Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন”

বর্ণালী কোলে

 


কথা বলুক নারীরা। হাঁটুক নারীরা। নির্ভীকতায়। সোচ্চার হোক তারা তাদের দাবিতে। গৃহে, কর্মস্থলে, সম্পর্কে তারা স্বাধীন হোক। তারা এগিয়ে যাক আলোর দিকে দৃপ্ত পায়ে। একদিন হবে জয়। ইতিমধ্যে একটা বড় বিজয় তারা করে ফেলেছে চোদ্দই আগস্টের রাতে, সেই জয়যাত্রা অব্যাহত থাক, সেই রাতদখলের রাতের স্বপ্নের মতো অজস্র রাত্রি লিখিত হোক আবার। লিখিত হোক জাগরণ, লিখিত হোক বেঁচে থাকা

 

একটি নারী। সেমিনার হলে শায়িত। ওপরের পোশাক ছেঁড়া। নিম্নাঙ্গে বস্ত্র নেই। চোখের কোণে রক্ত। ঠোঁটের কাছে চাপচাপ রক্ত। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত। যৌনাঙ্গ ছিন্নভিন্ন। মেয়েটির পিতামাতার কাছে খবর গেল তাঁদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এই কথা সংবাদমাধ্যমে সকলে জানল। ধর্ষণের, অত্যাচারের সকল চিহ্ন স্পষ্ট। তারপরেও বলা হল আত্মহত্যা। নারীটি একজন সরকারি হসপিটালের নাইটডিউটি করা ডাক্তার। তিনি একজন পিজি-কোর্সের পড়ুয়াও। তিনিও রাতের পর রাত সেবা করতেন। তাঁর হাতেও থাকত অদৃশ্য এক মোমবাতি। তাঁর শুশ্রূষায় অজস্র মুমূর্ষুর নতুন প্রাণ পাওয়া।

তারপর রাষ্ট্র কী করল? সুপারকে অন্য হসপিটালে বদলির নির্দেশ দিল। সেমিনার হলের একাংশের দেওয়াল ভাঙা হল। বুদ্ধিজীবীরা নির্বিকার। বিশিষ্টরা চুপ।

এমনি নিয়মমাফিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল, যেমন ঘটে প্রতিবার। কিন্তু প্রতিবারই কি এক হয়? মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব এখনও অবশিষ্ট আছে। মানুষের মনুষ্যত্বকে সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য একটি আহ্বানের দরকার ছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী রিমঝিম সিংহ, তিনি সোশাল মিডিয়াতে রাত দখলের প্রস্তাব দিলেন। দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়ল। নিশ্চিতভাবে এই ভয়ঙ্কর অত্যাচার, লালসা, ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে ১৪ আগস্টের মধ্যরাতে মানুষের এই জেগে ওঠা। কিন্তু তার সঙ্গে আমরা সকলে যদি নিজেদের দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাব আমরা ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ, শোষিত, ভীত। কারণ অন্যায়কে অন্যায় বলার ক্ষমতা নেই আমাদের। নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নিজ নিজ পরিধির সবরকমের রাজাকে আমরা তুষ্ট করে চলেছি নিজ নিজ মতো করে। শেষপর্যন্ত আমরা সুবোধ।

কিন্তু আমাদের ভিতরেই এখনও সে সত্তা আছে, শক্তি আছে, শুভর জন্য উন্মুখ, যে সত্তা এখনও গাছের মতো আলোর দিকে অগ্রসর হয়। কিছুদিন আগে আমরা অনেক বিপর্যয়, অনেক ঠিক-ভুল সংশয়ের মাঝেও চমকে উঠেছি বাংলাদেশের যুবশক্তির অধিকারের জন্য স্পর্ধা, লড়াই দেখে। কোথাও সেই আলো দীপ্ত করেছে হয়তো আমাদেরও। তার কিছুদিনের মধ্যেই একটি “রাত দখলের” ডাকে নেমে এল দেশ।

