Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একটি অসাবধানী প্রলাপ

অস্মিতা রায়

 

এক.

সমস্ত মধ্যবর্তী সংলাপ দিয়ে আজকাল আমার স্বপ্নের আসে যায়।

পাহাড়ের উপর লিখতে চাওয়া চিত্রকল্প ধরে এগোলে দেখা যায় পাখি, নদী ও স্থির কেউই নেই।

 

দুই.

কোথায় যেতে চাই মনে পড়ে না।

মনে পড়ার আগেই দেখি সেই ছোটকালের ঘরখানা ও তার ড্রয়ার। সেখানে সযত্নে তুলে রাখি টাকার ব্যাগ। তারপর লোকজন বেড়ে যায়। জমে ওঠে যাতায়াত।

হঠাৎই খোলা দরজা দিয়ে স্থিরদৃষ্টি নিয়ে যেতে আসতে দেখা যায় একটি সিংহকে। একেবারে বাইরের গেট পার করে সে ধীরে দুই পা তুলে তালা লাগিয়ে দেয় গেটে।

ঘরভর্তি লোকজনকে বলতে থাকি পালাও…

 

তিন.

পালিয়ে কোথায় যাব? যে ভূমি ক্রমশ গাছ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, যে খাল বুজে আসছে, যে পুকুরে মাছ কমে যাচ্ছে… সেই পৃথিবীতে পালিয়ে কোথায় যাব?

কিন্তু পালাতে হবেই। আমার ভালবাসা বিকিয়ে গেছে। আমার মফঃস্বল আজ উড়ালপুলের স্বপ্নে বিভোর। আমার মফস্বলে যদিও বর্ষা… যদিও ব্যাং ডাকে। যদিও আমার মফস্বলে কিছু কিছু উনুনে আঁচ পড়ে। বন্ধু বলে গেছে মানুষ চিরকাল এক ঠিকানায় থাকে না। আমি বারবার বরাবর ঠিকানা বদলাতে চেয়েছি… আবার চাইনি। আসলে মানুষমাত্রেই উদ্বাস্তু। ঠিকানাবদল শুধু ভুলভুলাইয়া… স্থির হতে পারিনি। প্রণয় আর প্রণয়ীর জন্য আমার মনের উচাটন বড় সাঙ্ঘাতিক। এও এক ভুলভুলাইয়া। আজ ভাবি ভাল থাকব। কাল ভাবি কেন থাকব। পরশু ভাবি কী ভাবি কূল পাই না… আঘাত আমাকে বিবশ করে দেয়। ফেলে আসা দশ বছর ভুলে গিয়ে নতুন করে ভাবি কী করব। ওজন ঝরাই। ভাল থাকার কথা ভাবি। ফুলদানি ভেঙে গেলে, ক্রমশ তুবড়ে যাই। মরা বেড়ালের মতো পড়ে থাকি। কে দেখে কে দেখে আর কে নিয়ে যাবে! যদিও আমি আর আমার মরা বন্ধু দুজনেই ডমেস্টিক্যালি চ্যালেঞ্জেড বলতাম একে অপরকে, আর হেসে গড়িয়ে পড়তাম। একদিন সে একটা জয়েন্ট লেখার কথা বলেছিল। আমি আর তুই বেশ গৃহবধূ হব। বরেরা বেরিয়ে গেলে রান্নাবান্না সেরে, ছাদে মেলব শাড়ি, মেয়ের জামা, সেলাই করা কুরুশের ঢাকনা। তারপর খেয়েদেয়ে, পান খেয়ে মেয়েলি ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাব। বৃষ্টির ঝড়ের শব্দে কাপড় তুলব আর বারান্দা থেকে রাস্তার লোকের ব্যস্ততা দেখব। খানিকটা চারুলতার দুপুরের মতো। আমারা এসব পারব না পারব না… আমরা তো ডমেস্টিক্যালি চ্যালেঞ্জেড!! এরপর আর কথা হয় না।

একদিন খবর পাই সে চলে গেছে। মরা নদী, গাংচিল পেরিয়ে যায় অপাই, উপর থেকে সে তুমুল হাসতে থাকে। আমার কান থেকে রক্ত পড়ে আর বলে যাই “চুপ কর! চুপ কর! তুই চুপ কর অপাই।”

রক্তপাতে রক্তপাতে সমস্ত হিমোগ্লোবিন জবাব দিয়ে দিয়েছে। মাথার তারে তারে জট। মন থাকে মাথায় যেখানে সেখানে ক্ষতর উপর ক্ষত।

নিউরোনে নিউরোনে সাড়া জাগে। এবার পালাতে হবে।

আমি স্বার্থপর হতে শিখি।

স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে একেবারে…

যদিও বন্ধু বলেছিল, মানুষ চিরকাল এক ঠিকানায় থাকে না।

 

চার.

