Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমি তিলোত্তমা, আমি অভয়া, আমার ধর্ষণের, আমার মৃত্যুর বিচার চাই, বিচার দাও

সায়নী ব্যানার্জি

 


এমন কত সার্ভেই তো হয়, কত খবরই তো বেরোয়। এক-একটা ধর্ষণের ঘটনা সে পরিবারের জন্য, সে এলাকার জন্য কী অসহ্য পরিস্থিতি ডেকে আনে, সে খবরও তো চোখে পড়ে দিব্যি। আমরা কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে, কিংবা লিঙ্ক খুলে, পড়ে ফেলি, অভ্যাসবশে ভুলেও যাই। ঠিক যেমন কদিন পরেই ভুলে যেতে পারি, হাথরাসের দলিত মেয়েটির পরিবারের দুটো ছোট মেয়ে এখনও স্কুলে যেতে পারে না। খুব নির্মম-নিষ্ঠুর কিছু ঘটলে সবাই মিলে রে রে করে তেড়ে ওঠা। তারপরে? আবারও ফিরে যাওয়া সেই একই ব্যবস্থার মধ্যে? ব্যতিক্রম কি এবার ঘটবে? আপাতত এমন আশায় বুক বাঁধছি

 

প্রথমে খুব ভয় করছিল। তারপরে আস্তে আস্তে ভয় কমেছে, রাগ বেড়েছে। এত মানুষকে পথে নামতে দেখে, এত মানুষের সম্মিলিত চিৎকার শুনতে শুনতে, বিচারের নামে প্রহসন দেখতে দেখতে সেই রাগ আরও বাড়ছে।

শুধু রাগ নয়, এই সিস্টেমের উপর এই মুহূর্তে আমার তীব্র ঘৃণা হচ্ছে। মেয়েটা কোটায় চান্স পেয়েছে, ওকে নিয়ে বেশি ভাবনার দরকার নেই— একজন মহিলার একটি ফেসবুক কমেন্ট মাঝে ভাইরাল হয়েছিল। ‘ধর্ষণের আগে খুন নাকি খুনের আগে ধর্ষণ’, ‘এটা কি একজনের কাজ নাকি গ্যাংরেপ’, ‘একজন যখন গলা টিপল, আরেকজন কি তখন ধর্ষণটা করল’, ‘ঠিক কত কেজি সিমেন গেল মেয়েটার শরীরে’, ‘কীভাবে হাড় ভাঙল’, ‘কীভাবে চোখ থেকে রক্ত পড়ল’— রাস্তাঘাটে, রিসার্চ ল্যাবে, এই নিয়ে তর্ক, আলোচনা। শুনতে শুনতে আমার গা গুলিয়ে উঠছে। এই প্রবল ব্রাহ্মণ্যবাদী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করতে করতেও আমার গা গুলিয়ে উঠছে। অসাম্যে ভরা এই সিস্টেমকে সারাবছর সগর্বে ধারণ-বহন করে এখন যারা আমাদের হয়ে জাস্টিস চাইছে, তাদের দেখেও আমার গা গুলিয়ে উঠছে।

বলতে ইচ্ছে করছে, তোমাদের সকলকে ধিক্কার। ধিক, ধিক, ধিক্কার।

যে রাষ্ট্র নিজের স্বার্থে আড়াল করছে ধর্ষককে, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার মুখোশ এবার খুলে যাক। যখন খুব রেগে উঠছি, তখন মনে হচ্ছে, সবচেয়ে চরম শাস্তি প্রাপ্য হোক ধর্ষকের, খুনির। রাগে দুর্বল মন বলে উঠছে, যদি সেই শাস্তি ফাঁসি হয়, তাই হোক, যদি তা এনকাউন্টার হয়, এবার তাই হোক। পরমুহূর্তেই সামলে নিচ্ছি নিজেকে। এটুকুতেই তিলোত্তমা, একমাত্র মেয়ে হারানো বাবা-মা সুবিচার পেয়ে যাবে, এমনটা আমরা আর মনে করছি না। আমাদের আরও অনেক দাবি আছে। আমরা, মানে সারা পৃথিবীর সেইসব মানুষ, যারা মোমবাতি বা মশাল হাতে, অথবা নানান স্লোগানলেখা কাগজ নিয়ে, দিনে বা রাতে, কখনও-না-কখনও চিৎকার করেছি, বলেছি, “we want justice, we want justice, we want justice”। আর কত আরজিকর, আর কত— এই স্লোগান দিতে দিতেই আমরা খবরে পড়েছি নন্দীগ্রামে এক মহিলাকে নগ্ন করে গ্রামে ঘোরানোর ঘটনা, যেখানে সরাসরি অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে, পড়েছি প্রিয়াঙ্কা হাঁসদার কথাও, অসংলগ্নভাবে কানে এল আরও অন্যান্য ঘটনার কথা— মানে, যেসব ঘটনাকে ‘জাস্ট অ্যানাদার ইনসিডেন্ট’ বলে মন্তব্য করতে আটকাবে না বাঙালির আইকনকুলের।

