Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দারুণ বিপ্লব মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে…

আহেলী পাল

 


পুরুষতন্ত্র উৎখাত করার মৌলিক পথ হল নারীর ক্ষমতায়ন। আর্থিক পরাধীনতা থেকে নারীর মুক্তি চাই। চাই একদম গোড়া থেকে পাঠ্য সিলেবাসে লিঙ্গসচেতনতার পাঠ। কিন্তু সেটা তো এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়। তাহলে আশু দাওয়াই কী? সরকার পরিচালনার মাথায় যারা রয়েছে তাদের ধ্যানধারণা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। একটা সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার মূল ভিত্তি যদি লুম্পেনবাহিনি হয়, এবং শীর্ষনেতৃত্ব যদি তাদের কার্যকলাপকে কেবল আড়াল করাই নয়, মদত জোগায়, তাহলে সেই সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রগতি ভাবনার সরকার প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে এই নৃশংসতা বন্ধ করা কঠিন

 

নারীজন্ম তো দেখলাম, পরের জন্মে পুরুষ হয়ে দেখব, কেমন লাগে।

আশাপূর্ণা দেবী, প্রথম প্রতিশ্রুতি

কয়েকদিন আগে, একটা খবর নেটপাড়ায় খুব ভাইরাল হয়েছিল। খবরটা এমন— মেয়েদের ওপর করা একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যদি এমন পরিস্থিতিতে মেয়েদের ফেলা হয়, যেখানে একটি গভীর জঙ্গলে কোনও মহিলাকে একটি ভালুক এবং একটি পুরুষের মধ্যে বেছে নিতে বলা হয়, অধিকাংশ মহিলা নির্দ্বিধায় ভালুককে বেছে নিচ্ছেন, পুরুষকে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর হাসিঠাট্টা টিটিকিরিতে ছেয়ে গেল, বলা বাহুল্য পিতৃতন্ত্রে।

আবার উঠে এল, মেয়েদের অতি-আবেগ (পড়ুন ন্যাকামো), নির্বুদ্ধিতার ফলাও প্রচার এবং তার সঙ্গে ভুরিভুরি টিটকিরি। আরও মজার ব্যাপার কেউ কেউ এই পর্যায়েও চলে গেলেন— “এই সব কারণেই তো নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডাকে, দিয়ে ছেলেদের দোষ হয়ে যায়।”

লীলা মজুমদার মনে হয় এইজন্যই লিখেছিলেন,

সত্যি কথা বলতে কি, এই যে পুরুষানুক্রমে মেয়েদের বুদ্ধিহীনতার প্রবাদ চলে আসছে, এতে মেয়েদের কম সুবিধে হচ্ছে না।‌ বেজায় বুদ্ধি না থাকলে মান্ধাতার আমল থেকে কেউ বোকা সেজে থাকতে পারত না!

—লীলা মজুমদার, খেরোর খাতা

তা নাহলে দরকার হলে একটা পশুর সঙ্গে থেকে যাব কিন্তু কোনও মতেই পুরুষ না। এই “না”-এর মধ্যে যে সপাটে একটা কষিয়ে থাপ্পড় লুকিয়ে আছে এই পিতৃতন্ত্রের গালে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হত না।

এবার অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন একটা আরজিকর-কাণ্ড হল বলেই সবাই রে রে করে তেড়ে আসছি নারীবাদের ঝান্ডা তুলে, এত দিন কোথায় ছিলাম? নানান জনে নানান প্রশ্ন তুলবে, অমুক কাণ্ড যখন ঘটল তখন কেন কিছু লিখিনি, এরকম চলতে চলতে হস্তিনাপুরে দৌপ্রদীর বস্ত্রহরণের সময় নিয়ে কই একটা প্রবন্ধ, অন্তত একটা ফেসবুক পোস্ট তো করা উচিত ছিল! সেটা যখন করা হয়নি, তখন এখন এসে “মেকি নারী-অধিকার চাই” বলে নাটক করা কেন বাপু।

