Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একা চাঁদ ও মেয়েদের কথা

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 


সেদিনও জেগে ছিল চাঁদ। রক্তের কথা হচ্ছিল যেদিন। মেয়েটা অন্ধকারের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। বুঝতে পারেনি নিজেও। অন্ধকারের মহাকাব্য রচনা করা হচ্ছিল। “মা খেয়েছ? আমি খাব, কাল ফিরছি সকালেই।” সেই ফেরার কথা। আশার কথা। আলোর কথা। চাঁদ সব শুনছিল। মেয়েটা খাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যাচ্ছিল। স্বপ্ন। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। সেবা করার ইচ্ছে। কর্তব্যের পথ সহজ হয় না। কাঁটা বেঁধে। রক্ত ঝরে। মেয়েটা জানে। তবু সেদিন যে এমনটা হবে জানত না

 

একটা রাত। অন্ধকারের পাশাপাশি আলো। রক্তের কথা। যন্ত্রণার কথা। নৈঃশব্দ্যের ভেতর লুকিয়েছিল সব কথা। গর্জে উঠল। চিৎকার হয়ে ফুটে বেরোনো সে-সব কথার সঙ্গে ছিল চাঁদ। একটা চাঁদ। সেদিন জেগেছিল। সম্মিলিত চিৎকারের কথা শুনতে পাচ্ছিল চাঁদ।

সেদিনও জেগে ছিল চাঁদ। রক্তের কথা হচ্ছিল যেদিন। মেয়েটা অন্ধকারের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। বুঝতে পারেনি নিজেও। অন্ধকারের মহাকাব্য রচনা করা হচ্ছিল। “মা খেয়েছ? আমি খাব, কাল ফিরছি সকালেই।” সেই ফেরার কথা। আশার কথা। আলোর কথা। চাঁদ সব শুনছিল। মেয়েটা খাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যাচ্ছিল। স্বপ্ন। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। সেবা করার ইচ্ছে। কর্তব্যের পথ সহজ হয় না। কাঁটা বেঁধে। রক্ত ঝরে। মেয়েটা জানে। তবু সেদিন যে এমনটা হবে জানত না। অন্ধকারের মধ্যে জন্তুগুলো ঢুকে আসে ঘরের ভেতর। পাশবিক খাবার খাওয়া। রক্তস্রোত বইছিল। ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেয়ে ফেলছিল একটা মানুষকে। একটা গিলে খাওয়ার রাত। চাঁদ দেখেছিল সবটা। পরের দিন সকালে যখন চাঁদ নিভে গেল, মেয়েটাও চাঁদের বাড়ি পাড়ি দিয়েছে।

ছোট্ট মেয়েটা কিছুতেই মায়ের হাত ছাড়বে না। মাকে এত রাতে আসতে দেবে না। মায়ের মনও বিষাদসিন্ধু। যে-মেয়েটা অত্যাচারিতা হয়েছে, পাশবিক যন্ত্রণা সহ্য করেছে সেই মেয়েটার পাশে দাঁড়াতেই হত। মা হয়ে, মেয়ে হয়ে। সেই মা চাঁদের গল্প জানত। চাঁদের বুড়ির চরকাকাটার গল্প শুনিয়ে মা সেদিন মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়েছিল। তবে এসেছিল বাইরে। রাত ঘিরে সেদিন আলোর জয়গান রচনা করতে হত সেই মাকে।

মেয়েটাকে সকলে খারাপ মেয়ে বলে। রাত করে ফেরে। মুখফোঁড়। কথা বলে বেশি। কথার জালে জড়িয়ে ফেলে সকলকে। সেই মেয়েটাই বাড়ির উঠোনটা পরিষ্কার করে। ফুলগাছে জল দেয়। যেদিন একটা মেয়ের শেষ হয়ে যাওয়ার কথা শুনেছে, ‘খারাপ মেয়ে’টার প্রাণ কেঁদেছে। মেয়েটা শিরশিরিয়ে উঠেছে। শাস্তি, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এই শব্দগুলো শরতের আলোর বেণুর মতো ঘুরে ফিরে এসেছে। মেয়েটা রাতে বেরোবে না ভেবেছিল। এই একটু আগে ফিরেছে ও। খারাপ মেয়ে। ঘড়ির কাঁটা যার কাছে টিকটিকির মতো। টিক টিক করে ভয় দেখায়। চোখ রাঙায়। মেয়েটা শুনেছে আজ রাতে কিছু একটা হবে। মধ্যরাতের রাস্তায় কোলাহল। কোলাহল নয় ঠিক। কণ্ঠস্বরের মিশে থাকা। ‘খারাপ মেয়েটা’ বেরোবে ভাবে। বেরোতে গিয়ে দেখে চাঁদটা পিছু নিয়েছে। রোজ রাতে খারাপ মেয়ে হওয়ার ‘অপরাধে’ যখন সব লাল চোখ ঘিনঘিনে মুখে তাকায়, একলা চাঁদই মেয়েটাকে বাড়ি পৌঁছে দিত। সেই চাঁদ আজও এসেছে। মশাল জ্বেলে যারা মিশে যাবে রাস্তায়, তাঁদের সঙ্গ দেবে চাঁদ। ‘খারাপ মেয়ে’টা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসে। চাঁদ এসেছে ওর সঙ্গে। সেদিন মধ্যরাতের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরগুলো চাঁদ হয়ে ওঠে মেয়েটার কাছে।

