আহমেদ-খান হীরক
চতুর্থ পর্বের পর
দ্য আর্টিস্ট
: হাতি আঁকতে পারো?
খসখস।
: বাহ। সুন্দর তো! কিন্তু হাতির শুঁড়টা তো কেমন টিকটিকির লেজের মতো হয়ে গেছে!
: আমার হাতির লেজ এরকমই।
: তুমি কখনও হাতি দেখেছ?
: না।
: তাহলে আঁকলে কীভাবে?
: ছবিতে দেখেছি! হাতি মেরা সাথী নামের ছবিতে হাতি দেখেছি। টারজান কার্টুনেও হাতি দেখেছি!
আমার ড্রইং খাতার দিকে অবাকভাবে তাকিয়ে আছে জেবা। আমার ফুপাতো বোন। আমি তাকে আরও বিস্মিত করার জন্য সাঁই সাঁই করে হাত চালালাম — একটা গাছ এঁকে ফেললাম। গাছে দুইটা পাখি। একটা পাখি কিছুটা রুগ্ন।
জেবা বলল, তুমি সব আঁকতে পারো?
আমি বুক ঢুকে বললাম, হুম!
: ইশ! আমি যদি আঁকতে পারতাম!
এই দীর্ঘশ্বাস এখন প্রায় সবারই। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠা প্রায় সব বন্ধুদের মধ্যে যেমন এই দীর্ঘশ্বাস বিরাজে, ঠিক তেমনি বড় ভাইদের মধ্যেও।
আমি যে আর্টিস্ট হয়ে গেছি তা তখন ছড়িয়ে পড়ছে রহনপুরে।
বড় ভাইয়েরা তাদের এবং তাদের প্রেমিকাদের প্র্যাকটিক্যাল খাতা নিয়ে মোটামোটি ধরণাই দিচ্ছে বাড়িতে। আমি আমার ছোট্ট ঘরের ব্যক্তিগত বিছানার ওপর বসে খাতা নিরীক্ষা করছি। পেনসিল রবার (আসলে ইরেজার — চিরকাল রবার বলতেই শিখেছি) নিয়ে দেখে নিচ্ছি কতদিনের মধ্যে আঁকা যাবে। আঁকার পর তরিকুল ভাই মিষ্টি খেতে বিশ টাকা দেওয়ার পর এই আগ্রহ আরও বেড়েছে। তাছাড়া, আমি আঁকিয়ে — দ্য আর্টিস্ট এটা জাহির করার মতো এমন সুযোগও তো হাতছাড়া করতে চাই না!
কেন এই জাহির করা?
তারও কারণ আছে। কারণ হল আমি এমনিতেই কিন্তু ডানপিটে টাইপ না। ঘুড়ি ওড়াতে পারি না, মার্বেল খেলতে পারি না, ফুটবলে শট মারলে পায়ে ব্যথা পেয়ে যাই। আমার সমবয়সীরা যখন টানা সাঁতার কেটে পুনর্ভবার ওইপাড়ে গিয়ে ঢিলিয়ে আম পারে, আমি তখন পাথর ঘাটেই গোল গোল ঘুরে মৃদু সাঁতারের প্র্যাকটিস করি। এই প্রায় নির্বিষ শৈশবে ছবি আঁকতে পারাটা ছিল আমার জন্য বেশ উত্তেজনার। নিজেকে তাই এত জাহির করার একটা চেষ্টা — দেখ, দেখ, আমিও কিছু পারি।
কিন্তু আমি যে আঁকি তার এহেন সুবাস ছড়িয়ে পড়ার আগে রয়েছে এক গল্প। সে গল্পটাও ইতোমধ্যে বলে নেয়া ভালো। আরেকটা কথা একটু বিনয়ের সাথে বলতে চাই আমাদের ওই গ্রাম-গ্রাম মফস্বলে যে-কোনও কিছুকেই, খুব স্বাভাবিকভাবেই, খুব বড় করে দেখা হত তখন — আমি যে ভীষণ কোনও আঁকিয়ে হয়ে গিয়েছিলাম সে সময় তা তো না। কিন্তু আমি একটা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছিলাম। গল্পটা সেটারই!
