অনির্বাণ সরকার
ফুটবলের বধ্যভূমি এ পোড়া দেশে একজন ফুটবলপ্রেমী হিসেবে গর্বিত হওয়ার দিন বড় একটা আসে না। আর ওদিকে কলকাতা কল্লোলিনী থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা নিজের মেয়েকে নিয়ে যখন প্রায়শই ঘিরে ধরে অজানা আশঙ্কা, যখন বাইরে চলে যাওয়া বন্ধু-আত্মীয়দের কাছে নিত্যদিন শুনতে হয় এই শহরটার আর রাজ্যের গঞ্জনার কথা, ঠিক তখনই 'তিলোত্তমা'র মর্মান্তিক মৃত্যু ঘিরে তৈরি হওয়া প্রতিবাদের ঢেউ আর সেই ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া ফুটবলমাঠের প্রতিবাদ একদিনের জন্য হলেও বের করে আনে আনন্দাশ্রু। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে— হ্যাঁ, আমাদের অনেক কিছু নেই, কিন্তু আজও একটা ফুটবল ময়দান আছে। ফুটবলই তো জীবন। খেলাই তো পারে দুঃখের মধ্যেও এক টুকরো আনন্দ দিতে, দূরের মানুষকে কাছে টেনে নিতে। ১৮-র দুপুর থেকে রাত দেখেছে সেই দৃশ্য। এবার মাঠটাকে আরও বড় করে খেলার দিন সমাগত
আগের দশকের মাঝামাঝি সময়। কোভিড নামক কোনও শব্দের সঙ্গে বিশ্ববাসীর তখনও পরিচিতি ঘটেনি। বার্সেলোনার ঘরের মাঠ ক্যাম্প ন্যু-তে বসেছে এক ফ্রেন্ডলি ম্যাচের আসর। খেলায় অংশগ্রহণ করেছে বার্সেলোনার প্রাক্তনীরা। ম্যাচশেষে সাজঘরে ফিরে একদা বার্সেলোনার ফুটবলার এবং অন্যতম সফল কোচ পেপ গার্দিওলা আবিষ্কার করেন সেদিন মাঠে তাঁর সতীর্থ মাঝমাঠের অন্যতম প্রধান ফুটবলার আর্জেন্টিনার হুয়ান রোমান রিকেলমের পরনে বোকা জুনিয়র্স ক্লাবের জার্সি, যেটা বার্সেলোনা জার্সির নিচে পরেই মাঠে নেমেছিলেন রিকেলমে। পেপ গার্দিওলা প্রশ্ন করেছিল, “বার্সেলোনা জার্সির নিচে বোকা জুনিয়র্স-এর জার্সি পরে খেলতে কোনও কষ্ট হল না?” জবাবে রিকেলমে বলেছিলেন, “বোকা ইজ দ্য রিলিজিয়ন ফর মি।” বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন পেপ গার্দিওলা।
কাট টু ২০২৩। কোপা লিবের্তোদোরেসের ফাইনালে মুখোমুখি আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স আর ব্রাজিলের ফ্লুমিনেসে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির সাজঘরে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরল দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমীদের চোখে দুই শ্রেষ্ঠ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার দুই ফুটবলার এডেরসন এবং হুলিয়ান আলভারেজকে। উপলক্ষ্য, কোপা লিব ফাইনালে নিজেদের দেশের ক্লাবের জয় সম্পর্কে কে কতটা প্রত্যয়ী সেটা জানার চেষ্টা করা। সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে আলভারেজ বলেছিলেন, “দেশের ক্লাব হলেও এক রিভারপ্লেটের প্রাক্তনী হিসেবে কখনওই বোকা জুনিয়র্সের জয় চাইতে পারব না।”
ওপরের ঘটনা দুটোর উল্লেখ করার কারণ হল যে, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা কাকে বলে সেটার অবতারণা করা। ফুটবলবিশ্বের সবচেয়ে উত্তেজক এবং রক্তক্ষয়ী ডার্বি বলা হয় আর্জেন্টিনার এই রিভার-বোকার ডার্বিকে। নিজের দেশের খেলাতেও তাদের সমর্থকরা অনেকেই দেশের জার্সির সঙ্গে স্ব স্ব ক্লাবের জার্সি পরে খেলা দেখতে যায়। বিশ্বকাপ জেতার পরও যে যার নিজের ক্লাবের প্রাক্তনীদের সংবর্ধনা দেয়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের প্রাক্তনীদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
এহেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের সমর্থকরাও একদিনের জন্য হলেও মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সেই অসাধ্যসাধন হয়েছিল শুধুমাত্র একজন মানুষের জন্য। তিনি আর্জেন্টিনা ফুটবলের ঈশ্বর, বিশ্বের কোটি কোটি লা আলবিসেলেস্তে সমর্থকদের হৃদয়সম্রাট দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। কোভিড-কন্টকিত বিশবিশের (২০২০) বিষাক্ততম ২৫ নভেম্বর যখন দিয়েগোর জীবনের ট্রেনটা পৃথিবীর শেষ স্টেশন পেরিয়ে দিকশূন্যপুরে বিলীন হয়ে গেল ঠিক তার পরের দিন হার্ডিন বেসা ভিস্তার কবরে শায়িত দিয়েগো মারাদোনার কবরের সামনে দুই দলের জার্সি গায়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন বোকা জুনিয়র্স এবং রিভারপ্লেটের দুই সমর্থক, এই দৃশ্য মুহূর্তের মধ্যে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমী মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের আপামর ফুটবলপ্রেমী মানুষজনও ভেবেছিল সেটাই বোধহয় বিশ্বের ক্লাব ফুটবলের শেষ এবং শ্রেষ্ঠতম বিস্ময়কর বিজ্ঞাপন।
কিন্তু পিকচার তখনও বাকি ছিল দোস্ত।
আরজিকর হসপিটালে কর্মরত অবস্থায় ধর্ষিতা এবং মৃতা তরুণী চিকিৎসক কোন দলের সমর্থক ছিলেন? মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল?? ফুটবলের সঙ্গে আদৌ কোনও সম্পর্ক ছিল কি তার? এ-কথা তার কাছের মানুষজন ছাড়া আর কেউ জানবে না। আর ভবিষ্যতেও বোধহয় সেসব জানার তেমন কোনও উপায় নেই। দিয়েগো মারাদোনা তো ফুটবলবিশ্বের অন্যতম সেরা চরিত্র ছিলেন। নন্দিত আবার নিন্দিতও। গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোলদাতার রাজমুকুট উঠেছিল তার মাথাতেই। কিন্তু আরজিকরের তরুণী চিকিৎসকের সঙ্গে তো ফুটবল মাঠের দূরদূরান্তেরও কোনও সংযোগ ছিল না। তবুও কেন তার জন্য এমন আকুল হয়ে উঠল কলকাতা ফুটবলমহল। কেন চিরবৈরিতা ভুলে এক হয়ে মিশে গেল শতাব্দীপ্রাচীন দুই ক্লাবের সমর্থকরা। শুধু একটা ডার্বি বাতিল হয়েছে বলে? উঁহু, তা তো নয়। কারণ, ম্যাচের আগেই কানাঘুষো ছিল যে ডার্বির যুবভারতীতে দুই দলের সমর্থকরাই নিজ নিজ গ্যালারিতে নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ জানাবে ধর্ষিতা এবং মৃতা তরুণী চিকিৎসকের ন্যায়বিচারের দাবিতে। যেটা আন্দাজ করেই পুলিশ ও প্রশাসন ডার্বি বাতিল করে।
কিন্তু খেলা ঘোরে সেখান থেকেই। যেমন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী এবং বর্তমানে গবেষণারতা রিমঝিম সিংহের সমাজমাধ্যমে এক আবেদনের ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে রাত জাগে গোটা শহর, গ্রাম, দেশ এমনকি বিদেশ পর্যন্ত। তেমনই, বাতিল ডার্বির খবর আসতেই সেই প্রেক্ষাপটেই সাধারণ মোহন-ইস্ট সমর্থকদের মধ্যে থেকেই দাবি ওঠে— “ডার্বি বাতিল করবি কর/জাস্টিস ফর আরজিকর” অথবা “ঘটি বাঙাল এক স্বর/জাস্টিস ফর আরজিকর”।
আসলে একেই বোধহয় বলে গণজাগরণ। কোনও রাজনৈতিক দল যার সুর বেঁধে দেয় না। সুর উঠে আসে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে। ক্ষমতার মদমত্ততায় শাসকের রাষ্ট্রযন্ত্র সেই জাগরণের অভিঘাত বুঝতে দেরি করে ফেলে। তা না হলে, ভিন্ন ধর্মে বিয়ে নিয়ে ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট, মনকষাকষি থেকে আত্মহত্যা এমনকি খুনও তো কতই ঘটে, কিন্তু রিজওয়ানুর হয় ক-জন? তেমনই এক প্রেক্ষাপট আবারও এসে ধরা দিয়েছে সিটি অফ জয় থেকে সিটি অফ ভয়-এ পরিণত হওয়া শহরে। আর সেই প্রেক্ষাপটেই কবিতা হয়ে ফিরে ফিরে আসে সেই চিরকালীন শব্দব্রহ্ম— “বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা”।
