Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শেখ হাসিনার ভুলে প্রগতিশীল রাজনীতি আক্রান্ত বাংলাদেশে

বুদ্ধদেব ঘোষ

 


বর্তমানে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের পরিস্থিতিও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বিরামহীনভাবে ঘটে চলেছে। এখন কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারকে দোষারোপের কোনও সুযোগ নেই। রাষ্ট্র সংস্কার করে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন ফেরি করেছেন প্রফেসর ইউনুস থেকে শুরু করে ছাত্র সমন্বয়করা। ভাঙার কথা ছিল দুর্নীতির সিন্ডিকেট। ভাঙছে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি রোডে শেখ মুজিবের বাড়ি, যা কিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। ভাঙছে স়ংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ভাঙছে অলি-আউলিয়া সুফিদের মাজার। মুখে বলা হচ্ছে ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ। কিন্তু অস্থায়ী সরকার গড়ার সময় যে বামপন্থী পার্টিগুলো আন্দোলনে তুমুল ভূমিকা নিয়েছিল, তারা আলোচনাতে ডাক পায়নি। আর হেফাজত ইসলাম রাজনৈতিক দল না-হওয়া সত্ত্বেও সরকারে স্থান পেয়ে গেছে

 

২০২৪-এর জুন থেকে ৫ আগস্ট— এই দুই মাসের কোটাবিরোধী রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলনে পতন ঘটল দীর্ঘ পনেরো বছর শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা শেখ হাসিনা সরকারের। গোটা উপমহাদেশ বিস্মিত। বঙ্গবন্ধু যিনি পদ্মাপারের দেশের কিনা জাতির পিতা, তাঁর কন্যার এই মর্মান্তিক পরিণতি কীভাবে সম্ভব হল? দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিএনপি এবং জামায়েত ইসলামিকে যিনি বোতলবন্দি করে ফেলেছিলেন, সেখানে কতকগুলো পুঁচকে ছেলেমেয়ে কী করে এই অসাধ্যসাধন করল, এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। এ এক অভিনব গণঅভ্যুত্থান। রাজনীতির ব্যাকরণের সঙ্গে যার অনেকটাই মিল নেই!

প্রথমেই বলে রাখা ভাল, এই পটপরিবর্তনকে বদরুদ্দীন উমরের মতো অনেকেই বিপ্লব বলে মানতে চাননি। সঙ্গত কারণেই। একটি বৈপ্লবিক মতাদর্শকে সামনে রেখে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমূল সমাজ রূপান্তরের যে কর্মকাণ্ড, সোশ্যাল সায়েন্সে, তাকেই তো বিপ্লব বলি আমরা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে প্রত্যেক বিপ্লবে একটা রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু সমস্ত অভ্যুত্থানই বিপ্লব নয়।

কূটকচাল ছেড়ে মূল প্রশ্নে আসা যাক। এই অভ্যুত্থানের একটা প্রেক্ষাপট আওয়ামি লিগ তথা শেখ হাসিনা নিজেই তৈরি করেছিলেন। পরপর দুইবার হাস্যকর এবং অগ্রহণযোগ্য পাতানো ভোট করা অর্থাৎ রিগিং, মূল্যবৃদ্ধি, মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ স়ংবাদমাধ্যমের ওপর লাগাতার আক্রমণ, বিরোধী রাজনীতির উপর দমনপীড়ন, সীমাহীন দুর্নীতি— ধীরে ধীরে একটা সর্বব্যাপী সরকারবিরোধী মনোভাব তৈরি করেছিল। এ সবই তাঁর স্বৈরাচারী রাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে তীব্র বিদ্বেষ তৈরি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে উদারনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বুর্জোয়া রাজনীতির প্র্যাকটিস থেকেও আওয়ামি লিগ ক্রমশ দূরে, আরও দূরে সরে যাচ্ছিল। এই সার্বিক নেতিবাচক রাজনীতির প্রেক্ষাপটের মধ্যে কোভিড মহামারি এবং অর্থনৈতিকভাবে সঙ্কটাপন্ন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পরাশক্তিগুলির অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের ফল ভুগতে হয়েছে শেখ হাসিনার সরকারকে।

