Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্যারিস প্যারালিম্পিক ২০২৪ ও ভারত

দেবাশিস সেনগুপ্ত

 


ভারতীয় প্যারা-অ্যাথলিটরা প্যারিস প্যারালিম্পিকে সবচেয়ে বেশি ১৭টি পদক জিতে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। যার মধ্যে আছে ৪টি সোনা, ৬টি রুপো ও ৭টি ব্রোঞ্জ পদক। ইতিহাসে প্রথমবার ভারত ট্র্যাক ইভেন্টে পদক জিতেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ১৯৬৮ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ১১টি প্যারালিম্পিকে ভারত ৪টি সোনা, ৪টি রুপো ও ৪টি ব্রোঞ্জ, মোট ১২টি পদক জেতে। আর ২০২০ ও ২০২৪, এই ২টি প্যারালিম্পিক মিলিয়ে ভারত মোট পদক জেতে ৪৮টি, যার মধ্যে আছে ১২টি সোনা, ১৭টি রুপো আর ১৯টি ব্রোঞ্জ। এই সংখ্যাটা থেকেই বোঝা যায় প্যারালিম্পিক গেমসে গত ৮ বছরে ভারত কতটা উন্নতি করেছে

 

মানসিক প্রতিবন্ধকতা-সম্পন্ন মানুষ আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা-সম্পন্ন মানুষদের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য থাকে। মানসিক প্রতিবন্ধকতা-সম্পন্ন মানুষরা তাঁদের চেনা ভুল বোঝা স্টান্সের বাইরে বেরিয়ে সহজে তাদের মানসিক প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পারেন না বা বেরোতে খুবই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। উল্টোদিকে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা-সম্পন্ন মানুষরা আপ্রাণ চেষ্টা করেন তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে স্বাভাবিকতায় ফিরতে। প্যারালিম্পিক গেমসের দিকে তাকালে আগের লাইনটার অর্থ বুঝতে সুবিধা হয়।

আর এই প্যারালিম্পিক গেমসের দিকে তাকাতে গেলে আমাদের ফিরতে হয় ২৯ জুলাই ১৯৪৮ তারিখটার দিকে। ২৯ জুলাই ১৯৪৮ ছিল লন্ডন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন। সেদিন সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) চলাকালীন আহত হওয়া ১৬ জন সেনা ও সেনানী হুইলচেয়ার-ক্রীড়াবিদদের জন্য সর্বপ্রথম কোনও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় (তিরন্দাজি) অংশ নিয়েছিলেন। হুইলচেয়ার-ক্রীড়াবিদদের জন্য সেই প্রতিযোগিতার আয়োজকের নাম ছিল ডাঃ লুডভিগ গুটম্যান। ডাঃ গুটম্যান এই প্রতিযোগিতার নাম দিয়েছিলেন স্টোক ম্যান্ডেভিল গেমস।

এই স্টোক ম্যান্ডেভিল গেমস ছিল প্যারালিম্পিকের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। স্টোক ম্যান্ডেভিল গেমস পরবর্তীতে প্যারালিম্পিক গেমসে পরিণত হয় যা ১৯৬০ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ইতালির রোমে। সেখানে ২৩টি দেশের প্রায় ৪০০ জন ক্রীড়াবিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারপর থেকে প্রতি চার বছর অন্তর এই  প্যারালিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হত।

১৯৭৬ সালে প্যারালিম্পিকের ইতিহাসে সর্বপ্রথম শীতকালীন গেমগুলি সুইডেনে অনুষ্ঠিত হয় এবং গ্রীষ্মকালীন গেমসের মতোই প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হতে থাকে এবং তাতে প্যারালিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং সমাপ্তি অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিওলের গ্রীষ্মকালীন গেমস এবং ১৯৯২ সালে ফ্রান্সের অ্যালবার্টভিলে শীতকালীন গেমসের পর থেকে ১৯৮৯-এ গঠিত আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক কমিটি (আইপিসি) এবং ১৮৯৪-তে গঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)-র মধ্যে একটি চুক্তির কারণে অলিম্পিকের মতো প্যারালিম্পিকও একই শহর এবং ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

