Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শাসক কি তার ৫০ শতাংশ নাগরিকের সঙ্গে কথোপকথনে আদৌ আগ্রহী?

যশোধরা রায়চৌধুরী

 


ধর্ষক পুরুষদের জেলখানার কয়েদের শিকের আড়ালে রাখার বন্দোবস্ত না করে, প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, যে রাষ্ট্রযন্ত্র মেয়েদের সুরক্ষা দিতে অপ্রস্তুত, অক্ষম বলে স্বীকার করে, knee jerk reaction-বশত এমন একুশে আইন আনে যা আসলে মেয়েদের কাজের জায়গা এবং কাজের সুযোগ খর্ব করে, কাজের সময়ের ওপরে খাঁড়া নামিয়ে আনে, সে-রাষ্ট্র আসলে তার নাগরিকদের সঙ্গে কোনও কথোপকথন করছে না। তার ডায়ালগ করার কোনও ক্ষমতা নেই। সে প্যানিক বাটন টিপছে, না হলে প্রলাপ বকছে, না হলে ঔদাসিন্যে ছেলে ভোলাচ্ছে। এমন রাষ্ট্রযন্ত্রের যে দিন ঘনিয়ে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না

 

কহেন কবি কালিদাস হেঁয়ালির ছন্দ।
জানলা দিয়ে ঘর পালাল গৃহস্থ রইল বন্ধ।।

জীবনের বাস্তব স্ববিরোধিতা দেখতে পেলে যেমন কালিদাসের হেঁয়ালি মনে আসে, শাসকদের আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া কখনও বা আমাদের প্রাচীন কাহিনির হবুচন্দ্র গবুচন্দ্র মনে করিয়ে দেয়। আর বিস্ময়করভাবে এ-ও মনে পড়ে যায় যে হিসেবমতো ভোটারই বলো আর নাগরিকই বলো, জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, এই স্বাভাবিক সহজ অঙ্কটাও কি শাসকের মাথায় থাকে না? কারও সঙ্গে কথা বলা, কোনও কনসালটেটিভ প্রক্রিয়াই তাঁদের মাথায় আসে না? যখন তাঁরা মেয়েদের “ভাল করতে” চান? জালের মধ্যে মাছেদের রেখে জলকে তার থেকে সরিয়ে রাখার মতো প্রতিকার নাহলে তাঁদের মাথায় আসে কেন? বাস্তববিমুখ এই সমাধানে তো শেষাবধি খাবি খেয়ে মরবে মেয়েরাই।

আমার একাধিক বান্ধবী প্রযুক্তিবিদ। সাদা বাংলায় ইঞ্জিনিয়ার। এঁদের সবার কাছেই শুনেছি, প্রযুক্তিক্ষেত্রের চাকরিতে মেয়েদের লড়াইটা কী ভীষণ। ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে চাকরির ময়দান অব্দি। তার আগে বছরের পর বছর পুরুষপ্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের মধ্যে নিজের মেধার পরীক্ষা দেওয়ার কথা না হয় বাদই রইল। চাকরির কঠিন কর্মভূমি, জটিল দায়িত্ব, শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব আছে, এই কারণ দর্শিয়ে চাকরিতে মেয়েদের না নেওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস ইতিমধ্যেই বিদ্যমান।

সদ্যই, শাসক-প্রস্তাবিত ১৭ দফা “সুরক্ষাবিধান”-এর শলাপরামর্শ আবারও সেই ইতিমধ্যেই একপেশে বৈষম্যমূলক কর্মক্ষেত্রটিকে আরও বেশি দাগিয়ে দিয়ে পশ্চাৎপদতার নতুন নজির সৃষ্টি করল।

সদ্য ঘটে যাওয়া আরজিকর-ঘটনার অভিঘাতে, মেয়েরাই প্রথম ডাক দিয়েছিলেন রাতদখলের। তারও পৃষ্ঠপট ছিল একটা।

মেয়েরা রাত দখল করো। এক বা একাধিক পোস্টারে ছেয়ে গেছিল সমাজমাধ্যম। প্রথমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ইনটার্ন ডাক্তারদের মধ্যে থেকে, ২৪ সালের এই কালো আগস্টের ৯ তারিখের রাত্রিতে ৩৬ ঘন্টা ডিউটির পর নিজের হাসপাতালের সেমিনার রুমে ঘুমোতে যাওয়া আরজিকরের ইনটার্ন ডাক্তার, ৩১-বর্ষীয়া তরুণীটির ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের নিরিখে যা ছিল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। অগ্নিসংযোগ হয়েছিল একটি মন্তব্যে। চেনা ঢঙের মন্তব্য। আরজিকরের তৎকালীন প্রধানের প্রথম প্রতিক্রিয়ার ঝোঁক এইই, যে, মেয়েটিকে রাতে ওখানে কে থাকতে বলেছিল?

