শুভদীপ ঘোষ
ঠাকুমার মুখ থেকে শোনা যে ওপার-বাংলার তৎকালীন উচ্চবর্ণের হিন্দু জোতদার-জমিদাররা গরিব মুসলমানদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাত। এর হাত থেকে রেহাই পেত না— এখন যাদের তফসিলি জাতিভুক্ত বলা হয়— সেই, তথাকথিত পিছিয়ে পড়া শ্রেণির গরিব মানুষগুলিও। ফলত ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াকে আলাদা-আলাদাভাবে চিনতে শেখার ব্যাপারটি উৎখাত ও চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত এই আলোচনাতেও আমি ভাগ করে নিতে চাই সাধ্যমতো। উৎখাত ও চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত এই আলোচনায় যে এক বা একাধিক ছবি নিয়ে আলোচনার কথা ভেবেছি, উৎখাত ব্যাপারটা সেখানে শিল্পের যাবতীয় শর্তকে অক্ষুণ্ণ রেখেই পরিবেশিত হয়েছে। এবং এর আবেদন দেশকালের ঊর্ধ্বে
স্থান থেকে স্থানচ্যুত হয়ে চিহ্ন ছেড়ে অন্য চিহ্নে গিয়ে…
—স্থান থেকে, জীবনানন্দ দাশ
স্বর্গত ঠাকুমার কাছে শুনেছি আমাদের আদি বাড়ি ছিল ঢাকায়। বলাবাহুল্য আমি নিজে ওপার থেকে এপারে আসিনি, এসেছিলেন আমার পিতামহরা। ঠাকুমার স্মৃতিপটে মাঝে-মাঝেই উঠে আসত গান্ধির একক দুঃসাহসিক নোয়াখালি অভিযানের কথা। আরও জানতে পারি সাতচল্লিশের মাঝামাঝি সময়ে আমার দাদু অবশেষে তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে ওপার-বাংলার ভিটে-মাটি ত্যাগ করেন কোনও এক মধ্যরাত্রে। শেষপর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ক্রমেই প্রাণনাশের হুমকি আসতে থাকায় বাধ্য হয়ে এক ভোরে সপরিবারে এসে ওঠেন উত্তর-কলকাতার মতিঝিল অঞ্চলে সুধাপিসিদের (দাদুর দুঃসম্পর্কের বোন) বাড়িতে। তারপর অন্য ইতিহাস। এও আমার ঠাকুমার মুখ থেকে শোনা যে ওপার-বাংলার তৎকালীন উচ্চবর্ণের হিন্দু জোতদার-জমিদাররা গরিব মুসলমানদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাত। এর হাত থেকে রেহাই পেত না— এখন যাদের তফসিলি জাতিভুক্ত বলা হয়— সেই, তথাকথিত পিছিয়ে পড়া শ্রেণির গরিব মানুষগুলিও।
ফলত ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াকে আলাদা-আলাদাভাবে চিনতে শেখার ব্যাপারটি উৎখাত ও চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত এই আলোচনাতেও আমি ভাগ করে নিতে চাই সাধ্যমতো। উৎখাত ও চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত এই আলোচনায় যে এক বা একাধিক ছবি নিয়ে আলোচনার কথা ভেবেছি, উৎখাত ব্যাপারটা সেখানে শিল্পের যাবতীয় শর্তকে অক্ষুণ্ণ রেখেই পরিবেশিত হয়েছে। এবং এর আবেদন দেশকালের ঊর্ধ্বে। কলকাতা থেকে অনতিদূরে ইছামতি নদীর ধারে টাকি নামক জায়গায় যাননি এরকম মানুষ হাতে গুণে পাওয়া যাবে। জায়গাটির বিশেষত্ব হল ইছামতির অপর পারটি খুলনা অর্থাৎ বাংলাদেশ। ঋত্বিক ঘটকের (১৯২৫-১৯৭৬) ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) ছবির বিয়োগচিহ্নের কথা আপনার মনে পড়বেই ওখানে গেলে। এপারের কত মানুষ দেশান্তরিত হয়েছিল, ওপারেরও। এই অঞ্চলটির স্থানমাহাত্ম্য আর যে স্মৃতিটিকে এক ধাক্কায় উসকে দেয় তাও একটি চলচ্চিত্রের স্মৃতি। যাঁরা গ্রিসের থিও অ্যাঞ্জেলোপোউলাস (১৯৩৫-২০১২)-এর দ্য সাসপেন্ডেড স্টেপ অব দ্য স্টর্ক (১৯৯১) দেখেছেন তাঁরা জানবেন এ-রকমই একটি নদী ছিল ওই ছবিটিতেও, যার এপারে এক দেশ ওপারে অন্য। ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এর তোয়াক্কা না করে সেখানে এপারের মানুষের সঙ্গে বিয়ে হত ওপারের মানুষীর।
