Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্যাপ্টেন দুপুরে ভাত খেতে গেছে আর নাবিকেরা দখল নিয়েছে জাহাজের — চতুর্থ পর্ব

চার্লস বুকাওস্কি

বাংলায়ন : শুভঙ্কর দাশ

(তৃতীয় পর্বের পর)

 

৯-২১-৯১

রাত ৯টা ২৭

গত রাতে একটা সিনেমার প্রিমিয়ারে গেছিলাম। লাল কার্পেট। আলোর ঝলকানি। তারপর পার্টি। দুটো পার্টি পরের দিকে। বড্ড ভিড়। বড্ড গরম। প্রথম পার্টিতে বারের এক কোণায় আমাকে ধরল একজন তরুণ যার গোল গোল চোখ আর সে চোখের পাতা ফেলে না একদম। আমি জানি না ও কী খেয়ে ছিল। অথবা কোন নেশার উৎরাইয়ে ছিল। বেশ কিছু মানুষই ছিল এরকম। তরুণটির সঙ্গে ছিল তিনটি বেশ সুন্দরী মেয়ে আর ও সমানে আমাকে বলে যাচ্ছিল ওরা লিঙ্গ চুষতে কত ভালোবাসে। সুন্দরীরা শুধু হাসছিল আর বলছিল, ‘ওহ, সত্যি তাই’। আর পুরো কথোপকথনটাই চলছিল ওভাবে। সমানে জাস্ট ওভাবেই। আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম ব্যাপারটা সত্যি নাকি আমাকে জাস্ট ঢপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ব্যাপারটা আমাকে ক্লান্ত করে দিল। কিন্তু তরুণ ছেলেটি সমানে আমাকে বলে চলল ওই সুন্দরীরা লিঙ্গ চুষতে কত ভালোবাসে। ওর মুখটা আমার দিকে এগিয়ে আসছিল আর ও সমানে বলে যাচ্ছিল ওইসব। শেষে, আমি হাত বাড়িয়ে ওর জামার কলারটা ধরলাম শক্ত হাতে, আর ধরে বললাম, ‘শোনো বাবা, এটা কি আদৌ ভাল দেখাবে যদি ৭১ বছরের একটা বয়স্ক লোক তোমাকে কেলিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেয় সবার সামনে, দেখাবে কি?’ তারপর ওকে ছেড়ে দিলাম আমি। ও বারের আরেক কোণায় চলে গেল, ওর পেছন পেছন গেল ওর সুন্দরীরা। শালা, আদৌ যদি কিছু মানে বার করতে পারতাম এটার।

আমার মনে হয় আমি অনেক বেশি অভ্যস্ত একটা ছোট ঘরে শব্দদের নিয়ে খেলতে। যথেষ্ট মনুষ্য প্রকৃতি আমার দেখা হয়ে গেছে ঘোড়দৌড়ের মাঠে, সুপারমার্কেটে, পেট্রল পাম্পে, ফ্রিওয়েতে, কাফে ইত্যাদিতে। কিছু উপায় নেই এছাড়া। কিন্তু নিজের পোঁদে লাথি মারতে ইচ্ছে করে আমার যখন এই ধরণের জমায়েতে যাই আমি, বিনিপয়সার মদ দেওয়া হলেও। আমার জন্য এটা কাজে দেয় না আদৌ। আমার যথেষ্ট মাটি আছে খেলার জন্য। লোকজন আমাকে শূন্য, খালি করে দেয় একেবারে। আমাকে পালাতে হয় ভেতরটা আরেকবার ভরার জন্য। আমার জন্য সেরা হল এখানে লেদকে বসে একটা বিড়ি টানা আর দেখা স্ক্রিনে শব্দের ঝলকানি। খুব কমই দেখা হয় একজন অন্য রকম আর ইন্টারেস্টিং মানুষের সঙ্গে। এটা জ্বালাতনের থেকেও বেশি, এটা বাঁড়া একটা শক যা চলছে সমানে। আমাকে একটা অসন্তোষের বিড়বিড়ানির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। যে কেউ অসন্তোষে বিড়বিড় করতে পারে আর বেশিরভাগ লোকই তাই করে। বাঁচাও।

