মণিশংকর বিশ্বাস
নির্যাতিতার নৃশংস খুন ও ধর্ষণই এই জন-বিস্ফোরণের একমাত্র কারণ নয়, এ বোধহয় আমরা সবাই বুঝতে পারছি। এই ঘটনা রাজ্যবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে শাসকঘনিষ্ঠ হলে যে-কোনও পরিস্থিতিতে, যত অন্যায়ই কেউ করুক না কেন, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান পর্যন্ত তার পক্ষ নেবেন এবং ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না পর্যন্ত সরকার ও প্রশাসনের গলা অব্ধি জল উঠে না আসে। এদিকে এই ঘটনা আরও দেখিয়ে দিয়েছে যে, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা ঠিক কী অবস্থায়
নন্দিনী: রাজা, এইবার সময় হল…
রাজা: কীসের সময়?
নন্দিনী: আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।
রাজা: আমার সঙ্গে লড়াই করবে তুমি! তোমাকে যে এই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পারি।
নন্দিনী: তারপর থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।[রক্তকরবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
এক.
বিভিন্ন অর্থে এখন পশ্চিমবঙ্গে যা ঘটে চলেছে তা ঐতিহাসিক। এমন নয় যে এ-রাজ্য তথা দেশ একযোগে নৃশংস খুন-ধর্ষণ আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে গণ-আন্দোলনের জোয়ার উঠেছে, তা এককথায় অভূতপূর্ব। সাম্প্রতিককালে একটি অন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এইরকম সর্বাত্মক আন্দোলন আর একটিই হয়েছে, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’! বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানটি এরকম একটি নির্দিষ্ট কোনও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। যাইহোক অভাবনীয় ক্রূরতা আর নৃশংসতার পাশাপাশি অনেকগুলি বিষয় একসঙ্গে উঠে এসেছে। সবার প্রথমেই যা ঘৃতাহুতি দিয়েছে, তা হল শাসকদলের, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে সম্ভবত এমন কাউকে আড়াল করতে চাওয়া। এমনকি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইবার ঘণ্টা চারেক পরেই, মুখ্যমন্ত্রী, তথা পুলিশমন্ত্রী, তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিজেই সাংবাদিক সম্মেলন করে ওই মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে আরও গুরুত্বপূর্ণ কলেজের অধ্যক্ষ করে পাঠানোর কথা সাংবাদিকদের জানানো। অনেকেই বলছেন, এই পদ ছিল আসলে প্রোমোশন। এই প্রহসনের পরেই মানুষ খুব সঙ্গত কারণেই ক্ষেপে ওঠেন। এবং একে একে আরও বহু দুর্নীতির কথা উঠে আসে। তবে এও ঠিক, আরজিকর-কাণ্ডে এমন কিছু চাঞ্চল্যকর বর্ণনা আসতে থাকে মানুষের কাছে, যার বেশিরভাগই ভুয়ো! কিন্তু এইসব ভুয়ো ন্যারেটিভগুলি এই ঘটনার সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যায়। অবশ্য এই প্রশ্নও ইতোমধ্যে উঠেছে যে একটি চরম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় দোষীদের যারা শাস্তির দাবি করছেন, তারা কেন ফেক ভয়েস নোট রেকর্ড করে সোশাল মিডিয়ায় তা ছড়িয়ে দিতে গেলেন! কেনই বা জাল পোস্টমর্টেম রিপোর্টের চাঞ্চল্যকর অংশগুলি সোশাল মিডিয়ায় ঘুরতে লাগল। এই সব জাল প্রমাণগুলি তো কোর্ট গ্রাহ্য করবে না! ন্যায়বিচারের দাবিতে এই ফেক ন্যারেটিভগুলি ঠিক কীভাবে ন্যায়বিচারকে ত্বরান্বিত করতে পারে?! