সংঘমিত্রা ঘোষ
শান্তিনিকেতন যে তার কমফোর্ট জোন ছেড়ে বেরোচ্ছে বুঝতে পারছিলাম। সেদিন আর রাত্রি ১১.৫৫ অবধি অপেক্ষা করতে হয়নি। তার অনেক আগেই মাঠ ভরে গেছিল। অনেক মানুষ সবাই শৃঙ্খলিত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রতিবাদে অনড় শক্ত। তারপর কখন জানি না আমি থেকে আমরা সবাই এক হয়ে গেলাম। একের পর এক গান কবিতা চিৎকার করা স্লোগান এক অন্য শান্তিনিকেতনকে চেনাল। নাকি একটা নতুন সময়ের শুরু হল জানি না
তখনও আমার জন্ম হয়নি। ১৯৭৬ সাল। মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ গল্প আত্মপ্রকাশ করল। দ্রৌপদী গণধর্ষণের শিকার। তার উপর নির্যাতনের মাত্রা এতটা বীভৎস অশালীন হতে পেরেছিল কেবলমাত্র সে নিম্নবর্গীয় অশিক্ষিত আদিবাসী রমণী বলেই।
তারপর কয়েক দশক পেরিয়ে গেছে তবুও যৌন অত্যাচার, ধর্ষণ থেকে মেয়েরা আজও রক্ষা পায়নি।
আজও প্রায় সমস্ত শ্রেণির সমস্ত বর্গের মেয়েরা বড় হতে হতে যৌন অত্যাচারের শিকার হয় নানাভাবে। তারা বড় হতে হতে বুঝে যায় শুধু মেয়ে হয়ে জন্মালেই মেয়ে হওয়া যায় না। পরিবার সমাজ শ্রেণিভেদে প্রতিদিন, প্রতিটি মেয়েকে মেয়ে হয়ে উঠতে হয়।
সেই মেয়ে হয়ে উঠতে উঠতে নিজের নিরাপত্তার জন্য অনিচ্ছাকৃত অনেক সীমা নিজেকেই দিয়ে দিতে হয়। আমরা মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের গণ্ডি কেটে নিই। শুধুমাত্র মেয়ের শরীর হওয়ার জন্য ঘরে বাইরে কত কত অশ্লীল দৃষ্টি স্পর্শ শব্দ থেকে লুকিয়ে বেড়াতে হয় আমাদের।
শুধু মেয়ে বলেই কাজের জায়গায় কতবার পিছনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। মেয়ে বলেই স্বাধীনতা ভাল নয় বলে, কল্পনার ডানা কেটে দেওয়া হয়।
নির্জন রাস্তায়, অচেনা গলিতে দম বন্ধ করে পেরোতে হয়। কত পুরুষকে অকারণ সন্দেহ করতে হয়। ছোট ছোট ইচ্ছে পূরণের জন্য কত লড়াই করতে হয় মেয়েদের শুধু মেয়ে হয়ে জন্মায় বলে।
এমনি এক বোঝাপড়া করে জীবনে বাঁচতে শিখে যায় মেয়েরা।
অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হয়েও তাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় পিতৃতন্ত্রের বেড়ায়। আমরা কমবেশি হয়তো কেউই তার বাইরে নই।
নব্বইয়ে বড় হওয়া আমরা, বিশ্বায়ন-পরবর্তী পৃথিবীতে, আন্তর্জাতিক সময়ে বেঁচে থাকা আমরাও তাই অনেকেই নিজের বৃত্ত ছোট করে নিয়েছি। বড় কোনও ব্যাপারের মধ্যে যাওয়ার শক্তি সাহস পাইনি, রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। জীবনের ছোট ছোট বিষয়, ব্যক্তিগত বৃত্তের মধ্যেই নিজেকে খুঁজেছি। সাদামাটা বৈচিত্রহীন জীবন কাটাতে চেয়েছি। বাধ্য না হলে রাতের বেলা একা কখনও বাড়ি ফিরিনি। যেখানে নিরাপত্তার অভাব অনুভব করেছি ভাই, বন্ধু, অভিভাবক ছাড়া সেখানে যাইনি।
পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতা, আস্ফালন আক্রমণ থেকে নিজেকে আড়াল করে মুক্তি যতটুকু পেয়েছি তাতেই সন্তুষ্ট থেকেছি।
তবুও বোধহয় কারও পক্ষেই তার দেশ, সময়, পরিবেশ বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ জীবন কাটানো সম্ভব হয় না।
