Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আরজিকর— যেন ভুলে না যাই বেদনা পাই শয়নে স্বপনে

শুভোদয় দাশগুপ্ত

 


কারা জড়িত এর সঙ্গে? এইসব প্রশ্নগুলো উঠে আসা দরকার। রাতের অন্ধকারে বা রাত ও ভোরের সন্ধিক্ষণে সঙ্ঘটিত এই নৃশংস ক্রাইমের পর তাকে সকাল নটা অবধি সাধারণ মানুষের গোচরে আসতে না দেওয়ার জন‍্য প্রফেশনাল ক্রিমিনালদের একটা টিম-ওয়ার্ক লাগে। এই জায়গাটাকেই উন্মোচিত করতে হবে। এবং এটা উন্মোচিত হওয়া শতকরা একশো ভাগ সম্ভব যেখানে ক্রাইমের প্লেস অফ অকারেন্স যাই হোক সেটা একটা সরকারি হাসপাতালের ভিতরে ঘটেছে। অপরাধীদের খুঁজে বের করা একশো শতাংশ সম্ভব যদি হাসপাতাল প্রশাসন পুলিশের প্রশ্রয়ে প্রচুর তথ‍্যপ্রমাণ লোপাট করে থাকে তাও। এমনকি ঘটনার অব‍্যবহিত পরে চেস্ট মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট সংলগ্ন দেওয়াল এবং ওয়াশরুম ভেঙেও অপরাধীদের বাঁচানো সম্ভব নয়

 

পরবর্তী পর্যায়ের সুপ্রিম-শুনানির আর দেরি নেই। তিলোত্তমা ধর্ষণ ও খুনের মামলায় সূচনাপর্বে এক সিভিক ভলান্টিয়ার-কে গ্রেফতার করবার পর একমাসের বেশি সময় পেরিয়ে অবশেষে আরও কিছু সম্ভাব‍্য অপরাধীকে গ্রেফতার করল সিবিআই। তার মধ‍্যে অন‍্যতম টালা থানার সেই বিতর্কিত ওসি, যে ব‍্যক্তি তিলোত্তমা হত‍্যার পর এফআইআর রুজু করিয়েছেন কমবেশি বারো ঘন্টা পর। যে ওসি সিবিআই তদন্তপ্রক্রিয়া শুরু করার পর “অসুস্থতা”র কারণে হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছিলেন। আর একটি গ্রেফতার আরজিকর মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ‍্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের যিনি আগেই গ্রেফতার হয়েছিলেন সিবিআইয়ের হাতে তবে দুর্নীতি মামলায়। তিলোত্তমাকে ধর্ষণ ও খুন মামলায় এই দুই গ্রেফতারি রাজ্য সরকারের কাছে বিরাট এক ধাক্কা।

তিলোত্তমার এক সরকারি মেডিকেল কলেজে পাঠরতা এবং কর্মরতা অবস্থায় এই নৃশংসভাবে ধর্ষিতা ও খুন হওয়ার অব‍্যবহিত পর থেকে সারা বাংলা, সারা দেশ এমন কি গোটা বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। জাস্টিস ফর আরজিকর এক আন্তর্জাতিক দাবি হয়ে উঠেছে। অনেক দুরাচার হয়েছে এই ঘৃণ‍্য অপরাধ নিয়ে। একবার মেয়ে গুরুতর অসুস্থ এই কথা জানানো হয়েছে নির্যাতিতার মা-বাবা-কে। একবার মেয়ে আত্মহত‍্যা করেছে এই মর্মে মিথ‍্যাচার করেছে হাসপাতালের একজন অ্যাসিসট‍্যান্ট সুপার। তার কাছ থেকেই ফোন গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মৃতার বাবা-মা-কে মিথ‍্যা তথ্য দেওয়া, আরজিকর মেডিকেল কলেজে তাঁদের নিয়ে গিয়ে তাঁদের তিন ঘন্টা মেয়ের মৃতদেহর সামনে আসতে না দেওয়া… এইসব নানা অভিযোগ। এই সব অভিযোগের সঙ্গেই জড়িয়েছিল হাসপাতালের অধ‍্যক্ষ ও পুলিশ এবং টালা থানার ওসির ভূমিকা। তীব্র বিক্ষোভের মুখে পড়া অধ‍্যক্ষকে সাসপেন্ড করবার পরিবর্তে দ্রুততার সঙ্গে তাকে বদলির অর্ডার বের করা হয় অন‍্য মেডিকেল কলেজে।

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে মহিলারা এইসব অনাচারের বিরুদ্ধে এবং ধর্ষকদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবিতে রাজ‍্যব‍্যাপী রাতদখলের ডাক দেয়। এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটে যায়। বাংলা যেন এক কালান্তরের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ‍্যে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে যাতে এই ধর্ষণ ও খুনের বিষয়ে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে।

আরজিকরে ঘটে যাওয়া এই বর্বরোচিত ঘটনার সম্ভাব‍্য প্লেস অফ অকারেন্সের চারপাশে ঘর, দেওয়াল এবং ওয়াশরুম ভেঙে রেনোভেশন করা তথ‍্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগকে জোরালো করে।

রাজ‍্য পুলিশের হাত থেকে তদন্তের ভার গ্রহণ করে সিবিআই-ও দিশা পাচ্ছিল না প্রথম পর্বে। কারণ তথ‍্যপ্রমাণ অনেক লোপাট হয়েছিল।

এই রাজ‍্যে বিগত একদশকের বেশি সময় থ্রেট-কালচার, দুর্নীতি সিন্ডিকেট চলে এসেছে অবাধে। সম্ভবত তারই বলি তিলোত্তমা। টালা থানার ওসির গ্রেফতারি এবং সন্দীপ ঘোষের দুর্নীতি মামলার পর ধর্ষণ-খুন মামলাতেও সিবিআই-এর হাতে দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হওয়া সেই সন্দেহকেই মান্যতা দিল।

জুনিয়র ডাক্তারদের মাসাধিক কালব‍্যাপী আন্দোলনকে কুর্নিশ! তাদের মহাকাব‍্যিক লড়াইয়ে দৃশ‍্যত অপ্রস্তুত অবস্থায় ধর্নামঞ্চে এলেন মাননীয়া। জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মাননীয়ার আলোচনার রাস্তা অবশ্য খুলল না।

সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার ওসির এই গ্রেফতারি মান‍্যতা দিল আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের অন‍্যতম দাবি পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের পদত‍্যাগের দাবিকেও।

বর্তমান এই পরিস্থিতিতেই ফিরে তাকাতে হবে তিলোত্তমা খুন ও ধর্ষণ মামলার বিগত একমাসের গতিপ্রকৃতির দিকে।

ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে আমাদের সমাজে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়? আজ আরজিকর-কাণ্ডে নাগরিক সমাজ আমরা এইভাবে ক্রোধ, ঘৃণা এবং প্রতিবাদে ফেটে পড়েছি কেন? এই পাপ নিয়ে সমাজে, শাসনব্যবস্থায় সত‍্যিই কি গুরুত্বসহকারে কোনও নিরাপত্তাবলয় তৈরির যথাযথ এবং ধারাবাহিক প্রয়াস আমরা কোনওকালে দেখেছি? নারীসুরক্ষা, নারীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে কোনও রাষ্ট্রীয় উদ‍্যোগ দেখেছি আমরা? কোনও সরকার, কী রাজ‍্য, কী কেন্দ্র তার সরকারি বাজেটে নারীদের নিরাপত্তাখাতে কোনও পৃথক বরাদ্দ করে? কোনও বিশেষ ব‍্যবস্থা গ্রহণ করে? আমাদের সমাজে ধর্ষণ তো পুরুষের একপ্রকার জন্মগত অধিকার। এ তো হল আদিম হিংস্র মানবিকতা যা বংশ-বিস্তারে এবং সমাজকে চালিয়ে নিয়ে যেতে অপরিহার্য। ধর্ষণ নানা আঙ্গিকে আবহমানকাল থেকে চলে আসছে পুরুষশাসিত সমাজে। প্রতি মুহূর্তে প্রতিনিয়ত এই ধর্ষণ চলেছে এই সমাজে, এমনকি পরিবারে অর্থাৎ দাম্পত‍্যেও। যৌনমিলন পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক ইচ্ছের নিরিখে এক আপাত পবিত্র ক্রিয়া। কিন্তু এই মিলনের ক্ষেত্রে পুরুষ-নারী উভয়েরই কিছু ব‍্যক্তিগত মানসিক পরিস্থিতি, এক-একটা দিন শারীরিক ক্লান্তি, মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবজনিত শারীরিক সীমাবদ্ধতা কাজ করে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অনীহাগুলো, শারীরিক সীমাবদ্ধতাগুলো অনেক বেশি। একজন পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে কোনও রাতে যৌনমিলনে বিরত থাকতে পারেন ব‍্যক্তিগত অনিচ্ছার কারণে। স্ত্রী সেক্ষেত্রে নিজের তীব্র ইচ্ছে থাকলেও স্বামীকে বাধ‍্য করেন না কিংবা বাধ‍্য করতে বলপ্রয়োগ করবার সামর্থ্য রাখেন না। কিন্তু বিপরীত সেনারিওতে একজন স্ত্রীর হাজারো মানসিক বা শারীরিক ক্লান্তি থাকলেও স্বামী তাকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধ‍্য করে থাকেন যৌনমিলনে। এটাও বলাৎকার। নারীরাই এর শিকার। সোশাল ডারউইনিজমের নিরিখে এটাই তো পুরুষের হকের পাওনা। যোগ‍্যতমের উদবর্তন। নেপথ‍্যে আছে শারীরিক গড়নে, পেশিশক্তিতে অনেক বেশি এগিয়ে থাকার প্রাধিকার। আর পুরুষ-নারীর মিলন বা সহবাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক তূরীয় আনন্দ মাত্র কয়েক মুহূর্তের। কিন্তু নারী সেখানেও অসহায়। সঙ্গমের পরেও নানা দায়বদ্ধতায় নানা উদ্বেগে তাকেই দিন অতিবাহিত করতে হয়, পুরুষকে নিশ্চিন্ত রেখে। গর্ভে সন্তান এল কিনা! এলে তার বৈধ পিতৃপরিচয় থাকবে কিনা! আর না থাকলে সম্ভাব‍্য মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার যন্ত্রণা সয়ে গর্ভপাত ঘটানোর মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সহ‍্য করা। আবার যে নারী নিজস্ব কারণে গর্ভপাত করাতে চান আমাদের সমাজে তাকেও অনেক সময় সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

আর এর বিপ্রতীপে সঙ্গম যদি বৈধ হয়, পরম স্নেহে, লালিত‍্যে, গর্ভে পালন করে তাকে নিরাপদে ভূমিষ্ঠ করবার দায়ও মূলত নারীর। তবে সুস্থ দাম্পত‍্য যখন সন্তানের জন্ম দেয়, পিতার ভূমিকাটাও সেখানে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং মায়ের মতোই স্নেহ, দায়িত্ব, উৎকণ্ঠা ও আবেগে পরিপূর্ণ। তেমনই আবার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে বড় হতে থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে এই সন্তান প্রতিপালনের মূল দায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বর্তায় নারীর উপর। এখানে কিছু আইনের জটিলতাও আছে। সন্তানের প্রতি বাবার নিবিড় টান থাকলেও বিবাহবিচ্ছেদ-কালে সন্তান অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকলে একটা বড় পর্বে সে মায়ের অভিভাবকত্বে থাকে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজব‍্যবস্থায় মেয়েরাই সর্বদা রিসিভিং এন্ড-এ।

ধর্ষণ তো আবহমানকাল থেকে চলেই আসছে এই ধর্ষকাম সমাজে। শতশত ধর্ষণের কোনও বিচার পায়নি ভিকটিম-রা। গোপনে গর্ভপাতের সুযোগ থাকে না অনেক সাধারণ, প্রান্তিক, নিরক্ষর নারীদের। গর্ভে সন্তান এসে গেলে লোকলজ্জার ভয়ে আজও আত্মঘাতী হতে হয় অনেক নারীকে। এটাই বাস্তব। আর যৌনহেনস্থা, নারীদের প্রতি অশালীন আচরণ, দুর্বল মুহূর্তে তাদের শরীরে ‘ব‍্যাড টাচ’ দেওয়া এইসব অপরাধে আমরা পুরুষরা সকলেই প্রায় আমাদের জীবনে কখনও-না-কখনও জ্ঞাতে এবং অজ্ঞাতে অপরাধী। আমার আত্মীয়া, সহপাঠিনী, কর্মক্ষেত্রে মহিলা সহকর্মী, কারও-না-কারও “মি-টু”-তে আমরাই অনুচ্চারিত অপরাধী। এটাই পুরুষতন্ত্র।