আমিও গিয়েছিলাম সেদিন নবদ্বীপের রাধাবাজারের জমায়েতে। রাত তখন বারোটা। শত শত নারী এসেছেন। এসেছিল কলেজের মেয়েরা। স্কুলের একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির মেয়েরা। কারও গলায় ব্যানার ঝোলানো। কারও হাতে প্ল্যাকার্ড। “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” ধ্বনিতে উত্তাল তখন নবদ্বীপ। “জাস্টিস, জাস্টিস” এই আওয়াজ তখন শোনা যাচ্ছে। শুধু নারীরা নন। পুরুষেরাও এসেছিলেন দলে দলে। তাঁরাও সোচ্চার ছিলেন এই প্রতিবাদে। এসেছিলেন অনেক বর্ষীয়ান নারী-পুরুষও। দেখেছিলাম এই জাগরণ। কোনও দল নেই। কোনও নেতা নেই। বাড়ি থেকে কাউকে জোর করে তুলে নিয়ে আসা নেই। এসেছিলেন মানুষ, মানুষী। স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যেমন আসে ঢেউ, ঢেউয়েরা সমুদ্রসৈকতে। এই অগণিত মানুষের ছুটে আসায় রাষ্ট্র নিশ্চয়ই বিহ্বল হয়েছে। ঈর্ষাতুর হয়েছে। ভীত হয়েছে। কারণ তাঁদের কোনও সমাবেশে এই প্রাণ থাকে না, যে প্রাণ, আলোড়ন মানুষের মধ্যে সেদিন ছিল।

আমার নিজের চোখের বাইরেও অন্যের চোখ দিয়ে দেখেছিলাম রাতদখলের কয়েকটি ছবি সমাজমাধ্যমে। মোমবাতি, মোমবাতিরা হাঁটছে। একট বিনম্র স্রোতের মতো সেই চলাচল। দেখলাম, রাস্তার ওপর দিয়ে অসংখ্য মানুষ চলেছেন। সে কী প্রাণ! বিস্মিত হলাম দেখে, হুইলচেয়ারেও একজন চলেছেন। কী তাঁর গতি! দেখলাম সঙ্কোচে, আড়ষ্ট এক মধ্যবয়সী মহিলা মোমবাতি ধরে আছেন। তাঁর এই সাদামাটা সারল্য, তারপরও তাঁর এই অংশগ্রহণ, কোথাও এক মানবতারই বিজয়। একটি পোস্টে দেখলাম, পুরুলিয়ার গ্রামের রাস্তা। গরু ঘুরছে তখনও ইতস্তত। সেখানেও হাঁটছে কয়েকটি বালক, বালিকা। কিশোর, কিশোরী। সেখানেও ভাসছে, একই সুর। “জাস্টিস, জাস্টিস”। শুনতে পাওয়া যাচ্ছে ধ্বনি, “ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।” সেদিন রাতে “একই সূত্রে” বাঁধা ছিল হাজার হাজার মন। সকলের প্রাণের প্রদীপের অভিমুখ ছিল এক। “জাস্টিস, জাস্টিস”।

একটি পোস্টে দেখলাম, ভোর হচ্ছে। ত্রিপল পাতা। রাতদখলের শেষে একটি স্বাধীন প্রভাত তখন। নারীরা কথা বলছেন।

কথা বলুক নারীরা। হাঁটুক নারীরা। নির্ভীকতায়। সোচ্চার হোক তারা তাদের দাবিতে। গৃহে, কর্মস্থলে, সম্পর্কে তারা স্বাধীন হোক। তারা এগিয়ে যাক আলোর দিকে দৃপ্ত পায়ে। একদিন হবে জয়। ইতিমধ্যে একটা বড় বিজয় তারা করে ফেলেছে চোদ্দই আগস্টের রাতে, সেই জয়যাত্রা অব্যাহত থাক, সেই রাতদখলের রাতের স্বপ্নের মতো অজস্র রাত্রি লিখিত হোক আবার। লিখিত হোক জাগরণ, লিখিত হোক বেঁচে থাকা।


*মতামত ব্যক্তিগত