ক্লাস ফাইভের অংক ক্লাস।
টানা এক মাস হুপিং কাশি টাইপের জিনিসের সাথে যুদ্ধ করে স্কুল গিয়েছি। আটাত্তর থেকে বত্রিশ বাদ দিতে বললে চোখে সর্ষেফুল দেখি। নুরুল স্যার দুইটা অংক করতে দিলেন আমাকে। খাতার দিকে তাকিয়ে মনে হল দুর্ভেদ্য কোনও সংকেত লেখা আছে। আমি আকাশ থেকে পড়তে পড়তে নুরুল স্যারের সামনে পড়লাম। খাতায় যা উত্তর লিখেছি তাতে চওড়া একটা থাবড়া খেলাম গালের ওপর। বয়স ছোট, কচি গাল, ফরসা ত্বক — সব কিছু মিলিয়ে থাবড়াটা শোভনীয় হল। আমার গালে নুরুল স্যারের তিন আঙুল বসে গেল! অন্য দুইটা আঙুল বসেনি, কারণ অত বিস্তৃত জায়গা আমার চোয়ালে ছিল না। দাঁত নড়ে গেল বলে ভ্রম হল। চোখ ফেটে পানি এল। কাঁদতে পারলাম না। আমরা তখন কম্বাইন্ড ক্লাস করি। ছন্দা-শাহিদারা একেবারে সামনে বসে। আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম।
স্যার বললেন, একে ঘাড় ধরে স্কুল থেকে বের করে দেয়া উচিত!
আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। এখন স্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে আমার কোনও আফসোস নেই, কিন্তু ব্যাপারটা তো বাড়িতে জানবে! আব্বা-আম্মা কী বলবে ভাবতে গিয়ে মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেল।
স্যার বললেন, আশিকে দশ দিয়ে ভাগ করলে সাতাত্তর হয়?
আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম। হয় না? আমি তো হিশেব করে তা-ই বের করলাম!
নুরুল স্যার খাতাটা আবার টেনে নিলেন। বড় একটা গোল্লা দিয়ে বললেন, নোটবুক আনো!
এই নোটবুকের বিষয়টা ক্লিয়ার করা উচিত।
আমাদের স্কুলটা ওই মফস্বলের একমাত্র কিন্ডারগার্টেন টাইপ ছিল বলে নানারকম ফাজলামি ছিল। এসব ফাজলামির একটা হল নোটবুক। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকা লিখে দিতেন কার কেমন পারফরমেন্স ক্লাসে। নিচে সিগনেচার করে মন্তব্যের ঘরটা দেখিয়ে বলতেন অভিভাবকের সই করে আনতে! নোটবুক ছিল আমাদের স্টুডেন্টদের এক বিভীষিকা!
আমি নোটবুক আনতে যাব তখনই দরজায় দাঁড়ালেন মামা।
মামা মানে স্কুলের পিয়ন। কী নাম ছিল মামাটার এখন মনে পড়ছে না। বা আদৌ মনে ছিল না কখনও। কারণ তাকে মামা ডেকেই আমাদের দিন বেশ চলে যেত। মামা ঘণ্টা বাজাত, নোটিশ নিয়ে আসত, আর গামলায় ভরে টিফিন নিয়ে ঢুকত টিফিন পিরিয়ডে। টিফিনের কারণে মামা আমাদের কাছে মন্ত্রী লেভেলের সম্মান ও তোষামোদ পেত।
স্যারের অনুমতি নিয়ে মামা ক্লাসে ঢুকেই একটা নোটিশ পড়লেন —
এতদ্বারা স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জানানো যাচ্ছে যে, এ বছর আবার মৌসুমী প্রতিযোগিতা শুরু হতে যাচ্ছে। প্রতিযোগীরা নিম্নের বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে —
১. কেরাত
২. আজান
৩. কবিতা আবৃত্তি
৪. উপস্থিত বক্তৃতা
৫. ড্রইং
আগ্রহীরা বিষয় উল্লেখ করে নিজের নাম জমা দেবে পিটি স্যারের কাছে।
ক্লাসে গুঞ্জন শুরু হল। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না নোটবুক নিয়ে যাব কি যাব না স্যারের কাছে। এরমধ্যেই মামা বললেন, যারা নাম দিবে তারা যেন এক্ষুণি অফিস রুমে গিয়ে পিটি স্যারের কাছে দেখা করে!