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনমানস একটা পর্যায়ে এই নিয়ে কোনও আলোচনাও শুনতে চায়নি। কেউ এই বিষয়ে প্রশ্ন তুললে, তাকে শাসকদলের বা দলের শীর্ষ-নেত্রীর ‘চটি-চাটা’ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে জন-আন্দোলনের এই যে অসহিষ্ণুতা একে অবশ্য দোষ দেওয়া চলে না। পৃথিবীর সর্বত্রই জন-আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কিছু এরকম। বস্তুত শাসকদলটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, চুরি, তোলাবাজি, উৎকোচ। এরা যে এখনও ক্ষমতায় আছে, তার কারণ সম্ভবত একটিই, যোগ্য বিরোধিতার অভাব। যাইহোক রাজনীতির আলোচনা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। যেটা বলবার, লিঙ্গ-বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিকতার বিরোধিতায় এইভাবে সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষত মহিলাদের, এমনকি স্কুলছাত্রীদের পর্যন্ত রাস্তায় নেমে আসা, নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। নিশ্চিতভাবেই অনেকে আছেন যারা শাসকদলের সমর্থকবাড়ি থেকেই এই আন্দোলনে রাস্তায় আছেন, আছেন প্রতিবাদে। অর্থাৎ গত নির্বাচনেই যাঁরা এ-রাজ্যের শাসকদলকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আবার এই মুহূর্তে রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। মধ্যবিত্তদের একটি বিশাল অংশ শাসকের চোখে চোখ রেখে বলতে পারছেন যে, না এই দুর্নীতির সংস্কৃতি, এই ভয়াবহ ঘটনাকে লঘু করে দেখাবার চেষ্টা আমরা মানছি না।
এই ওয়েবপত্রিকাতেই আমি বেশ কিছুদিন আগে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, “ভারতীয় বসন্ত কবে আসবে?” আজ সমগ্র ভারতে না হোক, পশ্চিমবঙ্গে যে একটি অন্য হাওয়া বইতে শুরু করেছে, একজন মেধাবিনীর অসীম মূল্যবান প্রাণের বিনিময়ে, তা অবশ্যই বলা যায়। যে-স্ফুলিঙ্গ নির্যাতিতা চিকিৎসক জ্বেলে দিয়ে গেছেন, তাকে আভূমি কুর্নিশ। যদিও তিনি শুরু করে যাননি, কিন্তু তাঁর মৃত্যুই নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে যে আলো জ্বেলে দিয়ে গেল তাতে তিনি খুব সঙ্গত কারণেই লিঙ্গ-বৈষম্য ও নারীস্বাধীনতা সংগ্রামের একজন শহিদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
প্রথমেই বলেছি, যে নির্যাতিতার নৃশংস খুন ও ধর্ষণই এই জন-বিস্ফোরণের একমাত্র কারণ নয়, এ বোধহয় আমরা সবাই বুঝতে পারছি। এই ঘটনা রাজ্যবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে শাসকঘনিষ্ঠ হলে যে-কোনও পরিস্থিতিতে, যত অন্যায়ই কেউ করুক না কেন, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান পর্যন্ত তার পক্ষ নেবেন এবং ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না পর্যন্ত সরকার ও প্রশাসনের গলা অব্ধি জল উঠে না আসে। এদিকে এই ঘটনা আরও দেখিয়ে দিয়েছে যে, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা ঠিক কী অবস্থায়! ডাক্তারির মতো এইরকম নোবেল প্রফেশনেও সরকারি হাসপাতালগুলিতে ডাক্তারদের কাজের জায়গায় ন্যূনতম সুবিধাগুলি নেই। কখনও কখনও কাজ করতে হয় একটানা ৩৬, ৪৮ এমনকি ৭২ ঘণ্টাও! হাসপাতালগুলিতে ডাক্তারদের কোনও বিশ্রামাগার নেই, এমনকি পুরুষ ডাক্তার ও মহিলা ডাক্তারদের আলাদা টয়লেট পর্যন্ত নেই! অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির মতো পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাক্ষেত্রেও কী পরিমাণ দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটরাজ জাঁকিয়ে বসেছে, এই ঘটনা তা একদম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
দুই.