উৎখাত বা স্থানচ্যুতিকে আমরা মূলত দু-ভাবে দেখতে পারি— শারীরিক এবং মানসিক। শারীরিক স্থানচ্যুতি আবার ঘটে থাকে মূলত দু-ভাবে— স্বেচ্ছায় এবং বাধ্য হয়ে। যিনি স্বেচ্ছায় স্থানত্যাগ করলেন এবং যিনি বলপূর্বক স্থানচ্যুত হলেন, উভয় ক্ষেত্রেই মানসিক স্থানচ্যুতি যে শারীরিক স্থানচ্যুতির পূর্বশর্ত, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অতএব মোদ্দা কথা উপরে-উপরে এই ভাগাভাগিগুলি আসলে ভেতরে-ভেতরে যথেষ্ট মেলামেশা করে। কার্ল মার্কস একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,
লক্ষণীয় রকমের একই জাতীয় ঘটনা কিন্তু বিভিন্ন ঐতিহাসিক পরিবেশে পুরোপুরি ভিন্ন ফলাফলের দিকে চলে যায়। এইসব বিবর্তনের প্রত্যেকটি আলাদাভাবে অনুধাবন করে তারপর সেগুলির মধ্যে তুলনা করে এই প্রক্রিয়াটিকে বোঝার চাবিকাঠিটি খুঁজে পাওয়া সহজ।
এখন দেশকালভেদে ফলাফল এক বা একধরনের হলেও কারণ যেরকম একই বা ভিন্ন হতে পারে, তেমনি পরবর্তীকালে সৃষ্ট শিল্পে কারণ-ফলাফলের প্রণিধানযোগ্য সময়ানুক্রমিক বিন্যাস সবক্ষেত্রে নাও ঘটে থাকতে পারে। উৎখাতের কারণ ও ফলাফলের প্রণিধানযোগ্য সময়ানুক্রমিক বিন্যাস আফগানিস্তানের পটভূমিতে তৈরি কন্দহর, ৯/১১ (স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি) এবং অ্যাট ফাইভ ইন দি আফটারনুন নামক তিনটি ছবিতে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে এ দাবি আমরা করছি। এই তিনটি ছবির প্রেক্ষাপট যেমন আফগানিস্তান, তেমনি এই আলোচনায় আমাদের কাজ হবে এই তিনটি ছবিকে প্রেক্ষাপটে রেখে ওই কালখণ্ডটিকে (মূলত উৎখাত সন্নিহিত রাজনীতি, ইতিহাস ও দর্শন) সাধ্যমতো নজরে নিয়ে আসা।
ইরানের প্রখ্যাত পরিচালক মহসেন মখমলবাফ (১৯৫৭-) ২০০১ সালে নির্মাণ করেন কন্দহর (২০০১) ছবিটি। স্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে যাওয়া একটি সম্পূর্ণ অবহেলিত দেশকে একজন সমাজ-সচেতন পরিচালক হিসেবে কেবলমাত্র সবার অনুধাবনে নিয়ে আসা নয়, নিজের দেশ ইরানের সঙ্গে ধর্মের বাইরেও ইতিহাসগতভাবেও যে বিশেষ সম্পর্ক আছে আফগানিস্তানের সে-কথা অন্যত্র জানতে পারি মখমলবাফ-এর কাছ থেকেই। কারণ আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে আফগানিস্তান ইরানের বৃহত্তর খোরসান প্রদেশের অংশ ছিল। তখন নাদির শাহের আমল। ইরানে যাওয়ার পথে ঘুচানে নাদির শাহ খুন হলেন। আফগান সেনাধ্যক্ষ আহমেদ আবদালি যে পৃথক ভূখণ্ডের স্বায়ত্তশাসন ঘোষণা করেন, তাই আজকের আফগানিস্তান। আমরা মখমলবাফ-এর জবানবন্দিতে এও জানতে পারি, কন্দহর-এর ব্যাপারে তিনি সচেতন হন একটি বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে—
One day a young Afgan woman, who has taken refuge in Canada, came to see me. She had just received a desperate letter from her friend who wanted to commit suicide because of the harsh conditions in Kandahar. She wanted to go back and help her friend at all cost. She asked me to go with her and film her journey.
