শময়িতা সেন
আজ আমরা জাতিগতভাবে যে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়েছি, সেই সময়ে হিসেব-নিকেশের অঙ্ক কষা চলবেই। তবে, ‘আমাদের হেরে যাওয়া সাজে’ না। আর তাই বাইপাসে পুলিশি লাঠিচার্জের মধ্যেও, বিরোধীপক্ষের ডাকা বনধ্-এর দিনে সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হাজিরা অবশ্যকর্তব্য করে দেওয়া সত্ত্বেও, সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে রাত্রির রাস্তা জুড়ে নিজস্ব একটা প্রতিবাদী রাজনীতি সংগঠিত করতেই হবে। ‘রাস্তা সেদিকেই যাবে যেদিকে তুমি যেতে চাও’ লিখেছিলেন কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। কোন্ রাস্তায় হাঁটব সেটা তাই ঠিক করতে হবে চলার ছন্দেই। নিজেদের প্রশ্নাতীত ভাবলে চলবে না, রাষ্ট্রর সঙ্গে আমাদের সেইখানেই তফাত। প্রশ্ন করে এগিয়ে যাওয়ার পদ্ধতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে নিপীড়িতের নিজস্ব সত্যি
ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হল। ১৯৭৫ সাল। জেরাল্ড ফোর্ড তখন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। ফার্স্ট-লেডি বেটি ফোর্ড। জেরাল্ড ফোর্ডকে ঘিরে ঠান্ডা যুদ্ধ-বিরোধী মার্কিনিদের উল্লাস যখন তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়ে ক্লিভল্যান্ড শহরের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ইয়ার কংগ্রেস’-এ বেটি ফোর্ড বলেন, “নারীসুলভতা নীরবতার দাবি করে না” (‘Being ladylike does not require silence’)। ওঁর এই ভাবনা আগুনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে দেখা দেয় সত্তর দশকের শেষের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের নানান প্রান্তে মূলত সাদা চামড়ার মধ্যবিত্তশ্রেণির নারীরা সারা রাত জুড়ে গণঅবস্থান আরম্ভ করেন। নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা যৌন অপরাধ, নির্যাতন ও নারীকেন্দ্রিক কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে। পরবর্তীকালে এই আন্দোলনগুলি ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ নামে পরিচিতি পায়।
এই আন্দোলনের রাজনীতি বোঝার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এর স্থানিক অর্থাৎ spatial আঙ্গিকটি নিয়ে আলোচনা। এই আন্দোলন সেইসব স্থানেই সংগঠিত হত যেখানে নারীরা নিজেদের বিশেষরকম অসুরক্ষিত মনে করতেন। এই আন্দোলনের মিছিল এবং প্রতিবাদ কোনওভাবেই ‘প্রতীকী’ ছিল না; এর মতাদর্শ সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিল পুরুষতান্ত্রিক সীমানির্ধারণের রাজনীতিকে। অধিকাংশ পুরুষ মনে করতেন (যেমন আজও করেন) যে, বেশ কিছু এলাকা নারীদের জন্য যেহেতু বিপজ্জনক, বিশেষ করে রাত্রিবেলায়, সেহেতু সেই সব এলাকায় তাঁদের না যাওয়াই কাম্য। এই ভাবনার বিরুদ্ধেই গর্জে ওঠেন ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ আন্দোলনের কর্মীরা। গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ‘নিরাপত্তাহীন’ স্থানগুলি শারীরিকভাবে দখল করে তাঁদের নিরাপদ ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার ছিনিয়ে নেন প্রতিবাদী শতসহস্র শ্বেতাঙ্গ নারী। ১৯৮০-র দশকে এই আন্দোলন পশ্চিমের নানান শহরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। স্বতঃস্ফূর্ততা ও সমানুভূতি ছিল এই আন্দোলনের ভিত্তি। মোমবাতি মিছিলে থেমে না গিয়ে, পদযাত্রায় রুখে না গিয়ে, নারীর প্রতিবাদী চৈতন্য শাণিত শারীরিক ভাষায় নিজের প্রকাশ খুঁজেছিল এই আন্দোলনে।
