অভিজ্ঞান সরকার
বিচারপ্রার্থী আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের সামনে সুযোগ ছিল অনেক। অবিশ্বাস্য জনসমর্থন, সমাজের প্রভাবশালী অংশকে পাশে পাওয়া, সংবাদমাধ্যমের সাহায্য, সমাজমাধ্যমে উপচে পড়া আনুকূল্য— এত বিশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের আশা জেগেছিল। আন্দোলনস্থল থেকে বিজেপি নেতৃত্বকে তাড়িয়ে তাঁরা এক অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্যভবন-উত্তর ঘটনাবলি, শাসকের সঙ্গে মিটিং ও তার পরবর্তীতে কর্মবিরতি টেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মনে হচ্ছে এই চমকপ্রদ আন্দোলন পথ হাতড়াচ্ছে
আরজিকর হাসপাতালে কর্মরত জুনিয়র ডাক্তার মেয়েটির ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে বিপুল জনরোষ তৈরি হয়েছে। সহকর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বিচারের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তাররা একজোট হয়ে কর্মবিরতি পালন করেছেন প্রায় মাসাধিকাল। সমাজের অন্যান্য স্তরেও প্রবল আন্দোলন শুরু হয়, যা এখনও চলছে। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে একটা সাধারণ (কমন) দাবি যেমন রয়েছে (মেয়েটির ন্যায়বিচার ও দোষীর শাস্তি), তেমনই কিছু দাবি উঠে এসেছে নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত থেকে— যেমন সরকারি হসপিটালে জুনিয়র ডাক্তার-সহ সমস্ত স্বাস্থ্যপরিষেবা কর্মীদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, পুলিশ-সহ স্বাস্থ্যবিভাগের কিছু অধিকারিকদের শাস্তিপ্রদান, বিদ্যমান থ্রেট কালচারের বিলোপ ঘটানো ইত্যাদি। অন্যদিকে রিক্লেইম দ্য নাইট, রিক্লেইম দ্য রাইটের মতো নতুন উদ্যোগ পিতৃতন্ত্রবিরোধী, লিঙ্গসাম্যের রাজনৈতিক দাবিগুলি সামনে নিয়ে আসছে। এই আন্দোলনের অন্যতম প্রাপ্তি মহিলাদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ এবং পুরুষদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে নারী-নেতৃত্বর উঠে আসা; নারী-প্রশ্নকে, বিশেষত কর্মরত নারীর অধিকারকে স্লোগানকে সামনের সারিতে রাখা। আবার বিজেপির দাবি মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করে শুভেন্দু বা দিলীপ ঘোষকে সিংহাসনে বসাতে হবে, তাহলে নারীনির্যাতন সমস্যার সমাধান হবে। বিজেপির দাবি উৎকট, জন সাইমনকে ‘সাইমন গো ব্যাক’ স্লোগান দিতে দিতে মিছিলে হাঁটতে দেখলে যে-রকম হাস্যরসের উদ্ভব হয়, নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে বিজেপির আওয়াজ তোলাটা গুণগতভাবে একইরকম (ফেসবুকে এক বন্ধুর লেখা ধার করে এই তুলনাটি দেওয়া হল)।
আরজিকরের ঘটনার প্রেক্ষিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় রীতিমতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন, সিংহাসন টলোমলো হওয়ার জোগাড়। অতীতের ধর্ষণের ঘটনা যেমন পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, হাঁসখালি ইত্যাদির সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রের দলের পক্ষ থেকে ধর্ষিতাদের চরিত্র, পোশাক ইত্যাদির ইঙ্গিত করা হয়েছিল, যেমনটা শাসকরা সাধারণত করে থাকে— ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণের উৎকোচ দিয়ে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। এইবারের ঘটনাটিকেও ধামাচাপা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয় প্রথম দু-দিনের মাথাতেই। মাঝের ঘটনাপ্রবাহ সকলেরই জানা, তাই মূল বিষয়ে আসা যাক। মাসাধিককাল ধরে চলা জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতিকে বলপ্রয়োগ করে, লাঠি চালিয়ে বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্দোলন দমনের কোনও উপায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রের ছিল না। সামাজিক তীব্র প্রতিক্রিয়ার ভয় তো ছিলই, আইনশৃঙ্খলার অবনতি দেখিয়ে কেন্দ্রের রাষ্ট্রপতি শাসনের জুজু ছিল প্রবলভাবে। তৃণমূল কংগ্রেসের নৈতিকতা এমনই নিম্নস্তরের যে দলগতভাবেও মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না পরিস্থিতির। প্রায় ঠুঁটো হয়ে রাজ্য প্রশাসনকে হজম করতে হয়েছে গণবিক্ষোভকে।