আমরা তাই থামছি না। তিলোত্তমার জন্যে বিচার চাইছি, প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে দিনে-রাতে পর্যাপ্ত সুরক্ষা চাইছি, প্রত্যেক এক কিলোমিটারের মধ্যে শৌচালয় চাইছি। যে কোনওদিন এমনভাবে ধর্ষিত হয়ে মরে যেতে আমরা চাই না।

আরজিকরের ঘটনার প্রতিবাদে এত মানুষ যে রাস্তায় নেমেছে, সেখানে তিলোত্তমার সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য নানান অন্যায়ের কথা শুনছি। শুনতে পাচ্ছি বহুদিন ধরে জমে থাকা কত ক্ষোভ, যন্ত্রণার কথা। ১৪ আগস্টের ‘মেয়েদের রাতদখল’ বা ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’-এর ডাকের পর থেকে দেখছি, কত কত মানুষ কেবল একদিন নয়, প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক রাত্রে পথে নামছেন। তাঁরা পথেই থাকছেন, লড়াই আমরা ছাড়ছি না, এ-কথা শাসককে প্রত্যেকদিন বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

 

আমি আর তিলোত্তমা একই বয়সি। এই একত্রিশ বছরের জীবনে প্রথম দেখলাম, কোনও একটা ঘটনায় আমার রাজ্যের পাড়ায়-পাড়ায় রাত্রে মিছিল বেরিয়েছে। এনআরসি-সিএএ-বিরোধিতার সময়ে আমার পাড়ায় একটা মঞ্চ হয়েছিল, যেখানে সারারাত বোরখায় ঢাকা মুসলিম মেয়েরা চিৎকার করত, ‘জো তুম না দোগে, হাম ছিন কে লেঙ্গে আজাদি, হ্যায় হক হামারি আজাদি, হ্যায় জান সে পেয়ারি আজাদি, আজাদি আজাদি আজাদি আজাদি’। আমি সেখানে কয়েকদিন গিয়েছিলাম, ওদের সঙ্গে বসে স্লোগান দিতাম, কথা বলতাম। কিন্তু বিজেপি-বিরোধী সেই প্রতিবাদ আমাদের এলাকাবাসীর সকলের প্রতিবাদ হয়ে ওঠেনি। আরজিকরের ঘটনায় যা হয়েছে। আমার ষাটোর্ধ্ব মা তার বন্ধুদের নিয়ে এই প্রথমবার রাস্তায় কোনও মিছিলে হাঁটল। তাও আবার মাঝরাতে।

১৪ আগস্ট ও তারপরে বিচিত্র সব ঘটনা কলকাতায় ঘটে গেছে। কলকাতার মেয়ে আমি এখন কল্যাণীতে। কলেজ স্ট্রিট, যাদবপুর বা অ্যাকাডেমির চেনা রাস্তায় নয়— অচেনা, নতুন গলিতে ‘রাত দখল’-এর মিছিলে হাঁটছি। ১৪ আগস্ট কল্যাণীর ‘ঋত্বিক সদন’-এর সামনের রাস্তা থেকে যখন মিছিল শুরু হচ্ছে, সেই মিছিলের একদম সামনে, বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে, সিংহভাগ স্লোগানিং-এর দায়িত্বে পুরুষই। মেয়েরা আশেপাশে কিংবা পেছনে। আমি অবাক, কিছুটা বিরক্তও। অল্প কিছুক্ষণ হাঁটবার পরে আর না থাকতে পেরে আমি যখন একটি মেয়েকে এ-কথা বললাম, সে পেছন থেকে মেয়েদের দলকে সামনে নিয়ে গেল। বেশ কাঁচুমাচু মুখে পুরুষসিংহরা সামনে থেকে অনিচ্ছা নিয়ে সরে গেলেন।

