Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আরজিকরের ঘটনায় কিছু পরস্পরবিরোধী ছবি

অঞ্জুশ্রী দে

 


অদ্ভুত একটা জটিল সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। চূড়ান্ত হতাশা গ্রাস করেছে। আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যেতে দেখলে, তার জীবন নিরপত্তাহীন হয়ে উঠলে হয়তো এরকম হতাশাই গ্রাস করে! শরীরে মনে ক্লান্তি আসে! এতদিনে পরিষ্কার, কারও সন্তানের সঙ্গে যদি অঘটন কিছু ঘটে বা তার মৃত্যু হয়, রাষ্ট্র তার দায় নেবে না। শুধু ওই সন্তানের নামটি চিরতরে মুছে যাবে পৃথিবী থেকে!

 

গত ৯ আগস্ট আরজিকর হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিভাগে এক মহিলা পিজিটি (স্নাতকোত্তর শিক্ষানবীশ) ডাক্তারকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। মৃত্যুর দিন থেকেই প্রশাসন কিছু একটা লুকোতে চাইছিল, ঘটনার পরম্পরা সেই কথাই বলছে। ঘটনার পরদিন থেকেই নাগরিক সমাজে নানা ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল। তবে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে ১৪ আগস্ট রাতের পর। যেদিন নারীরা রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন। সেই রাতে কলেজ স্ট্রিট মোড়ে রাতদখলে আমিও ছিলাম। আন্দোলনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল ধিক ধিক করে জ্বলতে থাকা ক্ষোভের আগুন এবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। তারপর থেকেই যেন আরজিকর-কাণ্ডের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল দেশের সর্বত্র। চিকিৎসকরা কর্মবিরতি চালাচ্ছেন, সুবিচারের আশায় আন্দোলন করছেন। তাঁদের এই আন্দোলনের পাশে থেকে মেয়েটির নৃশংস মৃত্যুর প্রকৃত তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সমস্ত পেশার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। বাদ নেই স্কুলপড়ুয়ারাও। সবার একটাই দাবি— ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। এই জাস্টিসের দাবি একজায়গায় এনেছে খেলার মাঠের চিরশত্রু মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলকে। আরজিকর আন্দোলনের চেহারা দেখে বলতে হয়— বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে/এত বিদ্রোহ কখনও দেখেনি কেউ/দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ। সত্যি তো নিকট অতীতে আমাদের রাজ্যে কোনও ঘটনায় এভাবে মানুষকে ক্ষেপে গিয়ে পথে নামতে দেখা যায়নি। কলকাতা হাইকোর্ট ঘটনার তদন্তভার রাজ্য পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে সিবিআইকে দিয়েছেন। ঘটনার গভীরতা, আন্দোলনের চাপ এইসব বিচার করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আরজিকর মামলা নিজেদের হাতে নিয়েছেন। ১৫ দিন পেরিয়ে গেল, উল্লেখযোগ্য কিছুই সামনে আসেনি। যেটুকু যা ওই কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া সিভিক পুলিশ। অধীর অপেক্ষায় প্রহর গোনা চলছে। এই বুঝি কিছু জানা গেল। তদন্তের আশানুরূপ ফল না আসায় মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। প্রতিদিন নতুন নতুন আন্দোলনের জন্ম নিচ্ছে।

আরজিকরে মাহিলা চিকিৎসকের মৃত্যু আমাদের অনেকগুলো প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। অদ্ভুত সব বৈপরীত্যও চোখে পড়ছে। সমাজমাধ্যমে ঘুরতে থাকা কিছু মিমের উপর ভর করেই কয়েকটা পরস্পরবিরোধী ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

 

বৈপরীত্য: ১

পরাধীন ভারতে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ইউরোপীয় মানুষদের ভিড়ে সেখানে নেটিভরা ভাল চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না। তা দেখে ডক্টর রাধা গোবিন্দ কর ভাবলেন, একটা মেডিকেল কলেজ করা গেলে দেশের মানুষগুলো একটু চিকিৎসা পায়। কিন্তু কে দেবে এত টাকা? নিজের সব দিয়েও মেডিকেল কলেজ তৈরি সম্ভব নয়! অগত্যা সমাজের গণ্যমান্যদের কাছে সাহায্য চাইলেন। কেউ সাহায্য করলেন, কেউ ফিরিয়ে দিলেন। তাচ্ছিল্যও জুটল। তবে শেষমেশ তিনি মেডিকেল কলেজ তৈরি করতে পেরেছিলেন। ১৯৪৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সেই কলেজের নামকরণ করলেন রাধা গোবিন্দ করের নামেই। সেই থেকেই আরজিকর হিসেবে পথ চলা শুরু।