চাঁদের পাশে বসে আছে একটা পুড়ে যাওয়া মেয়ে। তার বুক ভেসে গেছে আগুনে। মরে যাওয়ার আগে সে ছাই হয়েছে। লোকে তাকে মনে করে আজও। মরে গেছে বলে। সবাই বলে মেয়েটা ভাল ছিল। রাতে বেরোত না। বাধ্য ছিল। মরে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ভাল হওয়ার প্রমাণ দিয়ে গেছে। পাড়া-পড়শিরা তবুও কটূক্তি করতে ছাড়েনি। ভাল মেয়ে বললেও বাঁকা চোখে দেখত। এত কেন চুপচাপ? এত কেন শান্ত? অর্ধসত্য বলে নিশ্চয়ই। মেয়েটা একা কাঁদত। একা থাকতে থাকতে গরল চেপে বসেছিল মনে। পছন্দের কাউকে আপন করতে চেয়েছিল। একা থাকে মেয়ে। একা মানে ‘অ্যাভেলেবল’। একা মানে সহজলভ্য পণ্য। পছন্দের মানুষ আঘাত দিল। মেয়েটার মনে হল সবাই জেনে যাবে সব। মনের গোপন কুঠুরির সব রহস্য জেনে গেলে ‘ভাল মেয়ে’র লেবেল থাকবে না। প্রমাণ দিতে পুড়ল মেয়ে। ছাই হল। চাঁদের কাছে গেল। সেই মেয়েটা আর ভাল মেয়ে হতে চাইছে না। ও কথা দিচ্ছে। আবার আসবে পৃথিবীতে। গলা মিলিয়েছিল সেদিনও। অলক্ষ্যে। অদৃশ্য থেকে চাঁদের সঙ্গে। চাঁদের সঙ্গে এই মেয়েটাও সারারাত জেগেছিল।

চোখে দেখে না মেয়েটা। পরিবার বলতে স্বামী আর ছেলে। পাখির সংসার। ছেলে আর স্বামী রোজ মেয়েটাকে পাখির বাসার গল্প শোনায়। মেয়েটা কল্পনা করে নিত ওদের তিনজনের ছোট্ট পৃথিবীতে পাখির গল্প শোনা যায় ইচ্ছেমতো। সেই পাখি রাতের বেলায় চাঁদের গায়ে বসে। অ্যাসিডের ঝাঁঝে যেদিন ওর চোখ পুড়ে যায়, পুড়ে যাওয়া চোখ দিয়েও মেয়েটা চাঁদ দেখেছিল। আজ মেয়েটা আবার চাঁদ দেখছে। অনেকগুলো কণ্ঠস্বর। সকলের সঙ্গে মিশে মেয়েটা চাঁদের কথা ভাবছে। আর সেই ছোট্ট পাখিটা? সেদিন চাঁদের পাশে বসে ওই মেয়েটার পুড়ে যাওয়া চোখেও আগুন দেখতে পেয়েছিল সে। সেই মেয়েটাও পরিবারের হাত ধরে রাত দখল করেছিল। রাতে অন্ধকার চোখে মেখে মনে আলো জ্বালিয়েছিল। চিৎকার করছিল মেয়েটা। উই ওয়ান্ট জাস্টিস।

