Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মোদি-শাসনে আদানির স্ফূর্তি

প্রদীপ দত্ত

 


সম্প্রতি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ জানিয়েছে, তাদের অভিযোগের ঠিকমতো তদন্ত না করার পিছনে সেবি-র পর্ষদ সদস্য ও চেয়ারম্যান মাধবী পুরি বুচের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তারা জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দর বাড়াতে যে বিদেশি ফান্ড ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে মাধবী পুরি বুচ এবং তাঁর স্বামী ধবল বুচের অংশীদারি ছিল। মাধবী সেবির সদস্য হওয়ার পর স্বামী ধবলের লগ্নিকারী সংস্থা ব্ল্যাকস্টোনে যোগ দেন। ওই কোম্পানি আবার বেআইনিভাবে লগ্নি করে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারদর বাড়িয়ে দিয়েছিল। বোঝা গেল, মাধবী ও তাঁর স্বামী ধবলের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বলেই সেবি আদানিদের বিরুদ্ধে কোনও অনিয়ম খুঁজে না পাওয়ার কথা বলেছে

 

গৌতম আদানি স্কুলের লেখাপড়া শেষ না করে ১৯৭৮ সালে মুম্বাইয়ে হীরার ব্যবসা শুরু করেন। দাদা বিনোদ আদানির মুম্বাইয়ে কাপড়ের ব্যবসা ছিল। গৌতম হীরার ব্যবসা শুরু করার তিন বছর পর বিনোদ তাঁকে গুজরাতে নিজের ব্যবসায় টেনে নেন। ব্যবসায়ী পরিবারে বড় হওয়া গৌতমের কাছে বিনোদ প্রায় বাবার মতো। তিনি সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। তাঁর দুবাই, সাইপ্রাসের পাসপোর্ট রয়েছে। ৭৫-উত্তীর্ণ এই দাদা যুগাধিককাল ধরে বিদেশ থেকেই তাঁদের ব্যবসায় সক্রিয় রয়েছেন।

রাজীব গান্ধির আমলে নতুন এক্সিম পলিসি তৈরি হলে গৌতম রফতানির ব্যবসায় নামেন। ১৯৮৮ সালে আদানি এক্সপোর্টস কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৯৯৪ সালে আদানি এন্টারপ্রাইজেসে রূপান্তরিত হয়। ওই রফতানির ব্যবসায় বিনোদ দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দরে পাঠানো মালের তদারকি করতেন। পরে তিনিই গুজরাতের মুন্দ্রায় তাঁর ভাইকে বন্দর তৈরি করার জন্য অর্থসাহায্য করেছিলেন।

১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিনোদ বাহামাসে গিয়ে সাজানো কোম্পানির নেটওয়ার্ক তৈরি করার কাজে মন দেন। যার দুজন ডিরেক্টরের একজন তিনি অন্যজন তাঁর স্ত্রী রঞ্জনবেন বিনোদ আদানি। দু-বছর পর তিনি তাঁর নাম বদলের আবেদন করেন, বিনোদ শান্তিলাল আদানির জায়গায় হবে বিনোদ শান্তিলাল শাহ। আদানিদের নানা কোম্পানিতে সেই নামই রয়েছে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে বলা হয়েছে তারা মরিসাসের ৩৮টি সাজানো কোম্পানির নাম চিহ্নিত করেছে যা নিয়ন্ত্রণ করেন বিনোদ অথবা তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ। তাছাড়া সাইপ্রাস, আরব আমিরশাহি, ক্যারিবীয় দ্বীপ, সিঙ্গাপুরের সাজানো কোম্পানিও নিয়ন্ত্রণ করেন বিনোদ।

১৯৯৫ সালে গুজরাতে কেশুভাই পটেল মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গৌতম আদানি মুন্দ্রায় বন্দর নির্মাণ করেন, রাস্তাঘাট তৈরির বরাতও পান। তবে গুজরাতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত আদানি এ-দেশের শিল্পমহলের প্রথম সারিতে ছিলেন না। ২০০১ সালে মোদি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময়, শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠীর একমাত্র নথিভুক্ত সংস্থা ছিল আদানি এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড। মোদি ক্ষমতায় আসার পরই তাঁর ব্যবসায় উত্থান শুরু হয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আরও চমকপ্রদ উত্থান হয়। পরস্পরের ক্রমোন্নতিতে দুজনেই লাভবান হয়েছেন।

মোদি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে। পরের বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি সবরমতী এক্সপ্রেসে অযোধ্যা থেকে ফেরার পথে গোধরা স্টেশনের কাছে ট্রেনের মধ্যে ৫৯ জন হিন্দু করসেবক পুড়ে মরার জন্য সংখ্যালঘুরা দায়ী মনে করে গুজরাতে ব্যাপকভাবে তাদের গণহত্যার কিছুকাল পর থেকেই দুজনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। সে-সময় শহরে গ্রামে রাস্তাঘাটে হিন্দু বাহিনির প্রতিশোধস্পৃহা ও গণধর্ষণের বিভীষিকায় দেশ কেঁপে উঠেছিল। তার প্রভাবে কয়েকজন শিল্পপতি মোদির প্রতি বিরূপ হলেও গৌতম আদানি মোদির ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলেন।

পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে (২০০৩) সিআইআই দিল্লির অডিটোরিয়ামে “মিটিং উইথ নরেন্দ্র মোদি, দ্য নিউ চিফ মিনিস্টার অফ গুজরাত” শিরোনামে এক বিশেষ অধিবেশন ডেকেছিল। স্টেজে মোদির সঙ্গে সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল তরুণ দাস ছাড়া ছিলেন দুই বড় শিল্পপতি জামশিদ গোদরেজ এবং রাহুল বাজাজ। গুজরাতের নির্বাচনে তাঁর বিজয় উদযাপন করতে জানুয়ারি মাসে মুম্বাইয়ের এক সভায় দাঙ্গা ও গণহত্যার জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক তাঁকে অপদস্থ করেছিলেন। সেই ঘটনার সূত্রে গোদরেজ বলেন, মানুষের ভোটে তাঁর বিজয়ের রায়কে সম্মান জানিয়ে তিনি যেন সমস্ত গুজরাতির নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করেন।

বাজাজ বলেন: কাশ্মির, উত্তর-পূর্ব, উত্তরপ্রদেশ, বিহারে কেন বিনিয়োগ আসে না? শুধু পরিকাঠামোর অপ্রতুলতাই নয়, নিরাপত্তাহীনতার বোধও তার কারণ। গত বছরের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাপ্রবাহের জন্যই এসব কথা মনে পড়ছে। জানতে চাই আপনি কী মনে করেন? আপনি কীসের পক্ষে? আপনার দল এবং গুজরাত সরকারের আপনি অবিসংবাদী নেতা। আমরা আরও ভাল করে আপনাকে জানতে চাই। আমরা সব ধরনের সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে তৈরি। কিন্তু সমাজের জন্য কোনটা ভাল, কোনটা তার পক্ষে কাজ করে তা নিয়ে আমাদের নিজেদেরও মতামত রয়েছে।

মোদির বলার সময় হলে তিনি ওই দুই শিল্পপতিকে তুমুল আক্রমণ করেন। বলেন, গুজরাতকে কলঙ্কিত করায় অন্যদের কায়েমি স্বার্থ রয়েছে, কিন্তু আপনাদের স্বার্থ কী?

মোদি সিআইআইকে শিক্ষা দেবেন বলে তৈরি হলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই গৌতম আদানি-সহ তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা একটি প্রতিযোগী সংগঠন তৈরি করলেন, যার নাম দেওয়া হল ‘রিসার্জেন্ট গ্রুপ অফ গুজরাত’ (আরজিজি)। মোদি এবং গুজরাতিদের সিআইআই অপমানিত করেছে বলে সরে এসে তারা প্রেস স্টেটমেন্টে জানায়, সিআইআই-এর গুজরাত চ্যাপটার বিদায় নিক, তারা রাজ্যের স্বার্থরক্ষায় অপারগ।

গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে শিল্পপতিদের ওই বিদ্রোহে সিআইআইয়ের প্রধান পরামর্শদাতা তরুণ দাস বিচলিত হলেন। ততদিনে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মন্ত্রীদের কাছে সিআইআই-এর অ্যাক্সেস নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। শিল্পপতিদের হয়ে সরকারের কাছে তদ্বির করার সংগঠন হিসাবে সিআইআই-এর মূল উদ্দেশ্যে আঘাত লাগছে। ভয় পেয়ে, তরুণ দাস সিআইআই-এর পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়ার চিঠি মোদির কাছে পৌঁছে দিতে বাধ্য হন।

ওদিকে গৌতম আদানি ও অন্য শিল্পপতিরা মোদির সমালোচকদের নিন্দা করে, মোদিকে ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ হিসাবে অভিহিত করে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক সংহত করতে সাহায্য করলেন। এইভাবেই গুজরাত উন্নয়ন মডেলের জন্ম হয়, যা আসলে কর্পোরেটের টাকায় হিংসাত্মক হিন্দু জাতীয়তাবাদ। শুরু হয় মোদি-আদানি গভীর সম্পর্ক। আদানিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর সব কোম্পানিই এরপর থেকে ফুলে ফেঁপে ওঠে।

মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আদানি গোষ্ঠী কচ্ছের মুন্দ্রায় সরকারের কাছ থেকে ৭৩৫০ হেক্টর (এক হেক্টর= ১০০০ বর্গ মিটার) জমি ৩০ বছরের জন্য ইজারা পেয়েছে। পেয়েছে নামমাত্র মূল্যে। প্রতি বর্গমিটারের দাম এক মার্কিন সেন্ট (বর্তমানে এক সেন্ট= ০.৭৫৩ টাকা)। সর্বোচ্চ দাম বর্গমিটার প্রতি ৪৫ সেন্ট। মুন্দ্রায় গড়ে উঠেছে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (স্পেশাল ইকোনমিক জোন বা এসইজেড)। পরিবর্তে আদানি সেই জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইন্ডিয়ান অয়েল সহ নানা কোম্পানিকে প্রতি বর্গমিটার ১১ ডলার (বর্তমানে ১ ডলার= ৮৩.৩ টাকা) হিসাবে ভাড়া দিয়েছে। মুন্দ্রা বন্দরে এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা আমদানির টার্মিনাল চালু করেছিল। গুজরাত সরকার আদানির এসইজেডের জন্য গ্রামের প্রায় ৯৩০ হেক্টর চারণভূমি নিয়েছে। আদানি ওই জমি প্রতি বর্গমিটার (এক হেক্টর= ১০০০ বর্গ মিটার) পনের টাকার কম দামে ইজারা পেয়েছে।