অবশেষে মিছিলের পুরোভাগে মহিলারা

সামনে থেকে সরে গেলেও নেতৃত্বদানের লোভ থেকে পুরুষসিংহকে রোখা অত সহজ নয়, জানি। এবার, কয়েকজন অতিপাকা ছেলেকে দেখলাম, তাঁরা পাশে থেকে থেকে মিছিল পরিচালনা করছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দারুণ ‘অ্যাপলিটিকাল’, মেয়েদের ডাক দেওয়া মিছিলে একজন মেয়ে বিজেপি-আরএসএস-বিরোধী স্লোগান দিতে চাইলে তাঁর উপর খবরদারি চালাতে গিয়েছিলেন। আমার পুরুষসঙ্গী, যে প্রতিদিনের অনুশীলনে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধের লড়াইয়ে, একজন সত্যি সত্যি ভাল ‘অ্যালি’ হয়ে উঠছে, মিছিলের দৃশ্যমানতা থেকে যে নিজেকে সচেতনভাবে দূরে রেখেছিল, তারই হস্তক্ষেপে ও হাঁকডাকে, এমন তরুণদের সেই পাকামো করা থেকে রোখা গিয়েছে। অনুরূপ ‘অ্যালি’র ভূমিকা পালন করেছেন সেই পুরুষটিও, যিনি বারেবারে এসে আমাদের মশালে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে যাচ্ছিলেন, মশাল নিয়ে সাবধানে চলবার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, সে মনে-করানোর মধ্যে তাঁর সত্যিকারের স্নেহ-উদ্বেগ ছিল, সেভিয়ার কমপ্লেক্স বা নিয়ন্ত্রণ করবার মনোভাব ছিল না।

মশাল-বাহিনি

যাঁদের সঙ্গে মিছিলে হাঁটলাম, আমার মায়ের মতো, তাঁদের অনেকেরই মিছিলে সেদিন প্রথম হাঁটা। সেদিন আমাদের অনেকের হাতেই মশাল ছিল, আমরা সকলে মিলেই চিৎকার করছিলাম, ‘স্বাধীনতার মানে কী, একলা মেয়ের আজাদি’। এই মিছিলে সরকার-বিরোধী স্লোগান উঠেছে, সরকারের নানান দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে কোনও কোনও মানুষের বক্তৃতায়। ওই অতিপাকা ছেলেদের আশা চূর্ণ করে, মিছিল আপন চরিত্রেই ‘অ্যাপলিটিকাল’ থাকেনি।

আমাদের মিছিল শেষ হচ্ছে, পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে আরেকটি মিছিল— মৌন, সামনে-পিছনে শুধুই মহিলারা, সকলের হাতে মোমবাতি, কয়েকজনের হাতে ব্যানার, পোশাকের রং কালো। এমন মিছিলে হাঁটতে আমার দারুণ ভাল লাগত না, তবু আমার সলিডারিটি তাঁদের সঙ্গেও— সেই সবার সঙ্গেই, যারা তিলোত্তমার জন্যে রেগে ফুঁসে উঠেছে, ‘কী হবে এসব মিটিং-মিছিল করে’-র মতো আত্মঘাতী ভাবনাকে ছুড়ে ফেলে যারা পথে নেমেছে।

কল্যাণী কলকাতা নয়, এখানে সারারাত-জাগা মিছিল হয়নি। ১৪ আগস্ট রাতের পর আর কোনও বড় জমায়েত এখনও হয়নি। তবু যে-কোনও দোকানে কিছু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়লেই শোনা যাচ্ছে, আরজিকর। অটোওয়ালা বলে ফেলছেন, ডাক্তার আজও আমাদের কাছে ভগবানের মতন, তাঁরা আমাদের প্রাণ বাঁচান, কত বড় অন্যায় হয়ে গেল। সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা চিকিৎসা করছেন না, গরিব মানুষ ফিরে যাচ্ছেন, এই অভিযোগেও আর ডাক্তারদের বিরুদ্ধতা করার কথা ভাবছেন না কেউ। বরং, অবাক হয়ে দেখছি, সর্বত্র কেমন ঘুরে-ফিরে আসছে সরকারের যোগসাজসের চক্রান্ত।

 