মেয়েটার নাকি বুকের অসুখ ছিল। বুক মানে মন নয়। হৃদয় নয়। কোমল কোনও অনুভূতি নয়। বুক মানে একেবারে নিখুঁত মাংস-পিণ্ড। যে মাংস-পিণ্ডে মজে যাবে পুরুষের মন। যে মাংস-পিণ্ডে আটকে থাকবে পুরুষ। বিয়ের রাতে একটা পুরুষালি হাত যখন শরীরের ভেতর বিলি কাটতে শুরু করেছিল, মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে ছিল। ওর বুকটা ভাল নয়। নিখুঁত নয়। পুরুষকে আটকে রাখার মতো নয়। তাই হল ঠিক। ছিটকে উঠেছিল লোকটা। মেয়েটার স্বামী। সোহাগ করে ফোনে বর বলত। ‘তোকে তো কেউ পেলে রেপও করবে না।’ সেদিনই বাড়ি ছেড়েছিল মেয়েটা। একলা লেগেছিল বড্ড। আকাশের ভেতর ভালবাসা খুঁজত। একটা চাঁদ দেখতে পেয়েছিল সেদিন। সেই থেকে চাঁদটাই মেয়েটার বন্ধু। সেই চাঁদের সঙ্গেই মেয়েটা বেরিয়েছিল সেদিন। সকলের সঙ্গে গলা মেলাতে। অন্ধকারের প্রতিবাদ করেছিল মেয়েটা। হাতে হাত। আগে মেয়েটা সকলের বুকের দিকে তাকাত। তাঁর কেন অমন শরীর হল না! আক্ষেপ। কষ্ট। যন্ত্রণা। সেদিন রাতে সকলে যখন মশাল জ্বালিয়ে রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিল, একটা ছোট্ট মেয়ে ভয় পেয়ে দুপা পিছিয়ে এসেছিল। সেই মেয়েটাকে নিজের বুকেই জড়িয়ে ধরেছিল বুকহীন মেয়েটা। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ওরা দুজনেই বুঝেছিল চিৎকারের ভেতর কতটা স্বস্তি থাকে।

অন্ধকার গলির মতো রাস্তা। বিকেলে দুটো বাড়িতে কাজ সেরে ফেরার পথটা রোমশ, কালো অন্ধকার। ঠিক বাড়ির পুরুষসিংহটির মতো। এসব দেখলেই ভয় করে মেয়েটার। তবুও বাড়ির কাজগুলো ধরে রাখতে হবে। বাড়ি সারাতে হবে। আলো ধরে রাখতে হবে। চাঁদের আলোটা বড্ড তেজী। ভাঙা বাড়িটার ফাঁক গলে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে। মেয়েটা চোখের ওপর বালিশ মেলে দেয়। নিজের। ছেলে-মেয়েদেরও। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। সেদিন ঘুমোয়নি। চাঁদের আলো গায়ে পড়তেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। রাস্তায় মোমবাতির আলো। চাঁদের মতোই উজ্জ্বল। সেই আলোয় মেয়েটার বাড়ির কাছের গলিটাও উজ্জ্বল হয়। মেয়েটা হেঁটে বেরিয়ে আসে। একসঙ্গে আলো মেলায়।

একটা প্রাণহীন দেহ। চাঁদনি রাতে ঘুমিয়ে পড়া প্রাণহীন শরীর। ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত। দেহটায় অনেক ছবি আঁকা। লালসা, অবক্ষয়। নৃশংসতার চরম মুহূর্তের সাক্ষী চাঁদ। আর্তনাদের ভাষা ছিল স্পষ্ট। সব চাপা পড়ে গিয়েছিল সেদিন। তবে থেমে যায়নি। অন্য অজস্র কণ্ঠস্বরের মধ্যে দিয়ে সব বেরিয়ে আসে। অনেক রাত-জাগা চোখ। রাতের চাঁদ। অনেকগুলো আলো। মোমবাতির আলো মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে ধীরে ধীরে। একটা অন্ধকার রাতের পরিবর্ত জ্বলে ওঠে বহু আলো। রাতদখলের দ্রোহগাথা রচনা করে মেয়েরা। একটা জেগে থাকা শহর। অনেক চোখ। সকলের চোখে চাঁদের আলোর মতো রোশনাই। সেই রাতের ভোর হয়। শহরের বুক চিরে দুঃখের পাপড়ি ওড়ে। সব দুঃখের গন্ধ শুষে নিয়ে চাঁদ অপেক্ষা করে। প্রাণহীন শহরে প্রাণহীন মৃত্যুর বিচারের। শাস্তির অপেক্ষায় ভোরবেলার আলোকে ম্লান করে দিয়ে অপেক্ষার বার্তা দিয়ে যায় চাঁদ।


*মতামত ব্যক্তিগত