শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
শোষণ এবং নৃশংসতার এই ধারাবাহিকতা রুখে দিতে হলে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। প্রকৃতির সৃষ্টি হিসেবে মানুষ যতক্ষণ না ‘অপর’ মানুষকে প্রকৃতির সৃষ্টি হিসেবে দেখবে ততক্ষণ তুমি হিন্দু, আমি মুসলমান, তুমি পুরুষ, আমি নারী। মানুষকে কেবলমাত্র মানুষের পরিচয়ে দেখার এই আদিম, বুনিয়াদি বোধ এবং তা আরও বিকশিত করে ‘infinite responsibility for the other’, এই মহত্তর বোধের দিকে জোট বেঁধে এগিয়ে যেতে হবে। অথচ এই অনুশীলন থেকেই মানুষকে বিযুক্ত করে রাখা হয়েছে খুঁটিনাটি ছক কষে। বিযুক্তির এই বোধকে আরও বেশি তীব্র করার জন্যই তো এত অ্যালগরিদম, আইটি সেল, ফেক নিউজ, নজরদারি, আইপিএল আর মন্দির-মসজিদ খেলা
রাজ্য সরকারের তরফ থেকে বার্তা এল, ঘরের নারী তুমি কেন বাইরে রাতেরবেলায়? অন্ধকারে, যে-কোনও মুহূর্তে, বাজারে বা সেমিনারে তোমার শরীর খুবলে নিতে পারে রাষ্ট্রনীতির আজ্ঞাবহ কিছু মানুষ।
অলিম্পিকের সময় জিও সিনেমার প্ল্যাটফর্মে লাগাতার বার্তা ছিল, প্রতারক থেকে সাবধান। মোবাইলে ভুল একটা ক্লিকে আপনার ব্যাঙ্কের সমস্ত টাকা উধাও হয়ে যেতে পারে। সন্দেহজনক ফোন রিসিভ করা থেকে বিরত থাকুন, অচেনা লিঙ্কে ক্লিক করবেন না।
প্রসঙ্গত, এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। জুলাই মাসের শেষের দিক। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান তখন প্রাথমিক পর্যায়ে। অফিসের সামনে চায়ের দোকানে বসে। এক দেখায় ব্রহ্মচারীর মতো, আপাদমস্তক সাদা পোশাকে, ‘গীতা’ বিক্রি করতে এলেন এক মানুষ। তিনি ইসকনের সন্ন্যাসী। আমি বললাম, আমার ‘গীতা’ আছে। উত্তর এল, কিন্তু এটা ইসকনের। স্বভাবতই মানুষটি যা উহ্য রাখলেন তা হল, আপনি যে গীতাই পড়ুন না কেন, এটাই মোস্ট অথেন্টিক। তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তায় তাঁর পাল্টা যুক্তির মধ্যে রাষ্ট্র-কর্পোরেট নেক্সাসের কৌশলী বাচন ও বাচনভঙ্গির স্পষ্ট আভাস পেলাম। বললাম, আমি কিন্ত শোষিত। দশ-বারো ঘন্টা কাজ করতে হয়। এই সমস্ত অফিসে আমার মতো লাখ লাখ মানুষ শোষিত। তাঁর মুখ ফসকে, বিজনেসম্যানরা তো টাকা রোজগার করবেই, এই কথাটি বেরিয়ে গিয়েই, ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে তিনি ঈশ্বর-কেন্দ্রিক আধ্যাত্মিকতায় পাশ ফিরলেন। গাইলেন আত্ম-সংস্কারের সাফাই। বক্তব্য, মদ, গাঁজা, সর্বনাশী এবং খুচরো সব প্রলোভন ছাত্রদের সামনে থাকবে। অতএব ছাত্রদের আত্ম-সংযম প্রয়োজন। শেষে বললাম, আপনি ঈশ্বরের সেবক আবার একই সঙ্গে সেলসম্যান? উত্তর, অর্জুন কি শুধু কৃষ্ণের ভক্ত, সেও কিন্তু ছিল মিলিটারিম্যান।
ওপরের তিনটি ঘটনার যোগসূত্র কোথায়? বস্তুত, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতির তরফ থেকে সোজাসাপটা নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে বারংবার যে, শোষকশ্রেণির একমুঠো সমষ্টির শোষণ, দুর্নীতি, নৃশংসতা বজায় থাকবে কিন্তু তার দিকে আঙুল তুলে এক পৃথিবীর বিপুল মানুষ, তোমরা সমষ্টিগত প্রতিবাদ করলেই রাষ্ট্র কিন্তু তার দাঁত নখ বার করবে। নিজের ভাল চাইলে নতজানু হয়ে নিজের চরকায় তেল দাও, ব্যক্তিগত সম্পত্তি আগলে রাখো, না পারলে মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট করো আর অবশ্যই ঈশ্বর আরাধনায় আত্ম-সংস্কারে ডুবে যাও। সেখানেই মুক্তি। আর ঠিক তখনই এই সংস্কৃতির চামড়া ফাটিয়ে দগদগে ঘা-এর মতো উদোম হয়ে ফোটে তুরস্কের সমুদ্রসৈকতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা আয়লান কুর্দির মৃতদেহ, ২০১৫। কাঠুয়ার আট বছরের আসিফা বানো, ২০১৮। হাথরসের দলিত নারী, ২০২০। আরজিকর আর আউশগ্রামের আদিবাসী কন্যা প্রিয়াঙ্কা হাঁসদা, ২০২৪। তাছাড়াও থেকে গেল কামদুনি, উন্নাও, এবং আরও অনেক বেশি ভয়াবহ কিছু যা কিন্তু ঘটেছেই কিন্তু প্রকাশ্যে আনা হয়নি।