এই-ই সুযোগ!
কিছু পারি আর না-পারি পিটি স্যারের কাছে নাম দিতে যাই। এতে আর যাই হোক নুরুল স্যারকে নোটবুক দিতে হচ্ছে না। আমি সাথে সাথে হাত তুললাম!
এবং আমি একাই হাত তুললাম আমাদের ক্লাস থেকে!
নুরুল স্যার অত্যন্ত রাগী রাগী চোখে আমার দিকে তাকালেন।
: তুই কী করবি? কী পারিস তুই?
আমি বিড়বিড় করে কিছু বললাম। বলাই বাহুল্য, স্যার তা বুঝলেন না। হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, কী করবি তুই?
হঠাৎই ভীষণ পেশাব পেয়ে গেল। তোতলাতে তোতলাতে বললাম, আঁকব স্যার! ছবি!
ব্যস, মৌসুমী প্রতিযোগীতায় আমার নাম লেখানো হল ড্রইঙে।
ড্রইঙের দুইটা বিভাগ — পেনসিল স্কেচ আর জলরঙ।
আমার নাম দুটাতেই থাকল।
কিন্তু প্রতিযোগিতায় গিয়ে ডিসকোয়ালিফাই হয়ে গেলাম জলরঙে।
আমাদের কারও কাছেই জলরঙ ছিল না। এমনকি আমরা যারা আঁকতে বসেছিলাম তাদের কারও ধারণা পর্যন্ত ছিল না জলরঙ বিষয়টা আসলে কী!
আমি জলরঙের বদলে রঙ করেছিলাম কাঠ-পেন্সিল দিয়ে। সেই পেন্সিল রঙও আমার কাছে ছিল না। প্রতিযোগিতা মাঝরাস্তায় ফেলে দৌড়ে এক বন্ধুর দোকানে গিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এত ছোটাছুটি সবই বৃথা! পেন্সিল রঙ জলরঙ নয় বলে বাতিল হল আমার আঁকা ছবি। আর রনি ফার্স্ট হল জলরঙে। না, সেও জলরঙ ব্যবহার করতে পারেনি। ছিল না তারও। কিন্তু সে ব্যবহার করেছিল স্কেচপেন। স্কেচপেন পেন্সিল রঙের থেকে অধিক জলসমৃদ্ধ এই ছিল বিচারকদের দাবী!
আমি জলরঙে ডিসকোয়ালিফাই হয়ে স্কেচে মনোযোগী হলাম।
কী আঁকতে দিবে এই দুশ্চিন্তায় হাত-পা কাঁপতে থাকল। শেষে বিষয় পাওয়া গেল — একটি গ্রামের দৃশ্য!
তা গ্রামের দৃশ্য আমি আগেও এঁকেছিলাম।
বইয়ে আঁকা গ্রাম দেখে দেখে আঁকা ওইসব কসরত সেদিন কাজে দিল।
আমি হাশেম খানকে খুব বাজেরকমভাবে কপি করে আঁকলাম নদী ও পর্ণকুটির। পাশে গোল খড়ের গাদা। একটা গাছ — সম্ভবত আমের। আর একটা মুরগী। মুরগীই…তবে দেখতে কিছুটা মোরগ মোরগ লাগে।
আকাশে মেঘ। মেঘের ভেতর পাখি। মেঘের ওপার থেকে বেরিয়ে আসা সূর্যকিরণ!
হাশেম খান পেলে আমাকে নিশ্চয় থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দিতেন।
কিন্তু বিচারকেরা খুব খুশি হলেন সেই ছবিতে।
জলরঙের রনিকে সেকেন্ড করে আমাকে ফার্স্ট করলেন। আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। কিন্তু একটু পরেই শুনতে পেলাম মৌসুমী প্রতিযোগিতায় যারা ফার্স্ট হবে তারা জেলাসদরে গিয়েও জেলাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। আমার মনটা মুচড়ে উঠল। আমি জানি, আমাকে জীবনেও নবাবগঞ্জ যেতে দিবে না বাড়ির লোকজন!