তবে আরজিকর কেন এক গণ-আন্দোলনে পর্যবসিত হল যেখানে এই পুরুষ-শাসিত সমাজেই নারী-পুরুষনির্বিশেষে স্বাধীনতা দিবসের পূর্ববর্তী দিনে রাতের দখল নিল। এ-রাজ‍্যের জেলায় জেলায়, শহর ও গ্রামকে সারারাতব‍্যাপী অসংখ‍্য “ব্রিগেড” বানিয়ে দিল, যা কোনও রাজনৈতিক দল কোনওকালে সংগঠিত করতে পারেনি!

এই ধর্ষণ ও খুন ব‍্যতিক্রমী। এই নৃশংসতা ঘটে গেছে এই রাজ‍্যের এক সরকারি মেডিকেল কলেজে। কল‍্যাণী মেডিকেল কলেজ থেকে তিলোত্তমা এমবিবিএস ডিগ্রি পেয়ে প্রাকটিসও শুরু করেন। চেস্ট মেডিসিন-এ পোস্ট-গ‍্র‍্যাজুয়েট ডিগ্রি পড়তেই তাঁর আরজিকরে ঢোকা। এই সরকারি মেডিকেল কলেজেই একজন চিকিৎসক-পড়ুয়া হিসেবে তিলোত্তমা কর্মরতা অবস্থায় ধর্ষিতা হয়ে খুন হলেন।

খুনের পর আর কী কী ঘটল? অচানক সিবিআই রাজ‍্যপুলিশের হাত থেকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তদন্তভার গ্রহণ করল। এর মধ‍্যেই রাজ‍্য সরকার আর এক সরকারি মেডিকেল কলেজে সন্দীপ ঘোষকে গ্রিন করিডর করে বদলির চেষ্টা করে। ডাক্তারদের তীব্র আন্দোলনে সেই চেষ্টা অবশ‍্য ব‍্যর্থ হয়। তারপর আরজিকরের অধ‍্যক্ষ‍ তিন সপ্তাহের কাছাকাছি জেরার মুখোমুখি হয়েছেন সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত অথচ গ্রেফতার হননি, বাড়িও ফিরে গিয়েছেন। গ্রেফতার করা হয় বেশ কয়েকদিন পর দুর্নীতি মামলায়।

এর মধ‍্যে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে। কিছু মন্তব‍্য ও নির্দেশ জারি করে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে ৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু অনিবার্য কারণে সেই শুনানি পিছিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর ধার্য হয়। ৯ সেপ্টেম্বর শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট তিলোত্তমা ধর্ষণ ও খুনের তদন্ত-বিষয়ে সিবিআইকে ও রাজ‍্য সরকারের আইনজীবীকে আরও কয়েকটি নির্দেশ দেয়। সেইসঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের ১০ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার মধ‍্যে কাজে ফিরে যাওয়ারও সময়সীমা বেঁধে দেয়।

বিচারের দাবিতে আন্দোলনও তীব্রতর হচ্ছে। শাসকদল ও রাজ‍্যের প্রধান বিরোধী দল একটা বাইনারি তৈরির খেলায় নেমে পড়েছিল এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়েও। অধিকাংশ মানুষ এবং আন্দোলনরত চিকিৎসকরা অবশ‍্য এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এই নোংরা রাজনীতি করাকে তীব্র ঘৃণা দিয়ে প্রত‍্যাখ‍্যান করেছেন।

বস্তুত এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদকে জনজাগরণে পরিণত করেছে এই বাংলার নারীশক্তি গত ১৪ আগস্টে রাতভর পথের দখল নিয়ে। তিলোত্তমার বিচার পাওয়ার দাবি ওই রাতে শুধু বাংলায় নয়, সারা দেশে এবং বিদেশেও প্রতিষ্ঠিত করেছে নারীশক্তি। নবীন প্রজন্ম তো বটেই, আমার মতো অগণিত প্রবীণ-প্রবীণাও জীবদ্দশায় এমন জনজাগরণের সাক্ষী হয়নি।

এর আগেই এই নৃশংস খুনের পরেও একের পর এক অবিচার চলতে থেকেছে তিলোত্তমা ও তার পরিবারের সঙ্গে। যদিও রাজ‍্যপুলিশ আরজিকরের সেমিনার হলের সিসিটিভি ফুটেজ এবং অকুস্থলে পাওয়া এক হেডফোনের ব্লুটুথ-কে ট্র‍্যাক করে হাসপাতালের এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করে। এই সময় থেকেই রাজ‍্য সরকারের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার এবং অপরাধীদের আড়াল করবার সক্রিয়তার সূচনা।

এবার আসি সেই দুঃস্বপ্নের ও বিভীষিকাময় রাতের কথায়। টানা ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটি করে চিকিৎসক বন্ধুদের সঙ্গে স‍্যুইগিতে আনানো খাবার সবাই মিলে খেয়ে নীরজ চোপড়ার প‍্যারিস অলিম্পিকের রৌপ‍্যপদক পাওয়া টিভিতে দেখেছিলেন বলে আমরা জেনেছি সংবাদমাধ‍্যমে। সেই রাতে অভয়ার (তখনও তিনি ‘অভয়া’, ‘নির্ভয়া’ বা ‘তিলোত্তমা’ হননি; তার বাবা-মায়ের সাধ করে দেওয়া একটা নামই পরিচয় ছিল তার) সঙ্গে তাঁর হবু স্বামীর নিয়মমাফিক কথাও হয়েছিল।