কখনও কখনও সময়ে আচমকা এমন ঝড় আসে, এমন ঘটনার সাক্ষী করে দেয়, নিজের চৈতন্যের খাঁজে খাঁজে অস্থিরতা ঢুকে যায়।
আরজিকর-এর মেয়েটির ঘটনাও তেমনি। সোশাল মিডিয়ার, নানা সংবাদমাধ্যমের তথ্যে, মেয়েটির উপর হওয়া নির্যাতনের বীভৎসতা আমাদের হাড় হিম করে দিয়েছে। নিজের কাজের জায়গায়, ভরসার জায়গায় ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটি করে, খাবার খেয়ে ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিতে গিয়েছিল মেয়েটি। তারপরের ঘটনা সবার জানা। পরিকল্পিত ধর্ষণ খুন। একজন নয় একাধিক ব্যক্তি জড়িত।
গ্রাম নয়, মফস্বল নয় ব্যস্ত মহানগরের সরকারি হাসপাতালে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। তারপরে সব অপরাধ চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা, অপরাধীদের আড়াল করার প্রচেষ্টা আর এক গভীর অন্ধকারের সামনে নিয়ে এল আমাদের।
বুঝলাম ক্ষমতাই শেষ কথা। স্পষ্ট বুঝে গেলাম রাষ্ট্র তার ক্ষমতা দিয়ে যাদের প্রোটেকশন দিতে চায়, তার বাইরে আমরা সকলেই গুরুত্বহীন, অপ্রয়োজনীয়।
দুর্নীতি, লোভ, ক্ষমতার নৃশংস বীভৎসতার প্রভাবে যে কোনও অন্যায়ের বিচার না হতে পারে। উলটে ভিকটিমের আচরণ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে।
নব্বইয়ে বড় হওয়া, গ্রাম মফস্বলে জন্ম হওয়া আমাদের জীবনে বিশ্বায়নের প্রভাব সরাসরি পড়েনি তেমন। আমরা জেনেছি রাত মানে ভয়। সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফিরতে হয়। খুব প্রয়োজন হলে কাউকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ মিটিয়ে আসতে ফিরে আসতে হয়। ঘরে খিল আটকে বসে থাকতে হয়।
রাতের বেলা মামা মাসি পিসি জাতীয় আত্মীয় ছাড়া, বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটানোর অনুমতি পাওয়া যায় না।
সন্ধের পর বাড়ি ফেরা মেয়েদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে সমাজ। যুক্তি দিয়ে ভেবে পাই না নিজের ব্যক্তিগত যাপন রাতে আর দিনে আলাদা কী করে হয়। রাতের বেলার বন্ধ দরজা কী আটকাতে পারে?
তবুও এসব অনেক ভয়, যুক্তিহীন শেকল শরীরে জড়িয়েই মেয়েরা, আমরা উড়তে চাই, উড়ি। তারপরও যখন নিরাপত্তা পাই না তখন সেইসব অতীতের ভয়, ঘৃণা থেকে জন্ম নেওয়া অভিমান, অভিযোগ ক্ষোভ প্রতিবাদ হতে চায়। আমাদের ট্রিগার করে। যন্ত্রণা হয়। ছটফট করি।
কিছু করতে ইচ্ছে হয়, ঠিক সেই সময় বার্তা আসে একটা রাত দখলের।
স্বাধীনতার মধ্যরাতে নারীস্বাধীনতার জন্য নারীদের রাত দখল করার প্রতীকী আহ্বান।
আমাদের নিজেদেরই নিজেদের কর্তা হতে হবে। কারও কাছে রক্ষালাভের নিরাপত্তার প্রত্যাশা না করে নিরাপত্তা অর্জন করে নিতে হবে।
কীভাবে জানি না, কোন আশায় জানি না, কলকাতা শহর থেকে দূরে শান্তিনিকেতনে বসে রাতদখলের পরিকল্পনা করে ফেলি কয়েকজন মিলে।
তখনও মনে সংশয় ছিল। কোনও রাজনৈতিক দল নয়, ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান নয়, শুধুমাত্র সমাজমাধ্যমে মহানগরের ডাক এই শহরে ক-জন শুনতে পাবে!