অথচ মধ্যরাত্রে যেসব কান্নারা আসে তাদের আমি নিতান্ত বিষাদ বলে ছুড়ে ফেলে দিতে পারি না। পূর্ণবয়স্ক এক গাছ যেভাবে একে একে কদমফুলের জন্ম দেয়, তেমনই রাগ চেনায় অক্ষম আমার কান সমস্ত বিষাদের নাম মল্লার দ্যায়।

ঠিকানা বদল করবে না বলে যে চলে গেছে আমি তার অক্ষরে অক্ষরে হাত বুলাই আর পরিচিত মুখেরা আমাকে ছেড়ে যায়। আকাশ নির্লজ্জের মতো নীল হতে থাকে আর ফেনা তুলতে তুলতে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আসে আমার মন শরীর মুখ। তোমার শহর থেকে অনেক অনেক দূরে দক্ষিণে গেলে খনিক স্তিমিত হয়ে আসি। নিভে যাওয়া নিকোটিন জ্বলে জ্বলে ওঠে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমি ঘুমিয়ে পড়লে যদি শিয়ালের পাঞ্জা আমার মাথায় থাকা হৃদয়কে খুবলে খায়! এই ভয়ে আমি সারারাত বাদামগাছের পাতা গুনি। সকাল হলে কান, মাথা ঝিমঝিম করে। অবশ থেকে আরও অবশ হয়ে যাই। কিছুই মনে পড়ে না। শুধু মনে হয় দিদা বলত ‘কান মাথা গেছে।’ এই এক বাদে দিদার আর কিছুই মনে পড়ে না।

 

পাঁচ.

ভাগাড়ে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখি। দাগে ক্ষতবিক্ষত একটা সাদা মুখ। মায়া হয়। চোখের কাজল আঙুলে করে টেনে দিই। তারপর সেইসব পুরুষের কথা মনে পড়ে যারা কী অনায়াস ছেড়ে গেছে। একবারও দেখেনি ফিরে হৃদয়বিদারক চালচিত্রদের! আসলে তারপর থেকেই একটা এক টাকার কয়েনের মতো জীবন কাটাচ্ছি। মনের জায়গা মাথায় বলে শত তর্ক হয় ট্রেনে পাশে বসা ছেলেটির সঙ্গে। তারপর চলন্ত ট্রেনের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে কেমন ঘুমিয়ে যাই। আসলে ঘুম আসে না। আমি দশ বছর কড় গুনে গুনে মাপি। অকালবর্ষণে যখন মাঠ পুকুর ভেসে যায় ঠিক তক্ষুনি মহানিম কেটে দেয়। স্বপ্নে এদের প্রবল চড়থাপ্পড় দিই। চোরা গলি দিয়ে হাওয়া আসে, আমি ক্রমশ তলিয়ে তাই।

 

ছয়.

জনগণনার শেষে জানা গেল যেভাবে চলে যাব ভেবেছিলাম তা নিতান্তই মিথ্যে। যারা যারা আনন্দ পেয়েছিল, তাদের মাথায় আজ কদমফুল গোঁজা। কদমের পুংকেশর ওদের মাথায় বিঁধছে না? ওদের মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে না! কালো বর্ষাতি পরে সবাই পারে ভুরু এঁকে দিতে। মহানিম আর বুনো নদীর কথা মনে পড়ে যায় আজও। ভেবেছিলাম সিন্দুকে ভরে রাখা সব উড়িয়ে দিয়েছি— সব থেকে গেছে…!! যেমন আজ নামকরণের ভিড়ে তোমার তোমার তোমার নাম মনে পড়ে! আমি যেতে পারি না আমার একটা বর্ষাতি নেই বলে!!

আর থাকলেও অপাই মানা করেছে। তাই।