Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভয় দানা বাঁধছে মনের গভীরে

বিতস্তা ঘোষাল

 


আরজিকরের ঘটনা এই নারীদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে জোরকদমে এঁরা হাঁটছেন সংসার ও অফিসের যাবতীয় কাজ সামলে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণটি লুকিয়ে তা মনোবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে লালিত আত্মবিশ্বাসের জায়গায় ফাটল ধরা। এই আত্মবিশ্বাসটি কেমন? প্রতিটি মা তাঁর সন্তান যখন স্কুল কলেজ বা কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বাড়ি বা হোস্টেল থেকে বেরোয়, সেই সময় থেকে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছাতে যতক্ষণ সময় লাগে সেই সময়টুকু আশঙ্কায় থাকেন। পথেঘাটে কোনও বিপদ হল না তো! কিন্তু সন্তান যেই মুহূর্তে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেল তখন তাঁর মন দুশ্চিন্তামুক্ত হল, এই ভেবে যে আর চিন্তা নেই, আমার মেয়ে বা ছেলে সুরক্ষিত জোনে ঢুকে গেছে

 

পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।

কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরও হাতে হাত রেখে
আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।

—শঙ্খ ঘোষ

‘আই নিড জাস্টিস। শি নিডস জাস্টিস। উই নিড জাস্টিস। ইন্ডিয়া নিডস জাস্টিস। ওয়েস্ট বেঙ্গল নিডস জাস্টিস। জাস্টিস জাস্টিস…।’ ১৪ আগস্ট রাত থেকে এই স্লোগান শহর থেকে শহরতলি, জেলা থেকে গ্রাম ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ৯ আগস্ট ভোররাতে ঘটে যাওয়া চূড়ান্ত অমানবিক, পাশবিক ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। চিকিৎসকদের পাশাপাশি রাস্তায় নেমেছেন সাধারণ মানুষ। ক্রমশ যাতে যোগ দিচ্ছেন পরিচিত-অল্পপরিচিত শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য জগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও। প্রতিবাদের একেবারে সামনের সারিতে মেয়েরা, ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে মায়েরা, দিদিরা। আর তাদের সঙ্গে পায়ে পা মেলাচ্ছেন পুরুষও। যেন এ লড়াই বাঁচার লড়াই, সমবেত জনতার লড়াই। মুহুর্মুহু ডাক উঠছে— লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই।

আশ্চর্যজনকভাবে এই মিছিলের কোনও স্বনামধন্য প্রতিবাদী মুখ নেই যাঁদের অনুসরণ করে নাগরিক সমাজ থেকে জেলা, মফস্বল, গ্রাম উত্তাল হতে পারে। এর আগে নন্দীগ্রাম বা সিঙুর নিয়ে আন্দোলনে যেমন দেখা গিয়েছিল। শহর জুড়ে পোস্টার হোর্ডিং-এ বিখ্যাত মানুষদের মুখ পরিবর্তন চেয়ে। সেই বিশিষ্ট মুখেদের মধ্যে অনেকেরই আজ বয়সজনিত কারণেই হোক বা মানসিক শারীরিক দুর্বলতার জন্যই হোক— স্থবির হয়েছে তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা। সেবার আরেকটি জিনিসও ছিল— বিরোধী রাজনৈতিক দলের মাননীয়া সর্বজনশ্রদ্ধেয়া ভালবাসার দিদির মুখ, যিনি এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্বতন সরকারকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। এবং নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেছিলেন।

কিন্তু অবাক বিষয় এবার নারীরা কোনও ব্যক্তিবিশেষের মুখের, বা রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশা না-করেই পথে নেমেছেন, এই নারীদের মধ্যে অনেকেই সময় কাটান গৃহস্থালীর কাজে। সন্তান স্বামী পরিবার নিয়ে যাঁরা মোটামুটি শান্তির জীবনে অভ্যস্ত। আর রয়েছেন চাকুরিজীবী মায়েরা, যাঁরা সন্তানকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা চাকরির জায়গায় পৌঁছে দিয়ে নিজে অফিসে ঢোকেন। আশেপাশের ঘটনা তাঁদের খুব একটা ভাবায় না। ভোট দেন ঠিকই, তবে রাজনৈতিকভাবে ভীষণ সচেতন বা প্রতিবাদী মন, যখন-তখন পথে নেমে বিদ্রোহ করতে পারে এমন গোষ্ঠীর নন। তাঁদের কারওই প্রায় জন্ম কোনও আন্দোলনের লগ্নে ঘটেনি। অথচ আরজিকরের ঘটনা এই নারীদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে জোরকদমে এঁরা হাঁটছেন সংসার ও অফিসের যাবতীয় কাজ সামলে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণটি লুকিয়ে তা মনোবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে লালিত আত্মবিশ্বাসের জায়গায় ফাটল ধরা। এই আত্মবিশ্বাসটি কেমন? প্রতিটি মা তাঁর সন্তান যখন স্কুল কলেজ বা কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বাড়ি বা হোস্টেল থেকে বেরোয়, সেই সময় থেকে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছাতে যতক্ষণ সময় লাগে সেই সময়টুকু আশঙ্কায় থাকেন। পথেঘাটে কোনও বিপদ হল না তো! কিন্তু সন্তান যেই মুহূর্তে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেল তখন তাঁর মন দুশ্চিন্তামুক্ত হল, এই ভেবে যে আর চিন্তা নেই, আমার মেয়ে বা ছেলে সুরক্ষিত জোনে ঢুকে গেছে। এবার সে বাকি সারাদিনের জন্য নিশ্চিন্ত।

