Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ

কবিতাগুচ্ছ

 

 

১.

সারি সারি রক্তমাখা হাত
ঘুমের ভিতর এপাশ-ওপাশ ফেরে
সঙ্গী শুধু বালিশভেজা রাত
মেয়ে গেছে মায়ের আঁচল ছেড়ে।

মারল কারা মারল কারা চেনে
শহর জুড়ে চোখরাঙানো লোক।
বিপদ হবে বিপদ হবে মেনেও
জেগে উঠল শতকণ্ঠে শোক।

গোপন ব্যথা আগুন হলে জানি
একলা হয়েও দমের হয় জয়,
স্মৃতির উপর মায়ার চাদরখানি
মিটিয়ে দেয় অজানা সব ভয়।

তারা হয়ে গোটা আকাশ জুড়ে
মৃতরা সব অনন্তকাল বাঁচে,
একটা মেয়েই সবার মেয়ে হয়ে,
স্তব্ধ হয়ে থাকে বুকের আঁচে।

একটা মেয়ে দুর্গা যদি হয়
একই মেয়ে কালী হতে পারে,
করতে পারে ধ্বংস সৃষ্টি জয়,
সৃষ্টি যাকে স্রষ্টা মনে করে।

 

২.

যে সব মাঠেরা বীজ বোনার অপেক্ষায় থাকে।
শরীর ভিজিয়ে থৈ থৈ কামনায়,
অপেক্ষা করতে করতে
বর্ষা পার করে ফেলে—
তাদের শরীরেও কিছু ঘাস জন্মায়…
পাথরও তেমন করে ভিজলে
সবুজ জন্মায় ভাঁজে ভাঁজে।
আসলে কোনও ভিজে মাটিই বীজের অপেক্ষায় বন্ধ্যা হয় না।

 

৩.

বর্ষা এলে ধানে ভরা মাঠ স্বপ্ন দেখে
সাদা কাশেরা ফুটবে বলে
বেশি বেশি ভেজে।
নতুন শস্যের স্বাদ
আমাদেরও দেহকোষে মেশে।
বর্ষা এলে সবাই নতুন হয়…

আমদের কিছু কিছু দিন
তেমনই বর্ষা হয়ে যায়।
তারপর…
একটা বনের
নদীর দিকে ঝুঁকে থাকার মতো।
একটা পথের,
মাঠের ভিতর নেমে যাওয়ার মতো
অপেক্ষারা ঝুঁকে ঝুঁকে থেকে যায় দিনের উপর।

সেইসব দিনেরাই শরীরে নতুন শস্যের স্বাদ ছড়াতে পারে
যারা বর্ষা হতে পারে।
যারা শীতের কুয়াশার মতো
মাঠ ছেড়ে যাবে না বলে সূর্যকেও
অপেক্ষা করাতে পারে।

 

৪.

ঘন শ্রাবণ সন্ধেয়,
মরে আসা আলো-আঁধারিতে
‘লক্ষ্মী পাঁচালি’ পড়ছিল সর্বজয়া।
আধছেঁড়া কম্বলের আসনে গুটিসুটি বসে ছিল দুর্গা।
ছোট হওয়া জামার ঝুলে ঢাকা পড়েনি দুর্গার ঊরু।
সেই নরম ঊরুর উপর,
প্রদীপের আলোছায়ায়
একটা অরণ্য জেগেছিল যেন।
কখন কে জানে পাঁচালির সুর বেয়ে
একটা সাপ উঠছিল, অরণ্যের ভিতর।
মা বলেছিল তাকে,
তার মাও নাকি বলেছিল তাকে,
পাঁচালি শুনতে হয় স্থির হয়ে।
লক্ষ্মীকে ধারণ করা সহজ নয় জেনো।
তারপর যতবার দুর্গার শরীরে জেগে উঠেছে সাপ,
ততবার লক্ষ্মী হয়েছে মনে মনে।
অথচ দুর্গা জানে,
কী করে সাপের মাথা নিমেষে ধরে ফেলে, খেলতে হয় হাতের মুঠোয়।
কীভাবে ওদের বিষদাঁত ভেঙে,
জড়িয়ে নিতে হয় খোঁপার চুলে।

 

৫.

পড়ন্ত বিকেলে, কনে দেখা আলো মাখতে মাখতে,
মেয়েটি ভাবে, মায়ের কথা
অথবা তার মায়ের, মায়ের কথা—
যারা বলেছিল, হাতের রেখায় নাকি লেখা থাকে মেয়েদের জীবন,
জীবনের ফসল, ফসলের আয়ু।
তারপর এ-পথ ও-পথ ঘুরতে ঘুরতে বুঝেছে সে,
সব গন্তব্যের শেষে আলো থাকে না জেনো।
সব ফসলের গায়ে লেখা থাকে না দীর্ঘ দীর্ঘ আয়ু।
আমাদের পথ, ও-পথের রেখার ভিতর
অপেক্ষারা বন্ধ্যা ভূমির মতো দাঁড়িয়ে থাকে একা।
আমাদের হাত ও হাতের রেখায়
ক্ষতরা অজস্র কাটাকুটি রেখে যায় সময়ে সময়ে।
আমাদের হাতের ভিতর
অনন্ত অন্ধকার বসে থাকে ঘাপটি মেরে।
সব পথ গন্তব্য শেষে সূর্যের মতো,
মায়া-আলো দিতে পারে না জেনো।
তবুও আমাদের মায়েরা তারও মায়েরা
জানে, কীভাবে জমে ওঠা ক্ষতদের,
হাতের কাটাকুটির ভিতর একটা দিঘি করে রাখতে হয়।
কীভাবে পথের জমা অন্ধকারকে
ডুবিয়ে রাখতে হয় সেই দিঘির ভিতর।
সমস্ত মায়েরাই আসলে হাতের রেখার জীবন,
জীবনের ফসল ও ফসলের উপর আলো হয়ে যেতে পারে।
যেমন মৃত পুরুষ নিয়ে, অন্ধকার নিয়ে, বেহুলারা যুগে যুগে ভেসে যায় আলো হয়ে।

 

৬.

দিনগুলো ছিল ওলটপালট করা
সময়ে তখন বন্ধ চোখের ঘোর
ঝড়ের মতো উড়ে যাওয়া ছিল শুধু
হৃদয় ছিল উৎসবে উৎরোল।

ভাবনাবিহীন স্রোতের মতো চলা
সঞ্চয় ছিল অমলিন বিশ্বাস।
তখনও তো জিভ রক্ত পাইনি ঠোঁটে,
বিকশিত ছিল অভিভূত আশ্বাস।

সময় গড়ালে সোনা খাঁটি হয় জানি
তবুও আমরা সময়ের আগে ছুটি।
ষড়যন্ত্র ঘাপটি মেরেই থাকে
রঙিন চোখেই আঁধার সাজায় ঘুঁটি।

তারপর সেই আঁধার হওয়া দিনে
মীমাংসাহীন উত্তর খুঁজে ফেরা।
আঘাতে আঘাত পাল্টা আঘাত দিতে
অনাগত কাল রণক্ষেত্র করা।

সময় গড়ালে কোলাহল কিছু কমে
গুপ্ত আঘাত বহন করে ক্ষয়।
সব ক্ষতরাই দিনযাপনের ভাঁজে
রেখে দেয় কিছু আজানা সংশয়।

রক্তে যখন গোপন বেদনা মেশে,
রক্ষাকবচ বেঁধে দেয় ভুল বেলা,
ব্যথারা তখন অধরা মাধুরী হয়
শূন্য হলেও চোখ রাখা থাকে মেলা।