এই পরিস্থিতিতে বিচারপ্রার্থী আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের সামনে সুযোগ ছিল অনেক। অবিশ্বাস্য জনসমর্থন, সমাজের প্রভাবশালী অংশকে পাশে পাওয়া, সংবাদমাধ্যমের সাহায্য, সমাজমাধ্যমে উপচে পড়া আনুকূল্য— এত বিশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের আশা জেগেছিল, ব্যক্তিগতভাবে এই লেখকেরও প্রত্যাশা ছিল অনেক। আন্দোলনস্থল থেকে বিজেপি নেতৃত্বকে তাড়িয়ে তাঁরা এক অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্যভবন-উত্তর ঘটনাবলি, শাসকের সঙ্গে মিটিং ও তার পরবর্তীতে কর্মবিরতি টেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মনে হয়েছিল এই চমকপ্রদ আন্দোলন পথ হাতড়াচ্ছে। একটা গণজাগরণ যে সম্ভাবনাগুলির জন্ম দেয় তা সম্পূর্ণ সফল কখনওই হয় না, তবু সামাজিক ক্ষতগুলিকে নির্ণয় করে সেগুলিকে মেরামতির জন্য শাসককে বাধ্য করে। সাময়িকভাবে হলেও রাষ্ট্র কিছু সংস্কারমূলক কাজে বাধ্য হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিসিটিভি ও কোলাপসিবেল গেট, ফ্লাডলাইট বসানো ও পুলিশি প্রহারার শুকনো প্রতিশ্রুতির বিনিময়েই এই পর্যায়ে ডাক্তারবাবুদের আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটেছে। বিচারের দাবি চলে গেছে সিবিআই ও সুপ্রিম কোর্টের দফতরে।
মৃতা মেয়েটি ছিল রাষ্ট্রের মতাদর্শগত ব্যবস্থার অঙ্গ সরকারি হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তার। উচ্চতর সামাজিক স্তরের অংশ হওয়া সত্ত্বেও এই রাষ্ট্র ডাক্তার মেয়েটির নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এই স্তরের অংশ হিসেবে ডাক্তারদের (বা আমলা, টেকনোক্র্যাট, উকিল, ব্যাঙ্কার ও অন্যান্য) রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত কম সঙ্ঘাতমূলক, অনেকটাই মিথোজীবীতার। মেয়েটিকে হত্যা হয়েছে খোদ হাসপাতাল চত্বরে— এই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে সামাজিক বিশেষাধিকার ও নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা সমাজের উচ্চতর স্তরে অবস্থিত ডাক্তার-সমাজকে। তাঁদের এই প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক— উত্তর দেওয়ার দায় বর্তায় রাষ্ট্রের উপর। মেয়েটির মৃত্যুর জন্য প্রধান অভিযুক্ত এই ব্যর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন তোলা দরকার কেন পদ্ধতিগতভাবে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নির্মম ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে? এমন পরিস্থিতি তৈরি কেন করা হয়েছে যেখানে সরকারি ডাক্তার থেকে রোগী— সকলেরই নাভিশ্বাস উঠেছে? সর্বস্তরে কেন এই অবহেলা? বেসরকারি স্বাস্থ্যবাণিজ্যকে তোল্লাই দেওয়ার জন্য? জুনিয়র ডাক্তাররা এইসব মৌলিক প্রশ্নগুলি উচ্চারণ করলেন না। তাঁদের দাবিগুলির চতুর্থ পয়েন্টে রেফারাল সিস্টেমের আধুনিকীকরণ, হাসপাতালের কাঠামোগত পরিবর্তন— এই বিষয়গুলির উল্লেখ ছিল, গোল গোল, বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়ার মতো করে। তাঁদের বিভিন্ন আলোচনায় সরকারি স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর বেহাল অবস্থার কথাও উঠে এসেছে। কিন্তু দুর্নীতি বা সরকারি অপদার্থতার সাধারণ কথাতেই সেইসব আলোচনা সীমাবদ্ধ থেকেছে, সমস্যার গোড়ায় ফোকাস থাকেনি। যে সুনির্দিষ্ট সমস্যাটি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিপন্ন তা হল স্বাস্থ্যপরিষেবার বেসরকারিকরণ ও কর্পোরেটাইজেশনের সরকারি নীতি। নব্বই দশকের পর গ্যাট চুক্তির মাধ্যমে ভারতরাষ্ট্র সমাজের সর্বস্তরে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণের বুলডোজার