Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অন্ধকার সরণি বেয়ে…

দেবলীনা

 

 


এমন অনেক ঘটনাই আছে পৃথিবীর বুকে। ইতিহাস সাক্ষী, স্বৈরাচারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে যতবার মাথা তুলেছে, তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে— কখনও ধর্ম, কখনও বংশ, কখনও-বা রাজনীতি, কখনও-বা ফাঁপা পুরুষত্বের আচ্ছাদনের আড়ালে ক্ষমতার অস্ত্র নিয়ে। কিন্তু প্রতিবাদ জেগে উঠেছে বারবার। এ-কথা সত্যি যে প্রতিবার প্রতিবাদ সফল হয় না। প্রতিবাদ কোনও লক্ষ্য নয়। প্রতিবাদ একটা পথ। একটা দীর্ঘ, কঠিন পাকদণ্ডী পথ। যার শেষ মুখে লেখা থাকে নতুন সমাজ গঠনের আলেখ্য। প্রচলিত দুর্নীতি ভেঙেই হোক বা নতুন সমাজনীতি গঠনের মাধ্যমেই হোক— একসময় গোড়াপত্তন হয় নতুন সমাজের

 

গ্রামের নাম কুলধারা। জয়সলমির জেলায় অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত গ্রাম। কেউ বা বলে গ্রামটি ভূতুড়ে। চট করে একবার ইতিহাসটা শুনে নেওয়া যাক। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পালিওয়াল ব্রাহ্মণরা জয়সলমিরের এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। কিংবদন্তি অনুসারে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জয়সলমিরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সেলিম সিং। এই দুশ্চরিত্র, লম্পট মন্ত্রীর চোখ পড়ে কুলধারার গ্রামপ্রধানের অপূর্ব সুন্দরী কিশোরী মেয়েটির উপর। সেলিম সিং এই কন্যাটিকে দাবি করে বসে। মেয়েটিকে তার চাই। কিন্তু পালিওয়াল ব্রাহ্মণরা তাঁদের বংশমর্যাদা ও পরিবারের সম্মানরক্ষার্থে কন্যাকে তুলে দিতে অস্বীকার করেন। পাহারা বসায় সেলিম সিং। তিনি বলেন রাখিপূর্ণিমার পর মেয়েটিকে বলপূর্বক তুলে নিয়ে যাবেন। ১৮২৫ সালের রাখিপূর্ণিমার রাতে ঘটে যায় এক অদ্ভুত কাণ্ড। রাখিপূর্ণিমার সেই রাতে সমস্ত গ্রামবাসী পুরো গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যায়। তারা কোথায় চলে যায়, কীভাবে যায় ইতিহাসে তার কোনও খবর নেই। যাওয়ার সময় এই গ্রামবাসীরা অভিশাপ দিয়ে যায়— যাতে এখানে আর কোনওদিন কোনও জনবসতি গড়ে উঠতে না পারে। দিল্লির ইন্ডিয়ান প্যারানর্মাল সোসাইটির সূত্র অনুসারে, স্থানটিতে নাকি এখনও নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায়। কখনও রাতে তাপমাত্রা কমে যায়, না-হয় অন্ধকার রাতে শোনা যায় অগুনতি মানুষের আর্তচিৎকার। ইতিহাস সাক্ষী বারে বারে এমন ঘটনা ঘটে গেছে দেশ তথা পৃথিবীর বুকে।