এরই মাঝে বড় হয়ে উঠছে রাজনীতি-অরাজনীতির তর্ক, মূল দাবিকেও তা যেন মাঝেমাঝে ছাপিয়ে যাচ্ছে। অরাজনৈতিক রাখতে চাওয়ার বিরক্তিকর দৃশ্যও যেমন চোখে পড়ছে, তেমনই ভাল লাগছে না, সরকার-বিরোধী কথা সর্বত্র হওয়ার পরেও ‘যথেষ্ট রাজনৈতিক হচ্ছে না প্রতিবাদ’, এই অভিযোগ তুলছেন যাঁরা, তাঁদের বক্তব্যকেও।

অনেক দূর অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পর, নানাবিধ বিষয়ের চর্চায় আমি বুঝতে শিখেছি, রাজনীতি বিষয়টা আসলে কী। যা আমার সঙ্কট, আমার না পাওয়া-না পারা, যাকে একান্তই ব্যক্তিগত বলে মনে হয়েছিল, আজ, বুঝে ফেলছি সে-ই আসলে রাজনৈতিক সঙ্কট। কিন্তু, ‘পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল’, এই তত্ত্ব বুঝতে আমায় যে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, যে মেলামেশা বা চর্চার সুযোগ আমার হয়েছে, আমার শ্রেণির সকল মানুষের সে সুযোগ কোথায়? তার উপর যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের দলীয় রাজনীতির কদর্যতা, সমাজতন্ত্রের ভাঙন, পশ্চাদমুখী রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত, ফলে রাজনীতির প্রতি ঘৃণা, ভয় হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক অনুভূতি। তার সুযোগ নিয়ে ‘সবকিছুতে রাজনীতি করবেন না’-র বয়ান তৈরি করে কর্পোরেট-চালিত শক্তি। এই শ্রেণিগত অবস্থানকে না বুঝে কেবল ‘অরাজনৈতিক’ বলে সাধারণ মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত পথে নামাকে যাঁরা গুরুত্বহীন মনে করছেন, একটু ব্যঙ্গ, একটু তাচ্ছিল্য করছেন, এই সময়ে তাঁদের প্রতিও আমার রেজিস্টেন্স থাকল। তাঁরা আমার শ্রেণিকে চেনেন না, চিনলেও তেমন ভাল বোঝেন না বলেই আমার ধারণা।

এই মুহূর্তে ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ যে কোনও দলের ঝাণ্ডা চাইছে না, এই অবস্থানকে আমি পূর্ণ সমর্থন জানাই। যাঁরা কোনওদিনও রাস্তায় নামেন না, তাঁরা কেন এবার নামলেন, এবং তা কোনও রাজনৈতিক দলের ডাকে বা সেলিব্রিটির মুখের ডাকে নয়, তা বুঝতে গেলে ভেতর থেকেই এই আন্দোলনের চরিত্রকে বুঝতে হবে। এই নৃশংস ঘটনা আসলে সকল মেয়েদের, প্রান্তিক মানুষকে, কুইয়ার মানুষকে মনে করিয়েছে তাদের নিজস্ব ইতিহাস— বঞ্চনার ইতিহাস, যন্ত্রণার ইতিহাস, এবং অবশ্যই অসাম্যের ইতিহাস।

সমস্ত অসম্মান-অপমানেরই চরম ধাপে আসে ধর্ষণ। প্রত্যেক ধর্ষণ আসলে আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া, মেয়ে, তুমি যত বড়ই হও, ডাক্তার কিংবা মোক্তার, শারীরিক-মানসিক শ্রম দিয়ে তুমি মহাকাশে যাও কিংবা অ্যান্টার্কটিকায়, আমার (পুরুষের) চোখে তুমি শুধুই এক দেহ, যে-দেহে একটা দারুণ লোভনীয় যোনি থাকে, যে-পথ দিয়ে তোমার শরীরে প্রবেশ করবার অধিকার আছে আমাদের সকলের, পৃথিবীর সকল পুরুষের। এবং, বেশি বাড় বাড়লে মনে রেখো, তোমার দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অধিকার আছে রাষ্ট্রেরও।

 

