সুবীর সরকার
‘বাচ্চা বাপই সোনার চান
গরু দুইটা আইলত বান্ধ’
কইকান্তকে রাধাকান্তর দিকে হেলে পরতে হয়। চোখে চোখ রাখতে হয়। জনমভরের এ এক আবশ্যিকতাই হয়তো বা। তাদের অন্তরঙ্গতা দেখে পাখপাখালিরা উড়াল দেয়। সোমেশ্বরী তখন আন্ধনঘরের ভেতর তেলহলুদের এক দিনদুনিয়া নিয়ে পুরনো গল্পের দিকে নুতন গল্পগুলিকেই এগিয়ে দিতে থাকে। এগিনায় হেঁটে বেড়ানো হাঁসমুরগির দল তখন জীবনের জেগে ওঠাকেই যথাযথ করে তুলতে থাকে। গোহালের বুড়ি গাইয়ের হাম্বা ডাকের সঙ্গে খিলচাঁদ খামারুর চটকা গান মিশে যায় —
‘ওরে ধলা মুরগিটা
বাচ্চা ফুটাইছে
ওরে বগিলা চিলাটা
উড়িয়া রে যাছে’
উত্তরের লোকজীবনের ছন্দে ছন্দে এভাবেই সংসারের মায়া সাজাতে থাকে সোমেশ্বরীরা। বুঝি হলখল কাশিয়ার বন। হালাউ হালাউ দুধের ঘটি।
২।
দিনের পিঠে দিন যায়। শীতের জেগে ওঠা নদীর বিশাল সব চরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ময়নামতী কত রকমের পাখি দেখে। ফড়িং-এর পিছে পিছে, প্রজাপতির পাখনায় চলকে যাওয়া সোনা রোদের বাহার দ্যাখে। ময়নার জীবন জুড়ে চারপাশের এই ব্যাপ্ততা একধরনের শূন্যতা এনে দেয়। সে বুঝি বিষাদময় মেঘরোদের এক বহতা জীবনকে নিজের সমস্তটুকুর ভেতর তীব্রভাবে প্রবেশ করাতে থাকে। আর তার শরীরের খুব গোপন থেকে জেগে উঠতে থাকে কেমন এক বুক খালি করে দেওয়া গান —
‘তোমরা যাইবেন অংপুর মইশাল ও
ও মইশাল কিনিয়া রে আনিবেন কি
ও কি বাচ্চা বাপইর নাল বটুয়া
মোরও দাঁতের মিশি মইষাল ও’
গানের ভিতর রংপুর। কোথায় পড়ে থাকছে সেই রংপুর। এত এত দূরে থেকেও ময়নামতী তো গাইতে পারে, নাচতে পারে, সেই রংপুরের গানের দোলায় দোলায় ভেসেও যেতে পারে হয়তো বা! সে কি তবে তার মাও সোমেশ্বরীর আন্ধনঘরের দিকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে গেয়েই ফেলে —
‘ও রে অংপুরত হামার বাড়ি
যুবা বয়সের মুই চেংড়ী
কি দেখেন মোর
মুখের ভিতি চায়া’
এতসব ঘটে। ঘটতে থাকে। আর ময়নার চোখের সামনে ভাসতে থাকে রঙ্গরসে ভরা সেই এক মস্ত শহর রংপুর।
৩।
রাধাকান্ত কইকান্তকে ইশারা দিতেই কইকান্ত দেখে ফেলল আবারও দুই কুড়ি সাত বছর বাদে দিনদুপুরেই জমে ওঠা মস্ত এক গানবাড়ি। মেলা মানুষজন। ঢোলকাশিবাঁশিদোতোরার সুরে সুরে বাদ্যবাজনায় ভরে ওঠা। নানান রঙের রঙ্গিলা দালানবাড়ি যেন। তখন দূরের সেই দলদলির হাট মুছে যেতে থাকে। গরুর গাড়ি থেকে নেমে পড়ে কইকান্ত আর রাধাকান্ত। তারা পরম বিস্ময়ে দেখে ফেলল এত এত দিন, এত এত সময় পেরিয়ে তাদের থেকে মাত্র হাতকয়েক দূরেই দাঁড়িয়ে আছে কুদ্দুস আর ইয়াসিন। পরস্পরের মুখোমুখি হতেই হল তাদের। কিছুটা সময় এই দুনিয়ার কোথাও কোন শব্দ নেই। তারপর কইকান্ত আর রাধাকান্তর বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কুদ্দুস আর ইয়াসিন। সে এক বারংবার রচিত গল্প। গল্পের পাকে পাকে এ এক চিরকালীনতাই বুঝি! ভরা দুপুরের সেই গানবাড়িতে তখন গান বাজে, বাদ্যের বাইজনের সাথে নাচতে থাকে সোমেশ্বরী হলদিবালা ময়নামতী —