ডক্টর কর কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে বিলেত গেলেন এমআরসিপি করতে। দেশে ফিরে প্র্যাকটিস শুরু করলেন। হয়ে উঠলেন গরিবের ভগবান! যার ওষুধ কেনার পয়সা নেই তার ফি নিতেন না, এমনকি ওষুধ কেনার টাকাও দিতেন। কলকাতায় প্লেগ যখন মহামারির আকার নেয় তখন তিনি উত্তর কলকাতায় সারাদিন মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন, রোগীর পরিবারকে সচেতন করেছিলেন। ব্যক্তিগত সুখ বিসর্জন দিয়ে মানুষের চিকিৎসায় নিবেদিত ছিলেন ডক্টর কর। তাঁরই নামাঙ্কিত হাসপাতালে ঘটে যাওয়া অবাঞ্ছিত ঘটনায় যে সব অপরাধের কথা বাইরে আসছে তা ডক্টর রাধা গোবিন্দ করের স্বপ্নের পরিপন্থী। অভিযোগের তির হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের দিকে। সেই অভিযোগের তালিকায় টেন্ডার দুর্নীতি থেকে মৃতদেহ পাচার সব রয়েছে। সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ হাসপাতালের ওষুধ বাইরে বিক্রি করে দেওয়া। সরকারি হাসপাতাল, গরিব মানুষের স্বাস্থ্যপরিষেবার ভরসাস্থল। সেখানকার ওষুধ সরিয়ে ফেলার অর্থ তাদের চিকিৎসার পরিধিকে সঙ্কুচিত করা। অভিযোগ উঠেছে কোভিড ফান্ডের টাকা তিনি নয়ছয় করেছেন।

হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ভিক্ষে করে হাসপাতাল তৈরি করলেন, জীবন বাজি রেখে কলকাতায় প্লেগের চিকিৎসা দিলেন। উল্টোদিকে, সেই হাসপাতালের সদ্যোপ্রাক্তন অধ্যক্ষ নিজের সম্পত্তি বাড়াতে দুর্নীতির পর দুর্নীতি করে গেলেন। ঘুরপথে গরিবের স্বাস্থ্যপরিষেবা হরণ করলেন। ইনিও কোভিড-এর মতন মহামারিতে মানুষের পাশে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছিলেন। মহান হতে পারতেন। কিন্তু তিনি কোভিড-এর অর্থ নিজের চেম্বার সাজাতে ব্যবহার করলেন। সিবিআই সব কিছুর তদন্ত করছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বলতেই হবে মৃত চিকিৎসক জীবন দিয়ে ডক্টর করের স্বপ্নচোরদের চিহ্নিত করে দিয়ে গেলেন।

 

বৈপরীত্য: ২

গিটার বাজাচ্ছেন নায়িকা! গান চলছে, “আমার এই দেহখানি তুলে ধরো …”। সৌরভ গাঙ্গুলির মেয়ে সদ্য ইংল্যান্ড থেকে ফিরে ঝরঝরে ইংলিশে জানাচ্ছে, আমি কলকাতায় থাকি না। তবে এখানকার মেয়েদের নিরাপত্তা দরকার। কী যান্ত্রিক কথা! কী যান্ত্রিক গলার স্বর। কোনও আবেগ নেই, কোনও দুঃখ নেই। শুধু কোনওরকমে মিছিল শেষ করেই ফিরতে হবে। আবার যাঁরা রিল বানান, সেই ছেলেমেয়েরা, দুর্ভাগা মেয়েটির জন্য হাতে মোবাইল নিয়ে মিছিল করছে। রিল বানাতে বানাতে জুড়ে দিচ্ছে সেই অমোঘ গান, “দেখো আলোয় আলো আকাশ…”। রিল শেষে বলতে ভুলছে না আমার চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে নেবেন! ঠিক তখনই, অন্য এক জায়গায়, অনেকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে একটানা গেয়ে যাচ্ছে, “আজা শাম হুই মুঝে তেরি ফিকর হোনে লাগি …”। আবেগ ছত্রে ছত্রে! কিংবা বাঁধভাঙা বৃষ্টির মধ্যে জল ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে যাওয়া বাম ছাত্রযুবদের মিছিল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তারা বিচারের দাবিতে কতটা আন্তরিক।

 

বৈপরীত্য: ৩

সুপ্রিম কোর্টে আরজিকর-কাণ্ডের শুনানি চলাকালীন নজরে পড়েছে, সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা ও অন্যান্যরা রাজ্য পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কথা একের পর এক তুলে ধরছেন, বিচারপতিদের কাছে তদন্তের তথ্য লোপাটের অভিযোগ করছেন। বিপরীত দিকে, তাঁদের বাধা দেওয়ার জন্য কপিল সিব্বলের গোটা টিমকে ভাড়া করেছে রাজ্য সরকার। অভিজ্ঞ, দুঁদে উকিলরা একত্রিত হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন, আরজিকর-কাণ্ডের দায় কোনওভাবেই যেন রাজ্যের শাসকের ঘাড়ে এসে না পড়ে। ৩৬ ঘন্টা একটানা ডিউটি করা ক্লান্ত, ঘুমন্ত মহিলা চিকিৎসক নিজের কর্মক্ষেত্রে খুন হলেন। সেই কর্মক্ষেত্র যদি সরকারি হাসপাতাল হয় তার দায়দায়িত্ব সবই সরকারের হয়, এটা ভুললে কী করে চলবে।