চালিয়েছে, জনকল্যাণকামী রাষ্টের আপাত রূপ ছেড়ে কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে— সরকারি শিক্ষা, স্বাস্থ্যপরিষেবাকে বাজারের নিয়ন্ত্রণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। কেন্দ্র-বাজেটের দুই শতাংশও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হয় না, ভারতবর্ষ বিশ্বের তলার দশটি দেশের মধ্যে একটি, যেখানে সরকারি স্বাস্থ্যবাজেট সর্বনিম্ন। স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রীয় নীতির খাঁড়ায় রোগী ও চিকিৎসক দু-পক্ষই বিপন্ন। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের অভাব, ওষুধে ভেজাল, স্টেট হাসপাতালগুলিতে একটা ইসিজি করাতে রোগীর পরিবারের ঘাম ছুটে যায়। প্রাইমারি হেলথসেন্টারগুলির করুণ দশা। আমরা জানি যে কী অসহনীয় পরিস্থিতিতে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করতে হয়। নিয়মিত হাসপাতালে রোগীপক্ষের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তারদের সঙ্ঘর্ষের খবর আসে। এই পরিস্থিতির দায় রাষ্ট্রের, দায় রাষ্ট্রনীতির, যা বেসরকারিকরণের ধামাধরা। এই বিষয়টি ডাক্তাররা জানেন না তা নয়, কিন্তু গোটা আন্দোলনে এর উল্লেখ অনুপস্থিত।
এই সময়ে শ্রেণি ইত্যাদি উল্লেখ করলে গা জ্বলে যাবে বেশিরভাগ মানুষের জানি, তবুও তথ্যটথ্য যা দেখা যাচ্ছে তাতে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে এলিটিস্ট ঝোঁক যথেষ্ট ছিল, আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু কর্মবিরতিই ছিল আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ফর্ম, তাই আন্দোলনের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীদের যাঁদের বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। এই ফর্ম দীর্ঘস্থায়ী হলে তা জনবিরোধী হতে বাধ্য। ডাক্তারদের কর্মবিরতি ও রোগীর অধিকারের দ্বন্দ্ব এইক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী, আবার এই দ্বন্দ্বের নিরসনও সম্ভব যা অতীতে জুনিয়র ডাক্তাররা করে দেখিয়েছিলেন। আশির দশকে আন্দোলনের পাশাপাশি সাংগঠনিক উদ্যোগে বহির্বিভাগ চালিয়েছিলেন তাঁরা। সেই আন্দোলনের অভিমুখ ছিল চিকিৎসাপ্রার্থী-কেন্দ্রিক, মানবিক ও রাজনৈতিক— তাতে রাষ্ট্রর বিরোধিতা ছিল, রোগীর প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্য মনে করিয়ে দেওয়ার দায় ছিল। বর্তমান আন্দোলন কি আদৌ সেই দিশা দেখিয়েছে? মনে তো হয় না— কিছু মিডিয়াশোভিত বয়ান ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যভবনে অবস্থানের সময় ‘অভয়া ক্লিনিক’ চালু করা হয়েছিল, সেটিও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং-এর অনতিপূর্বে, আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে। তড়িঘড়ি প্রক্রিয়ায় মুখরক্ষার জন্য এবং কার্যত অচল এই উদ্যোগ— স্বাস্থ্যভবনে কোনও রোগী যান না। গরিব অসহায় সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল রোগীরা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত এই আন্দোলনে। গণ-স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ঔষধের দাম নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যব্যবস্থার পণ্যায়ন বিষয়ে, NEET নিয়ে একটিও শব্দ শোনা যায়নি আন্দোলনের মঞ্চ থেকে। প্রাইভেট হাসপাতালের রক্তচোষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করেননি তাঁরা।
প্রশ্ন করতে পারেন, এসব নিয়ে কেন বলবেন সহকর্মীর মৃত্যুতে বিচলিত ডাক্তাররা? তাঁরা তো নিজেদের সুরক্ষার দাবিই প্রচার করবেন! সেটা তো করবেনই, কিন্তু আন্দোলনের চরিত্র গণমুখী, জনস্বার্থে নিবেদিত নাকি বিশেষ সামাজিক স্তরের স্বার্থে পরিচালিত তার কাটাছেঁড়া তো হবেই। খালি স্লোগান-সর্বস্বতা দিয়ে নৈতিকতার পরকাষ্ঠার প্রতীক হওয়া সম্ভব নয়। আন্দোলন শেষপর্যন্ত বৃহৎ জনগণের পক্ষে দাঁড়াল নাকি এক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অন্য কোনও কায়েমি স্বার্থকে শক্তিশালী করল তার তুল্যমূল্য বিচার তো হবেই। বাংলাদেশের আন্দোলন এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
