Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জহরাতলা

শুভ্র মৈত্র

 

—দেশের সামনে আজ ভয়ঙ্কর বিপদ। বাইরের শত্রুরা এই দেশের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যেতে চাইছে। ছিন্নভিন্ন করতে চাইছে দেশের ঐক্য, সংহতি, একতা। আমরা কি আবার পরাধীন হব? আপনাদের প্রতিটি মানুষকে আজ ভাবতে হবে কোনটা আজ প্রায়োরিটি— নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ না এই আর্যাবর্তের অখণ্ডতা রক্ষা।

ইসস, গলার শিরা একেবারে ছিঁড়ে যাবে লাগছে। সব কথা সাদিকুলের মাথায় ঢোকে, তা নয়, তবে বেশ বুঝতে পারে লোকটা কথা বলার সময় শুধু মুখ নয়, সারা শরীর দিয়ে বলে। আর হাততালিও পড়ে খুব। সেই হাততালির ফাঁকে একবার বোতল থেকে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে নেয় পানি। যা গরম পড়েছে!

বৈশাখ মাস পড়লে যাদের নববর্ষ আর রবি ঠাকুরকে মনে পড়ে, সাদিকুল তাদের মধ্যে পড়ে না। বৈশাখ মাসে যারা বৃষ্টির জন্য কেঁদে মরে, সাদিকুল তাদের সুরেও গলা মেলাতে পারে না। আসলে বৈশাখ মানে সাদিকুলের কাছে জহরাতলা। জহরাতলার কালীমন্দির। বৈশাখ মাসেই শনি মঙ্গলবার করে পূজা হয় আর সেই পূজার দিনগুলিতে মেলা বসে। বছরের অন্য সময়েও পূজা হয় ঠিকই, তবে এই মাসে মায়ের পূজায় ধুমধাম বেশি। সারা বছরের সব গুনাহ নাকি কেটে যায়। মেলাও এই মাসেই বসে।

এবারের বৈশাখে অবশ্য অন্য কোনও কিছু মনে পড়ার জো নেই। শুধু রংবেরঙের পতাকা আর নানান রঙের মুখেই ছেয়ে গেছে বছরের প্রথম মাস। শুরু হয়েছিল আগে থেকেই। রাতে বাড়ি ঢোকার সময় যেদিন দেখল পাড়ার ছেলেরা চৌধুরীবাড়ির দেওয়ালে সাদা চুনকাম করছে, সাদিকুল জানতে পারে, ভোট আসছে। তারপর তো কয়েক দিনের মধ্যেই বাতাস ছেয়ে গেল ভোটের বাজনায়। নানান রঙের পতাকা, সাজগোজ করা মুখ, রাস্তার পাশের হোর্ডিংয়ে গয়না পরা ফর্সা মেয়ের জায়গায় হাতজোড় করা পুরুষমানুষ।

সাদিকুলের পাড়াতেও ব্যস্ততা শুরু হল। নানান ধরনের মানুষের যাতায়াত বাড়ল, পাড়ার ছোকরাগুলো গম্ভীর হয়ে যায়, দল বেঁধে ঘুরতে শুরু করে, ক্যারাম খেলে, আর বাইরে থেকে কেউ এলে গোল হয়ে ঘিরে বসে। গলির এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছোট ছোট পতাকা ঝোলে। কারও টালির বাড়ির ছাদে, কারও বা দেওয়ালে। দেখলেই বোঝা যায় কারা কোন পার্টি বেছে নিয়েছে এবারের ভোটে। সাদিকুলের কাছেও এসেছিল ওরা, নিয়ে গেছে ওকে মিছিলে মিটিঙে। শুনিয়েছে হরেক ভাষা, শিখিয়েছে নানান লব্জ। স্বপ্নের কথা, ভরসার কথা আর ভয়ের কথা শুনতে শুনতে একটু ফাঁক পেলেই সাদিকুলের মনে পড়ে জহরাতলার মেলা, আব্বুর সেই টমটম, আর সুলতান। সেই ঘোড়াটা যার ওপর ছিল টমটম টেনে নিয়ে যাওয়ার ভার। কে যে ওর নাম সুলতান রেখেছিল, আব্বুই হবে। বয়সও ছিল আব্বুর সমান, দুজনের ইয়ারি ছিল খুব। সাদিকুলের স্পষ্ট মনে আছে আব্বু সুলতানের গায়ে হাত বোলাত, ফিসফিস করে কথা বলত ওর সঙ্গে। আর সুলতানও মাথা নাড়ত। ভুখ লেগ্যাছে সুলতান? আর একটু বাপ, এই টিপটা শেষ করি! সুলতান বুঝত, লম্বা পা দুটো নিয়ে দৌড়ের ভঙ্গিতে এগিয়ে যেত, খটখট। অন্য সময়ে ঝিমাত দুজনে মিলেই। এই বৈশাখেই যত ব্যস্ততা।