১২৮৯ সালে ইতালিতে বিলুপ্ত হল ক্রীতদাস প্রথা। তার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হল দুটি প্রথা— এক, ‘বেগার খাটা’, আর অন্যটি ‘প্রথম রাত্রির অধিকার’। তাতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল অভিজাত জমিদার শ্রেণির মানুষ। জানেন কী ছিল এই প্রথম রাত্রির অধিকার? গ্রামে বা শহরাঞ্চলে তখন কোনও যুবক-যুবতীর বিয়ে হলেই স্থানীয় জমিদারের অনুমতি নিতে হত। এই অনুমতি নেওয়ার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও লজ্জাজনক। বিয়ের পর নববধূকে প্রথম জমিদারের কাছে সে রাতের জন্য অর্পণ করা হত। সে কিশোরী বা যুবতী মেয়েটির লাজহরণ করত স্থানীয় লম্পট জমিদারমশাই। এবং তা রীতিমতো অত্যাচার করেই। পরদিন এই হৃতসর্বস্বা নববধূকে ফিরিয়ে দেওয়া হত তার স্বামীর কাছে। মেয়েটির কুমারিত্বের বলি নিত নির্মম ক্ষমতাশালী উচ্চশ্রেণির লালসা। এই নিয়ে বিবাদ চলল দুই পক্ষের। মানে সমাজের দুই শ্রেণির। আর্জি জানানো হল অষ্টম বনিফাতসিওকে। তিনি ধর্মযাজক, তিনি সবার উপরে। কিন্তু তিনিও অভিজাতশ্রেণির এই স্বৈরাচারী অধিকারকে টিকিয়ে রাখার পক্ষেই দিলেন তাঁর রায়। ভালোয়ার দুশ্চরিত্র রাজকুমার শার্লের নেতৃত্বে আক্রমণের ফলে প্ৰতিবাদী পক্ষের প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। তার কিছু বছর পর, কবি দান্তে তাঁর বই ডিভাইন কমেডিতে স্পষ্ট ও তীব্রভাবে তুলে ধরেন অত্যাচারীদের কথা— ধর্মের ঠিকাদার, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও সুবিধাভোগী অভিজাত সম্প্রদায়ের কথা। তার জন্য তাঁকে দেশান্তরে যেতে হয়, ফেরা হয় না আর নিজের জন্মস্থানে ঠিকই। কিন্তু প্রতিবাদ হয়। আসলে প্রতিবাদ হতে হতেই একদিন ভেঙে পরে ক্ষমতার ফাঁপা ইমারত।

বেশ কিছুটা পিছিয়ে যাই চলুন। রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি প্রচলিত কিংবদন্তি আছে। এটি নিয়ে শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত কবিতা ছিল ‘রেপ অফ লুক্রিসি’। আনুমানিক ৫১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্বৈরাচারী রোমান সম্রাট সেক্সটাস টারকুইনাস, লুক্রেসিয়া নামে এক অভিজাত ভদ্রমহিলাকে বলপূর্বক ধর্ষণ করেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে লুক্রেসিয়া আত্মহত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর জনরোষ বৃদ্ধি পায়। সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের সাধারণ মানুষ ক্ষেপে ওঠে রাজশক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এই বিক্ষোভ আর কমেনি। রাজতন্ত্রের বহুদিনের অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ জনগণ তাদের রোষ স্তিমিত করতে পারে না আর। এবং তার ফলশ্রুতি হিসেবে একটা সময়কালের পর রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। কারণ জনগণ নিষ্কৃতি চাইছিল অত্যাচারের থাবা থেকে। ইতিহাস সাক্ষী, নির্দোষের ওপর বারে বারে নির্দয়ের অত্যাচার স্বৈরাচারকে নির্মূল করে, পতন ঘটায় তার।