অর্থাৎ মনোবিদদের মতে, প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কের প্রকোষ্ঠে একটি অ্যালার্ম নির্দিষ্ট থাকে এই সন্তান বা প্রিয়জনের সুরক্ষা নিয়ে, সেই অনুযায়ী যে যে স্থান তার কাছে সুরক্ষিত মনে হয়, সেটার সঙ্গে সময় ও স্থান ম্যাচ করে গেলেই তার ব্রেন সেই ভাবনা থেকে সরে এসে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। এই ভাবনা অনুযায়ী রাস্তায় বিপদের আশঙ্কা বেশি অনুভূত হয়। তাই আমাদের দেশের নানা প্রান্তরেই প্রায় প্রতিদিনই নারীধর্ষণ, খুন হলেও আমরা ততটা সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদে নামি না, কারণ সেগুলোর বেশিরভাগই রাস্তাঘাটে ঘটে যেগুলো আমাদের অবচেতন মন আগে থেকেই জানে অসুরক্ষিত, যখন খুশি যা কিছু ঘটে যেতে পারে। আমরা সন্তানকে প্রতিমুহূর্তে শিক্ষা দিই এটা উচিত, এটা অনুচিত, ছোট জামা পরে ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে রাত অবধি বাইরে কদাচিত নয়। ক্লাস, অফিস ছুটি হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে হয়… ইত্যাদি প্রভৃতি। ব্যতিক্রম ঘটেছিল নির্ভয়া বা কামদুনি কাণ্ডে। সেবারও দেশ জুড়ে প্রতিবাদ দেখা দিলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল শহরেই, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। এবং তার ব্যাপ্তিও ছিল সীমিত।

কিন্তু এই আরজিকর, যেখানে মেয়েটির শিক্ষা ও কর্মস্থল, যেখানে সে প্রায় প্রতিদিন কাটায়, যা তাঁর সেকেন্ড হোম, সেখানে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাওয়ায় মায়েদের চিরন্তন সেই ভাবনার জায়গাটা তুমুলভাবে নড়ে গেছে। তাঁরা ভরসা রাখতে পারছেন না প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আইনব্যবস্থা… কোনও কিছুর ওপরেই। আর তাই তাঁরা কারও প্রতীক্ষায় না থেকে নিজেরাই জোট বেঁধে পথে নামছেন। নির্দিষ্ট কারও পদত্যাগ, ভোটে জেতা সরকার ভেঙে দাও-গুঁড়িয়ে দাও-অমুক জবাব দাও-জবাব চাই… এসব স্লোগান না দিয়ে কেবল জাস্টিস চাইছেন, এবং মনে করিয়ে দিচ্ছেন— ‘পুলিশ তুমি যতই মারো, তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়’ বা ‘ধর্ষক খুনির চামড়া, গুটিয়ে দেব আমরা’…। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে প্রশাসনকে সচেতন করছেন। মেয়েদের মুখে এই ধরনের স্লোগান শেষ কবে এই রাজ্য বা দেশ শুনেছিল তা মনে করতে পারছেন না প্রবীণ ব্যক্তিরাও।

আসলে ভয় দানা বাঁধছে মায়েদের মনের গভীরে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে তাঁদের একই চিন্তায়, দিনের শেষে সন্তানের মুখটা দেখতে পাব তো! কোনও খারাপ খবর আসবে না তো! প্রতিদিনের এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তাঁরা বেছে নিচ্ছেন পথ, সেখানেই যেন তাঁরা সব অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে জিতে যেতে পারবেন, জেনে বা না-জেনেই উচ্চারণ করছেন ‘আমাদের পথ নেই কোনও/আমাদের ঘর গেছে উড়ে/আমাদের শিশুদের শব/ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে/আমরাও তবে এইভাবে এ-মুহূর্তে মরে যাব নাকি?/আমাদের পথ নেই আর/আয়, আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’ অমর প্রতিবাদী মেরুদণ্ড সোজা রাখা কবির মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ডাক দিচ্ছেন ‘জাস্টিস ফর…’। এখন সমবেত অপেক্ষা জাস্টিস কবে আলো হয়ে মুক্তির পথ দেখায়। তবে প্রত্যয় বাড়ছে।


*মতামত ব্যক্তিগত