সাদিকুলের কানের কাছে নানান কিসিমের শব্দ ঢুকেছে এই মাসে। পাকা রাস্তা আর কারেন্টের কথা শুনেছে এই বৈশাখে, শুনেছে হকের টাকা আর হকের চুরি নিয়ে চিল চিৎকার। টাউনের সব নেতারা ছিল, ছিল আরও বড় নেতা, নিশ্চয়ই আরও বড় টাউন থেকে এসেছে। কোনওদিন না দেখা লোকগুলোও সাদিকুলকে ‘চাচা’ বলে ডেকেছিল, পরবের নমাজের শেষে সকালে বুকে টেনে নিয়েছিল, ঘাবড়ে গিয়ে সাদিকুল হাসতে ভুলে গেছিল সেদিন। শুধু এটা বুঝেছিল ‘এরা’ খুব ভাল আর ‘ওরা’ খারাপ, ‘এরা’ নিজেদের লোক, ‘ওরা’ পরের। সরু হয়ে যাওয়া ঘাড়টা উঁচু করে ‘ওদের’ দেখতে মন চায়নি সাদিকুলের। এই সময়গুলি নিয়ম মেনে চলার সময়।

জহরাতলার কালীঠাকুরকে পূজা দিতে অনেক মানুষ আসে। টাউন থেকে তো সবাই যায়, আসে বাইরে থেকেও। যে মেয়েদের বিয়ে হয়েছে কলকাতায়, তারাও আসে জামাইকে নিয়ে। বচ্ছরকার দিন, বাপের বাড়ি আসা। আব্বুর টমটমে সামনে পিছনে মুখ করে বসত সবাই। সাদিকুল দেখত সকালে যে মানুষগুলি হইচই করে টমটমে উঠেছিল, দুপুরবেলা ফেরার সময় সবার কপালে সিঁদুর, ঘামে রোদে উজ্জ্বল মুখগুলিতে আর যাই থাক ক্লান্তি নেই। তখন বৈশাখে কেউ গরমের কথা বলত না। মেলা থেকে ফেরার সময়ে আব্বুও বাঁশের কঞ্চি আর পদ্মপাতার টুকরিতে জিলাপি নিয়ে আসত। ও জানে ঠাকুর খুব জাগ্রত, সবার মনের কথা জানে।

সেদিন সাতসকালেই ঘরে ঢুকেছিল পাড়ার ছোকরাগুলো। তখনও রিকশা বের করেনি। চাচা, সিলিপটা ভাল কর‍্যে রেখ্যে দিব্যা। ভোটের দিন লিয়্যে যেতে হবে। ভোট দিয়্যা ক্যাম্পে চল্যে আসব্যা, বিরিয়ানি খিলাছে দাদা। সাদিকুল জানে ওই স্লিপটায় লেখা আছে, ‘সাদিকুল শেখ, পিতা: আনারুল শেখ। নং…’। আব্বুর নামটা এই সময়েই একবার ভেসে ওঠে। বৈশাখে আব্বুর কথা আবার মনে আসে সাদিকুলের। আর আব্বুর সঙ্গে সুলতানও ভুসুক করে চোখের সামনে ফাল দিয়ে ওঠে। সুলতান বসে যাওয়ার পর আব্বু আর বেশিদিন থাকেনি এই দুনিয়ায়। সাদিকুল স্থির জানে সুলতান ডেকে নিয়ে গেছে, ওইপারে টমটম চালাবে বলে। আর সময়ের নিয়ম মেনেই ‘আনারুল টমটমের’ ব্যাটা একদিন হয়ে গেল ‘রিকশা সাদিকুল’।

পার্টির ছেলেরা চলে যাওয়ার পর রোজের মতো রিকশার সিটের নিচ থেকে ময়লা ন্যাকড়াটা বের করে সাদিকুল। ঘষে ঘষে চকচকে করার চেষ্টা করে সিট, পাদানি, হ্যান্ডেল, চাকার স্পোক। তেলের কৌটোটা নেয়, বড্ড ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে চাকাগুলো। নিজের মতোই বুড়ো হয়েছে রিকশাটা, সাদিকুল আদর দিয়ে বয়স ঢাকতে চায়। ভাড়া বিশেষ হয় না আজকাল, এখন তো প্রায় কেউ ওঠেই না, টোটো-র যা দাপট। মনে পড়ে ছোট সাদিকুল আব্বুর কাছে টমটমে ওঠার জন্য জেদ করত, মেলা যাওয়ার জন্য যতটা না, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ার জন্যই বেশি। অন্য সময়ে আব্বু হয়তো মেনে নিত, কিন্তু বৈশাখ এলেই আর একটা প্যাসেঞ্জারের ভাড়া ছাড়তে চাইত না। সাদিকুলের স্পষ্ট মনে আছে, সায় দিত সুলতানও। লেজ নেড়ে, মাথা নেড়ে মাঝে মাঝে নিচের পাটির দাঁত বের করে সায় দিত আব্বুকে, এখন নয়। আর আব্বু ভয় দেখাত, মন্দিরের পথে আমগাছের ঘন জঙ্গলের কথা শুনিয়ে বলত, মিশমিশা আন্ধার, এঠি জ্বিন আছে। সাদিকুল ভয় পেত। টাউনে প্রতিবছর মিনাবাজার আসে, সাদিকুল গেছে ওখানে আব্বুর সঙ্গে। ঝকঝকে লাইটে মটরসাইকেলে চড়া মানুষ দেখেছে, দেখেছে ‘মত কি কুঁয়া’, ভয় লাগেনি, কিন্তু আমগাছের অন্ধকার ওকে ভয় পাইয়ে দেয়, ভয় লাগে জ্বিনের কথা শুনলে।