সেই সময়ে এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীকালে মখমলবাফ গোপনে আফগানিস্তান যান এবং আফগান জীবন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর, বলা বাহুল্য, এই ঘটনাই কন্দহর চলচ্চিত্রের বিষয় করেন। ছবিতে উদ্বাস্তু এই আফগান মহিলার নাম দেওয়া হয় নফস্ (যার অর্থ স্বাধীনতা), যিনি একজন সাংবাদিক এবং বান্ধবীর স্থান নেয় ছোট বোন। একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন, সে-অর্থে বাস্তুহীন মানুষের মিছিল এ-ছবিতে সরাসরি বা বিশদভাবে অনুপস্থিত। এ-দাবি যথেষ্ট সঙ্গতও নয় কারণ কন্দহর দীর্ঘ দেশান্তরের উপর তোলা কোনও সাংবাদিকের সংবাদচিত্র নয়। এ-ছবি বরং অনেক বেশি করে একটি বিশেষ সময়ের দেশান্তরের অনুপুঙ্খ কারণ-চর্চা, যা বলার চাইতে দেখায় বেশি। মখমলবাফ-এর কন্দহর-এ দেশান্তর সামাজিকভাবে যে সময়ে স্থাপিত তার ইতিহাস মোটামুটিভাবে দু-দশকের। সত্তর দশকের শেষভাগে অর্থাৎ রাশিয়া যে সময়ে (১৯৭৯) আফগানিস্তান আগ্রাসন করে, অতঃপর আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধের সময়ে এবং পরিশেষে আমেরিকার আফগানিস্তান আক্রমণের সময়ে বড় ধরনের ‘এক্সুডাস’ হয় (যে আলোচনায় আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করব)। ছবিতে নফস্ তাঁর ছোট বোনকে বাঁচাতে রেড-ক্রস-এর হেলিকপ্টারে ইরান-আফগানিস্তান সীমান্ত গোপনে অতিক্রম করেন, কারণ আফগানিস্তান তাকে কন্দহর যাওয়ার ভিসা দেয়নি। এর পর আমরা নফস্-কে দেখতে পাই ইরানের একটি উদ্বাস্তু আফগান পরিবারের সঙ্গে কন্দহরের পথে। তালিবানরা মাঝরাস্তায় ওই পরিবারটির প্রায় সবকিছু ছিনিয়ে নিলে (মূলত যে সব জিনিস ব্যবহারে তাদের নিষেধাজ্ঞা আছে) তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আবার ইরানে ফিরে যায়। ছবিতে পরিষ্কার বলা না থাকলেও এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে এই পরিবারটি হয় সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়ে দেশত্যাগ করেছিল অথবা তালিবানদের বিরূদ্ধে গৃহযুদ্ধের সময়ে (যা এই ছবিরও প্রেক্ষাপট) দেশত্যাগ করেছিল।
দীর্ঘকাল ধরে ঘরে-বাইরে বিধ্বস্ত হওয়ার যে নজির আফগানিদের আছে তারও একটা ইতিহাস আছে। আহমেদ আবদালির (পাশতুন উপজাতি) আফগানিস্তানে আরও বিভিন্ন উপজাতি, যেমন, তাজিক, হাজারেহ, উজবেকরাও ছিল, যারা আবদালির স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়নি। ফলে প্রত্যেক উপজাতিই পরিচালিত হত তাদের স্ব-স্ব নেতা দ্বারা এবং এর ফলে আফগানিস্তান কোনওদিনই ‘নেশন স্টেট’ হয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭৯-তে সোভিয়েত রাশিয়ার আফগানিস্তান আগ্রাসনের পর আমেরিকার মদত পেত দেশের অভ্যন্তরে গজিয়ে ওঠা এইসব প্রতিরোধকারী উপজাতি জঙ্গি-গোষ্ঠীগুলি। ক্রমে রাশিয়া পিছু হটলে আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতায় কে আসবে এই নিয়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। অনেকের মতে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট তালিবরা, যারা পরবর্তীকালে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক-সামরিক দখলদার হলেন, তারা আসলে আহমেদ আবদালি যে পাশতুন কৌম উপজাতিভুক্ত ছিলেন, সেই উপজাতিরই মানুষ। এরাই অতীত থেকে অধিকাংশ সময় আফগানিস্তানে রাজত্ব