২০১৩ সালে গোয়াতে গৌতম আদানির ছেলের ধুমধাম করে বিয়ে হয়। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন দেশের সবচেয়ে ধনী বহু কোম্পানি ও ব্যাঙ্কের শীর্ষস্থানীয় এবং আমলারা। বেশিরভাগই যুগলকে আশীর্বাদ করে, রাতটা সেখানে থেকে পরেরদিন বিয়ের আগেই চলে যান। কিন্তু এক বিশেষ বন্ধু কয়েকদিন ধরে বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠানে ছিলেন। নিরুদ্বিগ্ন, অমায়িক– পাত্রপক্ষের প্রিয় সেই জেঠুই হলেন- গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তিন দফায় মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর ২০১৪ সালে মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। শপথ নিতে তিনি আদানির নামাঙ্কিত বিমানে উড়ে দিল্লিতে আসেন। তারপর একাধিকবার আদানি চড়েছেন মোদির বিমানে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আদানি মোদির সঙ্গে ইজরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ-সহ একের পর এক দেশে গিয়ে নানা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। ইজরায়েলের সঙ্গে সামরিক সরঞ্জাম কেনা, অস্ট্রেলিয়ার কয়লা খনি কেনা এবং তাতে বিনিয়োগের জন্য সেখানে বসেই স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একশো কোটি ডলারের ঋণ আদায়, ঝাড়খণ্ডে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে খুব চড়া দামে বাংলাদেশকে বেচা, শ্রীলঙ্কায় নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবসা— সবই হয়েছে মোদির দাক্ষিণ্যে।

বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর আদানি বেশ কয়েকটি বন্দর ও বিমানবন্দর পরিচালনার বরাত পান। ধীরে ধীরে তিনি টাটা, বিড়লা, আম্বানিদের টপকে বিশ্বের তিন নম্বর ধনীর তালিকায় উঠে আসেন। আপেলের ব্যবসা থেকে প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম— আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসার বিস্তার বিপুল। এই গোষ্ঠীই দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি তাপবিদ্যুৎ (১৫,২৫০ মেগাওয়াট), নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ (১০,৯৩৪ মেগাওয়াট) এবং দ্বিতীয় বৃহৎ সিমেন্ট উৎপাদনকারী, সামরিকক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী। হাতে রয়েছে সাতটা রাজ্যের ১৩টা বন্দর, যেখানে দেশের ৩০ শতাংশ মাল ওঠা-নামা করে। রয়েছে সাতটা বিমানবন্দর— মুম্বাই, আমেদাবাদ, লখনৌ, ম্যাঙ্গালুরু, জয়পুর, গুয়াহাটি এবং তিরুবনন্তপুরম— যেগুলিতে যাত্রীসংখ্যা দেশের ৩০ শতাংশ। তাদের তৈরি গুদামে থাকে দেশের ২৩ শতাংশ শস্য। তবে সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন কৃষিক্ষেত্রে তাদের বাড়ানো থাবা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হলেও তাদের মোট কর্মীসংখ্যা ২৩ হাজার।

আদানির ব্যবসা নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের মধ্যে সবচেয়ে লিখছেন সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ রিপোর্টে একমাত্র তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি আদানির রোষের শিকার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নানা রাজ্যে আদানি গোষ্ঠীর কয়েকটি মামলা ঝুলছে। তাঁকে ইকনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির সম্পাদকের পদ ছাড়তে হয়েছে। তিনি এবং আরও কয়েকজন সাংবাদিক দেখিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গৌতম আদানির দীর্ঘকালের বন্ধুত্বের জন্য অনেক সম্পদের মালিকানাই অতি অল্প দামে পাওয়া। মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর, বিশেষ করে অতিমারির সময় আদানি গোষ্ঠীর বিপুল উত্থান হয়েছে।

২০১৪ সাল থেকে, বিরোধীরা বলছেন, মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য তিনি আদানির প্রতি অত্যন্ত সদয়, বারবার তাঁকে আড়াল করেন। প্রায় প্রতিটি বড় প্রকল্প তাঁকে দেওয়া হয়। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আদানির ধন-সম্পদ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে ধনী, বিশ্বের তৃতীয় ধনীতে পরিণত হন। ২০০০ সালে আদানি গোষ্ঠীর ব্যাবসার অঙ্ক ছিল ৩,৩০০ কোটি টাকা (দ্য ইকনোমিক টাইমস)। ২০১৩ সালে সেটা বেড়ে হয়েছিল ৩১১ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে হয়েছিল ৯,০০০ কোটি ডলার, ২০২৩ সালে কমে হয়েছিল ৪৩৩৯ কোটি ডলার (স্ট্যাটিস্টা)।