আচ্ছা এই প্রশ্ন কি নিজেরাও নিজেদের করিনি? যে পশ্চিমবঙ্গে এখন বাঙালির পরিচয় একটা ধুঁকতে থাকা জাতি যাদের সেই রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার নস্টালজিয়াতে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই ভাল হয়, সেই রাজ্যে হঠাৎ চোদ্দোই আগস্টের মতো রাত নেমে এল! সারা রাজ্য তথা সারা দেশ এক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখ্য, সারা রাত জুড়ে লাখ লাখ সেই নরমসরম অবলা “মেয়েমানুষের” গর্জনে সরকার, সেই সরকার যে “এসব ছোট ঘটনা” কিংবা পার্কস্ট্রিট-কাণ্ডে “মেয়েটার ব্যক্তিগত কোনও স্ক্যান্ডাল আছে কিনা দেখতে হবে,” বলে আরামসে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেই প্রশাসনের কোলাপস করে যাওয়ার মতো অবস্থা এলো! তড়িঘড়ি কপিল সিবাল-এর মতো জাঁদরেল উকিলকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে আনার ব্যবস্থা করা হল সরকারের পক্ষে লড়ার জন্য। করুণা হয় সেই মানুষগুলোর বোধের ওপর যারা এরপরেও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি শুনে ক্ষেপে গিয়ে ছুটে বলতে আসে, একটা মেয়ে মারা গেছে, তার বিচার না চেয়ে কেন রাজনীতি-রাজনীতি খেলা হচ্ছে! আরও বেশি মজার ব্যাপার, “এই আমরা অরাজনৈতিক”-ট্রেন্ড আমাদের বাংলাতেই বেশি। স্বাভাবিক বাঙালি তো ইন্টেলেকচুয়াল, বলতে ইচ্ছে করলেও বলা যায় না “রেখেছ বাঙালি করে…” ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রশ্ন যতবার নিজেকে করেছি, বারবার মনে হয়েছে, যারা এই নিকৃষ্ট কাজ করল, তারা অপরাধী। তাদের বিচার চাইছি। চাইবও। কিন্তু এরা তো খাতায়কলমে অপরাধী, কারণ আমাদের আইন, সংবিধানে, বিশেষত সমাজের বইতে যে যে অপরাধকে অপরাধ বলে মনে করা হয়, তার মধ্যে খুব ওপরের সারিতে থাকা অপরাধ হল ধর্ষণ। দৈহিক ধর্ষণ। কিন্তু বাকিটা? পিতৃতন্ত্র আমাদের যা যা অপরাধ বলে চিনতে শিখিয়েছে, আর যা সুচতুর কৌশলে এড়িয়ে গেছে, বলেনি। যার কোনও নাম নেই, সেই অলিখিত, নামহীন অপরাধগুলোর কী হবে? শুধু আইনি বদল এনে খাতায়কলমে অপরাধীদের শাস্তি দিলে ধর্ষণ কমে যাবে তো? কমে যাবে মেয়েদের রোজ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উপায়ে পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতার তলায় চাপা পড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা? কর্মস্থলে, পরিবারে রোজ যে হেনস্থা, অসম্মান অবহেলা, সর্বোপরি করুণা তারা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে সেই গোড়ায় গলদের উপশম না ঘটলে, এই এতদিনের একটু একটু করে গড়ে ওঠা পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতায়নের সাম্রাজ্যকে শুধু আইন প্রণয়ন করে শাস্তি দিয়ে ভাঙা যাবে? মনে হয় না। তাহলে এনসিয়েন্ট যুগে যখন ধর্ষণকারীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে যৌনাঙ্গে পাথর ছুড়ে থেঁতলে থেঁতলে মারা হত, তারপরই তো হিসেবমতো ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। এক্ষুনি অনেকেই বলতে পারেন, আমাদের দেশে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়, তাই ধর্ষণ হয়। কিংবা আমাদের দেশের মেয়েরা কুংফু ক্যারাটে শেখেনি, তাই এদেশে এসব বেশি হয়। তাদের জ্ঞানার্থে একটু জানিয়ে রাখি, সাম্প্রতিক সময়ে ভিনেশ ফোগত-এর জবানবন্দি সবাই আশা করি শুনেছেন, তাই এই শারীরিক দুর্বলতা মেয়েদের ওপর অত্যাচার বাড়ার বড় কারণ— এই ধারণা বালখিল্যতা ছাড়া আর কিছু না।

কিন্তু এরপরেও প্রশ্ন আসে, এবং যা একেবারেই অবান্তর নয় বরং অনিবার্য, তা হল এর সুরাহা কী? আদৌ সম্ভব? পুরুষতন্ত্রের ভিত আমাদের বংশানুক্রমে এত মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে গেছে, যে তার শিকার যে শুধু মেয়েরা তা তো নয়, ট্রান্সজেন্ডার, কুইয়ার থেকে শুরু করে খোদ পুরুষরাও। এমনকী পরিসংখ্যান দেখায় এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা তথাকথিত সমাজের বাঁধাধরা সংজ্ঞা অনুযায়ী “পুরুষোচিত” নয়, “মেয়েলি”। অর্থাৎ, ঠিক যে যে আধিপত্য, কথায় কথায় মেয়েদেরকে অবজেক্টিফাই করে গালাগালি, অ্যারোগেন্স না থাকলে তথাকথিত পুরুষ হওয়া যায় না, সেই সকল গুণাবলি যে-সকল পুরুষদের মধ্যে নেই, তারাও এই ক্ষমতায়নের অত্যাচারের শিকার। তাহলে এর সমাধান কী? এত রুটেড অস্থিমজ্জায় গেঁথে থাকা সমস্যার সমাধান এক কথায় দেওয়া কঠিন।

এর মৌলিক সমাধান হল নারীর ক্ষমতায়ন। আর্থিক পরাধীনতা থেকে নারীর মুক্তি চাই। চাই একদম গোড়া থেকে পাঠ্য সিলেবাসে লিঙ্গসচেতনতার পাঠ। কিন্তু সেটা তো এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়। তাহলে আশু দাওয়াই কী? সরকার পরিচালনার মাথায় যারা রয়েছে তাদের ধ্যানধারণা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। একটা সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার মূল ভিত্তি যদি লুম্পেনবাহিনি হয়, এবং শীর্ষনেতৃত্ব যদি তাদের কার্যকলাপকে কেবল আড়াল করাই নয়, মদত জোগায়, তাহলে সেই সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রগতি ভাবনার সরকার প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে এই নৃশংসতা বন্ধ করা কঠিন।

নাহলে সামনের দিন হয়তো আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে। তবে এত আকালের মধ্যেও ভাল লাগছে, লাখ লাখ মানুষ আজ রোজ পুলিশের মার, সরকারের হুমকি, বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে রাস্তায় গর্জে উঠছে। এই স্পর্ধাকে অস্বীকার করার শক্তি পৃথিবীর কোনও শাসকের নেই।

রাজা: আমার সঙ্গে লড়াই করবে তুমি! তোমায় যে এই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পারি।
নন্দিনী: তারপর মূহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমায় মারবে। আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।…

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রক্তকরবী


*মতামত ব্যক্তিগত