‘বারো মাসে তেরো ফুল ফোটে
বছরে ফোটে হোলা সই
তোমরা না যাইও যাইও
না যাইও সই লো
ওই না যমুনার জলে’
উত্তরের পথে পথে টাঁড়িতে টাঁড়িতে এভাবেই আবহমানের সব আখ্যান রচিত হতেই থাকে।
৪।
পেছনে তখন পড়ে থাকছে দলদলির ভরা হাট। কত কত মানুষের, চেনা অচেনার এক চারণভূমি। কইকান্ত আর রাধাকান্তর তখন গরুর গাড়ির দুলুনিতে কেমন এক ভ্রমবিভ্রমের নেশার পাকে জড়িয়ে পড়বার দশা হয়। না কি, তারা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তে থাকে। একটা চলমান জীবনের দীর্ঘতাকে তারা অতিক্রম করে আসতেই থাকে। বামনডাঙ্গার সেই রাতের আন্ধারে মিশে থাকা আহত চিতাবাঘের হাহাকার থেকে সোমেশ্বরীর বিবাহনাচের দলে তুমুল নাচতে থাকার দৃশ্য ভরা হাটের ওপর উড়তে থাকা বগিলার মতন কেবলই পাক খেতে থাকে। ঘুমে ঢলে পড়বার আগে তাদের কানে এসে বাজে গান —
‘চিলমারিয়া চিকন চিড়া
দিনাজপুরের খই
ও রে, অংপুরিয়া বাচ্চা বাপই
কুড়িগ্রামের দই’
জীবনের ওঠাপড়ার দিকে বারবার যেতে যেতে অনন্তের এক যাপনের কাছেই তো কইকান্তদেরকে যেতে হয়। আসা ও যাওয়ার ভিতর উত্তরাঞ্চলের হাটগঞ্জপাথারনদীমেঘ ও মইষাল মিশে থাকে। ধানপাটসরিষার খেতে সাদা বকের দল, শালিকের দঙ্গল, খোরা জালে বন্দী ঝাঁক ঝাঁক মাছ সব নিয়ে মানুষের আবহমানের জীবনযাপন। নদী নদী ফরেস্ট ফরেস্ট এক জীবনে কেবলই জুড়তে থাকে উত্তরের নোলোক পড়া মেয়েদের গান —
‘ঘাড়ত কেনে গামছা নাই
গামছাবান্ধা দই নাই
হাত্তির পিঠিত মাহুত নাই
মাহুতবন্ধুর গান নাই
দাড়িয়াবান্ধা খেলা নাই
বড় গাঙত পানি নাই
ও রে, আজি মন কেনে মোর
উড়াং রে বাইরাং করে’
৫।
কুদ্দুস,ইয়াসিনদের কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে গেল ধলা গীদালের কথা। ৫০/৮০ মাইলের ভিতর যত হাট, যত গাঁ গঞ্জ, যত ফরেস্ট সবখানেই মিথের মতন এই ধলা গীদাল। বাবরি চুল, কপালে অজস্র কুঞ্চন, হাতির দাঁতের চিরুনী চুলে ছুঁইয়ে তার কিসসা বলা, আর দোতোরা বাজিয়ে সর্বশরীরে দুলুনি এনে গান শুরু করা উত্তরের এত এত জনপদগুলিতে তাকে ঘন জঙ্গলের প্রাচীন শালগাছের মতন উপাখ্যানের নায়ক করে তুলেছে। আর হাটে হাটে তাকে নিয়ে যে কত কত উপকথা ঘোরে, তার ইয়ত্তা নেই। আজ পঞ্চাশষাট বছর ধরে এমনই হয়ে আসছে। গানে গাঁথায় তার বুনে যাওয়া কথাকিসসায় আস্ত এক সময় ও উত্তরের ভুবনজোত। হাতিজোতদারের বাড়ির ডাকাতির গল্প বলো, কোচবিহারের রাজকুমারের সেই মহাশিকার বলো, রাজকুমারী নীহারবালার বিবাহে দু রাত্তিরের গানপালার আসর বলো, কালজানি নদীর সেই ভয়াবহ বন্যা বলো, ঝামপুরা কুশানীর কুশান গানের যাদুতে আটকে থাকা বলো, জল্পেশের ভরা হাটের সেই