কালের বুকে পথ হেঁটে আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যাক। সময়টা ইতালির নবজাগরণের সময়কাল। ১৭০০ শতাব্দীর অত্যন্ত নামকরা এবং একমাত্র মহিলা চিত্রশিল্পী ছিলেন আটিমেসিয়া জেন্টিলেস্চি। কারাভাজ্জিও-র প্রভাব মেলে তাঁর কাজে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি শিল্পী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলির বিষয়বস্তু মূলত ছিল নারীর প্রতিবাদ, শিকার, আত্মহত্যা, ও সামাজিক পরিকাঠামোর বাইরে গিয়ে নারীকে প্রতিবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বাইবেলের বেশ কিছু এমন ঘটনা ও চরিত্রকে নিজের ক্যানভাসে তুলে ধরেছিলেন যা দিয়ে প্রতিবাদ ঝরে, আগুনের মতো। আর তাই সেই সব চরিত্রের মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন ফরিয়াদ, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের অসামান্য দৃষ্টিকোণ। প্রায় নাবালিকা বয়সেই আর্টিমেসিয়ার সঙ্গে তাঁর বাবার বন্ধু স্বনামধন্য শিল্পী অগাস্টিনো তাসি জোর করে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে তাঁকে ধর্ষণ করেন। সমাজের কাছে সম্মান বাঁচাবার তাগিদে এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার প্রত্যাশা নিয়ে আর্টিমিসিয়া এই সম্পর্কে থেকে যান, অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কিন্তু একটা সময়ের পরে তিনি বুঝতে পারেন যে তাসি তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যবহার করেই চলেছেন। তাসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন আর্টিমিসিয়া ও তার বাবা, তাসকান শিল্পী ওরাজিও। তখনকার দিনে সমস্ত বিচারব্যবস্থাই ছিল চার্চের হাতে। সাত মাস ধরে বিচার চলে এই ঘটনার। তাসির এই ব্যাভিচারের জন্য তাঁকে রোম থেকে নির্বাসন দেওয়া হয়। কিন্তু শুধু কি তাই? বিচার চলাকালীন আর্টিমেসিয়া সত্যি বলছে কিনা যাচাই করার জন্য ‘থাম্ব-স্ক্রিউ’ বা সিবিল দিয়ে তার দুহাতের কব্জি ভেঙে দেওয়া হয়। হাতকড়ার মতো এই যন্ত্র কব্জিতে আটকে চাপ প্রয়োগ করে সত্য যাচাইয়ের চল ছিল তৎকালীন আইনি ব্যবস্থায়। লক্ষণীয় বিষয় হল আর্টিমেসিয়া অভিযোগকারী ও ‘ভিক্টিম’ বা অত্যাচারিতা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উপর এমন শাস্তি কেন? শুরুতেই বলেছি, এই উক্ত সময়কালে নারীদের শিল্পী হিসেবে, কবি বা লেখক হিসেবে সমাজ মান্যতা দিত না। সমাজের অভিজাত ও ধর্মীয় মাথাদের যথেষ্ট আপত্তি ছিল যে কোনও নারী এমন কোনও সৃজনকার্যে যুক্ত থাকবে। বলা বাহুল্য, একজন শিল্পীর কব্জি ভেঙে দেওয়া মানে তার আঁকা বন্ধ করে দেওয়া। যদিও এইসব অত্যাচার আর্টিমেসিয়াকে রুখতে পারেনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহের রঙে একের পর এক এঁকেছেন সুজানা, জুডিথ, এস্থার, জাএলের মতো বাইবেলের চরিত্রদের। যারা নিজেদের চৌহদ্দি ছেড়ে বেরিয়ে চিৎকার করেছে, হত্যা করেছে অন্যায়কারীকে, প্রতিবাদ করেছে সমাজের কালো চোখের বিরুদ্ধে। আসলে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার প্রচেষ্টাই হল বেঁচে থাকা। সম্মানহানি, ধর্ষণ, যৌনহেনস্থা যাই হয়ে যাক না কেন, যতদিন প্রাণ আছে ততদিন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাও থাকে। রাখতে হয়।