হুদাই এ ফার্স্ট হওয়া!
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাড়ির সবাই, বিশেষত আম্মা (যাকে নিয়েই আমার বেশি ভয় ছিল), যেতে দিলেন জেলাসদর।
আমরা একটা লম্বা কাফেলা রওনা দিলাম।
কেরাতে একজন, আজানে একজন, তবলায় একজন, উপস্থিত বক্তৃতায় একজন, আর আমরা ড্রইঙে। আমরা মানে আমি আর রনি।
এখানে রনির একটু পরিচয় দিই।
রনি আমার এক বছরের জুনিয়র। মানে ক্লাস ফোরে পড়ে সে। গোলগাল মুখ আর লম্বা চুলের মেয়ে। চেহারা সুন্দর। সুন্দর হওয়ার ফলে একটু অহঙ্কারী, বা একটু অহঙ্কারী হওয়ার ফলে সুন্দর। সে তার চাচার সাথে আর আমি পিটি স্যারের সাথে চলেছি জেলাসদর নবাবগঞ্জ। এবং চলতে চলতে, লম্বা সময় মাইক্রোবাসে থাকার ফলে, প্রথমেই সমরদার রেশমি পাঞ্জাবিটা আরেকটু হলুদ করে দিয়েছি বমি করে। আমরা চাপাচাপি বসে বমির গন্ধ নিতে নিতে যখন নবাবগঞ্জ পৌঁছালাম তখন সকাল আটটা।
নয়টায় প্রতিযোগিতা।
ইতোমধ্যে রনিরা জলরঙ কিনে নিয়ে এল নিউমার্কেট থেকে। আর আমি বুক ধুকপুক নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আমার সঙ্গে সাত-আট জন প্রতিযোগী। তাদের চেহারাই খতরনাক! ঘাতক ঘাতক ভাব। আমি আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকলাম যেন আবার একটা গ্রামের দৃশ্য আঁকতে দেয়। আর আমি যেন আবার হাশেম খান মেরে চলে আসতে পারি।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক!
আমাদের ছবি আঁকার বিষয় দেয়া হলো — মোমবাতি!
মোমবাতি! মোমবাতি!!
মোমবাতি আঁকার কোনও সাবজেক্ট হল নাকি?
আমাদের ঘরভরা এমন গুঞ্জন উঠল। অন্য প্রতিযোগীদের দেখলাম হতাশ। একজন তো কাঁদতেই শুরু করে দিল। আর আমি থ্যাঙ্কস দিলাম জামাল আনসারীকে।
কে এই জামাল আনসারী?
নেতা।
মৌসুমী প্রতিযোগিতার ক’দিন আগেই আমাদের ওখানে ইউনিয়ন নির্বাচন হয়ে গেছে। অনেকের মতো চেয়ারম্যান পদে জামাল আনসারীও ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। আর তিনি প্রতীক পেয়েছিলেন মোমবাতি। ফলে আমাদের এলাকা আরও অন্যান্যর সাথে মোমবাতির পোস্টারেও সয়লাব হয়ে গিয়েছিল।
একটা জ্বলন্ত মোমবাতি। যার গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে দুই ফোঁটা মোম!
ডাব, হাতি, তালপাখা ইত্যাদি মার্কার সাথে আমি তখন মোমবাতিও ঢের এঁকে এঁকে অংকের খাতা ভরিয়ে তুলেছিলাম। ভাগ্যিস তুলেছিলাম, ফলে জেলাসদরেও মোমবাতি আঁকাটা খারাপ হল না। আর আমি আরেকবারের মতো ফার্স্ট হলাম।
শুনলাম, এবার ফার্স্টদের নিয়ে বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় যাওয়া হবে। বিভাগ মানে রাজশাহী। রাজশাহী তখন অনেক দূরের পথ। ট্রেনে চেপে যেতে হয়, ট্রেনে চেপে ফিরতে হয়। দিনে গিয়ে দিনে ফেরত আসা যায় না বোধহয়। ফলে আমি নিশ্চিত হলাম আম্মা আমাকে কখনওই যেতে দেবে না। আমি জেলাসদরের ফার্স্ট হওয়া নিয়েই খুশি থাকলাম!