 

ভারতের ১ম ও ২য় বার অংশগ্রহণ ১৯৬৮-১৯৭২

ভারত প্রথমবারের জন্য প্যারালিম্পিকে অংশ নিয়েছিল ১৯৬৮ সালে (৪-১৩ নভেম্বর), ইজরায়েলের তেল আভিভে। সেবার ভারতের প্রতিনিধিদলে ছিলেন ১০ জন ক্রীড়াবিদ (৮ জন পুরুষ আর ২ জন মহিলা) যাঁরা কোনও পদক পাননি। ১৯৭২ সালের প্যারালিম্পিকে পশ্চিম জার্মানির হাইডেলবার্গে ১০ জন ক্রীড়াবিদের প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে (৮ জন পুরুষ আর ২ জন মহিলা) ভারতের ঘরে প্রথম প্যারালিম্পিক পদক এসেছিল মুরলীকান্ত পেটকারের দক্ষতায়। ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে তিনি সোনার পদক জিতেছিলেন। কবির খানের পরিচালনায় মুরলীকান্ত পেটকারের হিন্দি ভাষার বায়োপিক (১৪ জুন ২০২৪ তারিখে মুক্তি পাওয়া ‘চন্দু চ্যাম্পিয়ন’) বড় পর্দায় আমরা দেখেছি, যেখানে মুরলীকান্ত পেটকারের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন কার্তিক আরিয়ান। ১৯৭২-এর সফলতার জন্য মুরলীকান্ত পেটকার ২০১৮ সালের ২০ মার্চ পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছিলেন।

 

ভারতের ৩য় থেকে ৭ম বার অংশগ্রহণ ১৯৮৪-২০০০

এর পরে ১৯৮৪-তে লন্ডন ও নিউইয়র্কের প্যারালিম্পিকে অংশ নিয়েছিল ভারত এবং ৫ জন ক্রীড়াবিদ পাঠিয়ে ২টি রুপো (জ্যাভেলিনে ভীমরাও কেসরকার ও শটপাটে যোগিন্দার সিং বেদি) এবং ২টি ব্রোঞ্জ (জ্যাভেলিন ও ডিসকাসে যোগিন্দার সিং বেদি), মোট ৪টি পদক পেয়েছিল। তার মধ্যে ৩টিই পেয়েছিলেন যোগিন্দার সিং বেদি। ১৯৮৮-তে সিওল প্যারালিম্পিকে ২ জন ক্রীড়াবিদের ভারত ছিল পদকহীন। ১৯৯২-এ বার্সিলোনা প্যারালিম্পিকেও পদকহীন ছিল ভারত, ৯ জন ক্রীড়াবিদের দল পাঠিয়েও। এর পরে ১৯৯৪-এ গঠিত হয়েছিল প্যারালিম্পিক কমিটি অফ ইন্ডিয়া (পিসিআই)। পিসিআই গঠনের পরে ১৯৯৬-এর আটলান্টা প্যারালিম্পিকেও ৯ জন পুরুষ ক্রীড়াবিদের দল পাঠিয়ে ভারত ছিল পদকহীন। ২০০০-এর সিডনি প্যারালিম্পিকেও ভারত ছিল পদকহীন, এবারে অংশ নিয়েছিলেন ৪ জন ক্রীড়াবিদ।

 

