Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সব প্রশ্নের উত্তর রাস্তাতেই মিলবে

উপমা নির্ঝরণী

 


যে গণআন্দোলন এই মুহূর্তে চলছে, তার বেশিরভাগ কৃতিত্ব বা দায় পশ্চিমবঙ্গের সেই মানুষদের, যাঁরা সত্যিই বিচারের আশায় নিয়মিত পথে নামছেন। বিজেপি যাতে এই গণজাগরণের সুযোগ না নিতে পারে, তার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে। কাজটা অবশ্যই সহজ নয়, কারণ দক্ষিণপন্থী দলগুলি আত্মপরিচয় গোপন করেই আন্দোলনের পরিসর দখল করার চেষ্টায় রয়েছে। মফস্বলের প্রতিবাদী মিছিলগুলোর রাশ বেশিরভাগ সময়ে এমন মানুষদের হাতে থাকছে, যাদের রাজনৈতিক অবস্থান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেহজনক

 

যে আমাদের বিপ্লব শিখিয়েছিল আর এখন বলে বেড়ায় হিমালয় নাকি তার আত্মা ভেদ করে ঢুকে গেছে, তাকে আমি এক্ষুণি দেখলাম।

যে বুকে আগুন জ্বালানোর কথা বলেছিল, তাকেও এখনই দেখলাম।

যে সাধু কবিদের ‘স্পিরিট’ আত্মসাৎ করে বসে আছে তাকেও দেখলাম।

কোথায় দেখলাম?

মুখ্যমন্ত্রীর কাছাকাছি। কে কোন পকেটে ঢুকবে, সেই নিয়ে তিনজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। দুজন কোটের দুই পকেটে ঢুকে গেল। তৃতীয়জন বলে উঠল, ‘হায় রে, মুখ্যমন্ত্রী যদি প্যান্ট পরে থাকতেন, আমি তাহলে তার পকেটে ঢুকতে পারতাম।’

—হরিশঙ্কর পরসাই, ‘হম, বে, অউর ভিড়’

তিলোত্তমা হত্যার পর প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। নয় তারিখের পর, বিশেষত চোদ্দ তারিখ থেকে যে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো শহর থেকে শহরতলি ছাড়িয়ে প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়েছিল, তার তেজ ক্রমশ কমছে। কেন কমছে? তার কারণ অনুসন্ধান চলছে সমাজমাধ্যম থেকে শুরু করে শহরতলির চায়ের দোকানের চর্চায়। চোদ্দ তারিখ রাতে কী ঘটেছে, তা নিয়ে নতুন করে খুব একটা কিছু বলার নেই, তবু কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। কলকাতার কাছাকাছি এক মফস্বলের এক স্থানে সেদিন কলকাতা বা বারাসাতের মতোই হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। সেই ভিড়ে মহিলাদের থেকে পুরুষের সংখ্যাই বেশি ছিল, এবং নানা মানুষ নানা উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন। কেউ ধর্ষকদের ফাঁসি চাইছিলেন, কেউ নারীর ‘অসম্মানের’ বিচার চাইছিলেন; খুব কম মানুষই সেদিন লিঙ্গসাম্যের জন্য বা পিতৃতন্ত্রকে প্রশ্ন করার জন্য পথে নেমেছিলেন। ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’-এর ‘অরাজনীতিকরণ’ হতে দু-দিনও সময় লাগেনি। ফলে চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মানুষ এই ট্যাগলাইনটি ব্যবহার করে ‘অরাজনৈতিক’ ছদ্মবেশে প্রায়ই প্রতিবাদসভার আয়োজন করছে, এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে মানুষকে অরাজনীতির গেরুয়া রঙে রাঙাচ্ছে। অন্যদিকে যিনি দশই আগস্ট সমাজমাধ্যমে প্রথম রাত দখলের এই আহ্বান জানিয়েছিলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। অতএব একটা বিষয় এখন স্পষ্ট যে ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ আন্দোলন নানারূপে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেও নারীবাদের চেতনার সঙ্গে সেই ভিড়ের দূরত্ব এখনও বহু যোজনের। তারকেশ্বর লাইনের লোকাল ট্রেনে আলোচনা চলছে, ‘ওরা আমাদের মা-বোনেদের ইজ্জত রাখল না’; মফস্বলের মিছিলে স্লোগান উঠছে, ‘আমার মাটি, আমার মা, দাঙ্গাবাজের হবে না’ ইত্যাদি, মা বা বোন যে মাটি নয় আর তাদের বা তাদের গোষ্ঠী বা সমাজের সম্মান যে কারও যোনিতে থাকে না, এই সহজ কথাটিও বেশিরভাগ মানুষ মানতে চাইছেন না। এই কারণেই হয়তো এখনও ধর্ষণকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়,  এবং ধর্ষণের প্রতিবাদ করে ফেরার সময় এ রাজ্যে আদিবাসী তরুণীকে খুন হতে হয়। তদুপরি তৃণমূলের ভয়াবহ দুর্নীতির ধারাবাহিকতা এবং প্রতিটি যৌন নিগ্রহ ও খুনের ঘটনার পর এই মুহূর্তে ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর নির্লিপ্তি এবং অসংবেদনশীল আচরণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাঁরা অনেকেই এই মুহূর্তে এই সরকারের থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইছেন, এবং তার দায় অনেকটাই এই সরকারের। লোকসভায় এগারোজন মহিলা সাংসদ তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব করেন, অথচ এই রাজ্যে মানুষের, বিশেষত প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষের নিরাপত্তা অনেকদিন ধরেই সঙ্কটে, এবং লিঙ্গবৈষম্যও ক্রমবর্ধমান। অনেকে সঙ্গত কারণেই ভয় পাচ্ছেন, প্রত্যক্ষভাবে তৃণমূলের বিরোধিতা করলে বিজেপির লাভ হবে, তবে সেই সুযোগ কি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর কাছের মানুষরাই তৈরি করে দেননি?

‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ আন্দোলনের অন্যতম এক মঞ্চে এক সংগঠক আক্ষেপ করছিলেন, তাঁরা জেলাশহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে যৌনশিক্ষা নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারের চেষ্টা করলে, তাঁরা বাধাপ্রাপ্ত হন। প্রতিটি বিদ্যালয়ে যৌনসচেতনতামূলক শিক্ষা দেওয়া হলে, কিছুটা হলেও বৈষম্য কমানো যায়। যে সরকারের রাজত্বে আট হাজারেরও বেশি সরকারি বিদ্যালয় উঠে যাওয়ার মুখে, যেখানে সার্বিক শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রের অবস্থা গুরুতর সঙ্গীন, সেখানে এমন পরিস্থিতিতে সরকারের থেকে ইতিবাচক কোনও সংস্কারের আশা করা বালখিল্য।

অন্যদিকে যারা হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ধর্ষণ ও দুর্নীতির মোকাবিলা করবেন ভাবছেন, তাঁরা হয় দিবাস্বপ্ন দেখছেন, অথবা তাঁদের অন্য কোনও অভিসন্ধি রয়েছে। বিজেপি-আরএসএস-এর ধর্ষণ, গণহত্যা-সহ ভয়াবহ অপরাধগুলির পরিসংখ্যান বই আকারে প্রকাশ করলে একাধিক খণ্ড বেরোবে। আসিফা, বিলকিস বানোর কথা অনেকেই ভোলেননি। এছাড়া এই বছরের শুরুতে হিন্দুত্ববাদীরা সন্দেশখালির জমিদখল ও অত্যাচারের ঘটনার সময়ও নারীনির্যাতনকে ট্রয়ের অশ্ব হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। যে গণআন্দোলন এই মুহূর্তে চলছে, তার বেশিরভাগ কৃতিত্ব বা দায় পশ্চিমবঙ্গের সেই মানুষদের, যাঁরা সত্যিই বিচারের আশায় নিয়মিত পথে নামছেন। বিজেপি যাতে এই গণজাগরণের সুযোগ না নিতে পারে, তার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে। কাজটা অবশ্যই সহজ নয়, কারণ দক্ষিণপন্থী দলগুলি আত্মপরিচয় গোপন করেই আন্দোলনের পরিসর দখল করার চেষ্টায় রয়েছে। মফস্বলের প্রতিবাদী মিছিলগুলোর রাশ বেশিরভাগ সময়ে এমন মানুষদের হাতে থাকছে, যাদের রাজনৈতিক অবস্থান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেহজনক।

এই আন্দোলন কোন দিকে যাবে, সমাজে ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, তা বোধহয় কেউই এখন নিশ্চিতরূপে বলতে পারবেন না। সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কেউই ক্ষমতায় থাকাকালীন নারীর নিরাপত্তা, প্রান্তিক মানুষের অধিকারের জন্য কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি, এবং এখনও একজন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড, কড়া আইনের প্রস্তাব এনে মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছে। মথুরা ধর্ষণকাণ্ডের পর কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, তার পরেও যৌন হিংসা বা দলিতের উপর নিপীড়ন কমেনি। যে লড়াই শুরু হয়েছে, তা যদি চালিয়ে নিয়ে যেতে হয় তাহলে সর্বস্তরের প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ, শহর-মফস্বল-গ্রামের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আদানপ্রদানের পরিসর গঠন, এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়ে যাওয়া প্রয়োজন। খুব তাড়াতাড়ি সমাজ থেকে বৈষম্য মুছে যাবে এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন আশা আমার নেই; বরং অনেক প্রশ্ন রয়েছে— চলমান এই গণআন্দোলনগুলির সমস্ত সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েই বলছি, এই মুহূর্তে রাস্তায় না নামলে কোনও প্রশ্নেরই উত্তর হয়তো সঠিক সময়ে পাওয়া যাবে না।


*মতামত ব্যক্তিগত