Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মেয়েদের বিচারের লড়াই চলুক মেয়েদেরই নেতৃত্বে

রূপকথা চক্রবর্তী

 


যুগের পর যুগ ধরে সামাজিক নীতিবোধের সঙ্গে আপস করে তার ধারকে ভোঁতা করে দিয়েছে যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, যা প্রশ্ন করা থেকে আমাদের বিরত রাখে, অত্যাচারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শেখায়, আজও চলা-বলা-ধরন-ধারণের উপর কড়া নজরদারি চালায় যাতে ধর্ষণের খবর পেলে মেয়েটির পোশাক ও সে রাতে একা বাইরে কী করছিল তার কৈফিয়ত চায়, তার সামনে আজ মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টাও কি বিফল হবে না? এ তো প্রথম প্রতিবাদ নয়, তবে? তখন মনে পড়ে, মেয়েদের ইতিহাসটা খানিকটা এরকমই— অধিকার ছোট, বড় প্রতিবাদের মাধ্যমে ছিনিয়েই নিতে হয়েছে চিরকাল

 

মেয়েরা রাত দখল করো— তাই করতেই তো গিয়েছিলাম! চেয়েছিলাম ভয়, আশঙ্কা, অনিশ্চয়তার শত শত রাতের মধ্যে একটা, শুধু একটা রাতে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় নির্ভয়ে, গলা ছেড়ে চিৎকার করে সেই একটাই রাতে নিরাপদ থাকার অধিকার ছিনিয়ে নিতে। কিন্তু ভোর তিনটেতে যখন বাড়ি ফিরলাম অবশেষে, আদৌ তা করতে পারলাম কিনা, তাই নিয়ে উত্তরের চেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন ঘিরে ধরল বেশি।

কলকাতায় ১৪ আগস্ট রাতের জমায়েতের জন্য তিনটি মূল কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়— কলেজ স্ট্রিট, অ্যাকাডেমি এবং যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড। পাশাপাশি আরও অনেক জায়গায় ছোট-বড়-মাঝারি মাপের সমাবেশের আয়োজন হয়। বন্ধুদের অনেকের মুখে শুনি, বাড়িতে বেশ তর্ক-বিতর্ক চলেছে সেদিন বাড়ি থেকে বেরোনোর অনুমতি পেতে। আমাকে, সেখানে, বলতেই হয়— বাধা তো দেওয়া হয়ইনি, বরং মা-ই প্রথম আমাকে এই উদ্যোগটির কথা জানান এবং একসঙ্গে যাওয়ার কথা বলেন।

সে-রাতে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল বাড়ির কাছের হরিনাভি। সোনারপুরেও একটা সভা হচ্ছিল বলে খবর পেয়েছিলাম, যদিও যাব বলে ঠিক করলাম এখানেই। পৌঁছেই ছোট একটা মঞ্চ এবং চারপাশের তুমুল ভিড়ের মধ্যে দেখতে পাই অগুনতি মহিলাদের মুখ। আরেকবার বুঝতে পারি এই হত্যার মর্মান্তিক বর্বরতা শহর এবং দেশের নারীদের ঠিক কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাদের সকলের চোখের ক্রোধ, ভয়, দুঃখ দেখলে যেন এক মুহূর্তের জন্য সহজেই ভুলে যাওয়া যায় যে প্রাণ হারালেন যিনি, তিনি সেই অর্থে এঁদের কারও ‘আপনজন’ ছিলেন না। তবে আদি-অনন্তকাল জুড়ে একটি ক্রমান্বয়ে নির্যাতিত গোষ্ঠীর আন্তঃসম্পর্কের যে বুনোট, তা হয়তো-বা রক্তের চেয়ে অনেক গভীর।