সত্তর কিংবা আশির দশকে তৃতীয় বিশ্বে এই আন্দোলনের বিশেষ প্রভাব না থাকলেও, রাতের রাস্তায় মহিলাদের জমায়েত একবিংশ শতকের শুরুর দিকের নারী আন্দোলনের একটি হাতিয়ার হয়ে ওঠে দক্ষিণ-এশীয় ভূখণ্ডে। পুরুষতন্ত্রের দখলসর্বস্ব মানসিকতার বিরুদ্ধে পালটা প্রতিবাদের সুর চড়ান মূলত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীরা। আদিবাসী-দলিত-নিম্নবিত্ত নারীদের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের ঘটনার কথাও উঠে আসে সেই সব জমায়েতে। রাজনীতি তবু রাজনীতির ঢঙেই এগোয়, পুরুষতন্ত্রের লোহার খাঁচায় ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ সিঁধ কাটতে পারে না। ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’ বাড়বাড়ন্ত হয় তার পরিধিতে। ২০২১ সালে জর্জটাউন ইন্সটিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিওরিটির করা একটা সমীক্ষায় ১৭৭টি দেশের মধ্যে নারীসুরক্ষায় ভারতবর্ষের স্থান হয় ১৪৮ নম্বরে। ২০২৩-এ সেটা ‘বেড়ে’ হয় ১২৮। রাষ্ট্রীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার প্রতি এক লক্ষ নারীর হিসেবে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ১২.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এনসিআরবি-র বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া ২০২২’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে অপরাধের জাতীয় গড়ের হার ৬৬.৪। মোট ১৩টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই হার জাতীয় গড়ের কিছুটা বেশি, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের গড় ৭১.৮। ২০০৫ সাল থেকে ভারতে Protection of Women from Domestic Violence Act কার্যকরী হওয়া সত্ত্বেও, নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের মূল কারণ এখনও স্বামী বা আত্মীয়-স্বজনদের নির্যাতন (৩১.৪ শতাংশ)। এনসিআরবির রেকর্ডে এছাড়াও যে অপরাধ তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলো হল নারী অপহরণ (১৯.২ শতাংশ), নারীর সম্মানহানির উদ্দেশ্যে আক্রমণ (১৮.৭ শতাংশ) এবং ধর্ষণ (৭.১ শতাংশ)।
এই সব তথ্য ঝালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হল কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে ৯ আগস্ট ঘটে যাওয়া এক নারকীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে। ওইদিন রাতে আরজিকর নামক সরকারি হাসপাতালে পোস্টগ্র্যাজুয়েট পাঠরতা একজন কর্তব্যরত মহিলা ডাক্তারকে ধর্ষণ ও খুন করে কিছু বিকৃতমস্তিষ্ক দুষ্কৃতি। পুলিশ সেই ঘটনাকে প্রাথমিকভাবে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালাতে চাইলেও আসল দুষ্কর্ম, অর্থাৎ ধর্ষণ ও খুন বেশিক্ষণ গোপন থাকেনি। দুর্ঘটনাটির খবর টিভিতে সম্প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বত্র বিপুল জনরোষ দেখা দেয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানান, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ অর্থাৎ দোষীদের এনকাউন্টারের পক্ষে সওয়াল করেন। ইতিমধ্যেই পুলিশ এক সিভিক ভলেন্টিয়ারকে গ্রেফতার করে। সমাজমাধ্যমে ঘটনার কড়া সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মূলত নারী ও