এরপর থেকেই তাঁর অমূল‍্য প্রাণ এবং শরীরের উপর চলে নৃশংসতম অত‍্যাচার। বর্বরতমভাবে ধর্ষণ ও খুন করা হয় তাঁকে। আগে ধর্ষণ করে খুন? নাকি খুন করে ধর্ষণ? অপরাধী একজন? নাকি একদল ধর্ষক খুনির মিলিত ক্রাইম এটা? এসব কোনও কিছুরই কিনারা হয়নি। কিন্তু একটার পর একটা প্রশ্ন উঠে এসেছে। এবং প্রতিনিয়ত আরও প্রশ্ন উঠে আসছে, আরও আসবে, ক্রাইমের মোটিভ নিয়ে, ক্রাইমের প্রকৃত ঘটনাস্থল নিয়ে, অপরাধ সঙ্ঘটিত হওয়ার প্রকৃত সময়কাল নিয়ে। এইসব প্রশ্নে আবার পরে আসব।

তিলোত্তমার সঙ্গে শেষবার যে-রাতে কথা বলেছিলেন তাঁর মা, সেই রাতেই এই নৃশংস অপরাধ ঘটানো হয়েছে আরজিকর হাসপাতালে। কিন্তু ঘটনা সরকারিভাবে নজরে আসে সকাল ন-টার পর। (এইখানেই এক বড় প্রশ্ন যা নিয়ে কোনও চর্চা শুনিনি সেইভাবে)। তারপর টালা থানায় ফোন যায়, অধ‍্যক্ষের কাছে ফোন যায়। ফোন যায় তারও অনেক পরে মৃতার বাড়িতে। এখানেও মৃতার মা-বাবাকে মিথ‍্যে তথ‍্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয় দফায় দফায়। একবার বলা হয় তিলোত্তমা অসুস্থ, তারপর বলা হয় সে আত্মহত‍্যা করেছে। উৎকণ্ঠা, শোক বুকে চেপে বাবা-মা মেডিকেল কলেজ পৌঁছলে তাঁদের তিন ঘন্টা বসিয়ে রেখে মৃতদেহের সামনে আনা হয়। এই সময়কালে তাঁদের মেয়েকে দেখতে না দেওয়ার কারণ দর্শানো হয় এই বলে যে তদন্ত চলছে। অথচ এই তথাকথিত তদন্ত চলার সময়কালে তোলা এক ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দেখা যায় যে ‘তদন্ত’ চলার সময়কালে সেমিনার রুমে ভিড় থিকথিক করছে। আরজিকরের এবং অন‍্যান‍্য মেডিকেল কলেজের অনেক প্রভাবশালী, শাসকদল-ঘনিষ্ঠ ব‍্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে সংবাদমাধ‍্যম এবং আন্দোলনরত চিকিৎসকরা। কলকাতা পুলিশ অবশ‍্য এইসব ব‍্যক্তির অনেকের অন‍্য পরিচয় দাবি করছে।

একটা তথ‍্য উঠে এসেছে যে আরজিকর মেডিকেল কলেজেই কলকাতা পুলিশের যে আউটপোস্ট আছে সেখান থেকে সেমিনার হলে পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট। কিন্তু খবর পাওয়ার পর পুলিশ সেখানে পৌঁছতে জানা যাচ্ছে পঁচিশ মিনিট সময় নিয়েছে। এই সময়টা যে যাবতীয় তথ‍্যপ্রমাণ লোপাট করবার জন‍্য যথেষ্ট এই কথাও বলছে সংবাদমাধ‍্যম। পরের প্রশ্ন একটা হাসপাতালে সারারাতই অসংখ‍্য কর্মচারী, ডাক্তার, নার্স জেগে থাকেন। অনেক ক্রিটিকাল পেশেন্ট থাকে যাদের রাতভর মনিটর করতে হয়। রাত তিনটের পর দুধের গাড়ি ঢোকে। কিচেনের স্টাফরা জেগে উঠতে থাকেন। ভোরে যাদের অপারেশন থাকে সেই পেশেন্টদের প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমরা যারা মফস্বলে বড় হয়েছি, নাবালক থেকে সাবালক হতে-না-হতে হামেশাই যারা পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকাবাসীরা হাসপাতেলে ভর্তি হলেই পেশেন্ট-পার্টি হয়ে রাতের পর রাত জেগেছি তারা এসব ভালই জানি। এহেন এক সরকারি হাসপাতালে যাবতীয় গোপনীয়তা বজায় রেখে এই বর্বরোচিত অপরাধ ঘটানো হল কী করে?

এর জন‍্য নিশ্চিতভাবেই এক “গ্রিন করিডর” তৈরি করতে হয় যাতে জড়িত আছে অনেক ক্রিমিনাল। ম‍্যাকবেথের রাজা ডানকানকে হত‍্যার রাতের শেক্সপিয়রের বিবরণ টেনে এনে বলা যায় এহেন হত‍্যা সঙ্ঘটিত করবার পর অপরাধী বা অপরাধীদের কী নিদারুণ উৎকণ্ঠার প্রহর কাটে। সমস্ত নৈঃশব্দ্য, সমস্ত শব্দ, ওমেন-কে ভয় পেতে থাকে, সন্দেহ করতে থাকে অপরাধীরা।

প্রশ্ন হল শেষ রাতে সঙ্ঘটিত এই ক্রাইম একটা সরকারি মেডিকেল কলেজে গোচরে আসতে সকাল নটা বাজল কী করে? এই চার-পাঁচ ঘন্টা এই ঘটনাকে চেপে রাখা হল কোন উপায়ে? এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সকালে তিলোত্তমার মা, তাঁর বিশেষ বন্ধু অথবা তাঁর কোনও পেশেন্ট কী তাঁকে ফোন করে ফোন সুইচড অফ বা নো রিপ্লাই পেয়েছে?