গান এবং কবিতাকে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়ে তার পরিবেশনের সময় অনেকের চোখে জল আসছিল, কেঁপে উঠছিল গলা— তবে পরমুহূর্তেই রাতের আকাশ কাঁপিয়ে তোলা ‘বিচার চাই’-এর আর্তনাদ মনে করিয়ে দিচ্ছিল— তীব্র যন্ত্রণার পাশাপাশি এই প্রচণ্ড অপরাধ নারীদের মনে যে অনুভূতি সবচেয়ে প্রকট করে তুলেছে সেটা রাগ। অবিমিশ্র, অদম্য, মরিয়া রাগ।

 

সেই জমায়েত ছেড়ে যখন যাদবপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, তখন ঘড়ির কাটা সদ্য এগারোটা পেরিয়েছে। গাড়ি রাখতে হল বেশ দূরেই, এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম পার করে যাদবপুর স্টেশন রোড ধরে বাকি পথ চলা হল পায়ে হেঁটেই। ৮বি মোড়ের আগে পৌঁছতেই দেখলাম অসম্ভব ভিড়— সেটাই প্রত্যাশিত ছিল, হয়তো কাঙ্ক্ষিতও। তবে যার আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নেও করিনি, তার হদিশ মিলতে থাকে পরমুহূর্ত থেকেই। দেখি আমাদের চারিপাশে মহিলার চেয়ে পুরুষের সংখ্যা ঢের বেশি— এবং লজ্জার কথা। তাঁদের অনেকের ব্যবহারেই না-দেখলাম প্রতিবাদের প্রতি সমর্থন, না তাঁরা রাখলেন ন্যূনতম ভদ্রতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনে থেকে প্রবল ধাক্কা অনুভব করতে থাকি সকলে— ফিরতি মানুষের ঢল আমাদের পিছিয়ে দিতে থাকে। এমনি সময় কানে ভেসে আসে নানারকমের ব্যঙ্গ ও কটূক্তি। হাওয়া ভরে ওঠে মদের গন্ধে, ঘিরে ধরে অতিপরিচিত-অপরিচিতের ভয়— এই বুঝি কারও হাত ভিড়ের সুযোগ নিয়ে স্পর্শ করল! মনে হতে থাকে, যেমন করে সম্ভব আমাদের একটা নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো দরকার। যেভাবে হোক ওই প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসা দরকার!

এমন সময়ে শুনতে পাই আমাদের সঙ্গে থাকা আমার মাসির তীব্র প্রতিবাদ, মদ্যপ দুষ্কৃতিদের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে। বিশ্বাস করুন, তাতে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়ার কথা স্বীকার করতে লজ্জা করছে— অজান্তেই মনের মধ্যে ভেবে উঠি, মাসিকে বলা উচিত মাথা ঠান্ডা করে আগে বেরিয়ে আসতে। ওখানে কেন গেছি এই কথা ভেবে পরমুহূর্তেই লজ্জা পাই। কেন চুপ করবে মাসি? চুপ তো করার কথা নয়! যারা ওই প্রচণ্ড বেসামাল অবস্থাতে মেয়েদের অধিকার দখলের রাতে এসে স্বভাবত বিরক্ত করতে ছাড়েনি, চুপ তো তাদের করার কথা!

রাত যত বাড়তে থাকে, নানা সংবাদমাধ্যম এবং সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি যে এইরকম অভিজ্ঞতা সারা রাজ্যের বিভিন্ন মিছিলেই মেয়েদের হয়েছিল। অনেক জায়গায় খবর পাওয়া যায় মেয়েদের নেতৃত্ব অস্বীকার করে স্লোগান তুলছে ছেলেরা, নিজেদের দলে দলে জায়গা করে নিতে মেয়েদের ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে, ব্যঙ্গ করে রাস্তায় একা পেয়ে মেয়েদের ঘিরে ধরে “কই, একটু স্লোগান দাও দেখি, তোমরা কেমন প্রতিবাদ করতে পারো!” বলে হুমকি আর টিটকিরি দিয়েছে। তবে এই সবটার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খবর আসে মধ্যরাতে— বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী প্রিয়াঙ্কা হাঁসদার হত্যার খবর, রাজ্য-জুড়ে মেয়েদের রাতদখলের মিছিল চলাকালীন যার নিথর, রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হয় শক্তিগড়ে। এক মুহূর্তের জন্য সেই উন্মত্ত রাতেও প্রচণ্ড প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষা অতিক্রম করে আমাদের সকলের মধ্যেই জেগে ওঠে আবারও, সেই একই ভয়, সন্দেহ, পরাজয়।