কিন্তু এক শীতের ভোরে, আমরা এসে দাঁড়ালাম প্ল্যাটফর্মে। আমি, আম্মা আর আব্বা।
ট্রেন চলে যাবে। কিন্তু আম্মা আমাকে ছাড়ছেন না। ওদিকে অপেক্ষা করছে পিটি স্যার। সঙ্গে রনির চাচা ও রনি। (রনিও ফার্স্ট হয়েছিল জলরঙে; এবার সত্যিই সে জলরঙ ব্যবহার করেছিল)। সঙ্গে আছেন সমরদা। সমরদা তবলা বাজান। যখন বাজান না তখনও তার আঙুল চলতে থাকে। কোথাও মিউজিক বেজে উঠলে তার আঙুল কেঁপে কেঁপে ওঠে। সঙ্গে আছে শাহ আল সফী আনসারী। তিনি গাছ-গাছরা দিয়ে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে বসে আছেন। আমরা তার দিকে নিউটন দেখার বিস্ময় নিয়ে তাকাই।
ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে! আম্মা আমার গালে চুমু দিচ্ছেন! আর পিটি স্যার উদ্বেগ নিয়ে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন… এরকম একটা দৃশ্য এখন মাথায় আবিষ্কার করি। তারপর কীভাবে ট্রেনে উঠেছিলাম, কীভাবে গিয়ে বসেছিলাম, আর আমার প্রতি আম্মার অতি-আদর নিয়ে কীভাবে সবাই হাসাহাসি করেছিল তার সবটা এখন মনে নেই। শুধু ফিসফিস করে রনি বলেছিল, তোমার আম্মুটা কী ভালো!
তো এটা শুনে তখন লজ্জার সাথে সাথে আমার একটু গর্বও হয়েছিল। আর রনিকে এই প্রথম ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল মেয়েটার চেহারাটা তো শমী কায়সারের মতো!
রনিকে ভালো লাগা ছাড়া রাজশাহীতে আর বলার মতো কোনও গল্প ছিল না।
কারণ আমি আর রনি দুজনেই খুব বাজেভাবে হেরে গিয়েছিলাম রাজশাহীর কুশলী আর্টিস্টদের কাছে। ফেরার সময় রাতের ট্রেনের বাঙ্কারে বসে ‘স্বজন’ সিনেমার গানে মাতোয়ারা হওয়া আর ট্রেন বদল করতে গিয়ে সমরদার নতুন স্যান্ডেল হারানো ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও ঘটনাও ঘটেনি। তবু, এই ক’দিনের মৌসুমী প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মনে মনে আমি আর্টিস্ট হয়ে উঠেছিলাম।
আর হ্যাঁ, জলরঙের একটা বাক্স আমি কিনে এনেছিলাম রাজশাহী থেকে। ছাপান্ন টাকায়। সঙ্গে একটা তুলি দিয়েছিল ওরা। বলেছিল, তুলিটা কাঠবেড়ালির পশম দিয়ে তৈরি। কিন্তু সে তুলি তেমন ব্যবহার করা হত না। আমি বরং পেনসিলের নিব তিক্ষ্ণ করাতেই বেশি মন দিয়েছিলাম। কারণ সেটা দিয়েই তো প্র্যাকটিক্যাল খাতাগুলো আঁকতে হত। বিভিন্ন আকারের বিকার, ব্যাঙ, কেঁচো, তেলাপোকা ইত্যাদি আঁকতে আঁকতে কবে যেন আঁকাটা ভুলে গেলাম। তবে আমার বন্ধুদের কেউ কেউ এখনও সেটা মনে রেখেছে। দেখা হলে বলে, লেখালেখিতে তো কিছু করতে পারলি না! যদি তুই আঁকার লাইনে যেতি তাহলেই ভালো করতি! তখন আমি আমার শব্দগুচ্ছের দিকে তাকিয়ে থাকি! শব্দগুচ্ছ ধীরে ধীরে স্বর্গছেঁড়া গ্রামের দিকে ধাবিত হতে থাকে।
ষষ্ঠ পর্ব আগামী সংখ্যায়