সিজিলমিছিল বলো — সব সবকিছুই ধলা গীদালের আখ্যানের জরুরী অংশ হয়ে পড়ে। সে তার দল গড়েছে কত কত বার। কত কত গীদালের গুরু সে। কত বাবুর ঘরের জ্ঞানী মানসি, খবরের কাগজের বাবুর বেটা, কত সিনেমার মানসি তাকে নিয়ে কাজ করতে চেয়েছে। দ্যাশ বইদ্যাশে নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু কোনকিছুতেই ধলা গীদালের মন জয় করতে পারেনি তারা। ধলা গীদাল এই হাটটাট গঞ্জগাঁ নদীমাঠের জঙ্গলের ছায়ায় ছায়ায় কেবল থাকতে চেয়েছে, আদিঅনন্ত আবহমানের এক জীবনজড়ানো উত্তাপজড়ানো জীবনের ভেতরেই। তার হাসিমুখের কুঞ্চনে সে কেবল গেয়েই চলেছে জীবনেরই গান —
‘ধান কাটে ধানুয়া ভাইয়া রে
ও জীবন, ছাড়িয়া কাটে ও রে নাড়া
সেই মতন মানুষের দেহা
পবন গেইলে মরা জীবন রে’
৬।
আস্ত একটা জীবন নিয়ে কী করে মানুষ! এই জিজ্ঞাসাই কি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মানুষকে! জীবন যাপন করতে করতে কি ক্লান্তি জমে! ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গিয়ে কি এক খোঁজ পীড়িত করতে থাকলে তখন তো আর পলায়ন ছাড়া কোন উপায় থাকে না। সেরকম এক উপায়হীনতা থেকে ফরেস্ট ফরেস্ট হেঁটে হেঁটে কুদ্দুস ও ইয়াসিন এক কুড়ি সাত বছর আগে চলে গিয়েছিল আসাম দেশের এক বাথানে। কিন্তু তাদের সর্বশরীরে মিশেই ছিল উত্তরের সব নাচ, সব গান, সব গানবাড়ি, রাতের পর রাতের সব গানপালার আসরগুলি। আর ছিল ধলা গীদাল। তার এত এত সময় ডিঙিয়ে আবার ফিরতে হল তাদের। আর এই ফেরাকে উৎসবের মর্যাদা দিতে মধ্য হাট থেকেই আজ ফিরতে হচ্ছে রাধাকান্ত আর কইকান্তকে। এসবের ভিতর সাজিয়ে রাখা থাকছে গানের পর গান —
‘ছাড়িয়া না যাইস রে
বুকে শ্যালো দিয়া
তুই সোনা ছাড়িয়া গেইলে
আদর করিবে কায় জীবন রে’…
৭।
কুদ্দুস ও ইয়াসিনের কত কত সময়াতীতের পরে আবার দেখা। কত পালটে গেছে ওরাও। সময়ের হাওয়ায় হাওয়ায় জীবন সব হিসেব আদায় করে নেয়। দেখাসাক্ষাতের পর্বটা তুমুল আবেগময় হয়ে উঠল। চোখের জল, মন কেমন, কিঞ্চিত মানঅভিমান আর লজ্জা এসে কুয়াশার মতন ঢেকে দিল একসময় সব। তারপর চারপাশ থেকে বাদ্য বাজতে শুরু করল। কোমরে আঁচল জড়িয়ে মেয়েরা শুরু করল নাচ আর নাচ। আবোর ঘর ঘুরে ঘুরে নাতিপুতিদের সাথে রঙ্গে রঙ্গে মুখরিত এক দিনদুনিয়ার জন্ম দিতে দিতে আস্ত এক গানবাড়িতেই হামলে পড়ল। দশ কুড়ি গ্রামগঞ্জের দিকে উড়ে যেতে থাকল গানের পর গানের সুর, নাচের ও বাদ্যের উৎসবগাথাও —
‘দেখরে মোর ঢক আবো
কেমন রে সোন্দরী
বোঁচা নাকত নথ পিন্ধিছে’
একসময় এই গাননাচের পাকেই আবার জড়িয়ে যেতে হল কুদ্দুস ও ইয়াসিনকে। তার পুর্বজন্ম থেকে আবার তীব্র লাফে, মত্ত হস্তির বলে, ডোরাকাটা চিতার ঝাপিয়ে পড়বার মতন রো রো চিৎকার করে একেবারেই গানবাড়ির মাঝে এসে দাঁড়াল; শরীরময় নাচের হিল্লোলে আবার গানের বাদ্যের এক যাদু ফিরিয়ে আনতে থাকল উত্তরের এই আবহমান দেশদুনিয়ায়।