ফেসবুকে এই ঘটনাগুলিকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, হচ্ছে। প্রতিবাদের ধস নেমেছে, নামছে অজস্ৰ টাইমলাইনে। কালো প্রোফাইল পিকচার, কার্টুন, মিম ইত্যাদি মানুষকে ভার্চুয়ালি জড়ো করে উসকে দেয় ঠিকই কিন্তু এগুলি সবই অনুঘটক, তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ, সারফেস স্ট্রাকচার। আর শুধুমাত্র এই প্রবণতাটি ছড়াতে ছড়াতে ক্রমে সর্বজনীন সংস্কৃতির চেহারা নিলে ভিতরের গভীর অবকাঠামোটি কিন্ত ঢাকা পড়ে যায়। দুর্বল হয়ে পড়ে প্রকৃত বৈপ্লবিক অনুশীলন। রাজ্য, দেশ এগুলো সবই বিমূর্ত ধারণা, শব্দমাত্র। আসল তো দেশের মানুষ, যাকে ধরা ছোঁয়া যায়, আদর করা যায়, সুযোগ বুঝে চুপিসারে গণধর্ষণ বা উধাও করে দেওয়াও যায়। শোষণ ও নৃশংসতার বলি রাজ্য ও দেশ হয় না, হয় আমার আপনার মতো কোণঠাসা, ক্রুদ্ধ এবং একইসঙ্গে সন্ত্রস্ত, জাগ্রত এবং একই সঙ্গে আত্মহত্যাপ্রবণ সাধারণ মানুষ।
অতএব শোষণ এবং নৃশংসতার এই ধারাবাহিকতা রুখে দিতে হলে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। প্রকৃতির সৃষ্টি হিসেবে মানুষ যতক্ষণ না ‘অপর’ মানুষকে প্রকৃতির সৃষ্টি হিসেবে দেখবে ততক্ষণ তুমি হিন্দু, আমি মুসলমান, তুমি পুরুষ, আমি নারী। মানুষকে কেবলমাত্র মানুষের পরিচয়ে দেখার এই আদিম, বুনিয়াদি বোধ এবং তা আরও বিকশিত করে ‘infinite responsibility for the other’, এই মহত্তর বোধের দিকে জোট বেঁধে এগিয়ে যেতে হবে। অথচ এই অনুশীলন থেকেই মানুষকে বিযুক্ত করে রাখা হয়েছে খুঁটিনাটি ছক কষে। বিযুক্তির এই বোধকে আরও বেশি তীব্র করার জন্যই তো এত অ্যালগরিদম, আইটি সেল, ফেক নিউজ, নজরদারি, আইপিএল আর মন্দির-মসজিদ খেলা।
রাষ্ট্র ও কর্পোরেট যদি প্রত্যক্ষ প্যারাসাইট হয়, তাহলে পরোক্ষভাবে নৃশংসতার এই অনুশীলনকে কৌশলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন মহারাজের মতো বিরাট সব গডম্যান ক্রিকেটার, বলিউডের বাদশাবাহিনি, ওরফে একচেটিয়া সস্তা বিনোদন-বাণিজ্যজীবীরা। আট বছরের কুসুম-কুসুম একটি মেয়ের সারা শরীরে যখন গর্ত খোঁড়া হয়, আরজিকরের প্রতিবাদী চিকিৎসকের চোখ ফেটে যখন রক্ত বেরিয়ে আসে, বলিউডি বিজ্ঞাপনে কর্পোরেট তখন নারীকে ফ্যাশনে, অলঙ্কারে, বিজনেস লোনে বুঁদ করে রাখতে চায়, উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের তকমা দিয়ে। সিংহভাগ নারীর কিন্তু পা পিছলায়। ঘোর বাস্তব।
সময় আগেও ছিল, আমরা দেখেও দেখিনি। পাশ কাটিয়েছি। এবার কিন্তু ভাবতে হবে, আবালবৃদ্ধবণিতাকে জাগতে হবে। প্রকৃত প্রগতিশীল, বৈপ্লবিক নারীশক্তির ওপর ভরসা আমাদের সকলের ছিল, আছে, থাকবে। রাতের পর রাত, এই যে তীব্র আন্দোলন, অমানবিকতার বিরুদ্ধে নারীসমাজকে কেন্দ্রে রেখে মানবিকতার গর্জে ওঠা, এমনটাই তো প্রত্যাশিত। প্রকৃত মানুষের মতো ব্যবহার।
আমরা জানি, বিচার এখন অনেক কিছুরই বাকি। এই অপশাসনের বীজ কিন্ত অনেক গভীরে, অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। হাল ছাড়লে চলবে না। আগামী প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্যকর দিনগুলি রেখে যেতে হলে বিচক্ষণতার সঙ্গে, প্রয়োজনীয় সকল মাধ্যমকে হাতিয়ার করে, এই পিশাচ-সংস্কৃতির, নৃশংস এই সামাজিক ব্যবস্থার শেষ দেখে আমরা ছাড়ব। তারপরেই তো শুরু হবে আসল কাজ। প্রত্যেক মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের সেই যে সামাজিক কাঠামো!
আমাদের পারতেই হবে।
*মতামত ব্যক্তিগত