বড় হওয়ার পর ঠিক কবে থেকে জহরাতলার মেলায় যেতে শুরু করেছিল এখন আর মনে করতে পারে না। কোনও শনি মঙ্গলবার বাদ পড়ত না, আর নিজের হাতে যেদিন রিকশার হ্যান্ডেল ধরল, তখন তো তাকিয়ে থাকত সকাল থেকে, এদিন বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। যাওয়ার পথে আমগাছ, মেলায় বরফের রঙিন গোলা, মন্দিরের সামনে ভিড়, চিৎকার— সবকিছু টানত এই মাসটায়। পুজো দেওয়ার কথা মনে আসেনি, তবে এই মাসের শনি মঙ্গলে বাড়িতে মাছ-ডিম ঢোকে না।

এবারে বৈশাখে সাদিকুল শুনেছে অনেক ভারী ভারী কথা। কিছু কানের মধ্যে ঢুকেছে, কিছু আটকে থেকে গেছে মরা মহানন্দার পাঁকে, ঘর পর্যন্ত আসেনি। নদী আগে এই মাসে রোগা হয়ে যেত, এখন বছরভর শুকনোই থাকে, ওর হাড়জিরজিরে রিকশাটার মতো, শুকনো। হবে নাই বা কেন? মহানন্দার নরম বুকের খাঁচায় বড় বড় পিলার বসেছে যে, হয়েছে নতুন ব্রিজ। সাঁইসাঁই করে গাড়ি ছোটে ওপর দিয়ে সারাদিন। সাদিকের কানে এসেছে— এই ব্রিজ আমরাই করেছি, উন্নয়ন…। নদীর কথা কেউ বলে না, নদীর তো ভোট নেই। যেমন ভোট নেই আমগাছগুলোরও। সব কেটে সাফ। নতুন নতুন দালান উঠেছে সেই জায়গায়। এসেছে নতুন মানুষ, যারা জানেও না এখানে আমগাছের ঘন জঙ্গল ছিল।

—বন্ধুগণ এই যে আপনারা এখানে এত বছর ধরে আছেন, ওরা এখান থেকে আপনাদের তুলে দিতে চাইছে। তাড়িয়ে দেবে নিজের দেশ থেকে। এ-দেশের সংবিধান আমাদের যে অধিকার দিয়েছে তা কেড়ে নিতে চাইছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজেদের অভ্যাস সব পালটে দিতে চাইছে ওরা। আপনারা কী তা মেনে নেবেন?

বোধহয় বাইরে থেকে এসেছে কোনও নেতা। অনেক গাড়ি, আলো। হাততালির শব্দ উঠছে মাঝেমাঝেই। সাদিকুল এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে পার্টির ছেলেরা বলেছিল আসতে। ওর রিকশাটাও নিয়ে আসতে বলেছিল, রিকশার পাদানিতে জেনারেটর তুলেছে।

শুনেছে মিলমিশ থাকার কথা, শুনেছে ভাগবাঁটোয়ারার কথা। ও কান পেতে ছিল জহরাতলার কথা শুনবে বলে। কারণ বৈশাখ এলে ওর জহরাতলার কথাই মনে পড়ে। বড় নেতারা কেউ বলেনি। সাহস জোটে না তাদের জিজ্ঞেস করার। পাড়ার ওই ছেলেগুলো, যারা এই দুই মাসে পার্টির ছেলে হয়েছে, বড় নেতারা ওদের খোঁজ করে এই অঞ্চলে এলে, সাদিকুল ওদেরকেই জিজ্ঞেস করেছিল। তখন ক্লাবঘরে ক্যারাম খেলছে সবাই। আর এক কোণে কাগজের লিস্ট নিয়ে নাম মেলাতে ব্যস্ত কয়েকজন। কালকে তো মঙ্গলবার, জহরাতলা যাবি না তোরা? যেন ভূত দেখল সবাই। একটু রাগী চোখে তাকিয়েছিল নেতাগোছের ছেলেটা, চাচা, ওগুলান ওদের পরব, আমাদের না। তুমি এসব কথা মুখে আনবা না কহ্যে দিলাম।

সাদিকুল ভয় পায়। সব কথা বোঝে না, শুধু আব্বুর টমটমের টকটক আওয়াজটা ভেসে আসে এই বৈশাখ এলে, আর বিড়বিড় করে আব্বুর সঙ্গে কথা বলে,

—আমগাছগুলান আর নাই, সব ফকফকা। এখন অন্য জ্বিনের ভয়…