করেছে। এখন এই তালিবানদের জারি করা ফতোয়াগুলি ছিল— মেয়েদের বোরখা পরতে হবে, পুরুষসঙ্গী ছাড়া তারা রাস্তাঘাটে বেরোতে পারবে না, মেয়েদের সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং ফোটোগ্রাফি-সঙ্গীত-চিত্রকলা নির্বিশেষে যে-কোনও শিল্পকলা আসলে অপবিত্র অতএব নিষিদ্ধ হবে। ছবিতে নফস্-কেও তাই বাধ্য হয়ে বোরখা পরতে হয়। যদিও প্রায় মোটিফের মতো মাঝেমাঝেই নফস্ বোরখা তুলে তাঁর মুখাবয়ব আমাদের দেখান! এ যেন নিজের সত্তাকে রি-অ্যাসার্ট করা কিংবা নিদেনপক্ষে যে শ্বাসরোধকারী বশবর্তিতার শিকার গোটা আফগানিস্তান তাকে প্রতীকীরূপে খানিক লাঘব করা। তালিবানদের ফতোয়া মেনেই ছবিতে নফস্-কে তাঁর যাত্রা-পথে সঙ্গ দেয় একাধিক পুরুষ। ছবির অবয়বে টুকরো-টুকরোভাবে ছড়িয়ে দেওয়া কিছু ঘটনা যেন কতকগুলি সমকেন্দ্রিক বৃত্ত। মাদ্রাসাগুলিতে ধর্মগ্রন্থ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে শৈশব থেকেই কৃপাণ ও বন্দুক ব্যবহারের তালিবানি প্রশিক্ষণ মনন-পরিসরে বিস্তৃতি পায় যখন কিশোর খাক মরুভূমিতে পরে থাকা একটি কঙ্কালের হাত থেকে আংটি খুলে ডলারের বিনিময়ে বেচে দিতে চায় নফস্-এর কাছে। অপর আরেক সমকেন্দ্রিক বৃত্তে রেডক্রসের হেলিকপ্টার থেকে পতিত ফানুসের ন্যায় কৃত্রিম প্রত্যঙ্গগুলির দিকে ছুটে যেতে দেখি অসংখ্য বিকলাঙ্গ আফগানিদের। প্রসঙ্গত উল্লেখ প্রয়োজন, নফস্ তাঁর যে বোনকে আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচাতে আফগানিস্তান যাচ্ছে সেও তার পা দুটি হারিয়েছে। আমাদের চকিতে মনে পড়ে যায় একটি আফগানি কিশোরী তার খেলনা পুতুলটার গায়ে পা দিয়ে দেশজুড়ে বসন্তের দাগের মতো ছড়িয়ে থাকা ল্যান্ডমাইনগুলির ব্যাপারে নফস্-কে সাবধান করে দিয়েছিল। ছবির শেষের দিকে একঝলক দেখতে পাই ইরানে দেশান্তরিত একদল আফগানিদের। এর ঠিক পরেই প্রেতমূর্তির মতো রং-বেরঙের বোরখাপরা মানুষের ঢল, পর্দা প্রায় ঢেকে ফেলে, এরা একে অপরকে সার্চ করছে। রঙের বিচিত্র সমাহারের মধ্যে অবরুদ্ধতার বৃত্ত, চিত্রভাষা এত জোরালো যে সংলাপের প্রয়োজনই হয় না। ন্যারেটলজি-হেমোটলজির তাত্ত্বিক বিতর্কে না গিয়েও একথা বলা যায়, যা সরাসরিভাবে অনুক্তই থেকে যায় বলে এ-ছবি একার্থে প্রোপাগান্ডা না হয়ে দেশান্তরকে তার সঠিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করার ছবি হয়ে ওঠে তা হল, এই দীর্ঘ টালমাটালের মধ্যে প্রায় পঁচিশ লক্ষ আফগানি গৃহযুদ্ধ ও ক্ষুধার তাড়নায় দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেয় ইরানে গিয়ে (এবং প্রায় তিরিশ লক্ষের মতো পাকিস্তানে গিয়ে)। যা বলপূর্বক স্থানচ্যুত করা (মোট জনসংখ্যার তিরিশ শতাংশ বা পঁয়ষট্টি লক্ষ) আফগানিদের সংখ্যার প্রায় চল্লিশ শতাংশ। ২০০১-এর মে মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ডেভিড ম্যাকনামারা আফগানিস্তান সম্পর্কে বলেছিলেন “fastest growing displacement crisis anywhere seen so far” (একই সঙ্গে এও বলেছিলেন যে আফগানিস্তানের বাহান্ন শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে), একই মাসে ‘মানবাধিকার সংস্থা’ থেকে একদল চিকিৎসক, তালিবানি নীতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন “one of the most deliberate forms of discrimination against women in recent history.”
