সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
আন্তর্জাতিক মাতৃদিবসের দিন সকালে গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে যাব এমন সময় পাশে রাখা মুঠোফোনটা বেজে উঠল। তড়িঘড়ি হাতে নিয়ে কানের পাশে ধরতেই ওপার থেকে আমার ভগিনীর চেনা গলার স্বর ভেসে আসে— কি রে, আজকে জলখাবার কী হচ্ছে? জলখাবারের কথা শুনেই ফেলে আসা সময়ের একরাশ স্মৃতি মনে পড়ে গেল, তবে তার সবটুকুই যে সকালের প্রথম খাবারের মতো পুষ্টিসুখকর তা হলফ করে বলতে পারি না। আসলে দশটা বাজলেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যেতে হবে বলে বাড়িতে কাজের দিনগুলোতে জলখাবারের আলাদা পাট তেমন ছিল না। খান দুয়েক ব্রিটানিয়া কোম্পানির থিন অ্যারারুট বিস্কিট খেয়ে নিয়ে এই প্রভাতী খাবারের পর্বটাকে শেষ করে দিতে হত অধিকাংশ দিনেই। পাউরুটিতে পলসন কোম্পানির মাখন অথবা কেলাসিত ফ্রুট জ্যাম মাখিয়ে সকালে খাওয়া হত না তেমন নয়, তবে অনেক সময় আমরাই তাকে এড়িয়ে যেতাম পেটটা ভরা ভরা লাগছে এমন কথা বলে। আমাদের বাড়িতে বাঁধা গোয়ালা ছিলেন বাসুকাকু, বাসুদেব ঘোষ। সকালে দুধ দিয়ে গেলে মা সেটা গরম করে কাঁসার ছোট ছোট গেলাসে করে তিন ভাইবোনের সামনে রেখে দিয়ে যেতেন। ইচ্ছে আর অনিচ্ছের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে থেকে তার সদগতি করতাম যথাসম্ভব স্লো অ্যাকশনে। ছুটির দিনগুলোতে অবশ্য বেশ আয়েশ করে পেটপুরে জলখাবার খাওয়া হত। আসলে আমার মাকেও তাঁর কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হত বলে এই পর্বটি দীর্ঘায়িত করার সুযোগ তেমন ছিল না। অথচ একালের ডায়েটেশিয়ান অথবা খাদ্যবিদ্যাবিদদের মতে দিনের শুরুতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই বিষয়ে আলোচনা করার আগে জলখাবারের ব্যুৎপত্তি নিয়ে দু-একটা কথা বলে নেব আমরা।
জলখাবার, নাস্তা, ব্রেকফাস্ট
গোলাপকে যে নামেই ডাকো তা যেমন গোলাপই থাকে আমাদের আজকের নিবন্ধের শিরোনামে থাকা জলখাবারের অবস্থাও যেন ঠিক তেমনই। আমরা যাকে প্রচলিত বাংলায় জলখাবারের শিরোপা দিয়েছি, একালে তাই যে সর্বজনীন সাহেবি ব্রেকফাস্ট হয়ে উঠেছে তা কে না জানে?
ইংরেজি Breakfast শব্দটি আসলে একটি যুগ্ম শব্দ— Break আর Fast এই দুয়ে মিলে শব্দটির নির্মাণ। লেজ থেকেই কাটাছেঁড়া শুরু করি। Fast শব্দের অর্থ হল উপবাস বা অনাহার। আর Break মানে ভাঙা। তাহলে দুইয়ে মিলে অর্থ দাঁড়াল উপবাস-ভাঙা আহার। রাতের মেন কোর্সের খাবার খাওয়া হলে শুরু হয় ঘুম বা বিশ্রামের পর্ব, সেটাই এখানে উপবাসের সময়। আর তারপর নতুন দিনের শুরুতেই যে খাবার খাওয়া হয় তাই হল উপবাসভঙ্গের প্রথম আহার বা ব্রেকফাস্ট।
জলখাবার শব্দটির আরও একটি পরিশীলিত সমার্থক শব্দ অবশ্য আছে বাংলায়— প্রাতরাশ। ব্রেকফাস্টের মতো এই সংস্কৃত শব্দটিও একটি যুগ্ম শব্দ— প্রাতঃ + আশ। আশ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত অশন শব্দ থেকে, যার অর্থ হল আহার।
অর্থাৎ প্রাতঃকালের প্রথম আহারকেই বলা হয় প্রাতরাশ ওরফে জলখাবার। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে দিনের এই প্রথম আহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
জলখাবারের আর একটি প্রতিশব্দ হল নাস্তা। হিন্দি ভাষাভাষীদের কাছে দিনের প্রথম খাবার বোঝাতে নাস্তা শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়। বাংলাতেও আমরা এই শব্দটিকে সকালের প্রথম খাবার বোঝাতে প্রয়োগ করে থাকি। এটি একটি ফার্সি শব্দ। যদিও কোনও কোনও ভাষাবিদের মতে সংস্কৃত ‘অনাশিত’ শব্দ, যার অর্থ অভূক্ত, থেকেই নাকি নাস্তা বা নাশতা শব্দটি এসেছে।
পণ্ডিতদের লড়াই চলছে চলুক। আমরা বরং এই সুযোগে জেনে নিই শরীর-স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় জলখাবার/প্রাতরাশ/নাস্তা বা ইউনিভার্সাল শব্দ ব্রেকফাস্ট কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
জলখাবার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
আমাদের দেহ এক আশ্চর্য যন্ত্র বিশেষ। দেহের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ও সুষ্ঠু কর্মপরিচালনার জন্য জ্বালানি তথা আহারের গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু এ-কালে নয়, চিরকালই শরীরের সুস্থতা রক্ষায় দিনের প্রথম খাবারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মান্যতা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয়েছে— “প্রাতরাশ হবে পুষ্টিকর, সহজপাচ্য ও প্রাণদায়ী।” অর্থাৎ কোনও গুরুপাক খাবার দিনের শুরুতেই গ্রহণ করা শরীরের পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
আধুনিক চিকিৎসা ও পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে দিনের শুরুতে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। কোনওভাবেই তাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তাঁদের মতে প্রাতরাশ বা জলখাবার সঙ্গত কারণেই হল দিনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাবার। কেন?