কেন জুনিয়র ডাক্তাররা রাজনৈতিকভাবে বেসরকারিকরণ ও জনস্বার্থের দাবিগুলো সামনে আনতে পারলেন না? এই আন্দোলনে অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন আছেন যাঁরা গণস্বাস্থ্য আন্দোলনে দীর্ঘদিন যুক্ত, ফার্মা লবি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সরব। তাঁরা কি কোথাও অসমর্থ হলেন গণমুখী দাবিদাওয়াগুলি সংযুক্ত করতে? জানি না তাঁদের মতামত। তবে আন্দোলনে প্রবলভাবেই ছিল কর্পোরেট হাসপাতালের রক্তচোষা প্রতিনিধিরা— রোগীর জীবন-মৃত্যু নিয়ে যাদের ব্যবসা। এই কর্পোরেট ডাক্তারদের জনস্বাস্থ্য, শ্রমজীবী মানুষের পরিষেবা, সরকারি চিকিৎসা কাঠামোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ডাক্তার ও রোগী দুই-এর স্বার্থরক্ষা করার মতো কোনও ভাবনা নেই, কারণ এইগুলি তাদের শ্রেণিস্বার্থের বিরোধী। কর্পোরেট হাসপাতালে রোগীদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে কোটি কোটি টাকা কামানো, ফার্মা লবির দালাল এই কর্পোরেট ডাক্তাররা আন্দোলনের গঙ্গাজলে নিজেদের শুদ্ধ করতে নেমেছিলেন। এঁদের সক্রিয় উপস্থিতি আন্দোলনকে গণস্বাস্থ্য তথা জনস্বার্থের প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করতে বাধা দিয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিকল হলে কর্পোরেট হাসপাতালে বিপন্ন রোগীর ভিড় বাড়ে, মানুষের জীবনমৃত্যু নিয়ে ফাটকাবাজির খেলাটায় মুনাফা বাড়ে, কর্পোরেট ডাক্তারদের গুপ্তপকেটগুলো ধনধান্যেপুষ্পে ফুলেফেঁপে ওঠে। WHO-র রিপোর্ট বলছে চিকিৎসার খরচ জোগাতে প্রতি বছর সাড়ে পাঁচ কোটি ভারতীয় দারিদ্র্যসীমায় প্রবেশ করেন। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত অংশও রয়েছেন যাঁরা কার্যত সর্বস্বান্ত হয়ে যান বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হওয়ার ফলে, সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা না পেয়ে। যাদের কারসাজিতে এই দুরবস্থা সেই সব কর্পোরেট ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা গলাবাজি করছেন আন্দোলনের মঞ্চে। আসলে এই যুগ হল ‘Hood’-এর যুগ— ব্রাদারহুড, সিস্টারহুড পেরিয়ে ডক্টরহুডের জমানা— সেখানে কোনও শ্রেণিভেদ নাই, চশমখোর আর জনদরদির কোনও ফারাক নাই। বেসরকারিকরণের প্রতিভূ কিছু ডাক্তার দশচক্রে এই আন্দোলনের নেতা হয়ে গেছে! ডঃ কোটনিস বা বিনায়ক সেনের উত্তরপ্রজন্ম হিসাবে এদের মেনে নিতে এই লেখক অপারগ। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা-উত্তরকালে এক ডাক্তার নেতা আনন্দবাজার অনলাইনে সাক্ষাৎকারে বলছেন— তাঁদের রাষ্ট্রের উপর ভরসা আছে, সুপ্রিম কোর্টের উপর ভরসা আছে, মমতা ব্যানার্জির উপরেও ভরসা আছে। শুনে ব্যোমকে গেলাম— আন্দোলনের বর্শামুখ তাহলে কার বিরুদ্ধে? নির্যাতিতার বিচারের দাবি এক কমন দাবি, যা বর্তমানে আইনি ব্যবস্থার আওতাধীন, দীর্ঘস্থায়ী এক প্রক্রিয়া, এখনও চার্জশিট জমা পড়েনি। এই মামলার বিচার নিম্ন আদালতেই হবে, অর্থাৎ শিয়ালদহ কোর্টে, সুপ্রিম কোর্টে নয়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং-এর পরে কিছু পদের অদলবদল আর সুরক্ষার প্রতিশ্রুতিতেই যদি রাষ্ট্র, সুপ্রিম কোর্ট এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর ভরসা ফিরে আসে তাহলে বলতে হয় আরজিকরের ঘটনার প্রেক্ষিতে ধূমায়িত হয়ে ওঠা মানুষের ক্ষোভ-রাগকে প্রশমিত করবার সমাধানসূত্র পেয়ে গেছে রাষ্ট্র ও শাসক— ব্যবস্থার একচুল এদিক-ওদিক না করেই। কোনও কোনও গণবিক্ষোভ রাষ্ট্র ও তার শাসনের নৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়, কালেভদ্রে সেটা ঘটে— যেমন ঘটেছিল দিল্লির নির্ভয়ার ঘটনার সময়, যেমন ঘটেছে আরজিকরের ঘটনায়। রাষ্ট্রের নৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কোনও একটি স্তম্ভকে অবতার রূপে অবতীর্ণ হতে হয়, এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে প্রাথমিক ভূমিকা নিতে হয়েছে। ধীরে ধীরে আন্দোলনের সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের বোঝাপড়ায় পুনর্বস্থায় ফিরে আসে ব্যবস্থা, আমলারা যাকে বলে নর্মালসি। আবার একটি তিলোত্তমার ঘটনা না ঘটা অব্ধি ব্যবস্থা আবার যেরকম চলার সেরকম চলে।