বলা বাহুল্য, মখমলবাফ-এর কন্দহর সেই সময়ের দলিল যখনও পৃথিবীতে ‘গ্রাউন্ড জিরো’ শব্দটি পরবর্তীকালের অর্থ নিয়ে আবির্ভূত হয়নি। কন্দহর শেষ হয় মোটামুটি আগস্ট ২০০১ নাগাদ, ফলত স্বাভাবিকভাবেই তাতে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র কোনও ছাপ নেই। ৯/১১-র কিছু সময়ের মধ্যেই গোটা পৃথিবী বুঝে যায় যে আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করবে। যেখানে মখমলবাফ-কে পুসান চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর পরবর্তী ছবির বিষয় আফগানিস্তান শুনে প্রশ্ন করা হয় ‘আফগানিস্তান কী?’ সেখানে ‘গ্রাউন্ড জিরো’-পরবর্তী অধ্যায়ে এই দেশটিই হয়ে ওঠে তাবড় মিডিয়া-র আকর্ষণকেন্দ্র। ‘গ্রাউন্ড জিরো’ বিশ্বায়ন-প্রাপ্ত হয় বিশ্বজুড়ে তার ‘সরাসরি সম্প্রচার’-এর সুবাদে। কিন্তু আফগানিস্তানে যখন কমবেশি পঁয়ষট্টি লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং পঁচিশ লক্ষের মতো মানুষ কুড়ি বছরে যুদ্ধে বা অনাহারে মারা যায়, তখন তার কোনও ‘সরাসরি সম্প্রচার’ হয় না। তাই তালিবানি ফতোয়া চূড়ান্ত ক্ষমতার সিলমোহর পেয়ে যায় ওই দেশটির কাছ থেকে পাওয়ার মতো লাভজনক কিছুই নেই বলে। কিন্তু যা সূচ হয়ে এক দেশে ঢুকছে তাই যে ফাল হয়ে আরেক দেশে বেরোবে, তারই অন্য প্রতিকৃতি কন্দহর। একটি গুরুত্বহীন, ভুলে যাওয়া দেশকে বেশি করে মনে পড়ার আগাম ইঙ্গিত। সমিরা মখমলবাফ (১৯৮০-)-এর বয়ানে:
…9/11 proved that cinema can at times pre-empt television and satellite dishes in transmitting information…
মহসেন মখমলবাফ-এর বড় মেয়ে সমিরা। নিজের চিত্রনাট্যে ২০০২ সালে ৯/১১-র স্বল্প-দৈর্ঘ্যের গড, কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন অধ্যায় এবং বাবার ও নিজের যৌথ চিত্রনাট্যে ২০০৩ সালে অ্যাট ফাইভ ইন দি আফটারনুন নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি করেন সমিরা। দুটি ছবিরই প্রেক্ষাপট আফগানিস্তান। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র বাস্তব পটভূমিতে সমিরা আমাদের নিয়ে যান তাঁর ৯/১১: গড, কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন অধ্যায়ে। যুদ্ধ এখানে গৃহযুদ্ধ নয়, যুদ্ধ এখানে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ। মার্কিনিদের অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রর হাত থেকে নির্মীয়মাণ ইটের বাড়িগুলি যে দেশের মানুষকে বাঁচাতে পারবে না, এ-কথা বলতে শুনি একজন শিক্ষিকাকে। ইরানে দেশান্তরিত আফগানিরাও এ-ব্যাপারে অত্যন্ত শঙ্কিত এ-কথাও তাঁকে বলতে শুনি। আন্তঃরাষ্ট্রিক যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবেই বাস্তুচ্যুতি বা দেশান্তর এ-ছবিতে চিত্রিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি যে ইতালির প্রখ্যাত দার্শনিক তথা চিন্তাবিদ জর্জিও অ্যাগামবেন (১৯৪২-) একদা এ-মত ব্যক্ত করেছিলেন যে ৯/১১-র পর গোটা পৃথিবীটাই যেন রয়েছে একটা ‘ইমার্জেন্সি’-র মধ্যে। সমিরা-র ৯/১১: গড, কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন অধ্যায়ের আবহ অনেকটা সেইরকম। আসলে ১৯৭৯-র দ্বিমেরু বিশ্বে ঠান্ডা যুদ্ধ যেমন ছিল মার্কিনিদের কাছে পাল্টা ক্ষমতার প্রদর্শন, ২০০১-এর একমেরু বিশ্বে তা সম্পূর্ণ বল্গাহীন। অথচ কী আশ্চর্য, যে-ঘটনার জন্য মার্কিনিরা তালিবানদের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করতে এসেছে, সে-ব্যাপারে সমিরা-র ছবির আফগান শিশুগুলি কিছুই জানে না! বিশ্বায়নের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ সেখানে সঠিকভাবে না পৌঁছনোর দরুনই বোধহয় ৯/১১-য় নিহত মানুষগুলির প্রতি আফগান শিশুগুলি এক মিনিটও নীরব থাকতে পারে না। সমিরা-র এই দুর্ধর্ষ ‘মকারি’ অন্তিম পরিণতি পায় যখন শিশুগুলিকে শিক্ষিকাটি বাধ্য হয়ে টুইন টাওয়ারের-এর কাছাকাছি কোনও প্রতিরূপ হিসেবে ব্রিক ফারনেসটিকে দেখান। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ‘সরাসরি সম্প্রচার’-এ বিশ্বায়ন এটিকে যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত, অর্থাৎ টাওয়ারের মাথা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, এখানেও সমিরা হাই অ্যাঙ্গল-এ ব্রিক ফারনেসটিকে অনেকটা সেইভাবেই ধরেন। সেইজন্যই বলেন,
Basically radio, TV and satellites are the official voice of regimes and powerful authorities but cinema is the only broadcast medium where the author voices the spirit of nations without any tribune.