মোদির সৌজন্যে আদানির বেশিরভাগ ব্যবসা বা মালিকানা এসেছে বিস্ময়কর স্বল্প আর্থিক মূল্যে। তারপরও মোদি কিন্তু আজ পর্যন্ত আদানির সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক তা নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতারণা, শেয়ারদরে কারচুপির অভিযোগে জেপিসি তদন্তের দাবি নিয়ে একেবারে চুপ করে ছিলেন। আদানিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগেরও জবাব দেননি। স্বাভাবিকভাবেই মোদির সঙ্গে আদানির গোপন আঁতাত নিয়ে দেশবাসীর মনে গভীর প্রশ্ন জেগেছে।

কংগ্রেস বলে, পাঁচ বছর আগেই ‘পানামা পেপার্স’ ও ‘প্যান্ডোরা পেপার্স’ বলে পরিচিত গোপন নথি ফাঁস হলে জানা গিয়েছিল, বিনোদ আদানি বাহামাস ও ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের মতো কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্যে স্রেফ কাগজেকলমে নানা সংস্থা খুলে শেয়ারদরে কারচুপি করেছেন, তারপরও সরকার পদক্ষেপ করেনি।

এরপর যেদিন বিবিসির তথ্যচিত্র ‘মোদি কোয়েশ্চেন’-এর দ্বিতীয় পর্ব প্রদর্শিত হয়েছিল, ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট, ‘আদানি গ্রুপ: হাউ দ্য ওয়ার্ল্ড’স থার্ড রিচেস্ট ম্যান ইজ পুলিং দ্য লার্জেস্ট কন ইন কর্পোরেট হিস্ট্রি’। বিনিয়োগ সংক্রান্ত নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তাদের রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কর্পোরেট জগতের ইতিহাসে স্টকে সবচেয়ে বড় কারচুপির অভিযোগ করে। ওই কোম্পানি ‘শর্ট সেলিং’ করে।[1] বিশ্বের কোন কোম্পানি জালিয়াতি করে নিজেদের শেয়ারের দাম বাড়িয়ে রেখেছে তা তারা খুঁজে দেখে। সেই তথ্য প্রকাশ করাই তাদের কাজ। তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের জন্য কোনও কোম্পানির শেয়ারের মূল্য কমে গেলে, সেই কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনার সুবাদে তারা লাভ করে। ওই রিপোর্ট আদানি গোষ্ঠীর ১৭ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা নিয়ে কর্পোরেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র ফাঁস।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিদেশ থেকে সাজানো বা শেল কোম্পানির মাধ্যমে গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানি ও অন্যান্যেরা কৃত্রিমভাবে তাঁদের গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম বাড়িয়েছেন। সেই শেয়ার বন্ধক রেখে নানা আর্থিক সংস্থা থেকে বিপুল অর্থ ধার নিয়েছেন। ওই রিপোর্ট প্রকাশের পর হুড়মুড় করে তাদের শেয়ারের দাম কমে যায়। বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ পুঁজির মালিক থেকে আদানি তরতর করে অনেক নিচে নেমে আসেন।

আদানি গ্রুপ ওই রিপোর্টে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করলেও শেয়ারবাজার তাদের উপর আস্থা রাখেনি। রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে দু-মাসের মধ্যে আদানি গোষ্ঠীর নানা কোম্পানির শেয়ারের মূল্য গড়ে ৪৮ শতাংশ কমে যায়। তারা হিন্ডেনবার্গের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিলেও বাস্তবে কিছুই করেনি। পৃথিবীর তিন নম্বর ধনী থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি (২০২৩) আদানি নেমে আসেন ২১ নম্বরে। মার্কিন বাজারের ডাও জোন্স সূচক থেকে আদানি এন্টারপ্রাইজের নথিভুক্তি বাতিল করা হয়।

রিপোর্টে মরিশাস এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের মতো কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত নানা দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে আদানি গ্রুপের মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সেখানে অভিযোগ করা হয় যে, ভারতে লেনদেন হওয়া শেয়ারের দাম নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ঠিক করার জন্য তারা ওইসব অফশোর কোম্পানিকে ব্যবহার করেছে। গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানি ওইসব দেশে ভুঁইফোঁড় সংস্থা খুলে শেয়ারের দর কৃত্রিমভাবে বাড়িয়েছেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির বড় পরিমাণ ঋণ রয়েছে বলে গ্রুপটির আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে। অফশোর শেল কোম্পানির মাধ্যমে নির্লজ্জভাবে তাদের নানা কোম্পানির শেয়ারের দামে কারচুপি করে এবং কোম্পানির হিসাবের খাতায় জালিয়াতি চালিয়ে তাদের কোম্পানিগুলো শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রেখেছে।