প্রতিবার এই শুনি আমরা। রাতে মেয়েদের কী দরকার বাড়ির বাইরে থাকার? সেই ২০১২ সালেও শোনা গিয়েছিল এই মন্তব্য, নির্ভয়াকাণ্ডের সময়ে। ও কেন রাত করে সিনেমা দেখতে গেল? সুজেট জর্ডানের পার্ক স্ট্রিটে থাকাকালীন আক্রান্ত হওয়ায় সরকারি স্তরে তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আজকাল তো ভিকটিম ব্লেমিং ও স্লাট শেমিং শব্দবন্ধগুলো ভাত দিয়ে মেখে খাওয়ার মতো জলচল হয়ে গিয়েছে। যে-কোনও আঘাত ও আক্রমণের শিকার মেয়েরা এবং তারপর তার প্রাপ্য একটি সন্দেহের ফলা— ও কেন তখন ওখানে ছিল? লক্ষ্মীমন্ত মেয়েরা রাত সাতটার মধ্যে বাড়িতে ঢুকে পড়বে, এমত বিধান ৭০ দশকে মানাত। সত্যিই মানাত কি, তখনও? আর আজ যেখানে পেশাগত কারণে পৃথিবীর সমস্ত স্থানে ছড়িয়ে গেছে মেয়েরা, যে-কোনও সময়ে চব্বিশ ঘন্টা ইনটু সাত দিন মেয়েদের দেখা যাচ্ছে ট্রেনে বাসে ট্যাক্সিতে রাস্তায় কর্মস্থলেও, সেখানে, এই জাতীয় প্রশ্ন তোলাটাই একটা আলাদা প্রতিবাদের পরিসর তৈরি করে।

সুতরাং মেয়েদের এক পরিকল্পনা ফলিত হয়ে উঠে এল “রিক্লেইম দ্য নাইট” অথবা “রাত দখল করো”-র আকারে। কিছুটা সঙ্ঘবদ্ধ হলেও, স্বতঃস্ফূর্ততার আঁচ তাতে রীতিমত বিদ্যমান। গোড়ার পরিকল্পনায় ছিল কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর বাসস্ট্যান্ড ও অ্যাকাডেমির সামনের চত্বর, এই তিনটি জমায়েত। সেই থেকে নানা জেলার শহরে, পশ্চিমবাংলার নানা প্রান্তে ছড়াতে শুরু করল। পাড়ায় পাড়ায় পরিকল্পিত হল।

সময়টির সমাপতন দেখবার মতো ছিল। যেখানে হর ঘর তিরঙ্গা পালন করে ভারতবাসী জানান দিতে চলেছিলেন তাঁর স্বাধীনতার অমুকতম বার্ষিকী পালন চলছে! সেই ভারতবাসী নিজের বউ-মেয়েকে রাত্রে বাড়ির বাইরে থাকতে দিতে পারেন না, কাজের জন্য বেরোলেও ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন, ফেরার আগে দশবার ফোনে খবর নেন বাড়ি ফিরতে আর কত দেরি— এর চেয়ে বড় শ্লেষ আর কী বা হতে পারে।

অনেক নিন্দুক জ্যাঠামশাইরা, সন্দেহ করাই যাঁদের একমাত্র বিনোদন, তেমন মানুষ বলেছিলেন, প্রথম জমায়েতের ডাক অ্যাপলিটিকাল তাই এর কোনও দাম নেই, এটা বিচ্ছিন্ন। এই একরাতের বিপ্লব করে কি মেয়েদের রোজদিনের অনিরাপত্তা চলে যাবে? এমনও হাস্যকর কথা উঠেছিল, পুরুষরাও কি মাঝরাতে নিরাপদ বা স্বচ্ছন্দ? গাঁটকাটা বা রাহাজানির ভয় কি তাঁদেরও নেই? আছেই তো। বুলগেরিয়ার কবি রাজনীতিক ব্লাগা দিমিত্রোভার কবিতায় ছিল,

তবু এই বেরিয়ে পড়াটুকুই
তোমার সাফল্য।
একাকী নারী, রাস্তায়
তবু তুমি চলেছ
তবু তুমি থামোনি।
একজন পুরুষ কখনও
এতটা একা হয় না
যতটা এক একা নারী।