ভারতের ৮ম থেকে ১১শ বার অংশগ্রহণ ২০০৪-২০১৬

২০০৪-এ এথেন্স প্যারালিম্পিকে ১২ জন ক্রীড়াবিদের প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে (১১ জন পুরুষ আর ১ জন মহিলা) ভারত ১টি করে সোনা (এফ ৪৬ জ্যাভেলিনে দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া) ও ব্রোঞ্জ পদক (রাজিন্দার সিং রাহেলু পাওয়ার লিফটিংয়ে) পেয়েছিল। ২০০৮-এর বেজিং প্যারালিম্পিকে ৫ জন অ্যাথলিটের ভারত কোনও পদক পায়নি। ২০১২-র লন্ডন প্যারালিম্পিকে ১টি রুপো পেয়েছিল ভারত (এফ ৪২ হাইজাম্পে গিরিশ নাগরাজগৌড়া)। ২০১৬-র রিও প্যারালিম্পিকে ৪টি পদক পেয়েছিল ভারত, যার মধ্যে ছিল ২টি সোনা (এফ ৪২ হাইজাম্পে মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু এবং এফ ৪৬ জ্যাভেলিনে দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া) ও ১টি করে রুপো (এফ ৫৩ শটপাটে দীপা মালিক) আর ব্রোঞ্জ (এফ ৪২ হাইজাম্পে বরুণ সিং ভাটি)।

 

ভারতের ১২শ বার অংশগ্রহণ ২০২০

২৫ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত আয়োজিত টোকিও প্যারালিম্পিকে ভারত ৫টি সোনা, ৮টি রুপো ও ৬টি ব্রোঞ্জ, অর্থাৎ মোট ১৯টি পদক জিতেছিল। ভারতীয় ট্র্যাক এবং ফিল্ড অ্যাথলিটরা ৮টি পদক জয় করেছিলেন। এছাড়া তিরন্দাজি, ব্যাডমিন্টন, শ্যুটিং ও টেবল টেনিসে ভারত পেয়েছিল যথাক্রমে ১, ৪, ৫ ও ১টি পদক। ২০২০-র টোকিও প্যারালিম্পিকে ৫৪ জন প্রতিযোগীর দল পাঠিয়ে ভারত মোট ১৯টি পদক পেয়েছিল, যার তালিকাটি ছিল এইরকম:

ভাবিনা প্যাটেল – রুপো – মহিলাদের একক টেবিলটেনিস ক্লাস-৪
নিষাদ কুমার – রুপো – পুরুষদের হাইজাম্প টি-৪৭
অবনী লেখারা – সোনা – মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেল শুটিং স্ট্যান্ডিং এসএইচ-১
দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া – রুপো – পুরুষদের জ্যাভলিন নিক্ষেপ এফ-৪৬
সুন্দর সিং গুর্জার – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের জ্যাভলিন নিক্ষেপ এফ-৪৬
যোগেশ কাঠুনিয়া – রুপো – পুরুষদের ডিসকাস থ্রো এফ-৫৬
সুমিত আন্তিল – সোনা – পুরুষদের জ্যাভলিন থ্রো এফ-৬৪
সিংরাজ আধান – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের ১০ মিটার এয়ারপিস্তল শুটিং এসএইচ-১
মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু – রুপো – পুরুষদের হাইজাম্প টি-৪২
শরদ কুমার – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের হাইজাম্প টি-৪২
প্রবীণ কুমার – রুপো – পুরুষদের হাইজাম্প টি-৬৪
অবনী লেখারা – ব্রোঞ্জ – মহিলাদের ৫০ মিটার রাইফেল ৩ পজিশন শুটিং এসএইচ-১
হরবিন্দর সিং – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের ব্যক্তিগত রিকার্ভ ওপেন তিরন্দাজি
মণীশ নারওয়াল – সোনা – পুরুষদের ৫০ মিটার পিস্তল এসএইচ-১
সিংরাজ আধানা – রুপো – পুরুষদের ৫০ মিটার পিস্তল এসএইচ-১
প্রমোদ ভগত – সোনা – পুরুষদের একক ব্যাডমিন্টন এসএল-৩
মনোজ সরকার – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের একক ব্যাডমিন্টন এসএল-৩
সুহাস ইয়াথিরাজ – রুপো – পুরুষদের একক ব্যাডমিন্টন এসএল-৪
কৃষ্ণ নগর – সোনা – পুরুষদের একক ব্যাডমিন্টন এসএইচ-৬