কারা জড়িত এর সঙ্গে? এইসব প্রশ্নগুলো উঠে আসা দরকার। রাতের অন্ধকারে বা রাত ও ভোরের সন্ধিক্ষণে সঙ্ঘটিত এই নৃশংস ক্রাইমের পর তাকে সকাল নটা অবধি সাধারণ মানুষের গোচরে আসতে না দেওয়ার জন‍্য প্রফেশনাল ক্রিমিনালদের একটা টিম-ওয়ার্ক লাগে। এই জায়গাটাকেই উন্মোচিত করতে হবে। এবং এটা উন্মোচিত হওয়া শতকরা একশো ভাগ সম্ভব যেখানে ক্রাইমের প্লেস অফ অকারেন্স যাই হোক সেটা একটা সরকারি হাসপাতালের ভিতরে ঘটেছে। অপরাধীদের খুঁজে বের করা একশো শতাংশ সম্ভব যদি হাসপাতাল প্রশাসন পুলিশের প্রশ্রয়ে প্রচুর তথ‍্যপ্রমাণ লোপাট করে থাকে তাও। এমনকি ঘটনার অব‍্যবহিত পরে চেস্ট মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট সংলগ্ন দেওয়াল এবং ওয়াশরুম ভেঙেও অপরাধীদের বাঁচানো সম্ভব নয়।

এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও তো পেতেই হবে। কেন সন্দীপ ঘোষ সাসপেন্ড হওয়ার পরিবর্তে একটা বদলির নির্দেশ পেয়েছিলেন? কেন ক্রাইমের তদন্ত শুরু হয়ে যাওয়ার পর পিডবলুডি সেমিনার হল-সংলগ্ন ঘর ও ওয়াশরুম রেনোভেশনের নামে ভেঙে দিল, যে এলাকাগুলো তদন্তের স্বার্থে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল? কে এই ওয়ার্ক-অর্ডার দিয়েছিল? তাকে কি সিবিআই জেরা করেছে?

আমাদের প্রশাসনিক ব‍্যবস্থায় এই এক অতীব আইভরি টাওয়ার গোপনীয়তা। তদন্তের অগ্রগতির কথা বিন্দুমাত্র জানতে দেওয়া হয় না ভিকটিমের পরিবারকে এবং আমজনতাকে। তিলোত্তমার ধর্ষণ ও খুনের এই অতীব স্পর্শকাতর ঘটনা যা নিয়ে গোটা রাজ‍্য উত্তাল, দেশ উত্তাল, তখন আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে সিবিআই কেন আমজনতার উদ্দেশ‍্যে একটা দৈনন্দিন অগ্রগতির রিপোর্ট পেশ করবে না?

পুলিশের ভূমিকা নিয়েও আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশ অত‍্যন্ত সরব। আরজিকর-কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে এসেছে। ক্রাইম-স্থল ঘিরে ফেলা, যথাযথ নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে গোয়েন্দাদের এভিডেন্স কালেক্ট করতে দেওয়ার প্রশ্নে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সংবাদমাধ‍্যম যারপরনাই সোচ্চার। পুলিশ কমিশনারের পদত‍্যাগের দাবিতে অনড় আন্দোলনরত চিকিৎসকেরা। পুলিশি ব‍্যবস্থা বরাবরই আতসকাচের নিচে থাকে। এক অংশের পুলিশের চরম জনগণবিরোধী আচরণের জন‍্য পুলিশের একনিষ্ঠ, সৎ কর্মীরাও আক্রান্ত হন। পুলিশকে শাসকদলের দাসানুদাস করে রাখবার রীতি এ-দেশে এ-রাজ‍্যে পুলিশকে জনগণবিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এই ব‍্যবস্থার পরিবর্তন চাই পুলিশের চাকরি করা মানুষদের জন‍্যেও।

তিলোত্তমা-পর্বে প্রথমদিকে একজন এডিজি এবং একজন ডিসি অনবরত যে প্রেস কনফারেন্সগুলো করে চলেছিলেন হয়তো সেগুলো তখনকার পরিস্থিতিতে তাঁদেরও মনের কথা ছিল না। অথচ তাঁরা এইসব প্রেস কনফারেন্সে যা বলে চলেছিলেন চরম অসংবেদনশীল এবং নিষ্ঠুরভাবে, তা জনগণ চিরকাল মনে রাখবেন এবং ক্ষমাও করবেন না। অথচ এটা হয়তো নিছকই তাঁদের চাকরি বাঁচানোর দায়। হয়তো ব‍্যবস্থার শিকার তাঁরা।

আরজিকর-কাণ্ডে দিকে দিকে গণ-আন্দোলনে, মিছিলে এই স্লোগান উঠেছে “পুলিশ তুমি চিন্তা করো/তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়।” প্রশ্নটা পুলিশের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে দেওয়া নয়। প্রশ্নটা আমাদের দেশে পুলিশি ব‍্যবস্থা নিয়ে, যেখানে কোনওকালেই শাসকদল তাদের স্বাধীনভাবে জনগণের জন‍্য কাজ করতে দেয়নি। বেশিরভাগ থানায় সাধারণ মানুষ কোনও অভিযোগ জানাতে গেলে তাদেরকে হেনস্থা করা হয়। একটা অদ্ভুত শেডি পরিস্থিতি বিরাজ করে পুলিশ থানাগুলিতে। এও সত‍্যি যে ক্রাইম ওয়ার্ল্ডের অনেক তথ‍্যই থাকে পুলিশের নখদর্পণে। প্রভাবশালী ব‍্যক্তির মোবাইল বা মূল‍্যবান সামগ্রী চুরি গেলে অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো উদ্ধার করে আনে পুলিশ। তাই মহিলাদের রাতদখলের রাতে আরজিকরে যে-হামলা সঙ্ঘটিত হল তার খবর পুলিশের কাছে ছিল না এ-কথা মানতে চাইছেন না আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা।

এই পুলিশি ব‍্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। আন্দোলনরত চিকিৎসকদের এক সভায় বাংলার এক সেলিব্রিটি অভিনেত্রী বলেছেন যে ছেলেবেলা থেকেই অভিভাবকরা ভয় দেখাতে বলতেন “কথা শুনে নাও নইলে ওই দ‍্যাখো পুলিশকাকু আসছে।” মারাত্মক কথা!! অভিনেত্রী তারপর বললেন “ট্রাফিক আটকে নাকা চেকিং হলে আমার ভয় লাগতে থাকে যে পুলিশ আমার গাড়িটাকেই এসে ধরবে।” ভয়াবহ এই বিবৃতির অর্থ এই যে, পুলিশ আর যেখানে যাই করুক পাবলিক ডোমেইনে ভয় দেখায় নিরীহ মানুষদের। পুলিশ নরম ঘাড়ে থাবা বসায় আর প্রকৃত অপরাধীদের কেশাগ্র স্পর্শ করে না।