আসলে একজন নিরাপত্তাহীন নারী জানেন তাঁর অনিরাপত্তা কীরকম ধারালো নিখুঁত অস্ত্র। সে অনিরাপত্তার ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে বলেই, তিনি নিজের পাঁচ বছর বয়স থেকে মলেস্টেশন কাকে বলে, নিজের কোনও বিশেষ প্রচেষ্টা ছাড়াই জেনে ফেলেছেন বলেই, জানেন। সেই ট্র্যাডিশনকে পুরুষ সহনাগরিক যখন, “মেয়েদের যেমন একাকিত্ব আছে, পুরুষেরও আছে” বলে নস্যাৎ করতে চান, তখন হাস্যকর হয়ে ওঠে সে কথাটি।

রিক্লেইম দ্য নাইট, বা রাত্রিকে দখল করা একেবারে নতুন কিছু নয়, বিদেশেও বহু হয়েছে। আসলে এটা তো খুবই স্বাভাবিক একটা দাবি মেয়েদের। রাতের রাস্তা নিরাপদ হোক। কোনও-না-কোনও অঘটনে বা দৈব কৃপায় সামান্য যৌন লাঞ্ছনার ওপর দিয়ে পার পেয়েছি, কিন্তু মরে যাইনি বলে, বিগত ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে অবস্থার পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত ছিল কিন্তু পাল্টাতে দেখছি না বলেই, বিশ্বাস করি রাতের দখল ফিরে পাওয়া জরুরি। যেসব মেয়েদের কাজের জন্য বারবার বেরোতে হয়, একা, এবং রাত্রে, তাদের প্রত্যেকের জীবনের লড়াইকে সম্মান করি বলে।

যে-কোনও আক্রমণের ঘটনার পরই, “মেয়েদের তো এমন হবেই, দুর্ভাগ্য”-জাতীয় ফেটালিস্ট বা অদৃষ্টবাদী মানসিকতাও নির্দিষ্ট করে ত্যাগ করতে চাওয়া এই রিক্লেইম দ্য নাইটে আছে। মেয়েদের একজন ভিকটিম হওয়া মানে, আক্রামকদের একটা অন্য জয়। অন্য মেয়েদের মানসিকতায় ভিকটিম হওয়ার ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া। ভিকটিমের জন্য লড়াই তো আছেই। পাশাপাশি যারা এখনও ভিকটিম নয় তাদের সারভাইভার হয়ে উঠতে হবে। আর সেজন্যেই আমরা নঙর্থক নাস্তিপূর্ণ কথা বলা সচেতনে বন্ধ করব। বলব, মেয়েরা সর্বত্র যাবে। সবকিছু দখল করবে। বলতে চাই মধ্যরাতে যেখানে কারও যাওয়ার সাহস নেই সেইসব জায়গারও দখল নিতে হবে।

বিগত শত শত বছর ধরে মধ্যরাতে একা হেঁটে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর মেয়ে। আক্রমণের ভয় সত্ত্বেও। অস্বীকার করছে নানা বেড়ি মেয়েদের রাত্রে বাড়ি থেকে বেরোবার অধিকারের প্রসঙ্গে। কেন যাবে না, কেন যেতে নেই। মনুর সংহিতার নবম অধ্যায়ের বিধান,

পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমৰ্হতি॥

(স্ত্রীলোককে পিতা কুমারীজীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে; (কখনও) স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়।)।

তৃতীয় শ্লোকেই মনু তাঁর অ্যাজেন্ডা বিস্তৃত করে দিয়েছিলেন। আর আজকের ভারতীয় সমাজ মনোযোগ দিয়ে সেই অ্যাজেন্ডাকে অনুসরণ করে চলেছে, করেই চলেছে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলির মতো ডাক্তারের রুগি দেখতে বেরোনো দিয়ে যে অ্যাজেন্ডা ভাঙার চেষ্টা শুরু, সে কাহিনির আজও অবসান নেই।

সমাজ এগোবে না? কেন জানি না আজ তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, রাষ্ট্র কেন পশ্চাৎপদ থাকবে! নানা পেশায় রাত্রির ডিউটির মেয়েরা অফিসের গাড়িতে বাড়ি ফিরলেও পাড়ায় নানা পড়শি জানালা খুলে কৌতূহলী চোখ মেপে নেয় মেয়েটিকে, চরিত্র নিয়ে সন্দেহ ব্যক্ত করে সেসব চোখ। কতটাই লজ্জার এ-ঘটনা, কিন্তু এ-ও আমাদের ডালভাত। পাড়া আর রাষ্ট্র তো এক নয়। সরকারের তো দায়, পঞ্চাশ শতাংশ নাগরিককে এগিয়ে দেওয়ার।