 

ভারতের ১৩শ বার অংশগ্রহণ ২০২৪

২৮ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত আয়োজিত প্যারিস প্যারালিম্পিকে ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে এ-বছর সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা। পদক জয়ের নিরিখে তারা ছাপিয়ে গেছেন ২০২০ টোকিও প্যারালিম্পিকের রেকর্ডকে। এবারের প্রতিযোগিতার শেষে ভারতের মোট পদক সংখ্যা ২৯, ২০২০ সালে যা ছিল ১৯। এই ২৯টি পদকের মধ্যে রয়েছে ৭টি সোনা, ৯টি রুপো এবং ১৩টি ব্রোঞ্জ৷ টোকিওতে ভারত ৫টি সোনা, ৮টি রুপো ও ৬টি ব্রোঞ্জ পদক জয় করেছিল। প্যারিসে ভারতীয় ট্র্যাক এবং ফিল্ড তারকাদের পারফরম্যান্স নজর কেড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অনেক নতুন রেকর্ড। অনেক বিভাগে প্রথমবার পদক জয় করে নজির সৃষ্টি করেছেন ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা। এ-বছর প্যারালিম্পিক নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। আশা করা যেতেই পারে যে আগামী প্যারালিম্পিকে ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা আরও ভাল প্রদর্শন করবেন এবং আরও বেশি মেডেল জিতে নেবেন।

২০২৪-এ প্যারিস প্যারালিম্পিকে ভারতের বিস্তারিত পদকতালিকাটি এইরকম:

অবনী লাখেরা – সোনা – মহিলাদের ১০ মিটার এয়াররাইফেল স্ট্যান্ডিং এসএইচ-১
নীতেশ কুমার – সোনা – ব্যাডমিন্টন পুরুষদের একক এসএল-৩ ক্লাস
সুমিত আন্তিল – সোনা – জ্যাভলিন থ্রো এফ-৬৪
হরবিন্দর সিং – সোনা –পুরুষদের ব্যক্তিগত রিকার্ভ ওপেন তিরন্দাজি
ধরমবীর – সোনা – পুরুষদের ক্লাব এফ-৫১ ক্লাস থ্রো
প্রবীণ কুমার – সোনা – পুরুষদের হাইজাম্প টি-৬৪
নভদীপ সিং – সোনা – পুরুষদের জ্যাভলিন থ্রো এফ-৪১
মনীশ নারওয়াল – রুপো – পুরুষদের ১০ মিটার এয়ারপিস্তল এসএইচ-১
নিষাদ কুমার – রুপো – পুরুষদের হাইজাম্প টি-৪৭
যোগেশ কাঠুনিয়া – রুপো – পুরুষদের ডিসকাস থ্রো এফ-৫৬
থুলসিমাথি মুরুগেশন – রুপো –  ব্যাডমিন্টন মহিলাদের একক এসইউ-৫
সুহাস ইয়াথিরাজ – রুপো – ব্যাডমিন্টন পুরুষদের একক এসএল-৪
শরদ কুমার – রুপো – পুরুষদের হাইজাম্প টি-৬৩
অজিত সিং – রুপো – পুরুষদের জ্যাভলিন থ্রো এফ-৪৬
শচীন খিলারি – রুপো – পুরুষদের শটপাট এফ-৪৬
প্রণব সুরমা – রুপো – পুরুষদের ক্লাব এফ-৫১ ক্লাস থ্রো
মোনা আগরওয়াল – ব্রোঞ্জ – মহিলাদের ১০ মিটার এয়াররাইফেল স্ট্যান্ডিং এসএইচ-১
প্রীতি পাল – ব্রোঞ্জ – মহিলাদের ১০০ মিটার টি-৩৫
রুবিনা ফ্রান্সিস – ব্রোঞ্জ – মহিলাদের ১০ মিটার এয়ারপিস্তল এসএইচ-১
প্রীতি পাল – ব্রোঞ্জ – মহিলাদের ২০০ মিটার টি-৩৫
মনীষা রামদাস – ব্রোঞ্জ – ব্যাডমিন্টন মহিলাদের একক এসইউ-৫
রাকেশ কুমার/শীতল দেবী – ব্রোঞ্জ – মিশ্র দল কম্পাউন্ড ওপেন তিরন্দাজি
নিত্যাশ্রী শিবন – ব্রোঞ্জ – ব্যাডমিন্টন মহিলাদের একক এসএইচ-১৬
দীপ্তি জীবনজী – ব্রোঞ্জ – মহিলাদের ৪০০ মিটার টি-২০
মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের হাইজাম্প টি-৬৩
সুন্দর সিং গুর্জার – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের জ্যাভলিন নিক্ষেপ এফ-৪৬
কপিল পারমার – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের জুডো ৬০ কেজি জে-১
হোকাতো হোতোঝে সেমা – ব্রোঞ্জ – পুরুষদের শটপাট এফ-৫৭
সিমরান – ব্রোঞ্জ – মহিলাদের ২০০ মিটার টি-১২