এখন আমি ধীরে ধীরে কিছু অপ্রিয় প্রসঙ্গেও আসব। প্রথমেই মূল ঘটনাটি। এখানে মানুষের, সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনিটা ছিল, বোধহয় এই যে, এরকম একজন মেধাবিনী, যার ক্যারিয়ার শুরুই হয়নি এখনও, তাকে সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের শুরুতেই থামিয়ে দেওয়া হল! বা থেমে যেতে হল, এক (বা একাধিক) নরাধমের কারণে! এটা যেমন একটা দিক, তেমন অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে একজন মহিলা যেটা তার এক প্রকারের বাড়িই বলা যেতে পারে, যেখানে তিনি থাকছেন, কাজ করছেন, পড়ছেন, বিশ্রাম নিচ্ছেন, সেই সেখানেই তিনি যৌননির্যাতনের শিকার হলেন, খুন হলেন! এই ঘটনা যতখানি ভয়ঙ্কর, নৃশংস, ততখানিই স্নায়ুতে কাঁপুনি ধরানো, আতঙ্কজনক! চিকিৎসাবিজ্ঞানের পোস্টগ্র্যাজুয়েট পর্যন্ত পৌঁছানো বেশিরভাগ মানুষের কাছেই ঈর্ষণীয় সাফল্য। স্বভাবতই সচেতন না হোক, অন্তত অবচেতনে মানুষ ভাবছেন, যে এই পর্যায়ের অ্যাকাডেমিক সফলতার পরেও একজনের সঙ্গে এরকম নারকীয় ঘটনা ঘটতে পারে!! খুবই অপ্রিয় ও অসময়োচিত প্রশ্ন হল এই, যে যদি স্বাস্থ্যবিভাগের পে-রোলে না থাকা কোনও অস্থায়ী স্বাস্থ্যকর্মীর ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি ঘটত, তবেও কী এভাবে সর্বাত্মক প্রতিবাদে মানুষ নেমে পড়ত? যদি এই ঘটনা উত্তরবঙ্গের একটি প্রত্যন্ত গ্রামীণ হাসপাতালে ঘটত? নির্যাতিতা চিকিৎসক ভিন্নধর্মের হত? অথবা ধর্ষক যদি সংখ্যালঘু ধর্মের হত, তবেও কি এই আন্দোলন, এখন পর্যন্ত এতখানি যে অরাজনৈতিক চরিত্র বজায় রাখল, তা কি বজায় রাখতে পারত?
ধরা যাক কলেজের প্রিন্সিপাল এই যে ছেলেটি এখন পর্যন্ত এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা পুলিশের মতে একমাত্র অপরাধী, এখন সিবিআই-এর হেফাজতে, তাকে আড়াল করবার চেষ্টা করেছিলেন, শুধু নিজের প্রশাসনিক পদটিকে টিকিয়ে রাখতে (তখনও জানতেন না, তার সমূহ দুর্নীতিগুলিও এবার প্রকাশ্যে চলে আসবে)। এবার সিবিআইয়ের করা ইনভেস্টিগেশনে, ধরা যাক, ওই সঞ্জয় রায়ই যে প্রকৃত খুনি সেটা ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী সন্দেহাতীতভাবে ‘প্রমাণিত’ হল। তাহলে এই যে প্রিপ্ল্যানড খুন ধর্ষণ ও একাধিক ব্যক্তির জড়িয়ে থাকার এই তত্ত্বগুলি, এসব খারিজ হয়ে গেলেও কি আন্দোলনটি একই খাতে, একই খরতায় এগিয়ে যাবে? জুনিয়র ডাক্তারদের ফ্রন্ট ছাড়া সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার যাঁরাই মূলত এই আন্দোলন-উদ্যোগী তাঁদের কথা বা তত্ত্বগুলি ভ্রান্ত ‘প্রমাণিত’ হলেও কী মানুষের একইরকম আবেগ উদ্দীপনা থাকবে এই আন্দোলন সম্পর্কে?
এক নারী চিকিৎসক, যিনি তাঁর প্রাণের বিনিময়ে একটা স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দিয়েছেন আর তা এখন একটি দাবানলে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই প্রতিবাদ, শুধু আরজিকর-কাণ্ডের প্রতিবাদ নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। এই প্রতিবাদ, লিঙ্গ-বৈষম্য, সীমাহীন করাপশন ও অপশাসন, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে দেওয়া, সমাজে ও কর্মক্ষেত্রে অহরহ ঘটে চলা অসংখ্য নির্যাতনের যে-ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে বা অন্যায়ের সমর্থনে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা এসব কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ! অসংখ্য মুখ আছে এই আন্দোলনের। এর যে-কোনও একটা দিয়ে এই আন্দোলনকে চিহ্নিত করা যাবে না। তাই এর সমাধানও একটি নয়। অনেকেই বিচার চাইতে গিয়ে মমতা ব্যানার্জির অপসারণ চাইছেন। আমার মনে হয় না, উনি শুধু পদত্যাগ করলেই, আমরা যারা বিচার চাইছি, তারা ন্যায়বিচার পেয়ে যাব! আবার পুরুষতান্ত্রিকতা ও লিঙ্গবাদী রাজনীতি এমন একটি বিষয় নয়, যে এর বিরুদ্ধে কোনও জয়, শুধু একটি ঘটনা দিয়ে সম্পূর্ণ হতে পারে। তাই আমার অন্তত মনে হয় এই আন্দোলনের অভিমুখ, শুধু শাসকের বিরোধিতাটুকু বাদ দিলে, অনেকখানিই এখনও বিমূর্ত।
তিন.
