Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলার বিকল্প সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকার সমস্বর

একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি

 

১ অক্টোবর ২০২৪ (মঙ্গলবার) কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) পশ্চিমবঙ্গের বারোটি জায়গায়, অর্থাৎ অভিজ্ঞান সরকার (অ্যাক্টিভিস্ট ও স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা), প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী (স্বাধীন সাংবাদিক), শিপ্রা চক্রবর্তী (অ্যাক্টিভিস্ট), সুদীপ্ত পাল (ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের নেতা), জয়ন্ত ঘোষ (অ্যাক্টিভিস্ট), সিদ্ধেশ্বর বিশ্বাস (কমিটি ফর দ্য রিলিজ অফ পলিটিকাল প্রিজনার্স সংগঠনের সদস্য), সোমনাথ বেরা (অ্যাক্টিভিস্ট), শুদ্ধসত্ত্ব রায় (ছাত্র অ্যাক্টিভিস্ট) এবং গৌর মজুমদার (অ্যাক্টিভিস্ট)-এর বাড়িতে হানা দেয়। এনআইএ-র রাঁচি শাখাকে এই হানায় সঙ্গ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিসের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্য একযোগে স্বাধীন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, শ্রমিক নেতা, ছাত্রদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে এঁরা রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক এবং দেশে অশান্তি সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন— এই অভিযোগে (এনআইএ-র বিবৃতি অনুযায়ী)। এ-যাত্রায় কাউকে গ্রেফতার না করা হলেও উপর্যুক্ত ব্যক্তিদের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, যাতে তাঁদের কাজকর্মে বাধা দেওয়া যায়। এনআইএ-র রাঁচি অফিসে তলব করাও হয়েছে। অভিযোগ কী? এঁরা নাকি সিপিআই (মাওবাদী) দলের সমর্থক এবং ২০২২ সালে উত্তর ও পূর্ব ভারতে অতি বাম মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্তে যুক্ত ছিলেন।

অভিযোগগুলি সত্যি না মিথ্যা সে প্রশ্ন অবান্তর। কারণ আমরা সাম্প্রতিক অতীতেই দেখেছি, রাষ্ট্র অপছন্দের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ খাড়া করলে তা প্রমাণ করতেও জানে। নরেন্দ্র মোদির প্রাণের বন্ধু বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দেশের স্পাইওয়্যার দিয়ে কীভাবে নজরদারি করা যায়, একজন মানুষের নিজের ফোনকে তার অজান্তে তারই বিরুদ্ধে কীভাবে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যায় সেসব এক দশকের মোদিশাসনে আমাদের ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে। ঠিক এক বছর আগে, এই অক্টোবর মাসের প্রথম মঙ্গলবারেই একাধিক স্বাধীন সাংবাদিক, নিউজক্লিক ওয়েবসাইটের সম্পাদক এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধানের বাড়িতে একইভাবে হানা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাঁদেরও ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিলেও শেষ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁদের বিরুদ্ধেও তোলা হয়েছিল গুরুতর দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। সে অভিযোগ আজ পর্যন্ত প্রমাণ করে উঠতে পারেনি রাষ্ট্র। এ থেকে অনুমান করা অন্যায় হবে না, যে কিছুদিনের মধ্যেই এবারে যাঁদের বাড়িতে হানা দেওয়া হয়েছে তাঁদেরও গ্রেফতার করার চেষ্টা হবে। অভিযোগ তো তৈরিই আছে। রাষ্ট্র যমালয়ে জীবন্ত মানুষ ছবির যমরাজেরই দোসর। তার নীতি হল ‘দোষ করুক বা না-ই করুক, ঘপ করে অ্যারেস্টো কর, জেলে তো পচুক। তারপর বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হলে একটু দুখখু প্রকাশ করে ছেড়ে দোব।’ অবশ্য উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম প্রমুখ সাক্ষী আছেন যে এ আমলে তাও শক্ত, কারণ জামিনের আবেদনের শুনানিই হয়ে ওঠে না। কখনও বিচারপতির সময় হয় না, কখনও বিচারপতি নিজেকে ওই মামলার বিচারে অপারগ বলে ঘোষণা করেন, কখনও আবার বিচারপতির বদলি হয়ে যায়। ফলে আবার গোড়া থেকে নতুন বিচারপতির এজলাসে বিচার শুরু করার আবেদন করতে হয়। এসব করতে করতে স্ট্যান স্বামীর মতো বৃদ্ধ, অশক্ত অভিযুক্ত বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ডও পেয়ে যান অনেক সময়।

মোদ্দা কথা, যাঁরাই রাষ্ট্রের অপছন্দের বয়ান দেন বা অপছন্দের কাজ করেন, প্রতিবাদ সংগঠিত করেন তাঁদের উপরেই যে-কোনও সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কোনও রাষ্ট্রীয় সংস্থা। উঠতে পারে মারাত্মক অভিযোগ। নিক্ষেপ করা হতে পারে কারান্তরালে। আমরা, পশ্চিমবঙ্গের বিকল্প সংবাদমাধ্যম, জনসমক্ষে রাষ্ট্রীয় বয়ানের বিকল্প বয়ান পেশ করার কাজটাই করে থাকি। অন্তত চেষ্টা করি। ফলে এই আক্রমণের পাল্লায় আমরাও যে-কোনওদিন এসে যেতে পারি। ফলে একবছর আগে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন, আমরা তাঁদের পাশে ছিলাম। আজও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে যাঁদের উপর রাষ্ট্রীয় হামলা হয়েছে, কাজ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তাঁদের পাশে আছি।

দিল্লি পুলিস যখন নিউজক্লিক তথা দিল্লির স্বাধীন সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল তখন দেশের প্রায় সমস্ত বিরোধী দলের নেতারা প্রতিবাদ করেছিলেন— একথা আমাদের মনে আছে। আশা করব, এবারেও একই ধরনের প্রতিবাদ হবে। তবে আমরা জানি, যে দলীয় স্বার্থ অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে কোনও দল প্রতিবাদ করে, কোনও দল করে না। যেমন আমরা আশা করছি না, যে জাতীয় স্তরের গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জি এক্ষেত্রে প্রতিবাদ জানাবেন, কারণ এই হানায় তাঁর পুলিসবাহিনিও যুক্ত ছিল। আমরা এও জানি যে পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজকর্মীরা সর্বভারতীয় দলগুলির কাছে দিল্লির একই কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সমান গুরুত্ব পান না। তাই আমরা নিজেরা প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং রাজ্যের সাধারণ মানুষ, যাঁরা আমাদের পাঠক এবং পাঠক নন, তাঁদেরও প্রতিবাদ করতে আহ্বান জানাচ্ছি।