মেসবাহউদ্দিন আহমেদ
নিজের শাসনকালে শেখ হাসিনা সরকার তিনটে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করেন। প্রকৃতপক্ষে এর সবগুলোই ছিল গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করে জোরপূর্বক তাঁর দলের ক্ষমতায় থাকা। নির্বাচন একটা দেখাতে হয় বটে, তার জন্য যখন যা প্রয়োজন সেসব পন্থা শেখ হাসিনা নিয়েছেন। বিরোধীদল বিএনপি কোনওভাবেই যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেসব ব্যবস্থা করেছেন। আর এইসব নির্বাচনের বিশ্বের কাছে কোনও গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও ভারত শেখ হাসিনার সরকারকে আগাগোড়া মদত দিয়েছে। ভারতের মদতের কারণেই তাঁর সরকার টিকে ছিল এবং নজিরবিহীন স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছিল। ফলে আজ বাংলাদেশের জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ অকারণ নয়
গত ৫ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার এক মাস পূর্ণ হল। ১৯৭৫ সালে আগস্টে শেখ মুজিবর রহমান নিহত ও দেশে সামরিক শাসন জারি হলে ইউরোপে অবস্থানরত দুই বোন শেখ হাসিনা ও রেহানা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন এবং তাঁরা বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৮১ সালে। শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০০৯ সালে এবং তখন থেকে জনরোষ থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আওয়ামি লিগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
নিজের শাসনকালে অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকার তিনটে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করেন। প্রকৃতপক্ষে এর সবগুলোই ছিল গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করে জোরপূর্বক তাঁর দলের ক্ষমতায় থাকা। নির্বাচন একটা দেখাতে হয় বটে, তার জন্য যখন যা প্রয়োজন সেসব পন্থা শেখ হাসিনা নিয়েছেন। বিরোধীদল বিএনপি কোনওভাবেই যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেসব ব্যবস্থা করেছেন। আর এইসব নির্বাচনের বিশ্বের কাছে কোনও গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও ভারত শেখ হাসিনার সরকারকে আগাগোড়া মদত দিয়েছে। ভারতের মদতের কারণেই তাঁর সরকার টিকে ছিল এবং নজিরবিহীন স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছিল। ফলে আজ বাংলাদেশের জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ অকারণ নয়।
আওয়ামি লিগ সরকার ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন করে তাদের দ্বারা গঠিত তাঁবেদার নির্বাচন কমিশন দিয়ে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। সঙ্গে ছিল তাদের মিত্র দল জামাত-এ-ইসলামিও। বাম ও অন্যান্য দলগুলোও সেই নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপি পথে নেমে নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করে। বিএনপি-র প্রায় আট হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়। মিটিং-মিছিল করতে দেওয়া হয় না। বিএনপি দেশে বন্ধের ডাক দেয়। মিটিং-মিছিল বা পিকেটিং যখন করতে দেওয়া হয় না তখন বিএনপি ভাঙচুরের আশ্রয় নেয়। বিরোধী দল যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না তখন নির্বাচন গণতান্ত্রিক তা দেখানোর জন্য একটি শিখণ্ডী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন পড়ে। জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সরকার নির্বাচনে যেতে বাধ্য করে। জেনারেল এরশাদ নির্বাচনে যাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনিও নির্বাচন চলাকালীন কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছিলেন। শেখ হাসিনা তখন জাতীয় পার্টির একটি অংশকে উৎকোচ ও প্রলোভন দেখিয়ে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করলেন। এরশাদ সাহেবকে নির্বাচনে আনার জন্য ঢাকায় ছুটে আসেন ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব সুজাতা সিং। তিনি এরশাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। সুজাতা সিং দিল্লি ফেরার পর জেনারেল এরশাদ প্রকাশ্যে বলেন, সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন তাঁকে বোঝাতে যেন তিনি নির্বাচনে যান। এরশাদ তখন ভঙ্গুর অবস্থায় ছিলেন। ১৯৯০-এ তাঁর সরকারের পতন হওয়ার পর তিনি পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর বিচার তখনও চলমান ছিল। এক দল সামরিক অফিসার এসে এরশাদকে তুলে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। নির্বাচনে আওয়ামি লিগের অধিকাংশ প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত দেখানো হল। নির্বাচনের পর যখন সরকার গঠন হল সেখানে জাতীয় পার্টির কয়েকজনকে মন্ত্রী করা হল এবং এরশাদ সাহেব হলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এই সংসদে সঠিক কোনও বিরোধী দল ছিল না। জাতীয় পার্টি সরকারের অংশ ছিল, আবার তারাই বিরোধী দলও।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আর্ন্তজাতিক মহলের চাপে বিএনপি ও অন্যান্য দল নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে তা নামেমাত্র। বিরোধী দলকে কোনওভাবেই গণতান্ত্রিকভাবে ভোটে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। ভোটের দিনের আগের রাতেই ব্যালটে বক্স ভরে ফেলা হয়েছিল। বিরোধী দলের কাউকে নির্বাচনকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। প্রার্থীদের যার যার বাসস্থানে রাতেই পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছিল। এই নির্বাচনের সমস্ত আয়োজন করে পুলিশবাহিনি। সংসদে প্রায় নব্বই শতাংশ আসন পায় আওয়ামি লিগ। ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে ২০২৩ সাল থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চলছিল একটি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন করানোর। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলারও চেষ্টা করছিল। কিন্তু প্রবল সরকারি নির্যাতনের মুখে তারা পেরে ওঠেনি। এমনিতেই এখনও এদের বিরাট সংখ্যক কর্মী কারাগারে নিক্ষিপ্ত এবং বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেষ্টা চালিয়েছিল যেন বাংলাদেশে একটা অন্তর্ভুক্ত (Inclusive) নির্বাচন হয়। সরকার যেন নমনীয় হয়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন বা র্যাব-এর শীর্ষকর্তাদের বিরুদ্ধে লাগাতার নির্যাতন ও গুম-খুন করার অভিযোগে আমেরিকান ভিসা বাতিল বা আমেরিকা গমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তারা আরও ঘোষণা দেয় যারা অগণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে বা যারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকবে তাদের উপর আমেরিকার ভিসানীতি কার্যকর করা হবে। আমেরিকা বাংলাদেশকে শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আগে যে বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে আসছিল তা বেশ কয়েক বছর থেকেই বন্ধ রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রমমান ও মানবাধিকারের উন্নয়নের একটা রোডম্যাপ দিয়ে রেখেছে। তারা বাংলাদেশকে রফতানিতে সুবিধা বন্ধ করেনি কিন্তু নবায়নও করেনি। যথাযথভাবে নির্বাচন না হলে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচন পর্যবেক্ষক টিম পাঠাবে না বলে জানায়। এমতাবস্থায় ভারত সরকার শেখ হাসিনার পাশে দাড়ায়। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী আবদুল মোমেন পশ্চিমের দেশসমূহকে বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে ভারতের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্ট ভারতের বিদেশমন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রের মিনিস্ট্রি অব স্টেটসের আলোচনা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। নির্বাচনের আগে যে চাপ ছিল শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি, ভারতের হস্তক্ষেপে তা ক্রমশ কমে গেল। নিশ্চয়ই ভারতের এই ‘সাহায্য’ বিনাস্বার্থে নয়। ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনার একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, ভারতকে যা দিয়েছি, সে তা সারাজীবন মনে রাখবে।
বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখানোর জন্য আওয়ামি লিগ তার অফিসিয়াল প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলের সদস্যরা নির্বাচন করতে পারবে বলে ঘোষণা দেয়। যদিও এটা ছিল দলের গঠনতন্ত্র-বিরোধী। তারপরও নির্বাচনে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। অনেক ভোটকেন্দ্রে সারাদিনে মাত্র দু-চারজনকে ভোট দিতে দেখা গেছে। আওয়ামি লিগের সমর্থক বা কর্মীরাও কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাননি। কেননা তাঁরা জানেন ভোটের ফল তাঁদের পক্ষেই যাবে। পরিশেষে ভোটের ফলাফলে দেখা যায় মাত্র ১৮ থেকে ৩০ শতাংশ লোক ভোট দিয়েছে। সরকারের মুখপাত্ররা বললেন, মানুষের এখন অনেক ব্যস্ত জীবন, তাই তারা ভোটকেন্দ্রে আসতে পারেননি। এই নির্বাচনকে বাংলাদেশের জনসাধারণ লোকদেখানো বা ডামি নির্বাচন বলে থাকেন। কারণ নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখানোর জন্য আওয়ামি লিগ থেকে একাধিক ডামি প্রার্থীকে দাঁড় করানো হয়েছিল৷
ভারত থেকে যেসব সাংবাদিকরা বাংলাদেশে এসেছিলেন, সরকার থেকে আদর আপ্যয়ন করেন, থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা করা হয়। তাদের দৃষ্টি ছিল ভোটকেন্দ্রে নয়, প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে নির্বাচন যে একটা হয়েছে, বিদেশি অবজার্ভারবিহীন এই নির্বাচন শেষমেশ যে হতে পারল, এটা ভারতের বিজয় হিসেবেই তাঁরা মনে করেছেন। বিদেশের কোনও পত্রিকাই ভারতের পত্রিকাগুলোর মতো রিপোর্ট করেনি। নির্বাচনে আওয়ামি লিগ অফিসিয়াল ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে প্রায় ৯০ শতাংশ আসন পায়।
ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বললেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ভারতের বিদেশনীতির জয়। এরপর তিনি মুম্বাইতে পররাষ্ট্র-বিষয়ের এক অ্যাকাডেমিতে বিদেশ-মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এক সেমিনারে বলেন, ভারত বাংলাদেশে স্থায়ী সরকার দেখতে চায়। আমি তখন চেন্নাইতে আন্তর্জাতিক বইমেলায়। দ্য হিন্দু-তে খবরটা পড়ে তখনই মনে হয়েছে যে জয়শঙ্করের উক্তিটি কূটনীতিকসূলভ ছিল না। অতি উৎসাহে কথাগুলো ভুলভাবে পরিবেশন করেছেন। তিনি আরও বলেছেন নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয়লাভে ভারত আরও কানেকটিভিটি পাবে অর্থাৎ যোগাযোগ সহজ হবে। এর ফলে উত্তর-পূর্বে যাতায়াতের সময় ও খরচ কমে আসবে। উত্তর-পূর্বের সাত বোনের মধ্যে ছয়টি রাজ্যের প্রভূত উন্নয়ন হবে, শিল্পায়ন সম্ভব হবে। এই বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষকে রাগান্বিত করে। নিজস্বার্থে প্রতিবেশী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র তথা সাধারণ মানুষের ভোটাধিকারকে ধুলিসাৎ করছে ভারত।
ভারতের উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিতে যোগাযোগের বাস্তবতা কী? ত্রিপুরার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সড়ক, রেল ও নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল প্রধান বিষয়। একসময় পশ্চিমবঙ্গ হয়ে মেঘালয় ও আসাম হয়ে ত্রিপুরায় মালপত্র যেত। এখন হয়েছে উল্টো। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরা হয়ে মিজোরাম, আসাম, মণিপুরে যাওয়ার দ্বার খুলবে। বাংলাদেশ হয়ে নদীপথ ব্যবহার করে ত্রিপুরা-সহ অন্যান্য রাজ্যে যাতায়াত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে তিনটি সড়কপথে ত্রিপুরার সংযোগের কাজ চলমান। চট্টগাম পোর্ট থেকে আগরতলায় মালামাল গমনাগমন এখন একটি সড়কপথে চালু থাকলেও আরও দুটি পথে শীঘ্র চালু হবে। ত্রিপুরা থেকে মিজোরাম, আসাম ও মণিপুরে মাল সহজে যেতে পারবে। অবশ্য এখনও পর্যন্ত এসব যোগাযোগ পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি ধীরগতিতে উন্নয়ন কাজ চলার জন্য।