এছাড়া ভদ্রবিত্ত বাঙালির সাইকির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতস্থানও উন্মোচিত করেছে এই ঘটনা। সোশাল মিডিয়ায় আমরা সেসব প্রতিনিয়ত দেখে চলেছি। এড়িয়েও যাচ্ছি, ভাবছি আন্দোলনের গতি অব্যাহত থাকলেই, সেটা নিয়ে মাথাব্যথা করবার দরকারটাই বা কী? বা কেউ সামান্য এ বিষয়ে বিরূপ সমালোচনা করলে তাকে ব্যক্তিগত স্তরে তীব্র আক্রমণ করা হচ্ছে। যেন তাকে আক্রমণ করেই, এই ভয়াবহ ও নারকীয় ঘটনার সুষ্ঠু ও সর্বাঙ্গীণ গ্রহণযোগ্য বিচার পাওয়া যাবে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন উঠবে আমরা কার জন্য জাস্টিস চাইছি? ওই নারী চিকিৎসকের জন্য, না নিজেদের জন্য? সত্যি বলতে কী প্রচলিত অর্থে আত্মা-টাত্মায় আমার বিশ্বাস নেই। যাঁর জন্য বিচার চাইছি সে যেহেতু মৃত তাই তাঁর আর এই বিচারে কিচ্ছু আসে যায় না! এছাড়া তো থাকল শুধু মৃতার পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন ও আমরা, সাধারণ মানুষ! বাবা-মা ক্ষতিপূরণের টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন, তাঁদের জীবনে আর কিচ্ছু পাওয়ার নেই! এবার কেউ কেউ বলতে পারেন, এই কিছুর মধ্যে কি ন্যায়বিচার নেই? ন্যায়বিচার তাঁরা নিশ্চয়ই এখনও আশা করেন। কিন্তু সন্তানের খুনি ও ধর্ষককে ফাঁসিতে চড়তে দেখলেও কি বাবা-মা সত্যিই জাস্টিস পায়! মেয়েকে হারাবার কষ্ট বড়জোর শুকনো সান্ত্বনা পেতে পারে মাত্র। তারপর? তাই “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” এই যে লব্জ, আমার ধারণা, আমরা বিচার চাই, আমাদের নিজেদের জন্যে, কাউকে বিচার পাইয়ে দিতে নয় এই রাস্তায় নামা।
যাইহোক, এই নারকীয় ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে যে কুরুচিকর দিকগুলি অনেকের চোখে পড়েছে, এবার সেটা নিয়ে দু-একটি কথা বলব। এই আন্দোলনের যেটা শক্তির দিক, সেটিই সম্ভবত দুর্বলতার দিক। শক্তির দিক এই, যে সর্বস্তরের মানুষ কোথাও না কোথাও এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম বোধ করছেন। আগেই বলেছি, বাংলার ঘরের মেয়েদের এভাবে স্বতঃস্ফূর্ত বেরিয়ে আসতে এর আগে হয়তো কখনওই দেখা যায়নি। সঙ্গে পুরুষরা তো আছেনই। বলাই-বাহুল্য এদের অনেকেই শাসকদলের সমর্থক! কেননা সবাই (কিছু দলদাস ছাড়া) বুঝেছেন এ রাজ্যে, রাস্তাঘাটে তো নয়ই এমনকি নিজের কাজের জায়গাতেও মহিলারা নিরাপদ নন, অন্তত যতখানি ভাবা হত। মানুষ এও বুঝেছেন, যে সরকার মেয়েদের সুরক্ষার চেয়েও সমর্থক দোষী হলেও তাকে বাঁচাতে বেশি সচেষ্ট হয়ে পড়েন। এখানেই সম্ভবত জনবারুদের গায়ে স্ফুলিঙ্গটি এসে পড়েছে। কিন্তু যেহেতু এই আন্দোলনে সোশাল মিডিয়ার এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, আবার সোশাল মিডিয়াতেই এত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এত আলটপকা মন্তব্য, অভিমত, মিম শেয়ার করেছেন, যে কোথাও না কোথাও এই শাসকবিরোধী ঝড় শাসকের শাসনকেন্দ্রের দিকে না বয়ে গিয়ে উল্টোপাল্টা বয়ে আন্দোলনের স্পিরিট-টার ক্ষতি করেছে অনেক সময়ই। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে, আমরা দেখেছি জনপ্রিয় আইকনের হাতে চুড়ি পরা মিম। আবার পোস্ট দেখেছি, যেখানে শ্রীরামচন্দ্র জটায়ুকে জিজ্ঞেস করছেন, আপনি বৃদ্ধ, তবু গেলেন রাবণকে বাধা দিতে? তার প্রত্যুত্তরে জটায়ু বলছে নারীকে রক্ষা করতে, নারী-হরণকারীর বিরুদ্ধে যদি আমি গিয়ে না দাঁড়াই তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তো আমাকে বেজন্মা কাপুরুষ ভাববে! একটা-দুটো লাইন অথচ এত কী ভয়াবহ পুরুষবাদে আক্রান্ত! এসব নিয়েই পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইতে অনেকে নেমে পড়েছেন। এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, বছর কয়েক আগের ঘটনা, ওই যে একটা মিশন আছে না, যাদের নাম শুনলেই ভদ্রবিত্ত বাঙালির মন ভক্তিরসে গদগদ হয়ে ওঠে, সেই মিশনের এক সন্ন্যাসী, তার একটা ভিডিও ক্লিপ। সন্ন্যাসী বলছেন, আমাদের যে ভাইফোঁটা, রাখিবন্ধন উৎসবগুলি আছে তা আমাদের মধ্যে যে পশুগুলি থাকে সেগুলিকে দমন করে রাখে। তাই তো আমাদের সংসারে ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্ক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। ভেবে দেখুন, যে ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্কৃতির ভিতর এসব রীতিরেওয়াজ নেই, তাদের তো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার উপায়ই নেই! তাছাড়া পুরুষের নিজের ঘরে বোনদের সঙ্গে ওরকম ইচ্ছে করলে সেটা স্বাভাবিক, একজন সন্ন্যাসী বলছেন! যাইহোক এবারেও দেখেছি, গেরুয়া পরিহিত আরএসএসের আদর্শে আদর্শায়িত এক বৃদ্ধ জল-কামানের সামনে দাঁড়িয়ে বারংবার পুলিশকে চুড়ি পরবার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁকে সোশাল মিডিয়ায় অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। তিনি বীরশ্রেষ্ঠ সাহসী পুরুষ, ‘কাপুরুষোচিত’ পুলিশকে চুড়ি পরবার পরামর্শ দেন। এই যে ‘প্রায়-শহিদ’ হয়ে যাওয়া মানুষটি, তিনি পরবর্তীকালে ইন্টারভিউতেও বলেছেন, তিনি নিজেকে তার মা-বোন-কন্যার রক্ষাকর্তা হিসেবে দ্যাখেন! তারপরেও অনেকে ওঁর অপরিসীম ‘সাহস’ দেখে প্রশংসাবাক্যে ভরিয়ে দিয়েছেন। কেননা জলকামানের আঘাতে তো তিনি মরেও যেতে পারতেন!
অজস্র ফেসবুক পোস্ট দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি গত সপ্তাহ চারেক ধরে! সবগুলির উল্লেখ করতে গেলে এই লেখা অস্বাভাবিক বড় যেমন হয়ে যাবে, তেমন সবগুলি এখন মনেও পড়ছে না। তাই বেছে বেছে দু-একটিই উল্লেখ করি।
এক স্কুলশিক্ষিকা তাঁর ফেসবুক-ওয়ালে লিখেছেন, “এ তো সংরক্ষণের পড়ুয়া। পড়াশুনায় কি খুব ভালো? বদপাল্লায় মিশেছে। ভালো কলেজে যারা চান্স পাওয়ার যোগ্য লয় কোটার দৌলতে পাচ্ছে… সো এই মৃত্যুতে দুঃখিত হতে পারলাম না।” (বানান অপরিবর্তিত)
এই পোস্টের স্ক্রিনশট একজন শেয়ার করলে সেখানে আবার একাধিকজন পোস্টের পোস্টদাতার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, এই নির্যাতিতা মৃত চিকিৎসক সংরক্ষণের পড়ুয়া নন। অর্থাৎ এসসি/এসটি নন! হয়তো তাঁরা এই পোস্টদাতাকে বলতে চেয়েছেন আপানার কথাগুলিতে তত আপত্তিকর তো কিছু ছিল না, কিন্তু এই চিকিৎসক তো কোটার পড়ুয়াই নন!