প্রান্তিক-লিঙ্গের মানুষদের ভেতর থেকে উঠে আসে আরও কিছু ব্যক্তিগত, তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি। এই দুই গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে গর্জে ওঠেন সামাজিক মাধ্যমে। নিজেদের যৌন নির্যাতন এবং হেনস্থার অভিজ্ঞতা ভাগ করে ব্যাপকতর আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। ১০ আগস্ট ‘আসুন রাতের দখল নিই’ বলে একটি আহ্বান সমাজমাধ্যমে অভাবনীয় সাড়া ফেলে। ১৪ আগস্ট কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ‘রাতের দখল’ নেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। এই আন্দোলনের সমর্থনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় এমনকি বিদেশেও মানুষ রাস্তায় নামেন। কলকাতার ভিতরে মূলত মধ্যবিত্তশ্রেণির মহিলারা এই জন-অবস্থানগুলিকে নেতৃত্ব দেন।
ওইদিন রাতে প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে নানান অবস্থান-জমায়েতে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ‘মোমবাতি মিছিলের’ শহরে এমন স্পর্ধিত ও উদ্দীপ্ত প্রতিবাদ বিরল। প্রকৃতপক্ষেই এই জমায়েতে অংশগ্রহণ করেছেন আট থেকে আশি বছরের শিশু/নারী/বৃদ্ধা। তাঁদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এসেছেন ট্রান্স ও ক্যুইয়ার মানুষরা। শিশুরা হয়তো অবাক চোখে দেখেছে আশেপাশে তাদেরই মায়ের মতো আরও অসংখ্য মা চিন্তিত তাদের বাচ্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে, কিন্তু ভীত নন। বৃদ্ধারা সুর চড়িয়েছেন এই সংক্রান্তি সময়ে মূলত সরকারের ভূমিকার বিরুদ্ধে এবং ন্যায়বিচারের জন্য। নারীদের ওপর অত্যাচারের সময় কোনও নৈতিকতা, মূল্যবোধ কাজ করে না; আইন পড়ে থাকে কাগজে-কলমে-খাতায়। আসলে আইনও তো পুরুষতান্ত্রিক আর তাই বৃদ্ধারা সতর্ক করেছেন, আন্দোলন যেন থেমে না যায়। তাঁরা অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছেন যে রাষ্ট্র অথবা সরকার আসলে কথা দেয় তা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যেই। কিশোরী ও মাঝ-বয়সি মহিলারা স্লোগান তুলেছেন দোষীদের কঠিনতম শাস্তির দাবিতে। সরকার ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও তাঁদের নজর এড়ায়নি। তাঁরা সিস্টেমকে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন: গান, কবিতা, নাটক, তথ্যচিত্রর মাধ্যমে। তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন পুরুষতন্ত্রে নিমজ্জিত এক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ‘বিচারপতি’র বিচার চেয়েছেন তাঁরা মহিলাদের কাঠগড়ায়। তাঁদের দাবির সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের দাবিও। তাঁরা রূপান্তরকামী ও ক্যুইয়ারদের জন্য সুরক্ষিত শৌচালয় তৈরি, সুলভমূল্যে ২৪ ঘন্টা সরকারি গণপরিবহন ব্যবস্থা, নির্যাতিত মেয়েদের জন্য পৃথক হোস্টেল, কর্মরতা মায়েদের বাচ্চার জন্য আলাদা ক্রেশ-স্কুলের দাবিও জানিয়েছেন। পাড়ায় পাড়ায় ‘অভয়া ব্রিগেড’ তৈরি করার কথাও ইতিমধ্যে ভাবা হয়েছে। মিটিং-এর মাধ্যমে এলাকার নানান সমস্যার সমাধান এবং এলাকার প্রত্যেকটি জায়গায় নারীসুরক্ষা বাড়ানোই ব্রিগেডের লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করেছেন এক শ্রেণির আন্দোলনকারী।
একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, একে অপরের পাশাপাশি হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তা ‘দখল’ করে ঘন্টার পর ঘন্টা নারী ও ক্যুইয়াররা বসে থেকেছেন। এই দৃশ্য মনে গভীর রেখাপাত করে বিশেষত সেই দেশে যেখানে ধর্ষক ধর্মগুরু প্যারোলে বারবার মুক্তি পায়, যেখানে সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকরা সরকারের গৈরিক বদান্যতায় সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জেল থেকে বেরিয়ে পড়ে জনতার মধ্যে। উদ্ধত মূর্খের অসহ্য দম্ভের দেশে, হাথরাস-উন্নাও-বাস্তারের দেশে মহিলাদের এই নির্ভীক ও সোচ্চার সংহতি তাই শক্তি বাড়ায়। আসলে, আবহমান অত্যাচার অত্যাচারিতদের সঙ্ঘবদ্ধ করে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে। রাত ‘দখলের’ আন্দোলন তার প্রমাণ।
এই আন্দোলনে প্রাথমিকভাবে পুলিশের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের। আন্দোলনের স্থান গোল করে ঘিরে রাখা সারি সারি ব্যারিকেড যদিও রাষ্ট্রের উপস্থিতির কথা সোচ্চারেই জানান দিচ্ছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের তৎপরতা বাড়ে। শ্যামবাজারে যেমন ভোর-রাতে নানান ‘গোলমাল’ শুরু হয়। তার আগেই আরজিকর হাসপাতালে ঘটে যায় পুলিশ-মানুষ খণ্ডযুদ্ধ। কিছু ভাড়াটে গুন্ডা প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে আরজিকর হাসপাতালে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। সেখানে যদিও পুলিশের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের। আর তাই রাত যত বাড়ে, ততই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে জনসমাবেশের অলিন্দে। ধিক্কার দেওয়া হয় এই হঠকারিতার সময় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে। যা আশাব্যাঞ্জক তা হল এই যে, এই জমায়েত কর্মসূচি কোনও একটা গোষ্ঠীকে অত্যাচারী হিসেবে শনাক্ত না করে তুলোধোনা করতে চেয়েছে গোটা সিস্টেমকে যা এই নিপীড়ন, দমন ও পেষণকে একযোগে ইন্ধন দিয়ে চলেছে। এই জমায়েত কর্মসূচির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর অহিংসবাদী (non-violent) অবস্থান। সরকারের, বিশেষত তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু নেতাদের নানান উস্কানিমূলক মন্তব্য সত্ত্বেও জমায়েতের আহ্বায়করা অহিংস রাজনীতিতে অবিচল ছিলেন বলেই কিন্তু তাঁদের কর্মসূচি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এত নারী, প্রান্তিক লিঙ্গ (ও পুরুষের) সমর্থন আদায় করতে পারল। এই সাহসকেও কুর্নিশ জানাতেই হয়।
তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এই প্রশ্নগুলি রাখছি খুঁচিয়ে ঘা করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। যদি জমায়েতকে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয় তবে এগুলির উত্তর খোঁজা আমাদের সকলের কাজ।
প্রথমত, আমরা যারা এই আন্দোলনের সমর্থক তারা এই জমায়েতের রাজনৈতিক দাবিগুলি কীভাবে চিহ্নিত করব? কোনও একটি রাজনৈতিক দাবিসনদ যৌথভাবে তৈরি করতে না পারলে ‘জনতা’ নামক কাল্পনিক গোষ্ঠীকে কোনওরকমভাবেই এক সুতোয় বাঁধা সম্ভব নয়।