সরকারের সুরক্ষাদানের অপারগতার বিরুদ্ধে রাতদখলের ডাকের প্রথমদিকটা “মেয়েদের” ছিল। আর তাই-ই হয়তো, (মেয়েদের সব কিছুকেই ট্রিভিয়ালাইজ করার ও হাস্যকর ভাবার প্রবণতা আছে) এই ডাককে হুজুগ বলে দাগিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু ঘটে গেল এক অভাবিত ঘটনা। পুরুষ-নারীনির্বিশেষে পথে নামলেন হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ। ঘটে গেল সদর্থক একটা জাগরণ। যাকে ভাবা হচ্ছিল বেড়ি ভেঙে ফেলার একটা ছোট্ট প্রতীক, তা হয়ে উঠল আরজিকরের কন্যার জন্য সুবিচার চাওয়ার জনবন্যা। পশ্চিমবঙ্গের কোনও জনপদ বাকি রইল না যেখানে প্রতিবাদের ঢল না নামল। এমনকি স্নবিশ বহুতলের আবাসিকরা থেকে শুরু করে ছোট নিচুঘরের বাসিন্দা, সকলেই নেমে এলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মানুষের মধ্যে কতখানি ক্ষোভ জমা হয়েছে তা বোঝা গেল একটি রাত্রিতেই।

বিন্দু বিন্দু করে যেমন নদী সমুদ্র, খণ্ড খণ্ড প্রয়াস জুড়ে জুড়ে কিন্তু অনেক বড় একটা ব্যাপার হয়ে উঠল। তারপর সেই ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে পর পর বেশ কটি দিন অজস্র ঢেউয়ের মতো প্রতিবাদী মিছিলে ঢেকে গেল শহর, শহরতলি। মহল্লায় মহল্লায় ডাক উঠল বদলের।

যে রাষ্ট্র বা যে প্রশাসন একটি মেয়ের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে পারে না, সে এরপর কী করে? অজস্র মানুষের পথে নেমে আসা দেখে ভীত হয়ে সে কতগুলো দাওয়াই ঘোষণা করে। ১৭ দফার দাওয়াই। সুকুমার রায়ের একুশে আইনের মতো কোনও ভাবনাচিন্তার গভীরতায় না গিয়ে, নারীদের সঙ্গে আলোচনায় না বসে, বা সুরক্ষার বিষয়ে ডোমেইন এক্সপার্টদের বুদ্ধি না নিয়ে, যেন এক সন্ধ্যায় একটি কনফারেন্স টেবিলের চারিদিকে বসা কিছু পুরুষ আমলা আর এক পিতৃতান্ত্রিক খামখেয়ালি (লিঙ্গপরিচয়ে নারী!) প্রধানের মস্তিষ্কপ্রসূত চটপট সলিউশন। কিছু অর্ধপথে মুখ থুবড়ে পড়ার মতো সমাধানসূত্র। সোনার পাথরবাটির মতো কিছু উদ্ভট দাওয়াই। কিছু ক্ষেত্রে যা ইতিমধ্যেই বর্তমান সেই পুরনো বিশাখা গাইডলাইন বিধি, বা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস-এর পুরনো বিধি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। কিছু অভিনব নামকরণ যা বর্তমান সরকারের এক প্রিয় খেলা। কিছু আশ্চর্য বিধান, যা পরস্পরবিরোধী। মেয়েদের একা না ডিউটি দেওয়ার বিধান। হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের মতে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি নারীডাক্তার যেখানে, এবং যে-দেশের স্বাস্থ্যপরিষেবায় রোগীর সংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা নগণ্য, সেখানে একটি নাইট শিফটে মেয়েডাক্তারের একজনের বদলে দুজনের ডিউটি দিতে হবে বা “সম্ভব হলে নাইট ডিউটি নয়”— এই বিধান ঠিক যতটাই ইমপ্র্যাক্টিক্যাল, ততটাই পশ্চাৎপদ।