আমার ঠিকঠাক একটা রাতের ঘুম দরকার। কিন্তু প্রথমে শালা কিছুই পড়ার নেই। মোটামুটি ঠিকঠাক সাহিত্য কিছুটা পড়ার পর, এখন আর কিছুই নেই। ওটা আমাদেরই লিখতে হবে। আকাশ বাতাসে আর রসকষ কিছু নেই। কিন্তু আমি ভাবি আমি সকালে ঘুম থেকে উঠব। আর যে সকালে আমি উঠব না, ভালো কথা।

আমার আর জানালার পর্দা লাগবে না, দাঁড়ি কামানোর ব্লেড, ঘোড়দৌড়ের কাগজ বা ম্যাসেজ নেওয়ার যন্ত্র। ফোনগুলো তো বেশিরভাগ আসে আমার বউয়ের জন্য। বিপদের ঘন্টা বাজে না আমার জন্য।

ঘুম, ঘুম। আমি আমার পেটের উপর শুয়ে ঘুমোই। পুরনো অভ্যেস। আমি এত পাগলীদের সাথে কাটিয়েছি। গুপ্তাঙ্গকে তো বাঁচাতে হবে। এটা খুব খারাপ যে তরুণ ছেলেটি আমাকে চ্যালেঞ্জ করল না। আমার তো মুডই ছিল গাঁড় ভেঙ্গে দেওয়ার। খানিকটা আনন্দ পাওয়া যেত। শুভ রাত্রি।

৯-২৫-৯১

রাত ১২টা ২৮

একটা গরম বোকা বোকা রাত্রি, বেড়ালগুলো খুব কষ্টে আছে, ওই অত লোমের ভেতর, ওরা আমার দিকে তাকায় অথচ আমি কিছুই করতে পারি না। লিন্ডা বেরিয়েছে ওকে কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে। ওর কাজ আছে, দেখা করার আছে। আমার জন্য ঠিকই আছে কিন্তু ও মাঝে মাঝে মদ খেয়ে ফেলে আর ওকে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। আমি ভালো সঙ্গ দিতে পারি না, বকবক করা আমার ধাতে সয় না। আমার ভাব আমি কারও সাথে বিনিময় করতে চাই না অথবা আত্মা। আমি এক খণ্ড পাথর যে নিজেকে নিয়ে থাকে। আমি উৎপীড়িত না হয়ে এর ভেতরেই থাকতে চাই। শুরু থেকেই ব্যাপারটা এরকম। আমি আমার বাবা মা’র বিরোধিতা করেছি, তারপর বিরোধিতা করেছি স্কুলের, তারপর বিরোধিতা করেছি একজন ভদ্র নাগরিক হয়ে ওঠার পদ্ধতির। মানে আমি যা তা শুরু থেকেই ছিল আমার ভেতর। এটা নিয়ে আমায় কেউ ঘাঁটাক আমি চাইতাম না। এখনও চাই না।

আমি মনে করি যারা নোট বই সাথে রাখে আর তাতে লিখে রাখে তাদের ভাবনা তারা সব বালছাল। আমি এটা করছি কারণ কেউ আমাকে বলেছে এটা করতে, তো দেখলেন, আমি একজন মৌলিক বালছালও নই। কিন্তু এটাই ব্যাপারটাকে অনেকটা সহজ করে দেয়। আমি জাস্ট ব্যাপারটাকে বেরোতে দি। অনেকটা পাহাড় থেকে পড়তে থাকা গরম ন্যাড়ের মতো।

আমি জানি না ঘোড়দৌড়ের মাঠ নিয়ে আমি কী করব। আমার মনে হয় এটা আমায় নিজেকে পোড়াতে সাহায্য করে। আজ দাঁড়িয়েছিলাম হলিউড পার্কের কাছে, ইন্টার-ট্র্যাক বাজির জন্য, ফেয়ারপ্লেক্স পার্কের ১৩টা রেস। ৭ নম্বর রেসের পর আমি জিতছিলাম ৭২ ডলার। তো? ওটা কি আমার ভুরুর সাদা চুলগুলো সরাতে পারবে? আমাকে কি একজন অপেরা গায়ক বানাতে পারবে? আমি কী চাই? আমি একটা শক্ত খেলাকে হারাচ্ছি, আমি হারিয়ে দিচ্ছি ১৮% ফেরত পাওয়াকে। আমি এটা করেই থাকি। তাই, এটা নিশ্চয়ই খুব একটা শক্ত খেলা নয়। কী চাই আমি? আমি কেয়ার করি না ঈশ্বরের অস্তিত্বে। এটা নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। তো এই ১৮% ব্যাপারটা কী?