১৪ আগস্টের বিভিন্ন জমায়েতে কিন্তু দাবি বদলে বদলে গেছিল। অ্যাকাডেমির মঞ্চে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হলেও, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর পদত্যাগ দাবি করা হয়নি। পৃথকভাবে পূর্ণ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রীর দাবি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু শ্যামবাজারের মঞ্চে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। বিক্ষোভের আগুনের আঁচ যদি ভোটবাক্সের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে দিতে হয় ক্ষমতার করিডোরে, তবে একটা সম্মিলিত রাজনৈতিক প্রস্তাবনার আশু প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনের নিজস্ব কোনও ভাষা আছে কী? থাকলে তার ব্যাকরণ কী? যে জমায়েতগুলোতে ১৪ আগস্ট ব্যক্তিগতভাবে যোগদান করেছি, কোনও জমায়েতেই নতুন কোনও স্লোগান শুনতে পাইনি। পুরনোকে ভেঙেচুরে খানিকটা পথ নিশ্চিত যাওয়া যায়, কিন্তু নতুন স্বর উঠে না এলে আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে কী? কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর, অ্যাকাডেমি ও শ্যামবাজারে আন্দোলনলের ভাষার মধ্যে অনেক তফাত ছিল। এক স্বরে অবিশ্বাসী হয়েও বলছি জনগণকে সংগঠিত করার জন্য প্রত্যেকটি আন্দোলনের স্বতন্ত্র কিন্তু ঐক্যবদ্ধ ভাষা ও ব্যাকরণের প্রয়োজন আছে। নয়তো খুব তাড়াতাড়ি সেটা রাষ্ট্রের নিজস্ব ডিসিপ্লিনারি কাঠামোর প্রভাবে চলে আসে। আন্দোলনকারীদের সবরকম বাধা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দল, সে বাম-ই হোক, বা রাম-ই হোক, পতাকা নিয়েই হোক কিংবা শাঁখ নিয়েই হোক, অযাচিতভাবে যে সেদিন বিভিন্ন জমায়েত কর্মসূচিতে ঢুকে পড়েছিল তার কারণ লুকিয়ে আছে এই আন্দোলনের নিজস্ব ভাষার অভাবে। যদি দলীয় কোনও প্রশ্রয়কে এই আন্দোলন বর্জন করতে চায়, তবে এই আন্দোলনকে তার নিজের ভাষা খুঁজে বের করতেই হবে।
ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিক এমিল বেনভেনিস্তে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, সাবজেক্টিভিটির উৎস হল ভাষা। কারণ কেবলমাত্র ভাষার সাহায্যেই বক্তা নিজেকে এবং ‘অপর’-কে চিহ্নিত করতে পারে। এই পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু স্বরূপতার জ্ঞান সম্ভব। আন্দোলনের ভেতরের অবস্থান তখনই সুদৃঢ় হয় যখন আন্দোলনকারীরা সুসংহত ভাষায় বলতে পারেন আন্দোলন ঠিক কী এবং কী নয় অর্থাৎ যখন তাঁরা আন্দোলনের বিপরীতে তার ‘অপর’কে দাঁড় করাতে পারেন। এই আন্দোলনের স্বতন্ত্রতা এবং স্বরূপ ভাষার অভাবে এখনও ঠিক মতো প্রকাশ পাচ্ছে কী?
এই সুযোগে দখল শব্দটা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। দখল-এর মধ্যে লুকিয়ে আছে চোরা অধিকারবোধ। এই অধিকারের জায়গাটা সব ক্ষেত্রেই খুব গোলমেলে। একটি কবিতায় পড়েছিলাম, ‘তোমাকে দুহাতে চেপে ধরে/গোটা একটা দেশ দখলের/অনুভূতি।’… দখল আসলে সরাসরি ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা শব্দ। পিতৃতন্ত্রের গন্ধ সেই শব্দের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যে আন্দোলন এই তন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের আলাদা একটা মন্ত্র দিতে চাইছে, সে কেন অচেতনভাবেই একই ভাষার ফাঁদে পা দিচ্ছে? নারী কিংবা প্রান্তিক লিঙ্গগোষ্ঠীর রাজনীতির একটা বিরাট অংশ জুড়ে আছে সহমর্মিতা ও ন্যায়ের এথিক্স (care ethics)। যদিও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সাধারণত নারীদের সঙ্গে যুক্ত মূল্যবোধ ও গুণাবলিকে অবমূল্যায়ন করে, নারীবাদী রাজনীতি কিন্তু এই কেয়ার এথিক্সের সমর্থক। তাহলে ‘দখল’ শব্দটি ব্যবহারের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা নেই কি?
