Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একটি মিছিলের ধারাবিবরণী

বুলবুল ইসলাম

 


মিছিল তখনও খান্না ছাড়ায়নি। বাঁদিকের বিশাল বড় বাড়ির বারান্দাটা গিজগিজ করছে মানুষের মাথায়, তার মধ্যে প্রায় বেশিরভাগ মহিলা, এর নিচেই বসে হরি সাহার হাট, মিছিল থেকে স্লোগান নয়, বারান্দার স্লোগানে মিছিলের কমরেডরা প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন কখনও উই ওয়ান্ট জাস্টিস তো কখনও জাস্টিস ফর আরজিকর। মনে হচ্ছে মিছিলের জন্য মানুষ খোঁজা নয় মানুষই মিছিল খুঁজছেন

 

৮ আগস্টের সেই নৃশংস মর্মান্তিক ঘটনার কথা সারা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আগে মীনাক্ষী-দেবাঞ্জন-সহ ছাত্র-যুব কমরেডরা ডাক্তার ছাত্রীর শববাহী গাড়ি আটকে প্রশাসনের সঙ্গে প্রথম নৈতিক যুদ্ধ না করলে আজ প্রায় এক মাস ধরে রাজ্যে আলোড়ন ফেলে দেওয়া ঘটনাটা সাধারণ মানুষ ঘুণাক্ষরে জানতেও পারতেন না হয়তো। আরজিকর-এর ন্যাক্কারজনক ঘটনার রেশ যেন রাজ্য ছেড়ে দেশ থেকে বিদেশে সাধারণ মানুষকে আলোড়িত করেছে, আর সেই আলোড়নের ফলশ্রুতিতে প্রায় প্রতিদিন কলেজস্কোয়ার থেকে যেমন বিভিন্ন প্রতিবাদ-মিছিল একের পর এক সংগঠিত হচ্ছে, তেমনই সারা রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও মিছিল হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন।

রাজ্যের সুধী নাগরিকদের একটার একটা বড় মিছিল এই শহর প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের বিভিন্ন রং, বিভিন্ন স্লোগান, বিভিন্ন রূপ।

কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিল?? বিজেপি বাংলা বনধ করেছে, কংগ্রেস বড় মিছিল করেছে কলেজস্কোয়ার থেকেই।

বামফ্রন্ট মিছিলের ডাক দিল রাজাবাজার থেকে আরজিকর।

মিছিল শুরু হয়নি তখনও। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাল ব্রিগেডের বিভিন্ন বয়সের কর্মীরা আসছেন, জমায়েত রাজাবাজার, দুপুর আড়াইটেয় রাজাবাজার ট্রামডিপো ছাড়িয়ে মানুষজন ক্রমশ মিছিলে ভিড় করছেন। তার মধ্যেই কেউ কেউ স্লোগান দিচ্ছেন— উই ওয়ান্ট জাস্টিস।

হঠাৎ কানে এল একটা স্লোগান— শাসক তোমার কীসের ভয়??
অসংখ্য মানুষ স্লোগান দিয়ে উঠলেন— ধর্ষক তোমার কে হয়??

মিছিল শুরু না হতেই মিছিলের মেজাজ জানান দিচ্ছে মিছিলের উত্তাপ।

আশেপাশের চায়ের দোকান থেকে জলের বোতল বা সিগারেট-বিক্রেতাদের তখন হিমশিম অবস্থা, এই দুপুরে অন্যান্য দিনে এই অঞ্চলের এইসব দোকানিদের এই ব্যস্ততা থাকে না বললেই চলে।

পাশ থেকে একজন যুবক তার পরিচিত একজন বয়স্ক মানুষকে বলছেন জেঠু পুরোটা হাঁটবেন? উনি জবাব দিলেন জাস্টিস চাইতে আরজিকর পর্যন্ত হাঁটতে পারব না?