আমি তাকিয়ে দেখি সেই লোকটাই কথা বলছে। ও রোজ দাঁড়িয়ে থাকে একই জায়গায় এর ওর সাথে কথা বলে। রেসের কাগজ হাতে নিয়ে ঘোড়াদের সম্পর্কে কথা বলে। কী একঘেয়েমি। কী করছি আমি এখানে?

আমি চলে যাই ওখান থেকে। হেঁটে যাই পার্কিং-এর দিকে, আমার গাড়িতে উঠে বেরিয়ে চলে যাই। এখন মোটে বিকেল ৪টে। কী ভালো। আমার গাড়ি এগিয়ে চলে। অন্যরাও এগিয়ে চলে। আমরা সবাই একটা পাতায় বাওয়া শামুকের দল।

তারপর বাড়ি ফিরি। গাড়ি দাঁড় করাই। নামি। লিন্ডার একটা ম্যাসেজ ফোনের সাথে টেপ দিয়ে লাগানো। চিঠিপত্র কী এল দেখি। গ্যাসের বিল। আরেকটা বড় খাম ভর্তি কবিতা। সমস্ত ছাপানো, প্রতিটা কবিতা আলাদা আলাদা কাগজে। মেয়েরা কথা বলছে তাদের মাসিক নিয়ে, তাদের মাই নিয়ে আর কীভাবে চোদাল তাই নিয়ে। অত্যন্ত খারাপ লেখা। আমি সোজা ওটা ময়লার বালতিতে ফেলে দি।

তারপর মাল খালাস করি। বেশ ভালো লাগে। জামা কাপড় খুলে সুইমিং পুলে গিয়ে নামি। বরফের মতো হয়ে আছে জলটা। কিন্তু ভালো লাগে। আমি হেঁটে হেঁটে পুলের গভীর দিকটার দিকে এগোই, ইঞ্চি ইঞ্চি করে জল বাড়ে, আমাকে ঠাণ্ডা করে। তারপর ঝাঁপ মারি জলের তলায়। যেন একটা আশ্রয়। আমি কোথায় পৃথিবী জানে না। আমি উঠে আসি, সাঁতরে দুরের ধারটায় যাই, সরু তাকটা খুঁজে নিয়ে বসি তাতে। এটা নিশ্চয়ই ৯ বা ১০ নম্বর রেসের ব্যাপারে। ঘোড়াগুলো এখনও ছুটছে। আমি আবার জলে ডুব মারি, আমার বোকা বোকা ফর্সা চামড়ার কথা মাথায় রেখে আর আমার বয়স যা ঝুলে আছে একটা জোঁকের মতো। তবু ঠিকই আছে। আমার তো ৪০ বছর আগেই মরে যাওয়ার কথা। আমি আরেকবার সাঁতরে দূরের ধারটায় গেলাম, তারপর উঠে পড়লাম জল থেকে।

এটা অনেক দিন আগের ঘটনা। আর এখন আমি বাড়ির উপর তলায় ম্যাকিন্টসের সাথে। আর আজকের মতো এটুকুই। এখন মনে হয় আমি ঘুমব। কালকের ঘোড়দৌড়ের জন্য বিশ্রাম নেব।

৯-২৬-৯১

রাত ১২-১৬

আজকে হাতে পেলাম নতুন বইটার প্রুফ। কবিতার বই। মার্টিন বলছিল এটা প্রায় ৩৫০ পাতার হবে। আমার মনে হয় কবিতাগুলো দাঁড়িয়েছে। আমি একটা বুড়ো ট্রেন ধোঁয়া ছেড়ে চলেছি ট্র্যাকের উপর দিয়ে।

