরা, যারা ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্বের সন্ধান করে, এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। এছাড়া এনডিএর শরিক হওয়া সত্ত্বেও জেডিইউ বিরোধিতা করেছিল কিন্তু জোট ত্যাগ করেনি, আপ, তেলেগু দেশম ও মায়াবতীর বিএসপি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, তৃণমূল ও শরদ পওয়ারের এনসিপি কক্ষত্যাগ করেছিল। ভারতের সংবিধানে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট দিনটি কালিমালিপ্ত থেকে যাবে।

সম্ভবত, গত শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই রশিদ কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি থেকে নিজের দুরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছিলেন, আবার আঞ্চলিক মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলির মতের সঙ্গেও তাঁর মত মিলছিল না। তাই তিনি নির্দলই থেকে গেলেন, কিন্তু কখনওই রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে নয়। নির্দল হিসেবেই তিনি নিজের জন্মস্থান বারামুল্লার ল্যাঙ্গেট বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে জয়লাভ করে বিধানসভার সদস্য ছিলেন ২০০৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত যতদিন না মোদির সরকার বিধানসভা ভেঙে দিয়ে কাশ্মিরে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করে এবং রশিদকে কারারুদ্ধ করে। রশিদ একটি কথা স্থির জানেন যা-ই ঘটে যাক, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হারানো চলবে না। এই বিশ্বাসই এবারে বারামুল্লা কেন্দ্র থেকে তাঁকে জয় এনে দিয়েছে। এবারে কাশ্মির জুড়ে যে বিপুল পরিমাণে ভোট পড়েছে এবং ইঞ্জিনিয়ার রশিদের মতো নির্দল প্রার্থীর বিপুল জয় এনে দিয়েছে, তাতে নতুন একটি রাজনৈতিক সম্ভাবনা কাশ্মিরের মাটিতে সম্ভবত জায়মান হয়ে উঠছে।

কবে থেকে কাশ্মির জনমনে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের কথা বলার এই তাগিদ জাগরুক হয়ে উঠেছে, সে কথা কাশ্মিরের মানুষই জানেন। যখন থেকে ছররার পেলেটে শত কিশোর-কিশোরী চিরতরে পঙ্গু অথবা অন্ধ হয়ে গিয়েছে, অথবা যখন থেকে ব্লেডযুক্ত কাঁটাতারের বেড়ায় মহল্লার পর মহল্লা দিনের পর দিন অবরুদ্ধ থেকেছে, অথবা যখন থেকে মধ্যরাতে বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে স্ত্রী-পুরুষ-বালক-বালিকা নির্বিশেষে সকলকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বরফ জমা রাস্তার দুপাশ দিয়ে লাইন করে মাইলের পর মাইল খালি পায়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়েছে যাতে রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাওয়া সেনা কনভয়ের গাড়িগুলি জঙ্গিদের চোরাগোপ্তা আক্রমণের বিরুদ্ধে এই মানব-ঢালের আড়ালে থাকতে পারে, সম্ভবত সেই সব কালরাত্রির সময় থেকেই প্রতিরোধের এই নতুন উপলব্ধি কাশ্মিরিদের চেতনায় কল্লোল তুলেছে।

দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষরা রাহুল গান্ধির বিস্ময়কর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার শেষ লগ্নে তুষারপাতের মধ্যে অচঞ্চল বিপুল সমাবেশে শতসহস্র কাশ্মিরির নীরব যোগদানের মধ্যে এর অনুরণন খুঁজে পেয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলি বারে বারে কাশ্মিরের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছে। কিন্তু মোদির সরকার গত দশ বছর ধরে যেভাবে কাশ্মিরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়েছে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য বহিরাগতদের কাশ্মিরে বসতি স্থাপন করার উৎসাহ দিয়ে, তার তুলনা একমাত্র ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন-ভূমিতে অনুরূপ আচরণ।

সুপ্রিম কোর্টের তাড়নায় সেপ্টেম্বরে হয়তো নির্বাচন হবে, কিন্তু তা হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের গুরুত্বহীন নির্বাচন। রাজ্যের মর্যাদা ফেরত পাওয়া এখনও বিশ-বাঁও জলে। উলটে জম্মু-কাশ্মির ও লাদাখ অঞ্চলের লেফটেনান্ট জেনারেলের ক্ষমতা যেভাবে বাড়ানো হয়েছে তার ফলে নতুন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়রের চেয়েও কম ক্ষমতা থাকবে।

মূল ভূখণ্ডের ভারতীয়দের দুটি কর্তব্য রয়েছে— এক, বিশেষ মর্যাদা পুনরুদ্ধারে কাশ্মিরের মানুষের পাশে সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করা, এবং দুই, কাশ্মিরের আপামর মানুষকে সৌভ্রাতৃত্বের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করা।


*দি টেলিগ্রাফ পত্রিকার ২৫ জুলাই সংখ্যায় সঙ্কর্ষণ ঠাকুরের উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধ এই লেখার অনুপ্রেরণা। এই লেখার রাজনৈতিক ও অন্যান্য বক্তব্য বর্তমান লেখকের নিজস্ব।