Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় ছাত্র-জনতা সেটা মেনে নেবে না

ইভান তাহসীব

 

 

ইভান তাহসীব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষে তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ি

 

 

অর্ক ভাদুড়ি: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। একজন সমন্বয়ক হিসাবে আপনার কী অভিমত?

ইভান তাহসীব: রাজনৈতিক দল গঠনের এমন সিদ্ধান্ত এখনও নিশ্চিত হয়নি। তবে দেখুন, আমরা একটি বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে এসেছি। মানুষের মাঝে এখন নতুনের প্রতি প্রবল আকাঙ্ক্ষা। গত ১৬ বছরে হাসিনা সরকারের স্বৈরাচারী দুঃশাসনের পাশাপাশি পূর্বের শাসকদের নিয়েও এ-দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত। আওয়ামি লিগ-বিএনপি-জামাত— এই বৃত্ত থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে চায়। রাজনৈতিক দল যে কেউ গঠন করতে পারেন, এটি তার গণতান্ত্রিক অধিকার।

তবে এই মুহূর্তে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের এই প্ল্যাটফর্মটিকে আরও সংহত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। সারাদেশে যে কিছু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে একে কেন্দ্র করে, সেগুলোর সমাধান করে পুরো প্ল্যাটফর্মটিকে পুনর্গঠন করা যেতে পারে। কেননা, এই ব্যানারে দাঁড়িয়েই আমরা দলমতনির্বিশেষে সকলে আন্দোলনটা করেছি। ফলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার-সহ ভবিষ্যতের যে-কোনও সরকার-কাঠামোকে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে এই প্ল্যাটফর্মই বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছি।

অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলি ছাত্র রাজনীতি-মুক্ত করা দরকার। আপনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা। আপনি এই দাবি সমর্থন করেন? ‘ছাত্র রাজনীতি-মুক্তবলতে ছাত্র-জনতা ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?

যে-দেশের ইতিহাসই মূলত ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, সেদেশে ক্যাম্পাসগুলিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হতে পারে বলে আমি মনে করি না। আর সেটা সমাধানও নয়। তবে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের মতামত প্রকাশ পাচ্ছে একথা ঠিক। সরকার-দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলিগ যেভাবে এতদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং আবাসিক হলগুলোতে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব চালিয়েছে এবং সারাদেশে নির্যাতন-খুন-ধর্ষণ চালিয়েছে তার প্রতি ক্ষোভ থেকেই মূলত এই কথাটি আসছে। ছাত্রদলও তাই করেছিল বিএনপির শাসনামলে। তবে, আমি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলব, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এর সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এর মধ্যে দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পরিবেশ নষ্ট হবে। প্রশাসনিক দলীয়করণ এবং একচ্ছত্র স্বৈরতান্ত্রিকতার সুযোগ আরও বাড়বে। বরং ভেবে দেখুন, আমরা যে গণ-অভ্যুত্থানটি সংঘটিত করেছি, সেটি একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। দীর্ঘদিন পর এই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যে গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পেরেছি, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে আমরা সে পরিবেশটা ক্ষতিগ্রস্ত করছি না তো?

আমরা দেখছি বহু জায়গায় এখনও ছাত্ররা ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক কাজ করছে। এটা আর কতদিন চলবে? তাদের পড়াশোনার কী হবে?

আমরা একটি আপৎকালীন সময় পার করছি। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এই সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমরা মানুষের মাঝে দেখছি। একইসঙ্গে এই আন্দোলনকে ভূলুণ্ঠিত করতে বিভিন্ন অপচেষ্টাও আমরা দেখছি। এমন সময়ে, দেশে পুলিশ-প্রশাসন-সহ নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং সকল প্রশাসনিক কাঠামো অকার্যকর। ফলে, আন্দোলনের বিজয়কে অক্ষত রাখতেই শিক্ষার্থীদের এ-সকল কাজে যুক্ত হতে হয়েছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দ্রুততম সময়ে এটি সমাধানের দাবি জানিয়েছি। তারা আমাদের এই ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে এবং ইতোমধ্যেই সেই তৎপরতা দৃশ্যমান।

কোনও কোনও মহল আশঙ্কা করছে, শেখ হাসিনা একটি প্রতিবিপ্লবঘটাতে পারেন। যদি পরিস্থিতি তেমন হয়, ছাত্র-জনতা কী করবেন?