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যখন কলকাতা শহরের প্রথম সারির সরকারি মেডিকেল হাসপাতালের অধ্যক্ষের একের পর এক কুকীর্তি সামনে এল, আমরা তখনও অবাক হইনি। কারণ আমাদের রাজ্যে এখন এটাই (দুর্নীতি) স্বাভাবিক। বরং, আমরা নিজেরা আলোচনা করেছি, কীভাবে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অবস্থান করছে এমনই সব আদর্শহীন, অযোগ্য, অসৎ পুরুষ এবং কিছুক্ষেত্রে নারীও, যারা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত। সমস্ত অন্যায়কে যারা প্রশ্রয় দেয়, এমন নৃশংস মৃত্যুর পরও যারা বলে ওঠে, ‘অত রাত্রে মেয়েটা ওখানে কী করছিল’। এই ধরনের ভিকটিম-ব্লেমিংকে আইনের আওতায় আনতে হবে, এই দাবিও উঠে এসেছে এই আন্দোলন থেকে।

২০১২-র দিল্লির নির্ভয়ার ঘটনার পরে, ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী তখন আমি— ফাঁকা বাসে উঠতে ভয় করত। সেই বছর কী ভীষণ ঠান্ডা পড়েছিল কলকাতায়! বাসে উঠলেই তখন মনে হচ্ছে, এই যে আমার যোনিপথ, তার মধ্যেই লোহার রড ঢুকিয়ে দিতে পারে অজানা যে কেউ? আমার অনুমতি ছাড়া কেউ এই সংবেদনশীল পথে প্রবেশের অধিকার কেন পাবে? অনুপ্রবেশের যে যন্ত্রণা, তা যেমন শারীরিক, মানসিকও। কোনও পুরুষ কোনওদিনও কি তা অনুভব করতে পারে?

বাসে উঠে একবার দেখে নেওয়া, শুধুই পুরুষ নেই তো, তেমনটা হলে একটু সাবধানে থাকা— এটা এখনও আমার অভ্যাসের মধ্যে রয়ে গেছে। আজ যখন একথা ভাবছি, কী অসম্ভব রাগ হচ্ছে। সেই ঘটনার পরে আরও বারো বছর কেটে গেল, কেন্দ্রে-রাজ্যে-জেলায় কত রকমের ক্ষমতার হস্তান্তর, কত রকমের আইন পরিবর্তন, তবু কী ভীষণ যন্ত্রণা সহ্য করতে হল তিলোত্তমাকে, প্রিয়াঙ্কাকে। আরও কত কত মেয়েকে। গুগলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ-দেশে ঘণ্টায় চারটে ধর্ষণ হয়।

তা এমন কত সার্ভেই তো হয়, কত খবরই তো বেরোয়। এক-একটা ধর্ষণের ঘটনা সে পরিবারের জন্য, সে এলাকার জন্য কী অসহ্য পরিস্থিতি ডেকে আনে, সে খবরও তো চোখে পড়ে দিব্যি। আমরা কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে, কিংবা লিঙ্ক খুলে, পড়ে ফেলি, অভ্যাসবশে ভুলেও যাই। ভুলে যেতে হয়। ঠিক যেমন কদিন পরেই ভুলে যেতে পারি, হাথরাসের দলিত মেয়েটির পরিবারের দুটো ছোট মেয়ে এখনও স্কুলে যেতে পারে না, বাড়ির বাইরে এখনও পুলিশের ক্যাম্প, সই না করে মাছি গলার উপায় নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি।

খুব নির্মম-নিষ্ঠুর কিছু ঘটলে সবাই মিলে রে রে করে তেড়ে ওঠা। তারপরে? আবারও ফিরে যাওয়া সেই একই ব্যবস্থার মধ্যে? ব্যতিক্রম কি এবার ঘটবে? আপাতত এমন আশায় বুক বাঁধছি। চাইছি, ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’, বা অন্য কোনও নারীবাদী মঞ্চ, যারা এমন বিষয় নিয়ে সারাবছর কাজ করছে, তাদের আন্দোলন আরও দানা বাঁধুক, খুঁজে পাক সঠিক রাজনৈতিক দিশা। সাধারণ মানুষের সমর্থন আসতে বাধ্য। জেন্ডার ইকুয়ালিটি ইন্ডেক্সে, ১৪৬টা দেশের মধ্যে ১২৯ নম্বর স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ‘ভিক্সিত’ এদেশে নিপীড়িত নারীর অভাব নেই। পুরুষতন্ত্রে জর্জরিত বোধ করা পুরুষেরও এদেশে কমতি নেই।


*মতামত ব্যক্তিগত