যে আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ শেয়ারে কারসাজি ও হিসাবে জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছে, গৌতম আদানি তার মুখ, কিন্তু পিছনে রয়েছেন তাঁর দাদা বিনোদ আদানি। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিনোদ বহুকাল ধরে বিদেশের সাজানো কোম্পানির দেখাশোনা করতেন, বিনিয়োগকারীরা তা জানতেন না। সাজানো কোম্পানির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে তিনি গোষ্ঠীর আর্থিক স্বাস্থ্য ভাল রেখেছেন। ওদিকে আদানি গোষ্ঠী তাদের অস্ট্রেলিয়ার মাইনিং কোম্পানির হিসাব থেকে বিপুল সম্পত্তি সরিয়ে রেখেছিল, যেন তা ব্যালেন্সশিটে ধরা না পড়ে। কারণ কোম্পানিটি দুঃস্থ।

রিপোর্টে বলা হয়, অনেক বিদেশি সংস্থাই নিয়ন্ত্রণ করেন বিনোদ। তাঁর কাজ ওই গোষ্ঠীর নানা অ্যাকাউন্টে টাকা সরানো। বেশিরভাগ কোম্পানিরই কাজকর্মের প্রকাশ নেই, কর্মচারী নেই, অথচ ওইসব কোম্পানি আদানি গোষ্ঠীতে শতশত কোটি ডলার ঢোকাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের ডিরেক্টর টিম বাকলে অস্ট্রেলিয়ায় আদানি গ্রুপের ক্রিয়াকলাপ পরীক্ষা করেছেন। তাঁর কথায়, আমি এমন অস্বচ্ছ কর্পোরেট কাঠামো কখনও দেখিনি, যার হদিশ পাওয়া যায় না।

দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায় যে, সিঙ্গাপুরের এক সাজানো কোম্পানিতে বিনোদকে ডাইরেক্টর হিসাবে দেখানো হয়েছেল। অস্ট্রেলিয়ার কারমাইকেল কয়লা খনি অঞ্চলে রেললাইন পাতার পরিকল্পনা করে দুবাইয়ের একটি কোম্পানির থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, যা বিনোদই চালান। কিন্তু প্রদেশের সরকার দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করলে রেললাইন পাতার কাজ আর হয়নি।

আমেরিকার ওই দৈনিক আরও জানায়, সিঙ্গাপুরের এক কোম্পানি অ্যাবট পয়েন্ট পোর্ট হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেড ২০২১-২২ আর্থিক বছরে আদানি গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্টের কাছ থেকে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে। আদানি গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট হল বিনোদ আদানির দুবাইভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থা। সেই টাকা কোথা থেকে এল তা ধরা যায়নি। দু-বছর ধরে সিঙ্গাপুরের অন্য একটি সংস্থার সাবসিডিয়ারি অ্যাবট পয়েন্টের একমাত্র ডিরেক্টর ছিলেন বিনোদ। আদানিদের যেসব কোম্পানি অস্ট্রেলিয়ায় কয়লা, রেলওয়ে ও বন্দর ব্যবসায় যুক্ত তাদের ওই কোম্পানি ৯.৯৫ কোটি ডলার ধার দিয়েছে।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, সাম্প্রতিককালে আদানি গোষ্ঠিতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রায় অর্ধেকই তাদের সাজানো কোম্পানি থেকে এসেছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যেসব বিদেশি সাজানো কোম্পানি তারা অন্তত ২৭০ কোটি ডলার ঢেলেছে।

ভারতীয় সাংবাদিকরা অতীতে যে সমস্ত প্রশ্ন তুলেছিলেন হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে তা বিস্তারিতভাবে করা ছাড়াও অনেক নতুন প্রশ্ন যোগ করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী আদানির সাতটি লিস্টেড কোম্পানির দাম ৮৫ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে রাখা হয়েছে। সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতে ওইসব কোম্পানি আন্তর্জাতিক বাজার এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ও লাইফ ইন্সিওরেন্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে।

আদানি গ্রুপ দাবি করে, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট অভিসন্ধিমূলক, ভিত্তিহীন এবং ভারতবর্ষের উপর আক্রমণ। তবে বিনিয়োগকারীদের বোঝানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ওদিকে ক্রেডিট সুইস, সিটি গ্রুপ, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড আদানি গ্রুপের ঋণের জামানত (কোল্যাটারাল) হিসাবে তাদের বন্ড নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ফরাসি ফার্ম টোটাল এনার্জিস ৪০০ কোটি ডলারের হাইড্রোজেন উৎপাদনের উদ্যোগ বন্ধ করে। ব্রিটিশ সরকারের প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের ভাই জো জনসন এলারা ক্যাপিটালের ডিরেক্টর হিসাবে পদত্যাগ করেন। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে ওই কোম্পানি আদানি গোষ্ঠীর অপকর্মে জড়িত বলে উল্লেখ ছিল। আদানির কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি নিয়ে সে দেশে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়।