এই বলে থেমে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তিলোত্তমার ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি বিচ্ছিন্ন নয় সেটি একটি বড় প্রশ্ন। তিলোত্তমার ঘটনার পরে এইদেশে দৈনিক গড়ে নব্বই্টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাও ঘটেছে একাধিক। কোথাও এর প্রতিকার রয়েছে? কোথাও সেই সব নিয়ে বিপুল বিক্ষোভ-আন্দোলন হয়েছে? তিলোত্তমার ডাক্তার-পরিচয় ও তাঁর কর্মক্ষেত্রে নৃশংস মৃত্যু সমাজের সেই অংশকে নাড়িয়েছে যাঁরা সাধারণত এক সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকেন— মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তদের এই ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা সাধারণ নয়, বিশেষ। দলিত, আদিবাসী, সমাজের নিম্ন আর্থিক বর্গের মানুষের সমাজে অহরহ এই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে, যা পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতায়, মিডিয়ার অনাগ্রহে সাধারণত চাপা পড়ে থাকে। মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত অংশও নিম্নবর্গের প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে বিচলিত নয়। তিলোত্তমার ঘটনায় এই অংশের মানুষ বিচলিত হয়েছেন, তাঁদের জগতও যে বিপন্ন, নিরাপত্তাহীন সেই অনুভূতি কাজ করেছে, রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন তাঁরা, এবং সমাজের সর্বস্তরে সেই রাগ ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদি টলে গেছিল প্রায়— ধূর্ত শাসক সমাধানের পথ খুঁজছিল। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের এলিটিস্ট দিশাহীনতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে— কর্মবিরতিকে কেন্দ্র করে ডাক্তার ও রোগীদের দুই যুযুধান শিবির হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
খবরের কাগজ থেকে জানা গেল, আজ তিরিশে সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের মতামত শোনার পর নিরাপত্তার দাবিতে জুনিয়র ডাক্তাররা ফের কর্মবিরতিতে যেতে পারেন। ফের রোগীদের পণবন্দি করে দাবিপূরণের আন্দোলনে নামা কতটা সঠিক জানা নেই। জনগণের স্বার্থ না দেখলে কোনও আন্দোলন আদৌ এক ধাপও এগোয়? রোগীদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না করলে, সমস্যার মৌলিক দিক অর্থাৎ বেসরকারিকরণের নীতি নিয়ে একটি কথাও না উচ্চারণ করলে আন্দোলনের কোনও ভবিষ্যৎ থাকে?
এই প্রবন্ধের পাঠকের সিংহভাগ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করান না। এই আন্দোলনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা সরকারি হাসপাতালে যান না। যদিও মধ্যবিত্তের বিত্ত দোদুল্যমান, কর্পোরেট চিকিৎসার জাঁতাকলে ছিবড়ে হয়ে দারিদ্র্যসীমার অপর প্রান্তে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। ফের কর্মবিরতি শুরু হলে নিম্নবিত্তশ্রেণির রোগীর উপর তার প্রভাব উপলব্ধি করা সাধারণ মধ্যবিত্তের পক্ষেও সম্ভব। কর্পোরেট হসপিটাল, কর্পোরেট ডাক্তারদের ভবিতব্য ও ভগবান মেনে নেওয়ার বদলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার পণ্যায়ন ও বেসরকারিকরণের নীতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠানোর সময় আছে। জুনিয়র ডাক্তারদের কাছেও এই প্রশ্নকে সামনে রেখে আন্দোলনকে সফল করার আবেদন ও প্রত্যাশা রইল।
*মতামত ব্যক্তিগত