Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বুকের গভীরে কার যেন ডাক আসে— রিক্লেইম দ্য নাইট

আত্রেয়ী ভৌমিক

 


এ রাত কোনও ভোর আনবে, সেই বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি আমরা। এই লড়াই পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। এই লড়াই সিস্টেমের বিরুদ্ধে। পায়ের শিকল খুলে আকাশে ওড়ার জন্যে লড়াই। মানুষ অমানুষের বিরুদ্ধে রাত জাগছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় গর্জে উঠছে। স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে একটা গোটা রাত ইতিহাস হয়ে থাকল। আমার বিশ্বাস, আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি বাদে, ইতিহাসের শিক্ষিকা ক্লাসে পড়াবেন— "আজ আমাদের বিষয় রিক্লেইম দ্য নাইট"

 

৯ আগস্ট, ২০২৪। রোজকার মতো কর্মব্যস্ত সকাল। দুপুরের দিকেই চোখে পড়ে একটি খবর। আরজিকর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কলেজ শাখার সেমিনার হল থেকে একজন মহিলা ডাক্তারের মৃতদেহ পাওয়া যায়। খবর এতটুকু হলে হয়তো সব সাধারণ লাগত। যত বেলা বাড়তে থাকল, তত খুলতে থাকল একের পর এক জট। প্রথমে যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল পরে তাকেই খুন ও ধর্ষণ বলা হয়। খুন? ধর্ষণ? খুন করে ধর্ষণ? নাকি ধর্ষণ করে খুন? ভয়ঙ্কর সেই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। ভেসে আসছে বাবা-মায়ের আর্তনাদ। মনে করা হচ্ছে এত বীভৎস নারকীয় হত্যাকাণ্ড আমরা আগে শুনিনি এই বাংলায়। ঘটনার প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে গ্রেফতার করা হয় যাকে তিনি একজন সিভিক। এক গুচ্ছ প্রশ্নের মাঝখান থেকে উঠে এল যে জরুরি প্রশ্ন তা হল— নারীর নিরাপত্তা কোথায়? নিজের কর্মস্থলে একজন ডাক্তার নিরাপদ নয়? পথে, ঘাটে, স্কুলে, বাড়িতে, কর্মস্থলে অবাঞ্ছিত ছোঁয়া পায়নি এমন মেয়ে মনে হয় একজনও নেই। বয়স ৬ মাস হোক বা ৫৬, আপনি নিরাপদ নন। এমনকি আপনি মৃত্যুর পরেও নিরাপদ নন। রাত মেয়েদের জন্য ভয়ঙ্কর। প্রতিটি কোনায় কোনায় অজানা ভয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোক বা সহকর্মী, কাউকেই বিশ্বাস করবে না সে? ভালবাসবে না? কেউ এর বিরুদ্ধে কিচ্ছু করবে না? আমরা সত্যিই স্বাধীন? আটাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এ কোন প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ালাম আমরা?

১৪ আগস্ট, ২০২৪— কলকাতার মেয়েরা ডাক দিল ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’-এর। সারা শহর রাত জাগবে মেয়েরা। ঠিক পড়েছেন। মেয়েরা। যাদের বাড়ি ফেরার সময় বেধে দিয়েছেন আপনারা। সেই চিরকালীন গণ্ডি ভাঙবে এবার। প্রথমে এই জমায়েতের কথা হয় শহরে। একের পর এক মফঃস্বল যোগ দিল তাতে। সোদপুর থেকে শ্যামবাজার। পুরুলিয়া থেকে কোন্নগর, উত্তরপাড়া থেকে আশোকনগর। পথে নামলেন বাংলাদেশ, দার্জিলিং-এর মায়েরা, মেয়েরা। জুড়ে গেল বিদেশের মানুষ। এক হয়ে গেল জাতি-ধর্ম-বর্ণ। আওয়াজ মিলে গেল যাদবপুর, কলেজস্কোয়ার হয়ে আরজিকর। স্বাধীনতার ভোর দেখল সমস্ত রাজ্য। আকাশে বাতাসে একটাই আওয়াজ— ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ আপনার মনে আছে মণিপুরের সেই রাত? ১৯৭৭ সালে জন্ম নেয় ‘মেইরা পাইবি’, বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় মশালবাহিনি নারী অর্থাৎ মণিপুরের মা। তাদের দাবি ছিল স্বাধীনতা, অপরাধমুক্ত মণিপুর, সহনাগরিকের প্রাপ্য মর্যাদা। আজও রাতের মণিপুর পাহারা দেন মায়েরা। ফিরে আসুন পশ্চিমবঙ্গে। মধ্যরাত। কোলে ছ-মাসের ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে পথে এসে দাঁড়ালেন মা ও বাবা। এই বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যেতে হবে তো? এমন অঙ্গীকার নিয়েই তো পথ চলা শুরু করেন বাবা-মায়েরা। পা মেলালেন বয়স পঁচাত্তরের বৃদ্ধা। হুইলচেয়ার নিয়ে পথে নামলেন সেই মা, যিনি বহুকাল বাইরের আকাশ দেখেননি। যাঁদের মায়েরা রাত দশটায় ফেরার কথা বলতেন, তাঁরাই সন্তানদের পথে বের করলেন সারারাত পথদখলের লড়াইতে। অজস্র মানুষ আর তাঁদের কণ্ঠস্বর দলমতনির্বিশেষে একসঙ্গে গর্জে উঠল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এমন গণআন্দোলন আমি দেখিনি। আপনি দেখেছেন? পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে জলের বোতল এগিয়ে দিচ্ছেন পথচারীদের এক মানুষ। যেন ছবি হয়ে উঠল তিলোত্তমা। আমাদের মেয়েটা নেই। ফিরবে না। আমরা বহু রাত ঠিক করে খাই না, ঘুমাই না। মনে পড়ে সারা শরীরে একশো তেরোটা কামড়ের দাগ। ঘুমের মধ্যে কানে আসে কোলাহল। ভেসে আসে একটাই কথা— উই ওয়ান্ট জাস্টিস।

নবারুণ ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেছিলেন— ‘একটা ব্যথা বর্শা হয়ে মৌচাকেতে বিঁধবে কবে?’ উত্তর খুঁজছেন? বিঁধে গেছে। একটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা বিঁধেছে বুকে। একটা সময়ের পর শোক আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। দেশলাই থেকে মোমবাতি হয়ে মশাল। ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। হাত থেকে হাত ভরে ওঠে মশালে। মেয়েরা গলা ছেড়ে ডাক দেয় বিদ্রোহের। চিৎকার করে বলে— ‘সারা শহর উথালপাথাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।’

‘গোটা শহর বাতি জ্বেলে সতর্ক’। এ রাত কোনও ভোর আনবে, সেই বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি আমরা। এই লড়াই পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। এই লড়াই সিস্টেমের বিরুদ্ধে। পায়ের শিকল খুলে আকাশে ওড়ার জন্যে লড়াই। মানুষ অমানুষের বিরুদ্ধে রাত জাগছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় গর্জে উঠছে। স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে একটা গোটা রাত ইতিহাস হয়ে থাকল। আমার বিশ্বাস, আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি বাদে, ইতিহাসের শিক্ষিকা ক্লাসে পড়াবেন— “আজ আমাদের বিষয় রিক্লেইম দ্য নাইট।” হঠাৎ কানে এল, মিছিলের মাঝে চিৎকার করে এক কিশোরী অনর্গল বলে চলেছে—

Wherever I go
However I dress
No means no
Yes means yes.


*মতামত ব্যক্তিগত