ওদিকে আদানি গোষ্ঠীকে নানা আর্থিক সংস্থা থেকে নেওয়া ধারের প্রায় অর্ধেক মেটাতে হয়। কাজেই তাদের নতুন বা নির্মীয়মান প্রকল্পের কাজ স্থগিত রাখতে হয়। এরই মধ্যে মার্চ মাসে তারা দাবি করে, তাদের শেয়ারের বিনিময়ে গচ্ছিত ঋণের মধ্যে ২৫০ কোটি ডলার তারা শোধ করে দিয়েছে। ব্যাঙ্গালোরের ব্যবসায়িক খবরের মাধ্যম ‘দ্য কেন’ জানায়, কোল্যাটারাল হিসাবে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত শেয়ারের একটা অংশ ব্যাঙ্ক ছেড়ে দিয়েছে মাত্র। ব্যাঙ্ক যাতে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ না নেয় সেই উদ্দেশে ঋণ আংশিক শোধ করা হয়েছিল।

আদানিরা মহাকাশ ও সামরিক ব্যাবসায় এসেছে ২০১৭ সালে। নিজেরাই জানিয়েছে, এই ব্যবসায় তাদের বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই। সামরিক ব্যবসায় এখন তাদের অন্তত এগারোটি রেজিস্টার্ড কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে। রাহুল গান্ধি সংসদে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে সামরিক মন্ত্রকের কাছে প্রশ্ন তুলে বলেন, হাজার হাজার কোটি বিদেশি টাকা শেল কোম্পানির মাধ্যমে সাইফন করে আদানি গোষ্ঠীতে যে ঢালা হয়েছে, তাতে সামরিক মন্ত্রকও সক্রিয়। তাঁর প্রশ্ন, “কী করে হঠাৎ ২০ হাজার কোটি টাকা আদানির সাজানো কোম্পানিতে (কয়েকটি সামরিক কোম্পানি) এল? এ কার টাকা?” তিনি গোটা প্রক্রিয়ায় এক চিনা ব্যাক্তির ভূমিকা নিয়েও কথা বলেন। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে উল্লেখ ছিল জনৈক চিনা ব্যাক্তি তাইওয়ানে আদানি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। রাহুল বলেন, কেউ কেন বলছে না যে, কে এই চিনের লোক?

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীরা তিন দিন ধরে লাগাতার সংসদে আদানি ইস্যু নিয়ে তুলকালাম করে। অভিযোগ করে, মোদি আদানিকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পগোষ্ঠী কী করে সমস্ত নজরদারি এড়িয়ে গেল? যে সরকার এতদিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধুয়ো তুলে রাজনৈতিক ফায়দা কুড়িয়েছে, তাদের কাছে গৌতম আদানি কি এতটাই প্রয়োজনীয়? বিরোধীরা সংসদে যৌথ সংসদীয় কমিটি বা প্রধান বিচারপতির নজরদারিতে তদন্তের দাবি তুললেও মন্ত্রীরা বলেন, এই ব্যাপারে সরকারের কিছুই করার নেই।

কংগ্রেস প্রশ্ন তোলে, কালো টাকা শেষ করতে মোদি নোটবন্দি করেছিলেন। বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে সকলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই মোদিই তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতির দাদা বিনোদ আদানি যখন ভুঁইফোঁড় সংস্থা তৈরি করে কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত দেশগুলিতে টাকার লেনদেন করছেন, তারপরেও হাত গুটিয়ে বসে থাকেন কী করে? আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে কেন্দ্র নীরব কেন?

বিরোধী দলগুলো যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্ত দাবি করে। সেই দাবিকে শাসক দল আমল দেয়নি। সরকারপক্ষ সে-ব্যাপারে পাথরের দেওয়ালের মতো শক্ত ও উদাসীন থাকে। তৃণমূলের সাংসদ মহুয়া মৈত্র এবং কংগ্রেসের রাহুল গান্ধি— দুজনেই ওই রিপোর্ট প্রকাশের আগেই আদানি গোষ্ঠীকে নিয়ে সংসদে নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন। মহুয়া প্রশ্ন করেছিলেন, কী করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক আদানি গোষ্ঠীকে বন্দর ও বিমানবন্দর চালানোর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স দিল? কিসের ভিত্তিতে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং লাইফ ইন্সিওরেন্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ওই গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করল?