পড়তে কয়েক ঘন্টা লাগল। এই ব্যাপারে আমার কিছুটা অভ্যাস আছে। লাইনগুলো স্বাধীন, আসছে একের পর এক আর বলছে সেই কথা যা আমি তাদের বলাতে চাই। আমিই আমাকে প্রধানত প্রভাবিত করেছি।

বাঁচতে গিয়ে আমরা সবাই বিভিন্ন ফাঁদে পড়ি আর ছিঁড়ে-ফেঁড়ে যাই। কেউ বাঁচতে পারে না তার থেকে। কেউ কেউ আবার বেঁচে থাকে তাই নিয়ে। কথাটা হল এটা বোঝা যে ফাঁদটা ফাঁদই। আপনি যদি একটাতে পড়ে থাকেন আর সেটা টের না পান, তাহলে আপনি খতম। আমি মনে করি আমি টের পেয়েছি আমার বেশিরভাগ ফাঁদগুলো আর তা নিয়ে লিখেছি আমি। অবশ্য সমস্ত লেখালিখিই এই ফাঁদ বিষয়ক নয়। অন্য ব্যাপারও আছে। তবুও কেউ বলতে পারে জীবনটাই তো একটা ফাঁদ। লেখালিখিও আপনাকে ফাঁদে ফেলতে পারে। কিছু লেখক সেই লেখা লেখেন যা অতীতে তার পাঠককে খুশি করেছে। তাহলে তারা খতম। বেশিরভাগ লেখকের সৃষ্টিশীলতার সময়টা খুব কম। তারা তাদের সুনামের কথা শোনেন আর তাতে বিশ্বাস করেন। লেখালিখির একমাত্র বিচারপতি হল লেখক নিজে। যখন সে ক্রিটিক, সম্পাদক, প্রকাশক, পাঠকদের কথায় প্রভাবিত হয়, তখন সে খতম। আর অবশ্যই যখন সে প্রভাবিত হয় সুখ্যাতি আর সৌভাগ্যে তখন আপনি তাকে গুয়ের সঙ্গে ভাসিয়ে দিতে পারেন নদীতে।

প্রতিটা নতুন লাইনই একটা নতুন করে শুরু আর আগে কী লেখা হয়েছে তার তোয়াক্কা করে না তা। আমরা সবাই নতুন করে শুরু করি প্রতিবার। আর তা খুব একটা পবিত্র ব্যাপার নয়। গ্যাস সরবরাহ বা জল সরবরাহের বা বেরোনোর জন্য নল লাগানোর যে কাজ, তার থেকে পৃথিবী অনেক সহজে টিকে থাকতে পারে লেখালিখি ছাড়া। আর পৃথিবীর কিছু জায়গায় এ দুটোই বেশ কমই আছে। অবশ্যই আমি এই নল না লাগিয়েই বেঁচে থাকতে চাই কিন্তু আমি অসুস্থ।

একটা মানুষকে কিছুতেই লিখতে আটকানো যায় না যদিনা সে নিজে তা বন্ধ করে। একটা মানুষ যদি সত্যিই লিখতে চায়, তাহলে সে লিখবে। প্রত্যাখ্যান আর উপহাস তার শক্তি বাড়াবে শুধু। আর যত তাকে পেছনে টেনে রাখা হবে সে তত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ঠিক ওই বাঁধের গায়ে ক্রমে বেড়ে ওঠা জলের ভরের মতো। লেখালিখিতে কোনও হার নেই, আপনি যখন ঘুমোবেন আপনার পায়ের আঙ্গুলদের হাসাবে তা, আপনাকে বাঘের মতো লম্বা পা ফেলে চলতে সাহায্য করবে, চোখে আগুন ধরিয়ে দেবে আর নিয়ে আসবে মৃত্যুর মুখোমুখি। আপনি মারা যাবেন যোদ্ধা হয়ে, আপনাকে নরকে সম্মানিত করা হবে। শব্দের ভাগ্য। ওটার সাথে যান, ওটাকে পাঠান। হয়ে উঠুন একজন অন্ধকারের ক্লাউন। এটা মজার। মজার। আরেকটা নতুন লাইন…    

(পঞ্চম পর্ব আগামী সংখ্যায়)