যুগের পর যুগ ধরে সামাজিক নীতিবোধের সঙ্গে আপস করে তার ধারকে ভোঁতা করে দিয়েছে যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, যা প্রশ্ন করা থেকে আমাদের বিরত রাখে, অত্যাচারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শেখায়, আজও চলা-বলা-ধরন-ধারণের উপর কড়া নজরদারি চালায় যাতে ধর্ষণের খবর পেলে মেয়েটির পোশাক ও সে রাতে একা বাইরে কী করছিল তার কৈফিয়ত চায়, তার সামনে আজ মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টাও কি বিফল হবে না? এ তো প্রথম প্রতিবাদ নয়, তবে? তখন মনে পড়ে, মেয়েদের ইতিহাসটা খানিকটা এরকমই— অধিকার ছোট, বড় প্রতিবাদের মাধ্যমে ছিনিয়েই নিতে হয়েছে চিরকাল। পুরুষ সেখানে সহযোগিতা করে থাকলেও, মেয়েদের দায়িত্ব নিতে হয়নি কোনওদিন। আসলে, “ভাল মেয়ে”, “আদর্শ নারী” ইত্যাদি হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় আমরা বোধহয় অজান্তেই নিজেদের কণ্ঠ, নিজেদের আত্মমর্যাদা সবটুকুর দখল একটু একটু করে ছেড়ে দিই। যেখানে আজও নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বর তুললে পুরুষতন্ত্রের বুটজুতো পূর্ণশক্তি দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে, সেখানে নিজেদের সঙ্গে ভুল হচ্ছে জেনেও, প্রতিবাদ করা উচিত বুঝেও চুপ করে থাকি। কেন? আমাদের কি শুধু এই শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়েছে, নাকি অজান্তেই ‘ভাল মেয়ে’দের জন্য সমাজের পুরনো পাঠ আমাদের মায়েদের প্রতিবাদ ছাপিয়ে আমাদেরও বিবেককে গ্রাস করেছে? শিখিয়েছে যে অগ্রগতি, অধিকার চাইলেও তার দাবি জানাতে হবে সমাজনির্ধারিত শালীনতা, পরিমিতি বজায় রেখে?

বুকে আগুন জ্বলে ওঠে।

নীরবতাকে সম্মানরক্ষার অপর নাম হিসেবে ধরে নেওয়া হবে যতদিন, রাত দখলের লড়াই বোধহয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, আমাদের সমস্ত অধিকার তিলে তিলে ফিরিয়ে নেওয়ার লড়াই অসমাপ্ত থেকে যাবে।

 

এরপর মধ্যরাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মেয়েদের সমবেত কণ্ঠে স্লোগান এবং গান জানান দেয়— দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভয় মিটতে তো বহু দেরি, আমাদের প্রতিবাদের মিছিল শুরু হোক আমাদের নির্ভয়ে, নিরাপদভাবে যোগদানের অধিকার দিয়ে। সেই প্রতিবাদেই পুরুষের প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া নিমন্ত্রণের অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে মেয়েদের অধিকারের, বিচারের, সুরক্ষার লড়াই শুরু হোক মেয়েদেরই নেতৃত্বে, মেয়েদের গর্জনে— এ আগুন জ্বলুক, এ আগুন যেন কোনওদিন নিভে না যায়।


*মতামত ব্যক্তিগত। সমস্ত ছবি লেখকের তোলা