মিছিল হাঁটতে শুরু করেছে। রাজাবাজারের দু-প্রান্তের অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউ কেউ স্লোগান দিচ্ছেন। আসলে মূলত কলেজস্কোয়ার থেকেই বেশিরভাগ মিছিলগুলো শ্যামবাজারের দিকে গেছে এতদিন, তাই এই মিছিলের উত্তাপ বহুদিন এই অঞ্চলের মানুষ তেমনভাবে পাননি। দুদিকের যানচলাচল স্তব্ধ হয়ে আছে। বাসে বসে আরোহী বিরক্ত না হয়ে মিছিলের স্লোগানকে সংহতি জানাচ্ছেন। সময় ও আশেপাশের পরিবেশ মিছিলকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট, মিছিলের শেষ যখন সুকিয়া স্ট্রিট তখনই শোনা যাচ্ছে খান্নার মুখে ব্যারিকেড ভেঙে মিছিলের মুখ শ্যামবাজারের দিকে এগিয়ে গেছে।

 

ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের জানলাগুলোয় ছাত্রীরা ভিড় জমিয়েছে মিছিলের পানে তাকিয়ে, মিছিল এগোচ্ছে, মানিকতলার দু-প্রান্তের দোকানদার থেকে সাধারণ পথচলতি মানুষ ছবি নিচ্ছেন মিছিলের, হঠাৎ দেখা গেল একদল স্কুলফেরত কচিকাঁচা জাস্টিস ফর আরজিকর বলে চেঁচাচ্ছে, তাদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে। সেই ছবি ক্যামেরাবন্দি করে ফেললেন বেশ কিছু উৎসুক কমরেড।

স্লোগান উঠছে— তোমার স্বর আমার স্বর, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— জাস্টিস ফর আরজিকর।

অসংখ্য মানুষ মিছিলে এসেছেন। কেউ অফিস থেকে, কেউ-বা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ছাত্রছাত্রী, এসেছেন অসংখ্য মহিলা, চোখে পড়ল একজন ক্রাচ নিয়ে হাঁটছেন, কথা বলে জানা গেল মিছিলের পুরোটাই হাঁটবেন তিনি।

মিছিল তখনও খান্না ছাড়ায়নি। বাঁদিকের বিশাল বড় বাড়ির বারান্দাটা গিজগিজ করছে মানুষের মাথায়, তার মধ্যে প্রায় বেশিরভাগ মহিলা, এর নিচেই বসে হরি সাহার হাট, মিছিল থেকে স্লোগান নয়, বারান্দার স্লোগানে মিছিলের কমরেডরা প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন কখনও উই ওয়ান্ট জাস্টিস তো কখনও জাস্টিস ফর আরজিকর। মনে হচ্ছে মিছিলের জন্য মানুষ খোঁজা নয় মানুষই মিছিল খুঁজছেন। পাশের বাড়ির ছোট্ট বারান্দা থেকে একদল মহিলা আরও তীব্র স্লোগানে যোগ দিলেন। ঠিক তার নিচেই পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ, পড়ে রয়েছে সরিয়ে দেওয়া গার্ডরেল। এ যেন জানান দিচ্ছে মুক্ত করো ভয়।

 

মিছিল এগিয়ে চলল শ্যামবাজারের দিকে, শ্যামবাজার ছোঁয়ার আগেই ফড়িয়াপুকুর আসতে-না-আসতেই মিছিল দাঁড়িয়ে পড়েছে। আর কোথাও যাওয়ার জায়গা পর্যন্ত নেই। কারণ শ্যামবাজার থেকে ডানদিকের আরজিকর-এর রাস্তা গার্ডরেল দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে অসংখ্য পুলিশ। বামফ্রন্টের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখছেন, দু-প্রান্তের যানচলাচল সম্ভব নয়, শুধু মানুষের কালো মাথায় ধূসর পথ যেন ছেয়ে আছে। এই ধূসর পথকেই উজ্জীবিত করতে আগামী সময়কে নতুন করে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে বামফ্রন্টের মিছিল। মঞ্চ নয়, শ্যামবাজারের নেতাজি মূর্তির পাদদেশে তখন একটি ম্যাটাডোরে বসে বক্তৃতা শুনছেন কমরেড বিমান বসু।

এর মধ্যেই বাম ছাত্রযুবরা শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনের পাশেই তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণ-অবস্থানে বসছেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।

সূর্য তখন প্রায় অস্তমিত। গোধূলির রঙে পুরো আকাশ যেন রক্তিম অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে মিছিলের কমরেডদের।


*মতামত ব্যক্তিগত