আওয়ামি লিগ এই গণঅভ্যুত্থানকে দমন করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। ছাত্রলিগ-যুবলিগের সন্ত্রাসীদের নামিয়ে যখন তারা আন্দোলন ঠেকাতে ব্যর্থ হয় তখন তারা আটক করে, গুলি করে, শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনি নামায়। কিন্তু ছাত্র-জনতার অসাধারণ প্রতিরোধের মুখে তারা অবশেষে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। ফলে, ‘প্রতিবিপ্লব’ ঘটানোর কোনও সামর্থ্য তাদের এই মুহূর্তে আছে বলে আমার মনে হয় না। তারপরও যদি ধরেই নিই, শেখ হাসিনা ‘প্রতিবিপ্লব’ ঘটাতে পারেন, তাহলে বলব, সেটি প্রতিহত করবার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি ছাত্র-জনতার আছে।

বাংলাদেশে কি আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা সম্ভব? নাকি দেশটি ক্রমশ মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে যাবে?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তার অন্যতম একটি অংশ জুড়ে ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার দাবি। কিন্তু, আওয়ামি লিগ-সহ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কোনও সরকারই সে আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়নি। বরং তারা প্রত্যেকেই এই শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজ নিজ মতো ব্যবহার করে নিজস্ব শোষণকাঠামোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। যুগে যুগে দেশের মানুষ সেটা প্রতিহতও করেছে। ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৮৩-র মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ১০ দফা তারই প্রমাণ। ফলে, এদেশে একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা সম্ভব বলেই মনে করি। তবে সেক্ষেত্রে, দেশের গণতন্ত্রকামী শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্র সংগঠকদের নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান— এই কালপর্বটিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

২০১৮ সালে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে প্রথম আন্দোলন গড়ে ওঠে। শাহবাগ থেকে এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যৌক্তিক সংস্কারের দাবি উত্থাপিত হলেও শেখ হাসিনা সে-সময়ে একপ্রকার চালাকির আশ্রয় নিয়ে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। যার ফলে আন্দোলন সেখানে থেমে যায়। তার প্রায় তিন মাস পরই ঢাকায় বাসচাপায় দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে ছাত্ররা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে। নিরাপত্তার দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে আমরা এক পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা উঠতে দেখি। এই আন্দোলনে কোটা আন্দোলনকারীদেরও একটি বড় অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। আওয়ামি সরকার তার সন্ত্রাসী বাহিনি দিয়ে আন্দোলনটি কঠিনভাবে দমন করে।

পূর্বের যে-কোনও লড়াই পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য জমিন প্রস্তুত করে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে ২০১৮-র ওই দুটি আন্দোলনের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আমি মনে করি। যে-সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা সেসময় রাস্তায় নেমেছিল তারাই এই গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করতে ভূমিকা রেখেছে। সড়ক আন্দোলনে যে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা উঠেছিল তারই ধারাবাহিকতা আমরা ২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে দেখতে পাই। প্রত্যেকটি আন্দোলনেই বৈশিষ্ট্যগত অনেক মিল খুজে পাওয়া যায়। ১৮ সালের বিগত দুটি আন্দোলন থেকে সঞ্চারিত অভিজ্ঞতাই ছাত্ররা ২৪ সালের অভ্যুত্থানে কাজে লাগিয়েছে।

অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী? আদৌ কি তারা প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হচ্ছে অথচ যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ যুদ্ধে নেমেছিল তা এখনও অপূর্ণই রয়ে গেল। যারা আসলেই সে-সময় যুদ্ধে লড়েছিল তাদেরকে দেশগঠনে কোনও ভূমিকা পরবর্তীতে রাখতে দেওয়া হয়নি। এরপর প্রত্যেকটা সরকারের আমলেই আমাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের জন্যে লড়তে হয়েছে। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা আজ পর্যন্ত দেখিনি। ৯০ সালেও একটা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আমরা স্বৈরাচারী এরশাদকে হটিয়েছি। কিন্তু সেই আন্দোলনে উত্থাপিত ছাত্রদের যে ‘দশ দফা’ তার কোনও বাস্তবায়ন তারপর আর ঘটেনি। যুগে যুগে এভাবেই চলেছে। এই গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল হিসেবে তার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। ফলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা হল, যে আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে এত এত প্রাণ মানুষ দিয়েছে, তার সর্বোচ্চ প্রতিফলন যেন আমাদের নাগরিক জীবনে ঘটে তা নিশ্চিত করুন! একইসঙ্গে, এটাও বলব, অতীতের সকল আন্দোলনের মাত্রা ছাড়িয়ে আমাদের এই গণঅভ্যুত্থান দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচার কাঠামোর পতন যেমন ঘটিয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় ছাত্র-জনতা সেটা সহজে মেনে নেবে না।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!