ভারতীয় প্যারা অ্যাথলিটরা প্যারিস প্যারালিম্পিকে সবচেয়ে বেশি ১৭টি পদক জিতে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। যার মধ্যে আছে ৪টি সোনা, ৬টি রুপো ও ৭টি ব্রোঞ্জ পদক। ইতিহাসে প্রথমবার ভারত ট্র্যাক ইভেন্টে পদক জিতেছে। এই বিভাগে ভারতের হয়ে জোড়া ব্রোঞ্জ পদক জেতেন প্রীতি পাল। মহিলাদের টি-৩৫ বিভাগে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ব্রোঞ্জ পদক জেতেন তিনি, ফাইনালে দৌড় শেষ করেছিলেন মাত্র ১৪.২১ সেকেন্ডে। প্যারালিম্পিকের স্প্রিন্টে এটাই ভারতের প্রথম পদকপ্রাপ্তি। এছাড়া ২০০ মিটার দৌড়েও ব্রোঞ্জ পদক পান তিনি, দৌড় শেষ করেছিলেন ৩০.০১ সেকেন্ডে। অন্যদিকে, জ্যাভলিনের পুরুষদের এফ-৬৪ ইভেন্টে সুমিত আন্তিল ও এফ-৪১ ইভেন্টে নভদীপ সিং সোনার পদক জয় করেন। ব্যাডমিন্টন ও শ্যুটিং বিভাগে পদক এসেছে যথাক্রমে ৫টি এবং ৪টি। ২টি পদক এসেছে তিরন্দাজিতে, যার মধ্যে ১টি সোনাও আছে। এবার ব্রোঞ্জ এসেছে জুডোতেও। অবনী লেখারার সোনা জয় দিয়ে ভারতের পদক পাওয়া শুরু হয়েছিল আর নভদীপ সিংয়ের সোনা জয় দিয়ে শেষ হয়েছিল এবারের পদক জয়ের সফর। নভদীপ সিং পুরুষদের জ্যাভেলিন থ্রো এফ-৪১ ইভেন্টে ৪৭.৩২ মিটার দূরে বর্শা ছুড়ে রুপোর দাবিদার হন। সোনার দাবিদার ছিলেন ইরানের সাদেঘ বেইত সায়াহ। চূড়ান্ত থ্রো-তে ৪৭.৬৪ মিটার দূরত্বে বর্শা ছুড়ে সাদেঘ বারবার একটি আপত্তিকর পতাকা দেখাতে থাকেন। প্যারালিম্পিকের নিয়ম অনুযায়ী তিনি বাতিল হয়ে যান। ফলে নভদীপ সিংয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয় সোনার পদক। ২০২০-এর টোকিও প্যারালিম্পিকে নভদীপ চতুর্থ হয়েছিলেন।