শাসকদলের পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব‍্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করা নতুন কোনও বিষয় নয়। কিন্তু সিভিক পুলিশ নোমেনক্লেচারে দল এবং পুলিশের একটা টিম তৈরি করা অভিনব পদ্ধতি। এমন এক সিভিক পুলিশই তিলোত্তমা খুন ও ধর্ষণ-কাণ্ডে গ্রেফতার হয় ঘটনার দ্বিতীয় দিনেই।

এ-দেশে নাকি প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি ধর্ষণের কাণ্ড ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণ এবং খুনের কিনারা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। আর মুষ্টিমেয় নির্ভয়ারা বিচার পান জীবদ্দশাতেই অথবা মরণোত্তরভাবে। ধর্ষিতা হন নাবালিকা, দলিত, আদিবাসী। নানা জায়গায় ক্রাইম সঙ্ঘটিত হয়। অধিকাংশই, লোকালয় থেকে দূরে, নির্জন অন্ধকারে, ঝোপঝাড়ে, ধানক্ষেতে। এইসব নৃশংস ঘটনা নিয়ে যতটা প্রতিবাদ আন্দোলন হওয়ার কথা তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় না।

কিন্তু তিলোত্তমার ধর্ষণ ও খুন একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে কর্মরত অবস্থায়। একটি মেয়ে, অতি সাধারণ এক বাড়ি থেকে কষ্ট করেই পড়াশোনা করেছিল। বাবা স্বনির্ভর রোজগারে স্বল্পায়ে সংসার চালিয়ে মেয়েকে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। সে ডাক্তার হয়ে প্র‍্যাকটিস করাও শুরু করেছিল। পাড়ায় আজকের দিনে তুলনামূলকভাবে খুব কম ভিজিটে রোগী দেখছিল। সেইসঙ্গে আবার আরজিকর মেডিকেল কলেজে পোস্ট-গ্র‍্যাজুয়েশন পড়ছিল। আর সেই মেডিকেল কলেজেই কর্মরত অবস্থায় তার এই নির্মম পরিণতি। ঘটনার নৃশংসতার সঙ্গে মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটির ডাক্তার হয়ে ওঠার জীবনকাহিনি; তার মা-বাবার মেয়েকে পড়াশোনা করানোর স্ট্রাগল। সাধারণ মধ‍্যবিত্ত মানুষ অসম্ভব একটা প্রক্সিমিটি অনুভব করেছে এই ধর্ষিতা মেয়েটির সঙ্গে তার মৃত‍্যুর পরেই। প্রক্সিমিটি অনুভব করেছে তিলোত্তমার মা-বাবার সঙ্গেও। সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা এই মা-বাবাকে ইন্টারভিউ করতে করতে অন-ক‍্যামেরা নিজেরাই কান্না চাপতে পারেনি। এই ধর্ষণ ও খুন এইভাবেই অন‍্য ধর্ষণ ও খুনের তুলনায় অন‍্য ক্ষোভের সঞ্চার করেছে জনমানসে। আন্দোলন দিকে দিকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

তিলোত্তমা-কে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে এই জনজাগরণ, এই নাগরিক প্রতিবাদ, নারীশক্তির রাতের পর রাত দখল, নির্ভয়ার সহকর্মী জুনিয়র ডাক্তারদের রাষ্ট্রশক্তির কাছে মাথা নত না-করে মাসাধিককাল ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের, নাট‍্যকর্মী, সঙ্গীতশিল্পী, সাহিত‍্যিক, হাসপাতালের নার্স, কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার, ট‍্যাক্সিচালক, রিকশাচালকদের মিছিল, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহমেডান স্পোর্টিং-এর মতো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল দলগুলির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তায় এবং খেলার মাঠে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ এই দাবিতে ফেটে পড়া নিঃসন্দেহে এক ইতিহাস রচনা করে চলেছে তিলোত্তমা হত‍্যার পরদিন থেকে আজ প্রায় চল্লিশ দিন ধরে। এই জনজাগরণ নারীসুরক্ষার এক বিপ্লবের সন্ধিক্ষণে। আগামী দিনে দিকে দিকে সমস্ত নারীনিগ্রহ, ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে জাগরিত হোক গোটা সমাজ— নারীদের সম্ভ্রম, মর্যাদা সুরক্ষিত হোক চিরতরে। তিলোত্তমাকে ঘিরে এই অভূতপূর্ব বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ এ-যাবৎ বিচার না-পাওয়া সকল ‘নির্ভয়া’দের (কামদুনি, উন্নাও, হাথরাস-সহ) বিচার দিক।

আরজিকর মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ‍্যক্ষ‍ সন্দীপ ঘোষ দীর্ঘ দুই সপ্তাহ সিবিআইয়ের জেরার পর গ্রেফতার হন। এই গ্রেফতারির অব‍্যবহিত পর গ্রেফতার হয়েছে আরও তিনজন। এই গ্রেফতারি নিয়ে আন্দোলনকারীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ খুশি, কারও মনে সংশয়। সন্দীপকে গ্রেফতার করা হয়েছিল আরজিকরে চলে আসা সীমাহীন দুর্নীতির কারণে। কারও কারও প্রশ্ন জেগেছিল এই গ্রেফতারিতে কি তিলোত্তমার সুবিচার হবে? কিন্তু একটা প্রশ্ন তো ছিলই। এই দুর্নীতির সঙ্গেই কি জড়িয়ে নেই তিলোত্তমাকে নৃশংস ধর্ষণ এবং হত‍্যা? খুনি কারা? সুপারি কিলার? সন্দীপ-ঘনিষ্ঠ বাউন্সার, সিভিক পুলিশ এমনকি শাসকদল-ঘনিষ্ঠ ডাক্তাররাও? খুনের সঙ্গে ধর্ষণ এক কৌশল এবং  দুর্নীতিই এই হত‍্যার অন‍্যতম কারণ নয়? তিলোত্তমা দুর্নীতির কোনও বড় স্ক‍্যাম জেনে ফেলেছিল কিনা সেটা বড় প্রশ্ন।