ইতিহাসযাপন তো অনেক হল, ইট কাঠ ইমারতে গড়া বর্তমানকালের বুকে দেখা যাক। ব্যাঙ্গালোরে কৃষ্ণন পরিবারে ১৯৭২ সালে জন্মায় একটি মেয়ে, সুনীতা কৃষ্ণন। শৈশব থেকেই তার ছিল সমাজসেবার প্রতি অসম্ভব টান। মাত্র আট বছর বয়সে স্থানীয় বস্তিতে ছোট্ট সুনীতা মানসিক রোগীদের নাচ শেখাতে যেত নিজের আনন্দেই। বারো বছর বয়সে বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে তার একটি স্কুলও গড়ে ওঠে। সুনীতা যখন পনেরো বছর, সে দলিত সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করছিল পড়াশুনার পাশাপাশি। সহ্য হল না সমাজের ক্ষমতাশালী লোকেদের। আটজন দুষ্কৃতি মিলে ফুলের মতো নাবালিকা ১৫ বছরের সুনীতাকে ধর্ষণ করে। হয় অকথ্য অত্যাচার। এই তথাকথিত পুরুষ-সমাজে এক নারীর সমাজ গঠনের নেতৃত্ব তাদের পছন্দ হয় না। এত মার মারা হয় তাকে, যে সারা জীবনের জন্য একটি কানের শ্রবণশক্তি হারায় সে। অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও সুনীতা কৃষ্ণন কিন্তু হার মানেনি। পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পরে ম্যাঙ্গালোর থেকে এমএসডাব্লু ডিগ্রি করে মেডিকেল ও সাইকিয়াট্রি বিষয়ের উপর। আর থেমে থাকে না সুনিতা। বারবার অত্যাচারিত ও মৃত্যুর মুখোমুখি হয় সে। কিন্তু কোনও ভাঙনমূলক ক্ষমতার জোর তাকে আটকাতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে ‘মেহেবুব কি মেহেন্দি’ নামে হায়দ্রাবাদের এক নামকরা পতিতাপল্লী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হাজার হাজার দেহোপজীবিনীরা দুর্বিপাকে পড়ে। কৃষ্ণন তাদের নিয়ে শুরু করে একটি স্কুল। বাধা হয়ে দাঁড়ায় এইসব মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়া থেকে। এই কর্মকাণ্ড চালাতে তাকে তার গয়না থেকে শুরু করে বাসনপত্রও বেচে দিতে হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যে অনড় ছিল সুনীতা। গড়ে ওঠে তার সংস্থা, প্রজ্বলা। একটু একটু করে বেড়ে উঠতে উঠতে এই সংস্থা আজ নিষ্কম্প শিখার মতো জ্বলে আলো করে রেখেছে সমাজের অন্ধকার দিক। আজ এই সংস্থার পাঁচটি মূল ভিত্তি আছে। প্রতিরোধ, উদ্ধার, পুনর্বাসন, একত্রীকরণ, এবং আইন বা ওকালতির দিক। প্রজ্বলায় কাজ করে ২০০-রও বেশি কর্মী। প্রায় ১৪টা তথ্যচিত্র নির্মাণ করে সে এই সংস্থার মাধ্যমে। প্রতিটি সিনেমা কিন্তু সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলিকে তুলে ধরেছে। যৌনপাচার চক্র থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অল্প বয়সে বিবাহ কিংবা পতিতাবৃত্তি, যৌনহেনস্থা বা অজাচারের মতো বিষয়গুলি ধরা পড়েছে এই তথ্যচিত্রগুলিতে। যাতে মানুষ আরও বেশি চক্ষুষ্মান হয়ে ওঠে, বৃদ্ধি হয় তার নীতিবোধ। তার পথ চলাটা এত সুগম ছিল না। আর মাত্র একবার নয়। ১৪ বার সে শারীরিক এবং যৌনহেনস্থার শিকার হয়েছে, মিলেছে প্রাণহানির হুমকি। কিন্তু লক্ষ্যে অচল থেকে সুনীতা তার লড়াই চালিয়ে গেছে। তার এই নির্ভীক কাণ্ডের জন্য সে পেয়েছে অসংখ্য পুরস্কার, অনেক সম্মাননা। তার মাত্র কয়েকটি হল— ২০১০-এ পেয়েছে তেজস্বিনী আওয়ার্ড, ২০০৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপালের কাছ থেকে বিশেষ সাহসিকতার পুরস্কার, ভারত সরকারের থেকে ২০০৩-এ স্ত্রী-শক্তি পুরস্কার, কেরল সরকারের থেকে ২০১২ সালে নির্ভীক ও অসামান্য সমাজসেবার জন্য সম্মাননা, আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ২০১১ সালে হিউম্যান রাইট অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন থেকে ২০১৩ সালে অসামান্য নারী সম্মাননা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, ২০১৬ সালে সুনীতা কৃষ্ণন তার নির্ভীক সেবামূলক কাজের জন্য পেয়েছে পদ্মশ্রী পুরস্কার।