কোভিড ছোট দেশগুলিতে অর্থনৈতিক আঘাত হেনেছিল। তার মধ্যে তথাকথিত মেগা প্রোজেক্টগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার আন্তর্জাতিক চাপ তো ছিলই। দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর অবস্থাও ছিল সঙ্গিন। এদিক থেকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের মিল আছে। কিন্তু বাংলাদেশকে ঘিরে বিভিন্ন শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে মারাত্মক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চিন, পাকিস্তান— এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে ঘিরে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলেও শেষরক্ষা করতে পারলেন না। বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত সহায়তা এবং বিনিয়োগের প্রশ্নে চিনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমনৈকট্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছিল। ঠিক যেমন মায়ানমারের সঙ্গে চিনের ঘনিষ্ঠতাও তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছিল। চট্টগ্রামের কাছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের জন্য তাদের চাপ অব্যাহত থাকে। এই চাপকে এতদিন অগ্রাহ্য করেছেন মুজিবকন্যা, ভারতের ভরসায়। এই সরকারকে ফেলার ব্লুপ্রিন্ট ৫/৬ বছর আগেই করে ফেলেছিল বিশ্বের বৃহত্তম পরাশক্তি। চিনকে চাপে রাখার জন্য ভারত যেহেতু আমেরিকার স্ট্রাটেজিক পার্টনার, তাই আগের নির্বাচন পর্যন্ত ভারতের অনুরোধে ঢোক গিলতে হয়েছিল আমেরিকাকে। এবারে আমেরিকা ভারতের মাধ্যমে নয়, সরাসরি নিজেই আসরে নেমেছিল শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করতে। বাইরের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কোনও বিকল্প নেই। ঐক্যবদ্ধ রাখতে গেলে গণতন্ত্রের শিকড় তৃণমূল স্তর পর্যন্ত বিকশিত করার যে স্টেটসম্যানশিপ দরকার ছিল, শেখ হাসিনা সেই বিষয়ে গুরুতর ত্রুটির পরিচয় দিয়েছেন। খালেদা জিয়া এবং বিএনপির রাজনীতি তাঁর যতই অপছন্দ হোক, একজন গুরুতর অসুস্থ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে বারেবারে কারাগারে নিক্ষেপ করা শুধু নীতি হিসেবে নিকৃষ্ট ও অমানবিকই নয়, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও ভুল। এই অগণতান্ত্রিক, দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে কোটাবিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠল, বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে। বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপরতা শুরু করল। মৌলবাদী শক্তিগুলি সমস্ত শক্তি নিয়ে মাঠে নামল। এদিকে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে তীব্র বেকারত্বের সমস্যা। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে চাকরিতে ৩০ শতা়ংশ কোটার যারা সংস্থান রাখে, রাজনৈতিকভাবে তারা মুর্খই। স্বভাবতই এই আন্দোলন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সম্পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল। শুধু তাই নয় নানা অনাচারে হাঁফিয়ে ওঠা মানুষ সবাই রাস্তায় নেমেছিল এই আন্দোলনের সমর্থনে। আন্দোলন দমন করতে সরকারের দমনপীড়ন, নির্বিচারে গুলিচালনা ছিল মর্মান্তিক ও চূড়ান্ত স্বৈরাচার। বোঝাই গেছে, গুলিচালনা ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক কৌশল ভাবার মতো দূরদর্শিতা সরকারের কাছে অবশিষ্ট ছিল না। দীর্ঘদিন রাজনীতিবিচ্ছিন্ন হয়ে থেকে কার্যত আইনশৃঙ্খলা বাহিনির উপর ভর করে সরকার চালানোর জন্য এই পরিণতিই হয়তো-বা অপেক্ষা করেছিল শেখ হাসিনার জন্য।