দেখানোর আধিক্য এ-ছবিতে বলার চেয়ে আরও বেশি। সমিরা প্রায় কিছুই বলেন না, কেবল দর্শকের মননে ধ্বংসপ্রাপ্ত উত্তর-আধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্কিটেকচার-টিকে(টুইন টাওয়ার) রেখে ছবিতে দৃশ্যায়িত করেন প্রাগাধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্কিটেকচার-টিকে (ব্রিক ফারনেস)। দুটি আর্কিটেকচার-ই স্ব-স্ব ইতিহাসকে বহন করে চূড়ান্ত বৈপরীত্যে অদ্ভুতভাবে সমসময়ের দলিল হয়ে ওঠে! আর এই জরুরি অবস্থায় ইরানে দেশান্তরিত আফগানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় দু-কোটির মতো এবং পাকিস্তানে প্রায় পাঁচ কোটির মতো। নোয়াম চমস্কি-র ভাষ্য থেকে জানতে পারি আফগান বিদ্রোহী আবদুল হক, যিনি আমেরিকার অত্যন্ত কাছের মানুষ এবং আশ্রিত রয়েছেন পাকিস্তানে, ‘কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ নামক একটি সংগঠন তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেয়। যাতে তিনি দাবি করেন যে, যেখানে তাঁরা নিজেরাই দেশের অভ্যন্তর থেকে তালিবানদের উৎখাত করতে পারেন সেখানে মার্কিনদের এই বোমাবাজি সেই প্রক্রিয়াকে যথেষ্ট ব্যাহত করছে। এই সাক্ষাৎকারটি অমেরিকায় ছাপা হয়নি, ছাপা হয়েছিল ইউরোপে। ২০০১-এর অক্টোবর নাগাদ পাকিস্তানে মার্কিন-আশ্রিত প্রায় এক হাজার আফগান নেতাকে নিয়ে একটি বৈঠক হয়, সেখানেও তাঁরা বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে একই মত ব্যক্ত করেন। ‘রিভল্যুশনারি অ্যাসোসিয়েশন অফ দি উইমেন’ বলে আফগানিস্তানের একটি নারী-সংগঠনও যুদ্ধ ও দেশান্তরকে একই সূত্রে গাঁথে।
অ্যাট ফাইভ ইন দি আফটারনুন-এর প্রেক্ষাপট তালিবান উৎখাতের পরের আফগানিস্তান। যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন এ-ছবির সময়কাল। ভিতরে বাইরে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত একটি রাষ্ট্রকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এ-ছবি। একদিকে তালিবানহীন আফগানিস্তানে এ সময়ে ধীরে-ধীরে উদারিকরণের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। বোরখা-প্রথা অনেক শিথিল হয়ে এসেছে, মেয়েদের স্কুলগুলিও আসতে আসতে খুলতে শুরু করেছে। এ-ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র নোকরেহ্ আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হওয়ারও পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে। দীর্ঘ অবরুদ্ধতার পর এই প্রথম আফগান কোনও নারী (নোকরেহ্) পাকিস্তান-ফেরত আফগান এক যুবককে হুকুম করে তাঁকে অনুসরণ না করতে। এ-ছবির একটা স্তরে যেমন আছে বাবা ও মেয়ের অনুকল্পে যথাক্রমে ঐতিহ্য (যেভাবে আছি, ঠিক আছি) ও আধুনিকতার (যেভাবে আমি থাকতে চাই) দ্বন্দ্ব, অপর আরেকটি স্তরে এ-ছবি বাস্তুচ্যুতি ও পুনর্বাসনের ভিন্ন এক সমস্যার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। বাস্তবিকই এই সময় প্রায় দশ লক্ষ আফগানি পুনর্বাসনের অনেক আশা নিয়ে অন্যদেশ থেকে আফগানিস্তানে ফিরে আসে। তাদের মধ্যে পাকিস্তান-ফেরত একদল আফগানিদের আমরা এ-ছবিতে দেখতে পাই। নোকরেহ্ ও তাঁর পরিবারটিকে নিয়ে এ-ছবির কাহিনি শুরু হয়ে এই অংশে তাদের সাধারণীকরণ ঘটে। গোটা দলটির সঙ্গে নোকরেহ্-কে যেন মনে হয় নির্বাসিত। অতঃপর বাস্তবিকই নোকরেহ্-রা তাদের শেলটার ছাড়তে বাধ্য হন গোটা দলটি সেখানে এসে উঠলে। কাহিনি আবার সাধারণ-কর্তৃক নির্দিষ্ট হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত বাস্তুভিটেগুলি স্বভাবতই পুনরায় বসবাস করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অযোগ্য। ফলে ফিরে আসা গৃহহীন মানুষজনেরা অনেকাংশে গৃহহীনই থেকে যায়, তাদের একাংশ পুনরায় দেশত্যাগ করে এবং আরেকাংশ স্থান নেয় ওই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বা রাস্তাঘাটে নোকরেহ-দের মতোই কোনওক্রমে। একে পানীয় জল এবং পুষ্টিকর খাদ্যের তীব্র অভাব, তার উপর ফিরে আসা মানুষের খাদ্য-পানীয়ের চাহিদা পরিস্থিতিকে আরও অসহনীয় করে তোলে। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে কিন্তু সমগোত্রীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জর্জিও আগামবেন তাঁর ‘উই রিফিউজি’ নামক প্রবন্ধে এক জায়গায় লিখেছিলেন,
From the beginning, many refugees who technically were not stateless preferred to become so rather than to return to their homeland (this is the case of Polish and Romanian Jews who were in France or Germany at the end of the war, or today of victim of political persecution as well as of those for whom returning to their homeland would mean the impossibilities of survival).
কন্দহর, ৯/১১ হয়ে অ্যাট ফাইভ ইন দ্য আফটারনুন কীভাবে যেন উদ্বাস্তুদের ‘স্টেটলেস’ হয়ে ওঠার আলেখ্য। আইন যে মানুষকে চেনে তা দেশীয় হোক বা আন্তর্জাতিক, এ যেন তার অতিরিক্ত সত্য কথা। আসলে মানুষের উচ্ছেদ তো শুধুমাত্র কতকগুলি মানুষের উচ্ছেদ নয়, এর শিকড় আরও গভীরে। এ একটি চলমান প্রক্রিয়াকে (তা যথেষ্ট পঙ্গু হলেও) জোর করে প্রকরণভেদে সম্পূর্ণ ধ্বস্ত করা। ফলে ফিরে আসা মানুষের কাছে নতুন করে জীবিকা নির্ধারণ, সাংস্কৃতিক পুনঃসংযোগ যেমন একটা বিরাট সমস্যা ঠিক তেমনই যেখানে ফিরে এল সেই অঞ্চলের মানুষের কাছে দৈনন্দিন দুর্বিষহ সমস্যাগুলো এতে গুণোত্তর প্রগতিতে বৃদ্ধি পায়। ছবিতে এক জায়গায় দেখি পূর্বে উল্লেখিত শেলটার থেকে বেরিয়ে পরিত্যক্ত ভাঙা একটি যুদ্ধবিমানে গিয়ে নোকরেহ্-দের আশ্রয় নিতে (পাকিস্তান-ফেরত দলটির যে কেউই হতে পারত এই অংশে নোকরেহ-দের প্রতিকল্পন)। অত্যাচারী ও অত্যাচারিতকে আবার সমকালীনতায় বাঁধেন সমিরা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। এই ভাঙা যুদ্ধবিমানটি একই সঙ্গে সীমাহীন দম্ভ ও নির্বিকল্প শূন্যতার প্রতীক। চতুর্দিকে তীব্র দুরবস্থার মধ্যেই নোকরেহ্-র দিদি নোকরেহ্-কে জানান তাঁর সদ্যোজাত সন্তানটির জন্য আর অবশিষ্ট নেই একফোঁটা মাতৃদুগ্ধও। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি রোমান পোলানস্কি (১৯৩৩-)-র দ্য পিয়ানিস্ট ছবিটির কথা। এ-ছবিতে প্লিম্যান যখন সন্তানসম্ভবা ডরোথা-কে জিজ্ঞেস করে “When your baby delivered?” তখন ডরোথা তার উত্তরে বলে “It is not a good time to have children.” পোলানস্কি-র ক্যামেরা অতঃপর সেই ছবিতে ডরোথা-কে অনুসরণ করেনি, কিন্তু স্থান ও কালের বিশাল ব্যবধান সত্ত্বেও ডরোথা-র এই উক্তিকে অপর আরেক অসুখী সময়ে প্রায় দৈববাণীর মতো মনে হয়। নোকরেহ্-রা এরপর ওই ভাঙা যুদ্ধবিমানটিও পরিত্যাগ করে। ছবির একাংশে টাঙ্গাগাড়িতে নোকরেহ্-দের গোটা পরিবারটিকে দেখতে পাই। উপরে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলিকে উড়ে যেতে দেখি চূড়ান্ত বৈপরীত্যে। সবকিছুই বড় বেদনার মতো বাজতে থাকে আমাদের মনে। খাদ্যাভাব ও প্রচণ্ড ঠান্ডায় সদ্যোজাত শিশুটি ধীরে ধীরে