মৌ সেন, এক প্রযুক্তিবিদ কন্যে, লেখেন,

সালটা ১৯৯৩… আরই কলেজের লেডিস হোস্টেলে থাকি। কোনও এক রাতে কিছু বদমাশ লোক বাউন্ডারি টপকে হোস্টেল রুমে উঁকি দেয়। মেয়েরা স্বভাবতই রে রে করে ওঠে। পরের দিনই মেট্রন ওয়ার্ডেন-সহ কলেজের সর্বোচ্চ পদে নালিশ জানানো হল। উত্তেজিত হয়ে মেয়েরা সম্ভবত বর্ণনা করে ফেলেছিল অমুক মেয়ে তখন তার ঘরে টেপজামা পরেছিল। বুঝুন স্যার কী অবস্থা পাহারার। এ তো বিচ্ছিরি অবস্থা।

একটু ক-দিন হৈ হৈ হল। তারপর কলেজের নির্দেশ বের হল মেয়েরা হোস্টেলে টেপজামা বা স্লিভলেস পরে ঘোরাফেরা করতে পারবে না।

এটা ২০২৪… এখনও মেয়েদের সুরক্ষার জন্য মেয়েদেরই ভাল চাইতে গিয়ে নাইট ডিউটি যত সম্ভব কম দেওয়ার নির্দেশ জারি হল। এর অর্থ কী জানেন?

নব্বই দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে কোনও কোর ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মেয়েদের নিয়োগ করতে চাইত না। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম এমনই এক কোম্পানির উচ্চপদস্থ অফিসারকে, রেজাল্ট অনেক ভাল হওয়া সত্ত্বেও কেন মেয়েদের ইন্টারভিউতে ডাকা হল না। উত্তরে তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন because the waves of women do not match with our industrial environment. সেই সময় পাশ করা মেয়েরা তাই অপেক্ষাকৃত নরম রিস্কলেস জব যেমন ডিজাইন, রিসার্চ, টিচিং ইত্যাদিতে চলে যেতে বাধ্য হত।

অসংখ্য কর্মক্ষেত্রে নারী আগের চেয়ে অনেক বেশি করে প্রবেশ করছেন নিজের যোগ্যতায়। ডাক্তারি বা প্রযুক্তি তো আছেই কুশলতার মানদণ্ডে ওপরের দিকে। আইটি সেক্টরের নাইট শিফটের মেয়েরা আছেন, আছেন নার্সিং প্রফেশনের মেয়েরাও। এই দুই প্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্রের বাইরেও সাংবাদিকতা থেকে প্রশাসন, সর্বত্র ২৪ ইনটু ৭ ঘন্টার কাজে থাকার অঙ্গীকারে থাকেন মেয়েরা। তাছাড়াও আরও অজস্র পরিষেবাক্ষেত্রে ক্রমাগত প্রবেশ ঘটছে নারীর।

নারী গিগ-ওয়ার্কার (অ্যাপভিত্তিক, বাড়ি বাড়ি জিনিস পৌঁছে দেওয়ার কর্মী), নারী অ্যাপক্যাবচালক, বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানকারী মেয়েরা, মহিলা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। এদের কারও কাজের সময় ধরে বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়।

সমাজ প্রতিবাদ করেছিল এক বা একাধিক অন্যায়ের। মেয়েরা বলেছে রাত দখল করবে। কেন বলেছে? কারণ রাতের অধিকার একমাত্র পুরুষের নয়। এবং অবশ্যই ধর্ষক পুরুষের নয়। “পুরুষ নারী ইস্যু এখানে কিছুই নয়”, এই ভাবনা যেমন গলদপূর্ণ, তেমনই, reclaim the night-এর সরকারি উত্তর কখনও stay back at home হতে পারে না।

ধর্ষক পুরুষদের জেলখানার কয়েদের শিকের আড়ালে রাখার বন্দোবস্ত না করে, প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, যে রাষ্ট্রযন্ত্র মেয়েদের সুরক্ষা দিতে অপ্রস্তুত, অক্ষম বলে স্বীকার করে, knee jerk reaction-বশত এমন একুশে আইন আনে যা আসলে মেয়েদের কাজের জায়গা এবং কাজের সুযোগ খর্ব করে, কাজের সময়ের ওপরে খাঁড়া নামিয়ে আনে, সে-রাষ্ট্র আসলে তার নাগরিকদের সঙ্গে কোনও কথোপকথন করছে না। তার ডায়ালগ করার কোনও ক্ষমতা নেই। সে প্যানিক বাটন টিপছে, না হলে প্রলাপ বকছে, না হলে ঔদাসিন্যে ছেলে ভোলাচ্ছে। এমন রাষ্ট্রযন্ত্রের যে দিন ঘনিয়ে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


*মতামত ব্যক্তিগত