 

বৈপরীত্য: ৪

ধর্ষিতা চিকিৎসকের মৃত্যুর বিচার চাইতে স্কুলের পড়ুয়ারাও পথে নেমেছে সে ছবি নজরে পড়েছে। সরকার তা ভালভাবে নেয়নি। কোনও কোনও স্কুল শিক্ষা-দফতরের রোষানলেও পড়েছে। শিক্ষা-দফতর হাওড়ার তিনটি স্কুলকে কারণ দর্শানোর নোটিস ধরিয়েছে। তবে এভাবে বিচারের দাবিকে রোখা যায় কিনা জানি না! মিছিল করা শিক্ষকরা বলেছেন তাঁরা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য গর্বিত। বৈপরীত্য হল ফতোয়া জারি, শাস্তির ভয়কে উপেক্ষা করে, হাওড়া তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা তাঁর ছাত্রীদের শিক্ষা দিচ্ছেন— তারা যেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, যে কোনও ভিক্টিমের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তিনি কী সুন্দর করে ছাত্রীদের বলছেন, রাষ্ট্র ভেঙে পড়লে ১৮ বছরের নিচে থাকাদেরও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বলছেন কোনও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা নয়, এটা অন্যায়ের প্রতিবাদ। তিনি আরও জানিয়েছেন, আরজিকর-কাণ্ডে ছাত্রীরা প্রতিবাদ করতে চেয়ে তাঁর কাছে আবেদন জানানোয় তিনি গর্বিত।

 

বৈপরীত্য: ৫

হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকের মৃত্যুতে প্রশ্ন উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ মহিলাদের জন্য কতটা সুরক্ষিত। বিশেষ করে তাদের কাজের জায়গায়। নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। মহিলাদের কাজের জায়গায় সুরক্ষা দিতে রাজ্য সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে। তার মধ্যে অন্যতম রাতে মহিলাদের যতটা সম্ভব কম ডিউটি দেওয়া যায়। পাল্টা প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি সত্যি বাস্তবসম্মত? তথ্যপ্রযুক্তি, কলসেন্টার, নিউজপেপারের মতো এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে পেশাগত কারণে যুক্ত হলে নাইট করতেই হয়। সে তিনি পুরুষ হন বা মহিলা। হাসপাতালে ফিরি, সেখানে ফিমেল ওয়ার্ডের নাইটডিউটি কি শুধুই পুরুষ চিকিৎসক ও পুরুষ নার্স দিয়ে হবে? আমাদের রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে পুরুষ নার্স কোথায়? আর যে প্রশ্নটা জোরালো হয়েছে তা হল, বেসরকারি ক্ষেত্রে এটা কি আদৌ সম্ভব? এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে মহিলাদের কাজের বাজারকে ছোট করে দেবে। তাকে আবার ঘরের মধ্যেই আটকে দেবে। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যকে বাড়িয়ে দেবে। বৈপরীত্য হল মিটিং-মিছিল-সভা-সমিতিতে বারবার আলোচনা হচ্ছে লিঙ্গবৈষম্য কমাতে হবে। নারীর নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে হবে। তথ্য বলছে কাজের বাজারে লিঙ্গবৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকায় মহিলাদের সংখ্যা খুবই কম। স্পেশালিস্ট মহিলা চিকিৎসকদের নিরাপত্তা দিতে না পেরে তাঁদের নাইট ডিউটিতে লাগাম পরানোর অর্থ কর্মক্ষেত্রের লিঙ্গবৈষম্যকে বাড়ানোর পাশাপাশি কাজের জায়গায় মহিলাদের নেতৃত্বদানকারী ভূমিকাকেও অস্বীকার করা। আজকের দিনে এটা মোটেই কাম্য নয়।

শেষে বলতে ইচ্ছে করছে— আমি যেইদিকেতে চাই, দেখে অবাক বনে যাই/আমি অর্থ কোনও খুঁজে নাহি পাই রে….। অদ্ভুত একটা জটিল সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। চূড়ান্ত হতাশা গ্রাস করেছে। আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যেতে দেখলে, তার জীবন নিরপত্তাহীন হয়ে উঠলে হয়তো এরকম হতাশাই গ্রাস করে! শরীরে মনে ক্লান্তি আসে! এতদিনে পরিষ্কার, কারও সন্তানের সঙ্গে যদি অঘটন কিছু ঘটে বা তার মৃত্যু হয়, রাষ্ট্র তার দায় নেবে না। শুধু ওই সন্তানের নামটি চিরতরে মুছে যাবে পৃথিবী থেকে!

এত কিছুর পরও আমরা আমজনতা বেঁচে থাকব কিছু আশা নিয়ে! অপেক্ষা করব খুনির শাস্তির জন্য।


*মতামত ব্যক্তিগত