আরেকজন লিখেছেন এক কমেন্টে “ওখানে অনেক নারী বা মহিলা ডাক্তার আছেন, কিন্তু এনার সাথেই যখন ঘটনা ঘটেছে তখন অনেকটাই ওনার নিজস্ব দায় আছেই। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয় এটা একটা ঘটনা।”
আরেক ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ডাক্তারদের দোষে কত সময় তো রোগীও মারা যায়, এখন একজন ডাক্তার মারা যাওয়ায় এত হৈচৈ!! (এখন দেখলাম, এটার স্ক্রিনশট আমার কাছে নেই)
আবার রাতদখলের ডাকে কেউ কেউ শঙ্খ-উলুধ্বনি ইত্যাদি সহযোগে যোগদান করবার কথা বলছিলেন আর তাতে অনুমোদনের সিলমোহর দিতে বাঙালি ভদ্রবিত্ত দেরিও করেননি যথারীতি। খুব স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় সংখ্যালঘু শ্রেণির সঙ্গে যে আরও একবার এক্সক্লুশনের রাজনীতি করা হল এতে, সেটা অনেকেই বুঝতে চাননি! যে-কোনও হিন্দু রিচুয়ালকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, বিশেষত ভদ্রবিত্তের অতি কাছের, ধর্মীয় অনুষঙ্গ কম, বাংলার কালচারাল ট্র্যাডিশন বেশি মনে হয়!
অনেকেই অতি উৎসাহী হয়ে মৃত চিকিৎসকের পেলভিক বোন ভেঙে ফেলেন। এরপরেই আসে ১৫১ গ্রাম সিমেনের তত্ত্ব। সেটা ভুল প্রমাণ হতেই, ভুলটা কেন হয়েছে সে বিষয়ে সাফাই গাইতে শুরু করেন ঝকঝকে উজ্জ্বল সব ফেসবুকার, ডিজিটাল ক্রিয়েটর, তরুণ পডকাস্টার। আমারই ভুল, এঁদেরকে আমি এখন যা ভাবি, তার চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল ভাবতাম! অন্য মহিলাদের কথা ছেড়েই দিলাম, মৃত সন্তানের যৌনপ্রত্যঙ্গের ওজন বা তার ভিতর পাওয়া ঘন চটচটে আঠালো তরল নিয়ে আকচা-আকচি বা তথ্যমূলক ফেসবুক প্রতিবেদন একজন সন্তানহারা পিতার কাছে, একজন সন্তান-খোয়ানো মায়ের কাছে কতদূর মর্মান্তিক, কতখানি গভীর বেদনাবহ হতে পারে তা এঁরা বোঝেননি!! অবশ্য ওঁরা বলতে পারেন যে নিউজলন্ড্রি নিউজপোর্টালে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের সূত্র ধরেই তো এই আলোচনা। তারপরেও আমি বলব একটি ইংরেজি নিউজপোর্টালের খবর বাংলায় অনুবাদ করে মৃত-চিকিৎসকের পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় পৌঁছে দেওয়ার মহান কৃতিত্ব ও দায়িত্ব আপনারা পালন করেছেন! প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তৃণমূল সুপ্রিমোর যোগসূত্র থেকে শুরু করে সেটিং তত্ত্ব পর্যন্ত, এরকম আরও অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায় চাইলে কিন্তু তাতে এ লেখা অযথাই ভারাক্রান্ত হবে মাত্র।
চার.