আদানি গোষ্ঠীর অবিশ্বাস্য জালিয়াতি নিয়ে মোদি কিংবা সরকার মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। সংসদ কয়েকদিন ধরে অচল থাকার পরও কোনও কথা নেই। বরং সে আলোচনা যেন না হতে পারে তাই অহেতুক রাহুল গান্ধি ব্রিটেনে কী বলেছেন তার জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হবে রব তুলে সংসদ অচল করে। যাঁরা রাহুল গান্ধির বক্তব্য ইউটিউবে শুনেছেন তাঁরা বুঝবেন তিনি গর্হিত কিছু বলেননি। ভারতের গণতন্ত্রের বিপদ নিয়ে বিদেশের মাটিতে আলোচনা করা অন্যায়ও নয়। সে-কথা তাঁর মুখ থেকে শুনতে চান বলেই তাঁরা তাঁকে ডেকেছিলেন। তাছাড়া আজকের ইন্টারনেট, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপের যুগে সেই আলোচনা যেখানেই করা হোক, বিশ্বের কাছে আড়াল করা যায় না।

সংসদে এসে ‘আদানি আদানি’ রব শুনলেও মোদি মৌনই ছিলেন। আদানির নাম উল্লেখ না করে তিনি দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে আদানি সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে, বিরোধীরা মিথ্যে অভিযোগ তুলছেন বলে দাবি করলেও, অভিযোগের প্রসঙ্গ ছোঁননি। তাঁর ভাষণের আগে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধি সরাসরি মোদিকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। মোদি তা নিয়ে রাহুলকে এবং কংগ্রেস সাংসদদের কটাক্ষ করলেও আদানির নাম উচ্চারণ করেননি। তিনি বলেন, বিরোধীরা কিছু না পেয়ে অযথা তাঁর উপর কালি ছেটানোর চেষ্টা করছেন, মিথ্যে অভিযোগ আনছেন। বিরোধীরা অভিযোগ করলেও, মানুষ তা বিশ্বাস করবে না। ১৪০ কোটি মানুষের আশীর্বাদ তাঁর সুরক্ষাকবচ। গালি, মিথ্যা কখনও তা ভেদ করতে পারবে না। মোদি আদানিকে ব্যবসার বরাত দেওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কা সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। তা নিয়ে তিনি মন্তব্য করেননি।

রাজ্যসভাতেও মোদি নজিরবিহীন বিক্ষোভের মুখে পড়েন। প্রায় সব বিরোধী দলই সরব ছিল। তাঁরা মোদির সঙ্গে আদানির সম্পর্ক, আদানিদের প্রতারণা, শেয়ারদরে কারচুপি নিয়ে আক্রমণ শানান। রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার পর ধন্যবাদজ্ঞাপন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করতেই বিরোধীরা ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। দল বেঁধে তাঁর সামনে স্লোগান তোলেন— ‘মোদি-আদানি ভাই ভাই’, ‘আদানি কি গুলামি বন্ধ করো’, ‘এলআইসিপে কুছ তো বোলো’, ‘এসবিআইপে কুছ তো বোলো’। প্রায় সওয়া ঘণ্টা ধরে মোদির বক্তৃতা চলে। রাজ্যসভাতেও তাঁর সরকারের আমলে আদানিদের শ্রীবৃদ্ধি, তাদের বিরুদ্ধে শেয়ারদরে কারচুপি ও প্রতারণার অভিযোগ এবং আদানি গোষ্ঠীতে এলআইসি ও স্টেট ব্যাঙ্কের লগ্নি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। দুই কক্ষ মিলিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টার বক্তব্যে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী আদানি-প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন অনেকের মতে, তা তাঁর নজিরবিহীন ঔদ্ধত্য ও নির্লজ্জতার পরিচয়।

শাসক দল যৌথ সংসদীয় কমিটি বা প্রধান বিচারপতির নজরদারিতে তদন্তের দাবি না মানলে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি)-কে এ-বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়। এই ধরনের সংস্থার সর্বোচ্চ পদে যাঁরা নিযুক্ত হন তাঁরা সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছের লোক হন, তা রাজনৈতিক নিয়োগ— এটাই সমাজের ধারণা। সুপ্রিম কোর্ট হয়তো তা জানে না বা মানে না। গত দেড় বছরে তদন্ত প্রায় শেষ, কোনও অনিয়ম ধরা পড়েনি। এক সময় শোনা গিয়েছিল যে, সেবি আদানিদের নানা সংস্থায় ১২টি বিদেশি তহবিলের লগ্নির ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম ভাঙার খোঁজ পেয়েছে। তবে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদেশি ফান্ডের মালিকানা খুঁজে পায়নি।

সম্প্রতি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ জানিয়েছে, তাদের অভিযোগের ঠিকমতো তদন্ত না করার পিছনে সেবি-র পর্ষদ সদস্য ও চেয়ারম্যান মাধবী পুরি বুচের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। ১০ আগগস্ট তারা জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দর বাড়াতে যে বিদেশি ফান্ড ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে মাধবী পুরি বুচ এবং তাঁর স্বামী ধবল বুচের অংশীদারি ছিল। মাধবী ও ধবল দুজনেই তাঁদের বেতন থেকে ওই ফান্ডে অর্থ ঢালতেন। সেবিতে থাকাকালীনই, ২০১৮ সালে নিজের ই-মেল ব্যবহার করে মাধবী ওই ফান্ড থেকে স্বামীর নামের ইউনিট ভাঙিয়েছেন। তিনি সেবির সদস্য হওয়ার পর স্বামী ধবলের লগ্নিকারী সংস্থা ব্ল্যাকস্টোনে যোগ দেন। ওই সংস্থা ভারতে আবাসন, জমি, রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (আরইআইটি)-সহ নানা ক্ষেত্রে টাকা ঢেলেছে। মাধবী সেবির পর্ষদ সদস্য হওয়ার পর আরইআইটির নিয়ম বার বার বদলেছে। আরআইটিতে লগ্নির সুবাদে ব্ল্যাকস্টোন কোম্পানি বিপুল লাভ করেছে। ওই কোম্পানি আবার বেআইনিভাবে লগ্নি করে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারদর বাড়িয়ে দিয়েছিল। বোঝা গেল, মাধবী ও তাঁর স্বামী ধবলের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বলেই সেবি আদানিদের বিরুদ্ধে কোনও অনিয়ম খুঁজে না পাওয়ার কথা বলেছে।