ক্রাইমের আসল মোটিভ নিশ্চয়ই তাহলে দুর্নীতিকে ঢাকা। আর ধর্ষণ সেখানে গৌণ। যে সুপারি-দের নিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের মূল কাজ সম্পাদনের আগে একটা যুবতীর শরীর হাতে পেয়ে পৈশাচিক শারীরিক প্রবৃত্তিও চরিতার্থ করে নেওয়াটা নেহাতই অনিবার্যতা? এই ধারণাগুলোর যদি কোনও সারবত্তা থাকে তাহলে সন্দীপ ঘোষ গ্রেফতার হওয়ার প্রথম কারণ দুর্নীতি হলেও তিলোত্তমাকে ধর্ষণ এবং হত‍্যার অভিযোগে তার গ্রেফতার হওয়াটা সময়ের অপেক্ষা ছিল।

নির্যাতিতার মাও এই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন যে মেয়ে কলেজ নিয়ে খুব ভয়ে থাকত। বলত চেস্ট-মেডিসিন বিভাগে তাকে খুব চাপে থাকতে হত। বাবা-মা যেন আত্মীয় বা পরিচিত কাউকে মেয়ের রেফারেন্স-এ আরজিকরে না পাঠান কারণ তাহলে তাঁদের মেয়ের সঙ্গে হাসপাতালে আরও দুর্ব‍্যবহার করা হতে পারে। অর্থাৎ একটা আতঙ্কের আবহে তিলোত্তমাকে কলেজে পিজি ক্লাস ও ডাক্তারি করতে হত। এমন চর্চাও সংবাদমাধ‍্যমে উঠে এসেছে যে হয়তো দুর্নীতিচক্রের অনেক কিছু তিলোত্তমা দেখে ফেলেছিলেন বা তা নিয়ে তিলোত্তমা প্রতিবাদী হয়েছিলেন।

থ্রেট কালচার বলে একটা শব্দবন্ধ তৈরি হয়েছে। এটা অতি দুর্ভাগ্যজনক যে ভয়, সন্ত্রাস কাটিয়ে অনেক চেতনার উন্মেষ আমাদের মধ‍্যে হল এই মেয়েটির মর্মান্তিক পরিণতির বিনিময়ে। এই থ্রেট কালচার শুধু আরজিকরে নয়, আজ দশ বছর ধরে রাজ‍্যের সব মেডিকেল কলেজে, সব ডিগ্রি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান। আরজিকর-কাণ্ডের বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সারা রাজ‍্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে চলে আসা থ্রেট কালচারের অবসান। কমবেশি প্রত‍্যেকটি স্কুল-কলেজ বিগত বারো বছর ধরে বাহুবলী আর ঠিকাদারদের অঙ্গুলিহেলনে চলে আসছে। আরজিকরের অধ‍্যক্ষের মতো চরিত্র (বর্তমানে গ্রেফতার) পশ্চিমবঙ্গের আনাচেকানাচে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাস চালিয়েছে, যথেচ্ছ দুর্নীতি করেছে শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে টিম বানিয়ে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপুল অঙ্কের টাকা বছরের পর বছর ধরে লুঠ হয়েছে। শাসকদলের ছাত্রনেতাদের উদ্ধত, দুর্বিনীত আচরণে পদ পদে লাঞ্ছিত, সন্ত্রস্ত হয়েছেন শিক্ষক ও শিক্ষয়িত্রীরা। পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার হলে গণটোকাটুকি চলে এসেছে বহু প্রতিষ্ঠানে। বিকাশ ভবনে স্কুল ও উচ্চশিক্ষা দফতরের আমলা ও করণিকরা শিক্ষকদের ধমকিয়েছেন, ভৃত‍্যের মতো আচরণ করেছেন।

শাসকদল-বিরোধী যে-কোনও শিক্ষক সংগঠনের মিটিং মিছিল প্রতিবাদ রুদ্ধ করা হয়েছে। বিরোধী শিক্ষক সংগঠনের অনুগামীদের স্কুল-কলেজগুলোতে যথেচ্ছ অপমান, হুমকি দেওয়া এমনকি শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে মহিলা অধ‍্যাপকদেরও। যে নির্যাতন তাদের সঙ্গে এবং বড় অংশের শিক্ষাকর্মীদের সঙ্গে করা হয়েছে তা অবর্ণনীয়।

একদিকে এই সন্ত্রাসের বাতাবরণ যা শাসকদলের ছাত্র সংগঠনকে সামনে রেখে তৈরি করা হয়েছে, আর অন‍্যদিকে টাকা লুঠ হয়েছে, চাকরি বিক্রি হয়েছে যোগ‍্য প্রার্থীদের বঞ্চনা করে। কোটি কোটি টাকার কারবার চলবার পর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জেলে গেছে। কিন্তু দুর্নীতি থামেনি। চাকরি, বদলি সবের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। শিক্ষাজগতের মাধ‍্যমেই এই দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের প্রতিটা দফতরের দুর্বৃত্তায়ন করা হয়েছে। সিন্ডিকেট-রাজ কায়েম করা হয়েছে।

এক দশকেরও বেশি সময় এই হুমকির শাসন চলেছে এই রাজ‍্যে। বাহুবলীদের দখলে চলে গেছে এই রাজ‍্য। যারা অন্ধকারের জীব, সমাজবিরোধী; মেইনস্ট্রিম সমাজ যাদের থেকে চিরকাল ভয়ে থেকেছে, দূরে থেকেছে; তারাই সমাজের মূলস্রোত হয়ে উঠেছে বিগত এক দশকে।

এই একটি ঘটনা, আরজিকরের ঘটনা, এক লহমায় পুরনো বাংলাকে, প্রতিবাদী বাংলাকে ফিরিয়ে এনেছে। এখন আবার বাংলা জুড়ে বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে।

তিলোত্তমা নিজে আর কোনওদিনই বিচার পাবে না। কোনওদিন বিচার পেয়ে বাকি একটা জীবনযাপন করতে পারবে না। বিচার পেতে হবে তার মা-বাবা, তার যার সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন ছিল সেই বন্ধুকে, বিচার পেতে হবে তিলোত্তমার আত্মীয়পরিজন, প্রতিবেশী, সহকর্মী, স্কুলকলেজের সহপাঠী, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী-সহ কোটি কোটি প্রতিবাদী জনগণকে যারা এই নৃশংস ঘটনার পরদিন থেকে আজও পথে আছেন বিচারের দাবিতে।

আমাদের সমাজে ধর্ষিতা নারীকেও কলঙ্কিত করা হত। সমাজে সে পরিত‍্যক্তা হত। আর তাই ধর্ষিতা নারী যাতে মূলস্রোতে ফিরে এসে আবার সামাজিক জীবনে ঠাঁই পেতে পারে সেই কারণেই হয়তো ধর্ষিতার নাম গোপন করে তাকে ‘অভয়া’, ‘নির্ভয়া’, ‘তিলোত্তমা’ নামে অভিহিত করা হয়। ধর্ষিতার নাম গোপনের আর একটা উদ্দেশ‍্য নিশ্চয়ই এটাই যাতে সে আবার ধর্ষকের নিশানা না হয়।

কিন্তু যে নারী ধর্ষিতা হয়ে খুনও হয়েছেন তার আর সমাজের কোন রক্ষণশীলতাকে ভয়? তার বাবা-মায়ের দেওয়া আদরের নামটিকে মুছে দেওয়া কেন? তাকে তো আর ধর্ষিতা হওয়ার ‘কলঙ্ক’ গোপন করে আমাদের ঘুণধরা সমাজে ‘গ্রহণযোগ্য’ হতে হবে না!!

আমরা জানি না তিলোত্তমা হত‍্যার সঠিক বিচার আসবে কিনা। আমরা জানি না সঠিক অপরাধীই দোষী সাব‍্যস্ত হবে কিনা। আমরা জানি না বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরেও প্রকৃত অপরাধীরা আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াবে কিনা। আমরা জানি না তিলোত্তমাকে ধর্ষণ ও খুনের অপরাধীদের মতো এমন আরও কত তিলোত্তমাদের খুন করা অপরাধীরাও গত একমাস ধরে প্রতিবাদীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে মিছিলে প্রতিবাদে গলার শিরা ফুলিয়ে জাস্টিস চেয়েছে কিনা।

আমাদের বিচারপ্রক্রিয়াটাই বড় দীর্ঘসূত্রী। অনেক সময় লাগে আদালতের রায় পেতে। বিচারের দাবিটাই নিস্তেজ হয়ে আসে অনেক সময়। সুপ্রিম কোর্টের ৯ সেপ্টেম্বরের শুনানি ঘিরে জনমানসে অনেক প্রত‍্যাশা ছিল, শুনানি-শেষে যা এক হতাশার সঞ্চার করেছে। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। কিন্তু আমার মতো অনেকেই বিচারব‍্যবস্থার এই বিষয়টি বুঝতেই পারিনি যে সর্বোচ্চ আদালত এইমুহূর্তে শুধু এটুকুই দেখবে যে, সিবিআই তার তদন্তপ্রক্রিয়া যেন নিরুপদ্রবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

রাজপথ জুড়ে বিচারের দাবিতে আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছে। আকাশে চোখ মেললেই ‘ক্ষান্তবর্ষণ’ শরতের পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো নেশা ধরানো মেঘ, শহর ছাড়িয়ে কোথাও গেলেই কাশফুল আর শারদোৎসবের হাতছানি, আর সকালে ঘুম ভেঙে বারান্দায় গেলেই পুজো-পুজো রোদ্দুর। মাননীয়া বলেছেন অনেক তো হল, একমাস পেরিয়েছে, “এইবার উৎসবে ফিরুন”। তবে এইবার মানুষ এখনও পর্যন্ত এতটুকু দমেনি। বাঙালির নিজের সম্বিত হারিয়ে ফেলা আনন্দের উৎসব দুর্গাপুজো এগিয়ে আসছে দিনদিন। কিন্তু টেলিভিশনে কোনও বাণিজ‍্য সংস্থাও পুজোর ট‍্যাগলাইন দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারছে না বিবেকের তাড়নায়। প্রতিদিনের কাউন্টডাউনে সারাদিন ধরে বলাও হচ্ছে না যে পুজোর আর মাত্র চল্লিশ-ঊনচল্লিশ-আটত্রিশ দিন। এমন নিষ্প্রাণ, নিরানন্দ আগমনী আগে কখনও দেখিনি।

বিচার শুধু তিলোত্তমার ধর্ষণ ও খুনের অপরাধীদের নয়, বিচার চাই সেইসব সরকারি ব‍্যক্তিদের, সেই সরকারের যারা এই অপরাধীদের লালন করেছে, অবাধে সন্ত্রাস করার, হুমকি সংস্কৃতি কায়েম করবার লাইসেন্স দিয়েছে। তাদের চরম শাস্তিও এই জাস্টিসের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিচার চাই সেই অপরাধীদেরও যাদের প্রশ্রয়ে চাকরি চুরি হয়েছে শিক্ষকদের, সরকারি চাকরিতে বদলির আবেদন মঞ্জুর হয়েছে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিতে। যাদের প্রশ্রয়ে অধ‍্যক্ষ‍ ও কতিপয় শিক্ষক তিলোত্তমাকে দিনের পর দিন মানসিক নির্যাতন করে গেছে, তার গোল্ড মেডেল পাওয়ার স্বপ্ন চূর্ণ করে। পরীক্ষায় কৃতকার্য না হতে দেওয়ার হুমকি দিয়ে। তাকে নির্যাতন করে টানা ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটি অ্যালট করে। এই নৃশংসতা গত বারো-তেরো বছর শুধু মেডিকেল কলেজগুলোতে নয়, বাংলার দিকে দিকে স্কুল ও কলেজগুলোতে চলে আসছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষক, অধ‍্যক্ষরাও দিকে দিকে এই পাপের অংশীদার, চাপে পড়ে অথবা স্ব-ইচ্ছায়। শিক্ষাব‍্যবস্থার এই অবক্ষয় এই বিপর্যয় অভূতপূর্ব। তিলোত্তমা খুনের সময় অকুস্থলে থাকা অপরাধীদের সঙ্গে তাদের স্রষ্টা, পৃষ্ঠপোষক তথা প্রশাসনিক বেনিফিসিয়ারিদেরও চরম শাস্তি না হলে তিলোত্তমা খুনের বিচার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।


*মতামত ব্যক্তিগত