তৃতীয়ত, রাজনীতি শব্দটিকে কিছু কিছু জমায়েতে ওইদিন এড়িয়ে যাওয়া হল কেন? অ্যাপলিটিকাল/অরাজনৈতিক, নিউট্রাল/নিরপেক্ষ জাতীয় তথাকথিত সুবিধাজনক রাজনৈতিক অবস্থানের প্রয়োজনই বা হল কেন? কেবল মানুষকে এককাট্টা করার ইচ্ছে থেকেই কি? রাজনীতি যদি কেবল দল না হয়, রাজনীতি যদি ক্ষমতা ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার কোনও বিশেষ প্রক্রিয়া হয় তবে তো এই-সময় আমাদের থেকে রাজনৈতিকতাই দাবি করে সবচেয়ে বেশি। রাজনীতি শব্দটিকে এড়িয়ে না গিয়ে তার কোনও নতুন অর্থ কি এই জমায়েত থেকে উঠে আসতে পারে না? জমায়েত শব্দটি বারবার ব্যবহার করছি কারণ এখনও অব্দি কিন্তু রাতে রাস্তাদখল প্রতীকী স্তরেই থেকেছে। আস্তে আস্তে যদি তা বৃহত্তর কোনও আন্দোলনে পরিণত হয় তবে সেটি হবে আশাপ্রদ।
চতুর্থত, আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে আরেকটু ভাবনার দরকার আছে কি? মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তশ্রেণির বাইরে আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা আছেন? এই প্রশ্নটি নিয়ে ভাবা দরকার কারণ লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী নারী, প্রত্যেক রাতে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে প্রায় প্রাণ হাতে করে বেরোন, বেরোতে বাধ্য হন পেটের তাগিদে। তাঁদের সঙ্গে এই জমায়েতকে সংযুক্ত করতে না পারলে তৃণাদপি বিরোধীপক্ষ বড় সিঁধ কাটতেই পারে। শুধু তাই নয়, ‘মহিলা’ নামক বর্গটির বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা সহজ হয়ে যাবে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তর সঙ্গে নিম্নবিত্তকে, দলিত ও আদিবাসী নারীকে মেলানোর চেষ্টাটুকু না করলে। একটা সংলাপ তখনই সম্পূর্ণরূপে সংলাপ হয়ে উঠবে যখন তা একের মধ্যে সমগ্র ও সমগ্রের মধ্যে একের বোধ তৈরি করতে পারবে।
পঞ্চমত, সামাজিক নৃশংসতা ও সরকারের দুর্বিনীত আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জমায়েত/আন্দোলন কি কোনওভাবে নিজেদের বুর্জোয়া গিল্ট কমানোর মাধ্যম হয়ে উঠল আমাদের কাছে? জমায়েত-রাতের শেষে সামাজিক মাধ্যমে যাঁরা নিজেদের প্রতিবাদী ভাবমূর্তি নিজেরাই তুলে ধরলেন, যাঁরা গর্বিত বোধ করলেন পাশের ও কাছের মানুষের প্রতিবাদে, তাঁদের কি স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া উচিত? যে রাগ, ক্ষোভ, প্রতিরোধ স্বাভাবিক তার মধ্যে বাহুল্যের উচ্চারণ লুকিয়ে থাকবে কেন? এই আন্দোলন কিন্তু ‘প্রতীকী’ হয়েই আছে এখনও অবধি। ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ প্রতীকী রাজনীতির গন্ডি টপকে যেতে পেরেছিল বলেই যুক্তরাষ্ট্রের পরিধি ছাড়িয়ে তার প্রসার হয়েছিল গোটা ইউরোপে। ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার কথাও কি আমাদের ভাবতে হবে না?