বাংলাদেশের নির্বাচনের পরপরই শেখ হাসিনার ভারত সফরে একটি মেমোর্যান্ডাম অব আন্ডাস্ট্যান্ডিং বা মউ স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ সরকার এই মউ সম্পর্কে বিস্তারিত না জানালেও ভারতের বিদেশমন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় মেঘালয় ও আসাম থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে ট্রেন যাতায়াত করবে। এরপরই ঢাকাস্থ ভারতের দূতাবাসের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে সেসব স্থান পরিদর্শন করেন। এর সঙ্গে মুর্শিদাবাদ ও মালদহ থেকে বাংলাদেশের রাজশাহীর সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ করা হবে। এই ট্রেন-যোগাযোগ একসময় প্রসারিত করে কলকাতা পর্যন্ত হবে। সে যা-ই হোক, সেসব ভবিষ্যতের বিষয়। কিন্তু বাস্তব হল, ত্রিপুরার আগরতলা থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরত্বের বাংলাদেশের আখাউড়ার পর্যন্ত রেললাইনের কাজ এক দশক আগে শুরু হলেও এখনও পর্যন্ত সমাপ্ত হয়নি। আমার মাঝেমধ্যেই আগরতলা যাওয়া হয়, আমি দেখেছি এক রেললাইন নির্মাণ ও আগরতলা ট্রেনস্টেশন তৈরির অতি ধীরগতি। আমি এমনও দেখেছি কোনও কাজই হচ্ছে না, পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে নির্মাণাধীন রেললাইন। কয়েক মাইল গিয়েও কোথাও কাজ হচ্ছে বলে মনে হল না। যখন কেন্দ্র (দিল্লি) থেকে অর্থ আসে তখন কিছুদিন কাজ হয়, তারপর আবার বন্ধ হয়ে যায়, ত্রিপুরার মন্ত্রীরাও আমাকে এমনটাই বলেছেন। অথচ এই ট্রেনলাইন কার্যত উদ্বোধনও হয়ে গেছে, ট্রায়াল মালবাহী ট্রেনও চলেছে। গত মার্চ মাসে জেনেছি এখনও সিগন্যাল কেবল লাগানোর কাজ বাকি রয়েছে। বাকি রয়েছে আগরতলা রেলওয়ে স্টেশনের বিভিন্ন কাজ। বাকি রয়েছে গুদাম নির্মাণ, কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। এখনও বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত দিয়ে সকল যাতায়াতের পথে ইমিগ্রেশনের নেটওয়ার্কিং তৈরি হয়নি ফলে সড়কপথে বেনাপোল ও আগরতলা ছাড়া একজন যাত্রী যে সীমান্ত পথে ভারতে প্রবেশ করেন সেই পথেই তাঁকে ফিরে আসতে হয়। মান্ধাতা আমলের ব্যবস্থা।
আমি বাংলাদেশের অফিসিয়ালদের জিজ্ঞেস করেছি, কেন এই কাজে এত দেরি হচ্ছে? কেন ঐকমত্য হয়ে দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো সমাপ্ত করা হয় না। তাদের ইঙ্গিত ছিল দিল্লির দিকে। যখন ভারতের কোনও মন্ত্রী বা বড় কর্মকর্তা ঢাকায় আসেন, তার কয়েকদিন আগে দিল্লির তৎপরতা শুরু হয়, চিঠিপত্র চালাচালি হয়। তারপর তারা সব ভুলে যায়। একাধিক কর্মকর্তা আমাকে এই কথাই বলেছেন। তাঁরা আরও বলেছেন যে উদ্যোগ বা প্রকল্পে ভারতের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকে সেগুলো অবশ্য দ্রুত হয়। এখন প্রশ্ন গত পনেরো বছরে পাঁচ কিলোমিটার সংযোগ রেলপথ স্থাপন না-করার বা তিস্তা-সহ অন্যান্য পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ধীরগতির মাশুল কি বাংলাদেশের মানুষ দেবে তাঁদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের বিনিময়ে! না, দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ এই অবস্থা মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনের মাত্র মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের গত জানুয়ারিতে করা দাম্ভিক উক্তির জবাব দিয়েছে শেখ হাসিনাকে পত্রপাঠ ভারতে পাঠিয়ে। আগামী দিনে সকলের নজর থাকবে নতুন সরকারের ওপর। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পর্যালোচনার সময় বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের প্রতি তারা দায়বদ্ধতা থাকেন কিনা, সেটাই দেখার।