কিন্তু বর্তমানে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের পরিস্থিতিও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বিরামহীনভাবে ঘটে চলেছে। এখন কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারকে দোষারোপের কোনও সুযোগ নেই। রাষ্ট্র সংস্কার করে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন ফেরি করেছেন প্রফেসর ইউনুস থেকে শুরু করে ছাত্র সমন্বয়করা। ভাঙার কথা ছিল দুর্নীতির সিন্ডিকেট। ভাঙছে ৩২ নম্বর ধানমন্ডি রোডে শেখ মুজিবের বাড়ি, যা কিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। ভাঙছে স়ংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ভাঙছে অলি-আউলিয়া সুফিদের মাজার। এই অলি-আউলিয়া দরবেশদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে ইসলামের বিস্তার হয়েছিল। আজগর আলি ইঞ্জিনিয়ারি বাংলার ইসলামের এই ধরনকে ‘folk form of islam’ বলেছেন। এমনকি পাকিস্তান আমলেও এই চিশতিয়া, মাইজভান্ডারি-সহ বিবিধ সুফি মাজারগুলো কখনও ভাঙা হয়নি। মুখে বলা হচ্ছে ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ। কিন্তু অস্থায়ী সরকার গড়ার সময় যে বামপন্থী পার্টিগুলো আন্দোলনে তুমুল ভূমিকা নিয়েছিল, তারা আলোচনাতে ডাক পায়নি। আর হেফাজত ইসলাম রাজনৈতিক দল না-হওয়া সত্ত্বেও সরকারে স্থান পেয়ে গেছে। আর জামাতে ইসলাম ডাক পেলেও দল গোছানোর স্বার্থে মন্ত্রিসভায় যায়নি। এই সরকারে পশ্চিমাদের ফান্ডে চলে এরকম সাত-সাতটা এনজিও-র কর্তাব্যক্তিরা আছেন। আর জামাত-ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ আছে। হেফাজত ইসলাম আছে। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদত্যাগ করানো হল চাপ প্রয়োগ করে। ১৭৫ জন প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। পদত্যাগের সময় জুতোর মালা পরানো, মারধরের ঘটনাও অহরহ হচ্ছে।

আওয়ামি লিগের এমপি গাজি টায়ারের মালিক। শুধু এই কারণে আমরা দেখলাম গাজি টায়ারে আগুন দিয়ে ১৭৫ জনকে জীবন্ত হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই শ্রমিক। জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের লেখা। তাই জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ পাল্টানোর দাবি উঠেছে। হায় বাঙালি! একদিন পাকিস্তানিরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিল। গর্জে উঠেছিল বীর বাঙালি। সব মৌলবাদের এক রা। ভারতেও সঙ্ঘ পরিবারের হাতে রবীন্দ্রনাথ আক্রান্ত। নতুন সরকার বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করতে চায় (স়ংশোধন নয়)। অথচ এই সংবিধানের নামেই রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। একজন মুখ্য ছাত্র সমন্বয়কের বক্তব্য শুনলাম। তাঁর বক্তব্য— ব্যক্তিগতভাবে সেকুলার থাকব। কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেকুলারিস্ট হব না। গ্লোবাল আইডেন্টিটি হবে ইসলাম। সেখানে স়ংখ্যালঘুদের দেখে রাখা হবে, যাতে তারা আক্রান্ত না হয়। বলা বাহুল্য অত্যন্ত বিপজ্জনক আগ্রাসী ও কর্তৃত্ববাদী ধারণা। ভারতের সঙ্ঘ পরিবারের একই ন্যারেটিভ। শুধু কোম্পানি আলাদা। তারা বলে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হলে স়ংখ্যালঘুরা নিরাপদে থাকবেন। ছদ্ম সেকুলারিস্টরা তাদের নিয়ে অহেতুক এতকাল রাজনীতি করেছে। বাংলাদেশের এইসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে একটা সিগনেচার আছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা প্রায় করায়ত্ত করেছে। এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী। মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় ইতিহাসকে আওয়ামি লিগ একা আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল। মওলানা ভাসানি, মনি সিংহ, সিরাজ শিকদার, হায়দার আকবর খান রনো— এই ধারার কাউকে সেই ইতিহাসে স্থান দেওয়া হয়নি। আবার বাম ঘরানার অনেককে বলতে শুনি শেখ মুজিবের মুক্তিযুদ্ধে অবদান নেই। যে মানুষটা পাকিস্তানের কারাগারে ১৪ বছর ছিলেন, যাঁর ঘোষণায় উদ্বেলিত হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে গেছে, এমনকি ফাঁসির বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল প্রায়, ইতিহাস থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া বাংলাদেশকে অস্বীকার করার সামিল। একই সঙ্গে জিয়াউর রহমানও যুদ্ধ করেছেন, এই স্বীকৃতি দিতে হবে। আজ যখন দেখি রাশেদ খান মেননের মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে মারতে মারতে আদালতে তোলা হচ্ছে, তখন গণতন্ত্র লজ্জিত হয়। দীপু মনি, হাসানুল হক ইনু— তাঁদের সঙ্গে ঘটা বর্বরতাও ভাল লাগেনি।