এমন অনেক ঘটনাই আছে পৃথিবীর বুকে। ইতিহাস সাক্ষী, স্বৈরাচারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে যতবার মাথা তুলেছে, তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে— কখনও ধর্ম, কখনও বংশ, কখনও-বা রাজনীতি, কখনও-বা ফাঁপা পুরুষত্বের আচ্ছাদনের আড়ালে ক্ষমতার অস্ত্র নিয়ে। কিন্তু প্রতিবাদ জেগে উঠেছে বারবার। এ-কথা সত্যি যে প্রতিবার প্রতিবাদ সফল হয় না। প্রতিবাদ কোনও লক্ষ্য নয়। প্রতিবাদ একটা পথ। একটা দীর্ঘ, কঠিন পাকদণ্ডী পথ। যার শেষ মুখে লেখা থাকে নতুন সমাজ গঠনের আলেখ্য। প্রচলিত দুর্নীতি ভেঙেই হোক বা নতুন সমাজনীতি গঠনের মাধ্যমেই হোক— একসময় গোড়াপত্তন হয় নতুন সমাজের। আজ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের দুর্বিষহ সময়ে যেখানে দেখা যাচ্ছে নারীত্বের অপমান, নির্দয়ভাবে ধর্ষণ, নাবালক ও নাবালিকা কিংবা যুবক-যুবতী এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের যৌনহেনস্থা, পরিবারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অজাচারের অভিঘাত নিপীড়ন করে চলেছে, সেখানে শুধু ও শুধুমাত্র অস্ত্র হল সাহস। এই সাহস বৃদ্ধি পাবে একমাত্র সঠিক শিক্ষা, সংস্কৃতির পরিচিতি ও মানুষের সঙ্গে মানুষের ঐক্যের মাধ্যমে। মৃত্যু তো সবকিছুর শেষ। তাই এই ধরনের অত্যাচারের ফলশ্রুতিতে প্রাণনাশের পর ভিক্টিমের সত্যি তো আর কিছু করার থাকে না। কিন্তু তার পাশের মানুষগুলোর, সে যে সমাজে বাস করে সেই সমাজের প্রতিটি মানুষের দায়বদ্ধতা শতগুণে বেড়ে যায়। আর জীবনের শেষ বিন্দুটুকু শরীরে থাকা পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়া হল অস্তিত্বের সবথেকে বড় নিশান। মনে রবি ঠাকুরের সেই দুটি লাইন— “বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়”—  মন্ত্র করে এগিয়ে চলা— এটাই একমাত্র সম্ভব। একদিনে আপামর পরিবর্তন সম্ভব হবে না। স্বাধীনতাও একদিনে আসেনি। কিন্তু শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐক্যের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সাহস নিয়ে এগিয়ে চললে একটা সুস্থ সমাজ অন্তত আমাদের উত্তরসূরিরা দেখতে পাবেই। রাত সবচেয়ে ঘন কালো হওয়ার পর ভোর আসে। মহাভারতের সেই অমোঘ শ্লোকেও আছে—

সর্বে ক্ষয়ান্তা, নিচয়া পতনান্তা সমুচ্ছ্রয়া
সংযোগা, বিপ্রয়োগান্তা, মরণান্তম চ জীবিতম।

অর্থাৎ সব কিছুরই ধ্বংস আছে, শেষ আছে। এই অত্যাচার ও নারকীয় কর্মকাণ্ডের জন্যেও তা একইভাবে প্রযোজ্য। শুধু সময় আর সাহসের যুগলবন্দির সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষা।


*মতামত ব্যক্তিগত