তবে মাধবী এবং তাঁর স্বামী ধবল বিদেশি তহবিলের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের তথ্য ভুল বলে দাবি করেন। এরই মধ্যে সংবাদসংস্থা রয়টার্স হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের বক্তব্য সমর্থন করে জানিয়েছে, সেবির পর্ষদ সদস্য ও চেয়ারপার্সন হওয়ার পরও নিজের উপদেষ্টা সংস্থা আগোরা অ্যাডভাইজরিতে মাধবী তাঁর অংশীদারি বজায় রেখেছিলেন। ওই ভারতীয় উপদেষ্টা সংস্থাটি নানা দেশীয় শিল্পকে পরামর্শ দিয়ে রোজগার করে। ওই কোম্পানিতে তাঁর ৯৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। রয়টার্স জানিয়েছে, রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজের নথি থেকে জানা যায় যে, মাধবী সেবির পদে থাকাকালীন, ২০১৯-২০২২ পর্যন্ত আগোরা অ্যাডভাইজরি ৩.৭১ কোটি টাকা আয় করেছে। সেবি-তে কাজ করা সত্ত্বেও তিনি একই সময় নিজের সংস্থার অংশীদারিত্ব থেকে লাভ করেছেন। সেবি-র ২০০৮ সালের নিয়ম অনুযায়ী বাজার নিয়ন্ত্রককর্তারা লাভজনক সংস্থায় কাজ করতে বা সেখান থেকে বেতন বা অন্য কোনও ফি নিতে পারেন না। তাই এই ঘটনা গুরুতর নিয়মভঙ্গের সামিল। পর্ষদকে না জানিয়েই তিনি তা করেছেন। জানানো হলে সেই অনুমতি পেতেন না।

তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান হিসাবে তাঁর অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সেবির তদন্ত নিয়ে সন্দেহ হয় এর পরিণতিও ‘পেগাসাস’ ম্যালওয়ার, ‘রাফায়েল’ ডিল বা ‘পিএম কেয়ার ফান্ড’-এর মতোই হবে না তো? একের পর এক বড় বড় দুর্নীতি, অথচ তার বিচার নেই। এর শেষ কোথায়? না কি দেশে এভাবেই লুটেপুটে খাওয়াই চলবে? রাহুল গান্ধি তাই আদানি-কাণ্ডে আবার যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্ত দাবি করেছেন। এরই মধ্যে, ২৭ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের জল বিদ্যুৎ ও নদী-উপত্যকা কমিটিতে আদানি গ্রিন এনার্জির এক উপদেষ্টা হিসাবে জনার্দন চৌধরি অভিষিক্ত হয়েছেন। ওই অন্তর্ভুক্তির পর বিরোধীরা আদানির স্বার্থ নিয়ে কথা তোলে। অর্থাৎ সরকার শুধু যে আদানিদের বিরুদ্ধে তদন্তের কথা যেমন কানে তুলছে না তাই নয়, আদানি-সেবার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে। মোদি সরকারের আদানি-সেবার সর্বশেষ উদাহরণ, ঝাড়খন্ডের গোড্ডায় আদানিদের যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত যে বিদ্যুৎ একশো শতাংশই প্রায় দ্বিগুন দামে বিক্রি হতো বাংলাদেশে। ওই দেশের বর্তমান অনিশ্চিত অবস্থায় এবং চড়া দামে তা কেনা নিয়ে প্রতিবাদে আদানিরা যেন বিপাকে না পড়ে, তাই রাতারাতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ আমদানি-রপ্তানির নিয়মাবলি সংশোধন করেছে। কত দ্রুত তা করেছে ভেবে দেখুন! পরিবর্তিত নিয়মে গোড্ডায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন ভারতেও বিক্রি করা যাবে। আদানির জন্য সত্যিই মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।


[1] শর্ট সেলিং হল নিজের কাছে শেয়ার না থাকা অবস্থায় বিক্রি করে, পরে দাম কমলে তা কিনে নেওয়া, অর্থাৎ বেশি দামে বিক্রি করে কম দামে কেনা। শেয়ার বাজারে এক টাকাও বিনিয়োগ না করে এই ভাবে রোজগার করা (বা পুঁজি হারানো) অতি চালু খেলা। এদেশের হাজার হাজার মানুষ তাই করেন। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চকে বলা হয় অ্যাক্টিভিস্ট শর্ট সেলার।


*মতামত ব্যক্তিগত