রাজনীতি আসলে “battle of ideas”, ন্যারেটিভের সঙ্গে ন্যারেটিভের লড়াই। এত দ্রুত ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাভাবনা চাপানোর চেষ্টা চলছে যে, মনে হয় আওয়ামি লিগের অপরাধগুলি দ্রুত চাপা পড়ে যাবে। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষ বিকল্পের সন্ধান করবেই। বামপন্থীরা অপ্রস্তুত এবং দূরের ভাবনায় ভাবনাহীন তাৎক্ষণিক রাজনীতিতে মগ্ন বলে থোড়-বড়ি-খাড়ার মতো মানুষ অগ্যতা আবার আওয়ামি লিগকেই বেছে নিলে অবাক হব না। অথচ ওই দলটি ক্ষমতা বাদ দিয়ে এই মতাদর্শগত লড়াই লড়তে ততটা আন্তরিক নয়।

বাংলাদেশের বামপন্থীরা এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বড় ভুল করে বসল। তাদের একদল ক্ষমতার স্বাদ পেতে আওয়ামি লিগের সঙ্গে একেবারে লেপ্টে ছিল। আর বাদবাকি বামপন্থী পার্টিগুলি আওয়ামি লিগের প্রতি ক্রোধে ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ এই লাইনে এক কাতারে এসে দাঁড়াল। বলা বাহুল্য, এটা ফ্যাসিস্ট দর্শন। জামায়েত সম্পর্কে, হেফাজত সম্পর্কে এই আন্দোলনের মধ্যেও জনগণের কাছে সতর্কবার্তা তুলে ধরল না। ফলে এখন যা চলছে, যা চলবে এর দায় তাদেরও নিতে হবে। “যে যেখানে লড়ে যায় সব আমাদেরই লড়া” গানে শুনতে ভাল লাগলেও প্রগতিশীল রাজনীতির লোকেদের বোঝা উচিত, সব আমাদেরই লড়া নয়।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে আমরা কী করব, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। উত্তর হল, আমরা কিছুই করব না। বাংলাদেশের মানুষ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পথ চিনে লড়াইয়ে ক্রম-অগ্রসরমান হবেন। আমাদের জ্যাঠামশাই হওয়া চলবে না। আমাদের একটাই কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করতে হবে। আমরা লাতিন আমেরিকা জানি, ইউরোপ জানি, কিন্তু একই ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহনকারী কলকাতা থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানি না। এর জন্য ভারতরাষ্ট্রও দায়ী। দুই বাংলার বাঙালির অবাধ মেলামেশা তারা কখনওই চায়নি। এই ঘটনায় আরও দেখলাম মহানগরের বর্ণহিন্দু বাবু সম্প্রদায়ের চরম ইসলামোফোবিয়া। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে দুঃখের শেষ নেই, কিন্তু নিজের দেশে সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে ক্ষমতায় বসাতে তাদের বাঁধেনি। এর চেয়ে দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে। এই রাজ্যে আরজিকর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং হত্যার বিচার চেয়ে পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল। নজিরবিহীনভাবে মানুষ পথে নেমেছে। এখানেও বাংলাদেশের ছাপ পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে একটাই শিক্ষা নেওয়ার আছে। কোনও ছিদ্রপথে সাম্প্রদায়িক শক্তি যাতে মিনিমাম স্পেস না পায়। বাংলাদেশে  সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে এই সতর্কতা থাকলে বৈপ্লবিক নতুন ভোরের সকাল খানিকটা দেখা যেত। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ সেই রাস্তায় হাঁটেনি। গোটা উপমহাদেশকে এর মাশুল গুনতে হবে।