Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আরজিকর গণআন্দোলন: কোন পথে?

কৌশিক বিশ্বাস

 

ন্যায়বিচারের লড়াই যত তীব্র হবে, বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব, যেমন সরকার-আন্দোলনকারীর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, সরকার-আধিকারিকদের দ্বন্দ্ব, সরকার-শাসকদলের দ্বন্দ্ব, আন্দোলনকারীদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বাড়তে থাকবে। এই সময় যা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে তা হল মতাদর্শ। ইতিহাস শেখায়, মতাদর্শ ছাড়া সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই বা রাজনৈতিক লড়াই জেতা কঠিন। লড়াই-সংগ্রাম থেকেই বারবার মতাদর্শ উঠে আসে বা বিদ্যমান মতাদর্শ আরও শক্তিশালী হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা

 

আরজিকর মেডিকেল কলেজে সঙ্ঘটিত ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড বাঙালি জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। কলকাতা ও মফস্বলের লক্ষ লক্ষ মানুষ সামিল হয়েছেন প্রতিবাদ, আন্দোলনে। মহিলাদের রাতদখল অভিযান এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। রাতদখল অভিযানে কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন জায়গায় নারীপুরুষ সকলে একসঙ্গে দখল নেন রাস্তার। এত বিশাল সংখক মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সমর্থন ইদানিংকালে ঘটা কোনও আন্দোলনে দেখা গেছে বলে আমার মনে পড়ছে না। গত ১৮ আগস্ট এক অবিস্মরণীয় ইতিহাসের সাক্ষী থাকল আপামর জনসাধারণ। ফুটবলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সমর্থকেরা একসঙ্গে প্রতিবাদে সামিল হলেন তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে। এই সংযুক্তি আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছে।

এই অভূতপূর্ব, ব্যাপক আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করা জরুরি। এই ঐতিহাসিক গণআন্দোলন যেন বাঙালির প্রতিবাদী সত্তাকে আবারও জাগরিত করেছে। এই আন্দোলন হয়তো আগামীদিনে বাংলা, বাঙালি ও গোটা দেশকেই পথ দেখাবে। মূলত কলকাতা ও মফস্বলের শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত মানুষ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব। একেবারে শুরুতেই আন্দোলনকারীদের মূল অংশ ঘোষণা করেন যে এই আন্দোলনের চরিত্র হবে ‘অরাজনৈতিক’, অর্থাৎ দলীয় পতাকাবিহীন এক জনগণের আন্দোলন। দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব রয়েছে নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণকারী সকলেরই। হয়তো রাজনৈতিক দলগুলির উপর অনাস্থা প্রকাশ পাচ্ছে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। আন্দোলন থেকেই নেতা তৈরি হয়, আর নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দাবি করে নীতির। এই আন্দোলন থেকে পশ্চিমবঙ্গে নতুন নেতা এবং নীতির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। লড়াই এখন রাস্তা দখলের, প্রতিবাদ এখন সাধারণ জনগণের। হয়তো পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ রাজনীতির নতুন দিকনির্দেশ রচনা করবে এই গণআন্দোলন। আমরা দেখলাম শহর ও মফস্বলের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ রাস্তায় নামলেন, অংশগ্রহণ করলেন মিছিলে, অবরোধে। যা তাদের এতদিনের চিন্তাচেতনার একেবারেই বিপরীত প্রতিক্রিয়া। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বুঝেছেন যে রাস্তায় নেমে আন্দোলন না করলে দাবি আদায় সম্ভব হয় না। বাঙালি ভদ্রলোকদের বোধোদয় হয়েছে যে সরকার বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ভীষণ জরুরি। রাস্তায় মিছিল বা মিটিং করা মানেই ‘কোনও কাজ নেই’ তা নয়। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করা একটা গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক কাজ। তাঁরা বুঝছেন, আন্দোলন করেই অবস্থার পরিবর্তন করা যায়। শিক্ষিত-মধ্যবিত্তরা একটা শৃঙ্খল অন্তত ভাঙলেন। তবু যে দ্বিধা এখনও রয়ে গেছে তাঁদের মনে তা হল ‘সব রাজনৈতিক দল একই’। এক ভীষণ ‘সুশীল সমাজ’ দাবি করে রাজনীতি মানেই খারাপ, এবং ‘অরাজনৈতিক’ হওয়া স্বাভাবিক। আরজিকরের ঘটনার সঙ্গে কি সরকারের বা সরকারি নীতির কোনও যোগ নেই? এখনও কি এই বিশেষ ‘অরাজনৈতিক’ মানুষেরা বলবেন, রাজনীতি করা যাবে না? এরপরেও কি বলবেন, সব দল একই? এই আন্দোলনের আরেকটি বিশেষ দিক হল যে আন্দোলনকারীরা বুদ্ধিজীবী বা সেলেব্রিটিদের প্রতি অনাস্থা জানালেন, বাধ সাধলেন তাঁদের অংশগ্রহণে। যদিও শিল্পীরা তাঁদের মতো করে সামিল হয়েছেন প্রতিবাদে। অর্থাৎ মানুষ ক্যামেরার ঝলকানি নয়, চাইছেন তাঁদের হক— ন্যায়বিচার। আসলে পশ্চিমবাংলার এক দশকের অপশাসন ও দুর্বৃত্তায়ন, যার ফলশ্রুতি বাংলার অবনমন, বাঙালির মননে ধীরে ধীরে বদল এনেছে। বলা যেতে পারে এই গুণগত পরিবর্তনই হয়তো আন্দোলন যে রূপ ধারণ করেছে তার কারণ।

ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা সেখান থেকে তৈরি হয়ে ছোট-বড় গ্রুপ (সোশাল মিডিয়া-পরবর্তীতে সরাসরি)-এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে সমস্ত কর্মসূচি। ফলে একসঙ্গে অনেক জায়গায় আন্দোলন হচ্ছে, আবার সিদ্ধান্তহীনতা বা জড়তাও দেখা যাচ্ছে। ছড়িয়ে থাকা আন্দোলনকারীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ঘটতে পারে, যা আন্দোলনকে দুর্বল করবে। সরকার এবং তদন্তকারী সংস্থার উপর আরও চাপ তৈরি করার জন্য দাবিসমূহকে জোরালো করা এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আন্দোলনের কৌশল বদল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একমাস হয়ে গেল, সরকার সময় দীর্ঘ করতে চাইছে— যাতে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ফলে আন্দোলনকে আরও জমাট করা বা তীব্র করার জন্য প্রয়োজন একটা সমন্বয়। আরও দীর্ঘ সময় ও পরিসরে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন পরিকল্পনা এবং একটা মঞ্চ— যৌথ মঞ্চ। আন্দোলনের কেন্দ্র এখনও মূলত কলকাতা ও মফস্বল, এবং সকলেই এ-বিষয়ে অবগত। গ্রামগঞ্জে এর প্রভাব ঠিক কতটা? ভাবতে হবে। যে-কোনও সংগঠিত আন্দোলন সবসময় প্রতিবাদের আঁচ যত বেশি সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাই করবে। এক্ষেত্রেও কি তাই হচ্ছে? নাকি আন্দোলন শিক্ষিত-মধ্যবিত্তদের মধ্যে রয়ে গেছে? গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য এর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষ ঠিক কী ভাবছেন বা তাঁদের অংশগ্রহণ কতটা? বুঝতে হবে। এই আন্দোলন কি শুধুমাত্র একটি ঘটনার ন্যায়বিচার চেয়ে শান্ত হবে? নাকি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নীতিগত কিছু অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে চাইবে? সরকারকে বাধ্য করবে ন্যায়বিচার যাতে আরও বড় পরিসরে অগ্রগতি লাভ করে? এই নিয়ে আন্দোলনকারীদের মতামত বা ভাবনা ঠিক কী? বিশাল সংখ্যক গ্রামীণ মানুষকে এই প্রতিবাদে সামিল করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে গরিব কৃষক-কলকারখানা শ্রমিক-অসংগঠিত শ্রমিকদের সমস্যা বা দাবি কি এই আন্দোলনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে? কারণ এঁরাও প্রতিদিন ভয়ঙ্কর দুর্নীতি ও ভয়ের পরিবেশকে সহ্য করেই জীবনযাপন করছেন। নারীসুরক্ষার যে দাবি উঠেছে তা সঠিক, কিন্তু গ্রামীণ মহিলা কৃষক বা কারখানার মহিলা শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট দাবি কি এর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে না? একটা বিরাট অংশের গ্রামীণ মহিলারা প্রতিদিন যে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে থাকেন, তাঁদের কথাও এর সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারলে আন্দোলনের পরিসর বড় করা যেতে পারে। আরও শক্তিশালী ন্যাবিচারের দাবি নিশ্চিত করা যেতে পারে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নিশ্চিতভাবেই এই আন্দোলনের এক বড় শক্তি। তাঁরা আলাদা আলাদা করে বা কখনও একসঙ্গেও প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। কিন্তু জেলার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা প্রয়োজন। একসঙ্গে সমস্ত ছাত্র ইউনিয়ন মিলে যৌথ কর্মসূচি এখনও অব্দি আমার নজরে পড়েনি (মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রী বাদ দিয়ে)। ছাত্রছাত্রীদের মিলিত প্রয়াস আন্দোলনকে শক্তিশালী করবে। ন্যায়বিচারের লড়াই যত তীব্র হবে, বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব, যেমন সরকার-আন্দোলনকারীর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, সরকার-আধিকারিকদের দ্বন্দ্ব, সরকার-শাসকদলের দ্বন্দ্ব, আন্দোলনকারীদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বাড়তে থাকবে। এই সময় যা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে তা হল মতাদর্শ। ইতিহাস শেখায়, মতাদর্শ ছাড়া সংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই বা রাজনৈতিক লড়াই জেতা কঠিন। লড়াই-সংগ্রাম থেকেই বারবার মতাদর্শ উঠে আসে বা বিদ্যমান মতাদর্শ আরও শক্তিশালী হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

এই তীব্র গণআন্দোলন নিশ্চয়ই আরও বড় আকার নেবে, এবং ন্যায়বিচারের দাবিতে মানুষের লড়াই সফল হবে। আমরা আশায় বুক বেঁধেছি এই আন্দোলন ইতিহাস রচনা করবে। ইতিহাসে বাংলা ও বাঙালি বারংবার স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেছে, পথ দেখিয়েছে সঙ্কটমুক্তির, শোষণমুক্তির।


*মতামত ব্যক্তিগত