সবশেষে, আরজিকর-কাণ্ডে শাসক যে পরোক্ষভাবে হলেও জড়িত এ-কথা ফাঁস হয়ে গেছে। এই তো সপ্তাহ খানেক আগেই টালা থানার ওসি যখন অসুস্থতার ভান করছিলেন এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলি ভর্তি নিতে চায়নি, মুখ্যমন্ত্রী হুমকির সুরে বলেছিলেন, উনি দেখে নেবেন কাদের এত সাহস! তার কয়েকদিন পরেই ওই ওসিকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই! আরজিকরে তথ্যপ্রমাণ যে লোপাট হয়েছে, তা এখন একটা বাচ্চাও বোঝে। এই তথ্যপ্রমাণ যারা লোপাট করেছে, শাসক তাদের পক্ষে, এ-কথা মানুষের মন থেকে কিছুতেই আর মুছে ফেলা যাবে না। সত্যি বলতে কী এরকমটা এই বাংলা এর আগে কখনও দেখেনি! আন্দোলনকারীদের উপর রাতদখলের রাতে কার অঙ্গুলিহেলনে ভয়াবহ আক্রমণ নেমে এসেছিল, কার নির্দেশে পুলিশ অ্যাক্টিভলি নিষ্ক্রিয় ছিল সেদিন, কলকাতা পুলিশ ছাড়া এ-কথাও কারও অজানা নয়। আর সত্যি বলতে কী, বহুদিন আগে থেকেই এই শাসকদলের ক্ষমতায় থাকবার আর কোনও নৈতিক অধিকার নেই। সারদাকাণ্ডে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের সংসার পথে বসেছে। যাঁরা বলেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ইত্যাদি ভাতাগুলি চালু করে বর্তমান সরকার গরিবের ক্ষমতায়নের পথে হেঁটেছেন তাঁদের কাউকে অবশ্য কখনও এটা বলতে শুনি না যে বহু গরিবের রুটিরুজি থেকে আরম্ভ করে শেষ সঞ্চয়টুকুও সারদা, রোজভ্যালি ইত্যাদি করে এই সরকার কেড়ে নিয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে যে অভাবনীয় দুর্নীতি করে গোটা ব্যবস্থাটাই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক আগেই বাংলার উচিত ছিল হবু-শিক্ষকদের সঙ্গে রাস্তায় এসে দাঁড়ানো! তাহলে হয়তো আজ আরজিকরের মতো কালো দিন আমাদের দেখতে হত না! যাইহোক শিক্ষা ও খাদ্যমন্ত্রী জেলে! কুণাল ঘোষ নিজেও সারদাকাণ্ডে জেল খেটে এসেছেন। নারদাতে নির্লজ্জের মতো টাকা নিতে দেখা গেছে সাংসদ-নেতা-মন্ত্রীদেরকে। তাছাড়া গরুপাচার, কয়লাপাচার— করাপশনের লিস্ট লম্বা শাসকদলের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে উদার ও আশাবাদী মানুষটিও বলবে না পশ্চিমবঙ্গের জন্য কোনও আশার আলো তিনি দেখতে পাচ্ছেন। একটি প্রকাশ্য-সাম্প্রদায়িক দলকে রুখে দেওয়া ছাড়া সাম্প্রতিককালে শাসকদলের হাতে আর কোনও তাস নেই। এই তাস আর কিছু ডোলের রাজনীতি দিয়েই হয়তো শাসকদলের প্রধান ও তার সহকর্মীরা আরও সময় কিনে নিতে চাইছেন। আমি অবশ্য না চাইলেও এই প্রশ্ন উঠবে এখানে যে, এভাবে কি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার হস্তান্তর সম্ভব? বিকল্প হিসেবে কাদের উপর রাজ্যশাসনের দায়িত্ব-ভার অর্পণ করা হবে? পাশের দেশটির মতো, ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে তো আর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অ্যাপয়েন্ট করা সম্ভব না। রাজ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটির গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নাতীত নয় এখনও। আর গত লোকসভা নির্বাচনেও, এটা কারও নজর এড়ায়নি যে বাম দলগুলির পিছনে জনসমর্থন এখনও তলানিতেই! সোশাল মিডিয়া বা দু-একটি জনসভার হিসেব দিয়ে যার হদিস মিলবে না! তাই যাঁরা রাজনীতি নিয়ে আরও গভীরভাবে চর্চা করেন, তাঁদের এ-নিয়ে ভাবতে বলব। শুধু আমি ভাবি, যে এই বিপুল জনশক্তি, এই জনআন্দোলনের তীব্রতা, তা-কি পারে না, সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, নগরকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত, সত্যিকারের প্রান্তিক ও সর্বস্তরের মানুষের সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে আপসহীন একটি নতুন জনগণশক্তির উত্থান ঘটাতে?
*মতামত ব্যক্তিগত