৮।
সেই ফিরে আসবার পরে কত কত দিন অতিক্রান্ত এক সময়ে এক শীতের সন্ধেতে রাধাকান্ত ও কইকান্ত গায়ে ভারী শাল জড়িয়ে শালকুমারের গিরি জোতদারের বাড়ি থেকে তালুকমুলুকের গল্পগুলিকে নিয়ে ফিরছিল নয় এগারো হাটের এক শালজঙ্গলের মধ্য দিয়ে, তাদের দুপুরের অতিভোজনের ফলজাত রসস্থ শরীর মহিষের গাড়ির দুলুনিতে এসে পড়া আলস্য ও অন্যমনস্কতা ভেঙ্গে দিয়ে কোথাও যেন ডুকরে কেঁদে ওঠা বাঘের ডাক তাদেরকে সচকিত করেই ফেলল; গাড়িয়াল গতি আনতে চাইলেও ভয়ে পেয়ে গুটিয়ে যাওয়া মহিষেরা স্থির দাঁড়িয়ে পড়ে। ভীত হওয়া ছাড়া তো আর কিছু করার নেই। তারা চুপচাপ বসে থাকে ছইয়ের তলায়। কত দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেল এইভাবে। অন্ধকার শীতরাত। ঘন হচ্ছে কুয়াশা। শিশিরের শব্দ। এই শালজঙ্গল শেষ হলেই তো আবার সেই ধাইধাইবিটের ফরেস্ট। উত্তরের হাতি বাঘ বাইসন নিয়েই তাদের ঝুঁকির জীবন। কইকান্ত রাধাকান্তর দিকে তাকাল। তারপর নিয়তির হাতে সব ছেড়ে দিয়ে তারা তামাকুসেবনে মনোযোগী হয়ে পড়ল। এমন কত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে জনমভর। অবশ্য এখন শরীরে তারুণ্য নেই। সাহস কমে গেছে। একসময় বাঘের ডাক দূরে সরে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়েই গেল। আর মহিষেরা স্থিরতা পেয়ে গেল। গাড়িতে গতি এনে ফেলেই শরীরের পেশীতে কম্পন তুলে গাড়িয়াল গেয়ে উঠল গান —
‘হামার দ্যাশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায়
ফান্দে পড়িয়া বুড়া বাঘা কান্দে রে রূপা রায়’
বাড়ি ফেরার পরে এই গল্প পল্লবিত হতে হতে অনেক অনেক সময় পেরিয়ে সেই আহত বাঘের কান্নায় গুমরে ওঠা শালফরেস্টের নাম পালটে হয়ে উঠেছিল ‘বাঘাকান্দির টাড়ি’।
৯।
সোমেশ্বরীর খুব মনে পড়ে বাবার দেশের সেই সব কুরুয়া পাখির কথা। শরীরে মরণ জাগিয়ে উদাসীন হতে থাকা বড়বাবার কথা। এই সব শীতের দিনে সোমেশ্বরীর অদ্ভূত উদাসীনতা জাগে। সে তখন একা একাই নিজের মতন গান ধরে, যদিও সেই গানের শ্রোতাও একমাত্র সে —
‘ও কি ও মোর ভাবের দ্যাওরা রে
থুইয়া আয় মোকে তুই বাপ ভাইয়ার দ্যাশে’
এই মাইল মাইল মাঠখেতপাথারবাড়ির ভিতর, নদী জঙ্গল সরিষার হলুদ বিস্তারের ভিতর, মেলা উৎসব গাননাচের ভুবনের ভিতর বেঁচে থাকতে থাকতে সোমেশ্বরী কিন্তু জীবনের খুব গভীরতাতেই তার জীবনকে জন্মভর মেলে দিতেই থাকে আর গানে গানে সে তার বেঁচে থাকতে চাওয়ার তীব্র এক আকুতিকেই উত্তরের হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে থাকে —
‘আরে হাত্তি মার্কা কেরাসিন কায় বা আইনছেন দ্যাশতে
বাপ রে বাপ মাও রে মাও আজি গাও ঝমঝম করে রে’
জন্মমরণের ভিতর আর কিছু নয়, কেবল জীবন জেগে থাকে!