নিথর হয়ে আসে। মর্মস্পর্শী এই সমস্ত প্রতীকে অতিরিক্ত মাত্রা যুক্ত হয় যখন শিশুটিকে নিদেনপক্ষে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য টাঙ্গাগাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। মানবতার ক্রমবর্ধমান অবনমন পরিশেষে বাস্তবের দাবি মেনেই চূড়ান্ত রূপ পায় যখন শিশুটিকে শেষ পর্যন্ত আর বাঁচানো যায় না। প্রাণোচ্ছ্বল, সদাচঞ্চল, শব্দ-মুখর শৈশবের বিপরীতে মাতৃমুখে শিশুটির অস্তিত্ব ছাড়া নিজস্ব কোনও অস্তিত্ব (কি শিশুটির কান্নার শব্দে, কি শিশুটির মুখভঙ্গিতে) সমিরা তৈরি হতে দেন না। এমনকী, অতি-নাটকের ত্রিসীমানায় না গিয়ে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই প্রায় ভাবলেশহীনভাবে চিত্রায়িত করেন ভাঙা যুদ্ধবিমান পরিত্যাগ থেকে শিশুটিকে কবর দেওয়া পর্যন্ত গোটা সময়কালটিকে। ক্যামেরার পিছনে একজন কৃতি চলচ্চিত্রকারের বেদনাহত হৃদয়টিকে আমরা চিনে নিতে থাকি এ-ছবি দেখতে দেখতে। উল্লেখ প্রয়োজন যে,
An interim government was formed under the Bonn Agreement— a roadmap for peace, stability and democracy in Afghanistan – which was signed on 5 December 2001 at Bonn, Germany, by the Afghan military commanders, representatives of the former Afghan King, Zahir Shah and representatives of Afghanistan’s different ethnic groups.
—“Post 9/11 Afghanistan and the Regional Security Scenario” by Nasiha Gul
সমিরা এই তথ্যটি আমাদের বলেন না, বরং যা দেখান তাতে এই তথ্য অন্যসূত্রে জানা থাকলে সঙ্কটকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি) কাঠামোগুলির অসাড়তা আমাদের নতুন করে ভাবায়। মহসেন মখমলবাফ-এর কন্দহর-এ আমরা একজন ব্ল্যাক আমেরিকান মুসলমান চিকিৎসকের দেখা পাই। কথায়-কথায় জানান তিনি আফগানিস্তান এসেছিলেন ঈশ্বরের সন্ধানে। কখনও তাজিকদের হয়ে পাশতুনদের বিরুদ্ধে ঈশ্বর তাজিকদের সঙ্গে আছেন এ দাবি মেনে নিয়ে, কখনও পাশতুনদের হয়ে তাজিকদের বিরুদ্ধে ঈশ্বর পাশতুনদের সঙ্গে আছেন এ দাবি মেনে নিয়ে তিনি জারি রেখেছিলেন তাঁর এই অনুসন্ধান। অতঃপর একদিন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন অনাহারক্লিষ্ট দুটি শিশুকে, “One was Pasthoon, one was Tazik, then I understood that in search for god is in helping this people, heal the pains.” অনেক সমালোচকই এর মধ্যে পাশ্চাত্যের উত্তর-ঔপনিবেশিকতার লক্ষণ খুঁজে পান। কিন্তু আমরা একে সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখব না। বরং দেশভাগ, দেশান্তর, রাজনৈতিক উচ্ছেদ, যুদ্ধের মতো সঙ্কটেও যে মানুষের সভ্যতা থমকে থাকে না, হাজার বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করে জীবনকে বয়ে নিয়ে চলার যে আবহমান শাশ্বত প্রচেষ্টা তা জারি থাকে এ-জাতীয় বোধ কম-বেশি থেকে যায় বলেই বোধ হয়।
তথ্যসূত্র:
- Closeup: Hamid Dabashi (Publication: Verso)
- Image and Narrative (Online magazine of the visual narrative)
- ক্ষমতা ও সন্ত্রাস: নোয়াম চমস্কি (প্রকাশক: মনচাষা)
- আফগানিস্তান ট্র্যাজেডি: মোহসেন মখমলবাফ (প্রকাশক: জীতেন নন্দী, মন্থন সাময়িকী)
*২০০৮ সালে সিল্যুয়েট ম্যাগাজিন-এর ষষ্ঠ সংখ্যায় এই প্রবন্ধটির একটি আদিরূপ প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান প্রবন্ধটি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত।