অতনু দে
কেউ মিছিলে হাঁটছে, কেউ গান গাইছে, কেউ চুপ করে তাকিয়ে আছে জাতীয় পতাকার দিকে। লক্ষ লক্ষ লোক প্রশ্ন করছে প্রশাসনকে— পুলিশ তোমার কীসের ভয়, ধর্ষক তোমার কে হয়? শুধু তো সে রাত নয়। বিচারের সময় যত দীর্ঘ হচ্ছে রাজপথে আছড়ে পড়ছে মানুষ। লাঠি নেই, ইট পাথর ছোড়া নেই। মানুষ আসছে রাস্তায় বসছে, মানববন্ধন গড়ছে, গাইছে, মোমবাতি জ্বালছে আর প্রশ্ন করছে প্রশাসনকে। পুলিশমন্ত্রীর নির্দেশে শিরদাঁড়াহীন ঘুণে খাওয়া এক প্রশাসনকে। তারপরেও যদি এ গণঅভুত্থান না হয় তাহলে তা নয়। কিন্তু দিনবদল তো অবশ্যই
ইতিহাস। প্রচণ্ড অপছন্দের বিষয়। গাদা গাদা দিন-তারিখ মুখস্থ করা বিরক্তিকর। অষ্টম শ্রেণিতে পা দিলাম। রাজ্যে তখন সাদা চুলওয়ালা এক লোক মুখমন্ত্রীর গদিতে। পাড়ার বয়স্ক দাদুরা কোনও সভায় বক্তব্য রাখলেই তুলে নিয়ে আসতেন সাম্যবাদ আর শ্রেণিবিভাগহীন সমাজের কথা। কেন্দ্রের স্বৈরাচারী শাসনে নৈরাজ্যের কথা। অর্ধেক বুঝতাম না। শরীরে গরম টগবগ করে ফুটতে থাকা রক্ত ভালবাসত মিছিলের স্লোগান আর বিকালের ফুটবল। এই ফুটবলের সূত্র ধরে পরিচয় হল একটা বেঁটে মোটাসোটা আর্জেন্টিনার জার্সি-পরিহিত এক ছবির সঙ্গে, দিয়েগো মারাদোনা। পড়াশুনো শুরু করলাম লোকটাকে নিয়ে। এই মারাদোনাকে নিয়ে আমার শিক্ষকের সঙ্গে চৰ্চা করতে গিয়ে উঠে এল তার মাঠের চেয়েও বেশি মাঠের বাইরের কার্যকলাপ। পরিচয় হল চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো থেকে হিটলার, মুসোলিনি, গ্যারিবল্ডি, রুশো, নেলসন ম্যান্ডেলা সবার জীবনের সঙ্গে। ইতিহাস যেন টানতে শুরু করল নেশার মতো। তবু গণঅভ্যুত্থান শব্দটাকে কখনও এত সামনে থেকে দেখতে পাব, সেই লড়াইয়ের সঙ্গী হব, ভাবিনি।
গণঅভ্যুত্থান বলা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে অনেকের। তারপরেও বলব স্বাধীনতা বা নকশাল আন্দোলন-এর সময় জন্ম হয়নি আমার। আমার জীবিত অবস্থায় দেখা সর্বস্তরের মানুষের লড়াইয়ের ফসল আরজিকর-এর এই আন্দোলন। প্রথম ১৪ আগস্ট রাতে প্রাক-স্বাধীনতা দিবসে শহরের রাস্তায় হাজারে হাজারে মহিলা স্লোগান দিচ্ছে বিচার চেয়ে। স্তব্ধ শহরের প্রতিটা রাজপথ। তিলোত্তমার নারকীয় ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে শাসকের বিরুদ্ধে গলা ফুলিয়ে স্লোগান তুলছে মানুষ—
“আমার বোনের রক্ত, হবে নাকো ব্যর্থ”
“জনগণের একই স্বর, জাস্টিস ফর আরজিকর”
কেউ মিছিলে হাঁটছে, কেউ গান গাইছে, কেউ চুপ করে তাকিয়ে আছে জাতীয় পতাকার দিকে। লক্ষ লক্ষ লোক প্রশ্ন করছে প্রশাসনকে— পুলিশ তোমার কীসের ভয়, ধর্ষক তোমার কে হয়? শুধু তো সে রাত নয়। বিচারের সময় যত দীর্ঘ হচ্ছে রাজপথে আছড়ে পড়ছে মানুষ। লাঠি নেই, ইট পাথর ছোড়া নেই। মানুষ আসছে রাস্তায় বসছে, মানববন্ধন গড়ছে, গাইছে, মোমবাতি জ্বালছে আর প্রশ্ন করছে প্রশাসনকে। পুলিশমন্ত্রীর নির্দেশে শিরদাঁড়াহীন ঘুণে খাওয়া এক প্রশাসনকে। তারপরেও যদি এ গণঅভুত্থান না হয় তাহলে তা নয়। কিন্তু দিনবদল তো অবশ্যই।
কেন দিনবদল? আসুন দেখাই কতগুলো ছবি।
বারাসাত থেকে গাড়ি চালিয়ে ব্যারাকপুরে হয়ে বাড়ি ফিরছি। রাত ১টা ছুঁয়েছে ঘড়ির কাঁটা। ব্যারাকপুর-বারাসাত রোডের ওপর এক জায়গায় ১৫ থেকে ১৮ বছরের মাত্র সাত বা আটজন মেয়ে রাস্তায় গাড়ি আটকে স্লোগান দিচ্ছে বিচার চেয়ে। আশেপাশে কোনও একটি ছেলেকেও দেখলাম না। দাঁড়ালাম, প্রায় ১৫ মিনিট পর পাশে একটা ফুটফুটে বোন এসে বলল দাদা পিছনে একটা রাস্তা আছে তোমার ছোট গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারবে। আমরা কিন্তু অনেকক্ষণ থাকব এখন। উত্তরে হাসলাম, ব্যাগ থেকে নতুন জলের বোতলটা বের করে হাতে দিয়ে বললাম ‘ঘেমে গেছিস, একটু জল খা। আমরা আছি, তোরা লড়াই চালা।’ এরকম ভয় না পেয়ে মাত্র সাত বা আটজন মিলে রাস্তা রুখে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সাহসের ছবি দিনবদল নয়?
ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডুরান্ড কাপ ডার্বি বাতিল। জন্ম থেকে কট্টর ইস্টবেঙ্গলি হাত মেলাল সবচেয়ে রাইভাল মোহনবাগানিদের সঙ্গে। বছরের পর বছরের লড়াই ধুয়ে দিয়ে গেল একটা আন্দোলন। মহামেডান সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে শাসকের জনপ্রিয় স্লোগান ‘খেলা হবে’ থেকেই শাসকের ভিত কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠল—
“মাঠ ময়দান বন্ধ তবে, রাজপথেই আজ খেলা হবে”
“যত বার ডার্বি, শাসক তোরা হারবি”
“এক হয়েছে বাঙাল ঘটি, ভয় পেয়েছে হাওয়াই চটি”
আর মোহনবাগানি ভাইয়ের কাঁধে চেপে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের সে ছবি তো বাংলার ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফ্রেম।
এবার জুনিয়র ডাক্তাররা। পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের অপসারণ চেয়ে ডেপুটেশন দিতে চললেন লালবাজার। এক কিলোমিটার আগেই লোহার ব্যারিকেড বসাতে হল পুলিশকে। এতটাই ভয় জাঁকিয়ে বসেছে উর্দিধারীদের। তবু নড়লেন না জুনিয়র ডাক্তাররা। সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন কতক্ষণ বসে থাকবেন আপনারা? উত্তর এল ৪৮ ঘন্টা ডিউটি করতে হয়ে আমাদের। সময়ের ভয় দেখবেন না। রাতভর তাঁরা বসে রইলেন রাস্তায়। এ যেন হঠাৎ কোনও হড়পা বানের ঢেউয়ে ভেসে চলা কোনও নদী। রেয়াত করা হচ্ছে না পুলিশকে বা রাজনৈতিক হুমকিকে। বিচার ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ে এক সময় পিছু হটল পুলিশ। গলার স্বরে পিছু হটল পুলিশ, উঠল ব্যারিকেড। পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকেই মাথা নিচু করে গ্রহণ করতে হল তাঁর নিজের অপসারণের ডেপুটেশন।
আর সাধারণ মানুষ? তারা কি শুধু রাতদখলেই থেমে গেল? ভুল। সাধারণ মানুষ লড়ছে প্রতিটা পদক্ষেপে। বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে সকাল তখন ১০টা। রোদ্দুর বাড়ছে প্রচণ্ডরকম আর পাল্লা দিয়ে গরম। হঠাৎ চারিদিক থেকে আসতে শুরু করল ত্রিপল আর দড়ি। হাতপাখা বিক্রি করে দিনে ১৫০ টাকা আয় করা কাকু দিয়ে গেলেন ৩০০ পিস হাতপাখা। আশেপাশের দোকান রইল সারারাত খোলা আন্দোলনকারীদের টয়লেট ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য। সকাল হতেই চায়ের দোকানি দেবুদা হাজির সবার জন্য ব্রেকফাস্টের স্যান্ডুইচ নিয়ে। দেবুদাকে বললাম, দাদা অনেকগুলো টাকা যে বেরিয়ে গেল। উত্তরে বললেন, বোনের জন্য ভাই-বোন সবাই মিলে লড়ছে। আজ টাকার কথা কেন ভাবব বলো তো? সরে এলাম মাথা নত করে।
দুপুর ১টা। আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না জুনিয়র ডাক্তাররা। ততক্ষনে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট-এর স্থানীয় মা-কাকিমারা থালায় করে ভাত, ডাল মেখে সবজি আর বেগুনির সঙ্গে মুখে পুরে দিচ্ছে জুনিয়র ডাক্তারদের। ওঁরা নিজেরাই এইভাবে রান্না করে পথে নেমে এলেন এবং এর জন্য ধন্যবাদ জানাতে গেলে বললেন— ‘ছেলেমেয়েগুলো কাল থেকে বসে আছে চোখের সামনে। ওরা না খেলে এ গলা থেকে খাবার নামবে না।’ বাড়ির মায়ের রান্নাঘরে পৌঁছে যাওয়া আন্দোলনকে গণঅভুত্থান বলে কি? উত্তর খুঁজছি।
আসলে ভয়টাই যে আর নেই। এটাই যে দিনবদল। জন্ম থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারে বড় হওয়ায় কোনও ঝামেলা বা মিটিং-মিছিলের নাম শুনলে বড্ড ভয় পেত মা। না বলে রক্তদান করার জন্য কতবার যে বকা খেয়েছি বাড়িতে তার ইয়ত্তা নেই। আসলে বড্ড ভীতু মা আমার তার সন্তানদের নিয়ে। সেই মা এখন রাত দশটার মধ্যে আমাদের রাতের খাবার খাইয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়ছে রাস্তায়। নিজে ওই ভিড়ে ওই স্লোগানের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে—
“আমার মেয়ের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ”
“বিচার তোমায় দিতেই হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে”
আমিও চোখে জল আর বুকে অনেকটা আশা নিয়ে গলা মেলাই—
“We want justice, we demand justice”…
*মতামত ব্যক্তিগত