বিশেষ করে জায়গাটি যখন শান্তিনিকেতন। যেখানে এমনি তাড়াতাড়ি রাত নামে। আটটা বেজে গেলে রাস্তা ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে যায়। সেখানকার মানুষ স্বভাবতই নির্ঝঞ্ঝাট নিরুপদ্রব জীবন কাটান। খুব প্রয়োজন না হলে কখনওই অশান্ত হন না। তাদের প্রতিবাদের ধরন আলাদা। তারা কি আসবেন এই ডাকে!
ফেসবুক পোস্টে রাতদখলের ডাক পেয়ে কতজন হাসল, টিপ্পনি দিল, কতজন জল মাপতে ফোন করল, কতজন ভেস্তে দেওয়ারও বুদ্ধি দিল।
কিন্তু তারপরেও দেখলাম সেই রাতদখলের ডাক একটু একটু করে ছড়িয়ে গেল গোটা শহরে।
১৩ আগস্ট রাতেও মাথা গুনেছিলাম আমরা। ব্যক্তিগত বন্ধুবান্ধব পরিচিতদের মনে করাচ্ছিলাম, অনুরোধ করছিলাম ফোন করে। এর মধ্যে অনেকেই সমাজমাধ্যমে যোগদানের কথা জানাচ্ছিলেন। জমায়েত শেষে মেয়েদের নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও নিচ্ছিলেন কেউ কেউ। ১৪ আগস্ট এই আহ্বান যখন গোটা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল তখন কিছুটা নিশ্চিত লাগছিল।
শান্তিনিকেতন যে তার কমফোর্ট জোন ছেড়ে বেরোচ্ছে বুঝতে পারছিলাম। সেদিন আর রাত্রি ১১.৫৫ অবধি অপেক্ষা করতে হয়নি। তার অনেক আগেই মাঠ ভরে গেছিল। অনেক মানুষ সবাই শৃঙ্খলিত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রতিবাদে অনড় শক্ত। তারপর কখন জানি না আমি থেকে আমরা সবাই এক হয়ে গেলাম। একের পর এক গান কবিতা চিৎকার করা স্লোগান এক অন্য শান্তিনিকেতনকে চেনাল। নাকি একটা নতুন সময়ের শুরু হল জানি না।
শুধু তারপর মনে মনে বলছি,
একলা মেয়ে একলা নয়
লক্ষ মেয়ে রাত্রি জয়।
বুঝতে পারছিলাম ধরে ধরে থাকার বেঁধে বেঁধে থাকার সময় হয়েছে। একটা আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। মানুষ যখন একা থাকে তখন সব সময় নিজের শক্তি বুঝতে পারে না। মেয়েরা এখন বুঝতে পেরেছে নিজেকে সুরক্ষিত করতে গেলে ক্ষমতার প্রয়োজন। আর সেই ক্ষমতা নিজেদেরই আধিকার করতে হবে। জোট বাধতে হবে তাদের। জোট বাধলেই সাহস বাড়ে ভয় ভাঙে। মুখ ফোটে। একমাত্র একজোট হলেই আবার বাঁচার ইচ্ছে হয়। এখন আমরা মেয়েরা একজোট হয়ে বিচার চাইছি। মেয়ের অধিকার নয় একজন মানুষের মানুষ হয়ে স্বাধীনভাবে, ইচ্ছেমতো বাঁচার অধিকার চাইছি।
*মতামত ব্যক্তিগত