পদক সংখ্যার বিচারে ভারত এবারে ছিল ১৮ নম্বর স্থানে। প্রথম স্থানে থাকা চিন ৯৪টি সোনা, ৭৬টি রুপো ও ৫০টি ব্রোঞ্জ-সহ মোট ২২০টি পদক লাভ করেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা গ্রেট ব্রিটেন ৪৯টি সোনা, ৪৪টি রুপো ও ৩১টি ব্রোঞ্জ-সহ মোট ১২৪টি পদক লাভ করেছে। তৃতীয় স্থানে থাকা আমেরিকা ৩৬টি সোনা, ৪২টি রুপো ও ২৭টি ব্রোঞ্জ-সহ মোট ১০৫টি পদক জয় করেছে। প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে বাকি দেশগুলি হল নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিল, ইতালি, ইউক্রেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি, কানাডা, উজবেকিস্তান, ইরান, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, স্পেন, ভারত, কলম্বিয়া এবং বেলজিয়াম। আয়োজক দেশ ফ্রান্স শেষ করেছে অষ্টম স্থানে (১৯টি সোনা, ২৮টি রুপো ও ২৮টি ব্রোঞ্জ-সহ মোট ৭৫টি পদক)। ভারতের পিছনে ছিল কলম্বিয়া, বেলজিয়াম, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, আর্জেন্তিনার মতো দেশও। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শ্রীলঙ্কা শেষ করেছে ৭৫তম স্থানে (১টি রুপো) ও পাকিস্তান শেষ করেছে সবার শেষে অর্থাৎ ৭৯তম স্থানে (১টি ব্রোঞ্জ)। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে বর্ণাঢ্য সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ও পতাকা বহন করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিরন্দাজিতে সোনার পদকজয়ী হরবিন্দার সিং ও স্প্রিন্টে জোড়া পদকজয়ী প্রীতি পাল। সমাপ্তি অনুষ্ঠানে নাচে, গানে মঞ্চ মাতান তারকারা।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ১৯৬৮ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ১১টি প্যারালিম্পিকে ভারত ৪টি সোনা, ৪টি রুপো ও ৪টি ব্রোঞ্জ, মোট ১২টি পদক জেতে। আর ২০২০ ও ২০২৪, এই ২টি প্যারালিম্পিক মিলিয়ে ভারত মোট পদক জেতে ৪৮টি, যার মধ্যে আছে ১২টি সোনা, ১৭টি রুপো আর ১৯টি ব্রোঞ্জ। এই সংখ্যাটাই কিন্তু প্যারালিম্পিকে ভারতের পদকসংখ্যা ও পদকতালিকায় স্থান, এই দুই-ই সাফল্যের ছবিটা তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। এতেই বোঝা যায় প্যারালিম্পিক গেমসে গত ৮ বছরে ভারত কতটা উন্নতি করেছে। সব মিলিয়ে আজ অবধি ১৩টি প্যারালিম্পিকে অংশ নিয়ে ভারত জিতেছে মোট ৬০টি পদক, যার মধ্যে আছে ১৬টি সোনা, ২১টি রুপো ও ২৩টি ব্রোঞ্জ।

সবমিলিয়ে ২০২৪ প্যারিস প্যারালিম্পিকে ভারতের ইতিহাস সৃষ্টির ফলে আরও অনেকে ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরেও অন্যান্য খেলার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবেন বলে আশাবাদী ক্রীড়াবিদরা। তাই এ-লেখার শেষে আবার নতমস্তকে ফিরে যাচ্ছি প্রথম পরিচ্ছদে। ভারতের প্যারালিম্পিয়ানরা যেভাবে নিজেদের সেরাটা দেশের জন্য দিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। তাদের সবাইকে এ-জন্য অকুণ্ঠ কুর্নিশ জানাই।