ষষ্ঠত, পুরুষমানুষের উপস্থিতি নিয়ে জমায়েত কর্মসূচিগুলিতে কিছু মতভেদ দেখা যায়। অ্যাকাডেমির অবস্থান থেকে যেমন ঘোষণা করা হয় যে, মূল মঞ্চে কোনও পুরুষ থাকবে না। কলেজস্ট্রিটেও এই ভাবনার প্রকাশ চোখে পড়ে। কিন্তু শ্যামবাজারে, যেখানে জাতি ও শ্রেণিনির্বিশেষে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ জমায়েত করেছিল, সেইখানে ‘দখল’-এর দড়ি মহিলাদের হাতে থাকলেও, পুরুষের উপস্থিতি ও সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। অ্যাকাডেমি এবং শ্যামবাজারে মহিলাদের থেকে সংখ্যায় পুরুষ বেশি বই কম ছিলেন না। এই তথ্য দেওয়া প্রয়োজন হয়ে উঠল এই কারণে যে, আন্দোলনকারীদের একাংশকে বলতে শুনলুম All Men অর্থাৎ প্রত্যেক পুরুষই ধর্ষক। এই ধারণা কি কখনও কোনও সচেতন রাজনৈতিক অথবা সামাজিক বক্তব্য হতে পারে? যদি হয়, তাহলে যে মহিলারা তাঁদের স্বামী/পার্টনার/প্রেমিককে স্বেচ্ছায় নিয়ে এলেন জমায়েতের রাতে, তাঁদের আমরা কীভাবে দেখব? সেই দিনে নানান মুহূর্তে পুরুষের তোলা স্লোগানে মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত গলা মেলানোই বা কীভাবে পড়ব আমরা? পুরুষতন্ত্রের মতাদর্শ লিঙ্গনির্বিশেষেই তার প্রভাব বিস্তার করে। আর তাই বোধহয় কেবল পুরুষরা এই জমায়েত-কর্মসূচির ‘অপর’ হয়ে উঠতে পারে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বজায় রাখার কাজ করে পুঁজিবাদী সরকার ও ধনতন্ত্র। এই দুইয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক লড়াইয়ে পুরুষরা সহযোদ্ধা হিসেবে বাদ পড়বেন কোন রাজনৈতিক হিসেবে?
আজ আমরা জাতিগতভাবে যে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়েছি, সেই সময়ে হিসেব-নিকেশের অঙ্ক কষা চলবেই। তবে, ‘আমাদের হেরে যাওয়া সাজে’ না। আর তাই বাইপাসে পুলিশি লাঠিচার্জের মধ্যেও, বিরোধীপক্ষের ডাকা বনধ্-এর দিনে সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হাজিরা অবশ্যকর্তব্য করে দেওয়া সত্ত্বেও, সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে রাত্রির রাস্তা জুড়ে নিজস্ব একটা প্রতিবাদী রাজনীতি সংগঠিত করতেই হবে। ‘রাস্তা সেদিকেই যাবে যেদিকে তুমি যেতে চাও’ লিখেছিলেন কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। কোন্ রাস্তায় হাঁটব সেটা তাই ঠিক করতে হবে চলার ছন্দেই। নিজেদের প্রশ্নাতীত ভাবলে চলবে না, রাষ্ট্রর সঙ্গে আমাদের সেইখানেই তফাত। প্রশ্ন করে এগিয়ে যাওয়ার পদ্ধতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে নিপীড়িতের নিজস্ব সত্যি। অত্যাচারীরা তাদের পৃথিবীর গড়নটা জানলেও নিপীড়িতরা জানে যে, পুরো পৃথিবীটাই একটা মহড়াঘর। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে রিহার্সালের মাধ্যমে সত্যের স্বরূপের কাছে এগিয়ে যাওয়াই অত্যাচারিতের ধর্ম। তাই তো কোজাগরী জাগে, সজাগ থাকে।
জেগে থাকাও
জেগে থাকাও একটা ধর্ম।
*মতামত ব্যক্তিগত