১৪ আগস্ট রাত জেগে রাজপথের দখল নিয়েছিল উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত-সহ সমাজের সমস্ত অংশের মানুষরা। আর ১৮ আগস্ট দুপুর থেকেই যুবভারতীতে স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকার আশপাশ ভেসে গিয়েছিল মোহন-ইস্ট নির্বিশেষে আপামর ফুটবলপ্রেমী জনতার জনস্রোতে। মোহনবাগান পতাকা হাতে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এবং ঠিক তার উল্টোটা অথবা মোহনবাগান সমর্থকের কাঁধে চড়ে স্লোগান দিচ্ছে ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক— এ দৃশ্য চোখ কচলে দেখতে দেখতেই সে ছবি সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে বিশ্বজনীন। ডার্বি খেলতে দিলে হয়তো আদৌ এতটা প্রতিবাদ দেখাবার সুযোগ পেত না এই জনতা। কিন্তু ওই যে বলে না, ক্ষমতার দম্ভে রাজা (এক্ষেত্রে রানি) যখন কানে দেখে তখন তার বিচারবুদ্ধিতে পদে পদে ভুল হয়ে যায়। আর তাই যুবভারতীতেই ফুটবলজনতার প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ থাকে না, যত রাত বাড়ে ততই সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে যুবভারতী থেকে যাদবপুর, মধ্যমগ্রাম হয়ে টবিন রোড, চন্দননগর থেকে মন্দিরতলা।
পঞ্চাশোর্ধ্ব জীবনে ফুটবলের বধ্যভূমি এ পোড়া দেশে একজন ফুটবলপ্রেমী হিসেবে গর্বিত হওয়ার দিন বড় একটা আসে না। ফুটবল এদেশে সাব-অল্টার্নদের খেলা। ফিফা ক্রমতালিকায় আমার দেশ একশোরও নিচে। দিনের পর দিন ভালবাসার ফুটবল ক্লাবগুলো চোখের সামনে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসের এক্সটেনশন পার্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রাণের শহর ছেড়ে দলে দলে অল্পবয়সী তরুণ-তরুণীরা অভিবাসী শ্রমিকের বেশে ভিড় জমাচ্ছে ভিন রাজ্যে অথবা ভিন দেশে। কলকাতা কল্লোলিনী থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা নিজের মেয়েকে নিয়ে যখন প্রায়শই ঘিরে ধরে অজানা আশঙ্কা, যখন বাইরের রাজ্যে চলে যাওয়া বন্ধু, আত্মীয়পরিজনদের কাছে নিত্যদিন শুনতে হয় এই শহরটার আর রাজ্যের গঞ্জনার কথা, ঠিক তখনই ‘তিলোত্তমা’র মর্মান্তিক মৃত্যু ঘিরে তৈরি হওয়া প্রতিবাদের ঢেউ আর সেই ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া ফুটবলমাঠের প্রতিবাদ একদিনের জন্য হলেও বিষাদের ছায়ার ভেতর থেকেও বের করে আনে আনন্দাশ্রু। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে— হ্যাঁ, আমাদের অনেক কিছু নেই, কিন্তু আজও একটা ফুটবল ময়দান আছে। সে ময়দানের মাথাগুলোকে হয়তো ক্ষমতার জোরে অথবা লোভে দখল করে নেওয়া যায়, কিন্তু শত ভয় আর প্রলোভনেও কেনা যায় না সেই ময়দানের হৃদয়টাকে।
ফুটবলই তো জীবন। খেলাই তো পারে দুঃখের মধ্যেও এক টুকরো আনন্দ দিতে, দূরের মানুষকে কাছে টেনে নিতে। ১৮-র দুপুর থেকে রাত দেখেছে সেই দৃশ্য। এবার মাঠটাকে আরও বড় করে খেলার দিন সমাগত। মাঠের মানুষ অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে “এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে….” তোলার দাবিতে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতা কি তাকে রোখে?
তাই প্রতিদিন মরতে থাকা মানুষগুলো ‘তিলোত্তমা’র ন্যায়বিচারের দাবিতে আশায় আশায় দিন গোনে নবারুণ ভট্টাচার্যের সেই কবিতার ছন্দে—
একটা গোলাপ বারুদগন্ধে মাতাল হয়ে ফুটবে কবে?
সারা শহর উথালপাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে
*মতামত ব্যক্তিগত