আসলে সারারাত দেহযন্ত্র আপাত নিশ্চল অবস্থায় থাকে। সকাল থেকেই নতুন করে শুরু হয় যন্ত্রের ঘড়ঘড়ানি। তাই এই শুরুর সময়টাতে শক্তির চাহিদা থাকে সর্বাধিক। এই শক্তি শরীরে প্রয়োজনীয় গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, বাড়ায় অন্যান্য পুষ্টির জোগান। গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে সকালের নাস্তা দৈহিক শক্তি বাড়ায়, বৃদ্ধি করে কাজে মনোনিবেশ করার ক্ষমতা। এছাড়া শরীরের ওজন ভারসাম্য রক্ষা করতে, টাইপ-টু ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকির সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে প্রাতরাশ গ্রহণ খুব জরুরি। তবে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে দিনের প্রথম খাবার যেন অবশ্যই টাটকা, সঠিক মাত্রায় পুষ্টি উপাদানে ভরপুর এবং সুস্বাদু হয়।
আপ রুচি খানা
পুরনো এক প্রবচনে বলা হয়েছে আপ রুচি খানা, অর্থাৎ নিজের অভিরুচি অনুসারে একজন মানুষ ঠিক করবেন তিনি কী খাবেন, কীভাবে খাবেন এই বিষয়টি। এখানে গা-জোয়ারি করে কোনও কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, কেননা তাতে হিতে বিপরীত হবে। পাশাপাশি কোনও একটি অঞ্চলের মানুষ ঠিক কী খাবেন তা নির্ভর করে সেই অঞ্চলের ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচারের বিভিন্নতার ওপর। এই বিষয়টি যেমন প্রধান খাদ্যসম্ভারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ঠিক তেমনই প্রাতরাশের বেলাতেও তাই।
মনে রাখতে হবে যে-কোনও একটি অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষজনের খাদ্যগ্রহণের বিষয়টি এক দীর্ঘ পরীক্ষানিরীক্ষার ফসল। বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা জনপদের অগণিত মানুষ নানা ভাষা, নানা মত নানা পরিধানের মতো নানা খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত। এই বিবিধতা স্বাভাবিক। আর এই কারণেই ভারতের উত্তরতম প্রদেশের কাশ্মিরবাসী মানুষেরা যখন রকমারি রুটির সম্ভারে প্রাতরাশের টেবিল সাজাচ্ছেন তখন দক্ষিণের কেরলের মানুষজনেরা অপেক্ষা করে আছেন গরম গরম ইডলি, দোসা, সম্বরের জন্য। বাঙালির সকালের জলখাবারের পাতে গরম গরম ফুলকো লুচি আর কালোজিরা অথবা পাঁচফোড়ন দিয়ে তৈরি আলুর তরকারি মিললে, গুজরাটের সুরেন্দ্রভাই নাস্তা সারবেন সরষে আর কারিপাতার গন্ধে মন মাতোয়ারা করা বেসনের তৈরি ধোকলা দিয়ে। আঞ্চলিক বিভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে অন্তঃআঞ্চলিক স্তরের জলখাবারের বৈচিত্র্যকে যুক্ত করা হলে গোটা বিষয়টি আরও অনেক বেশি বর্ণময় হয়ে উঠবে সন্দেহাতীতভাবে। অবশ্য তাতে করে শুধু জটিলতা বাড়বে তা নয় খাদ্যরসিক সুধীজনদের মধ্যেও বিভ্রান্তি বাড়বে কোনটা ফেলে কোনটা খাব তা নিয়ে।
ভারতবর্ষে খাদ্য নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের নানাপ্রান্তের আহার্য নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা গবেষণা চলেছে। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে বর্তমান কর্নাটক রাজ্যের তৎকালীন চালুক্যবংশীয় শাসক রাজা তৃতীয় সোমেশ্বর মানসোল্লাস তথা অভিলাষিতার্থ চিন্তামণি নামে সংস্কৃত ভাষায় একটি মূল্যবান প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেন। এই বিশ্বকোষ-প্রমাণ গ্রন্থের প্রায় শত সংখ্যক বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যে একটি অধ্যায়ে ভারতীয় রন্ধনশৈলীর অনুপম বিবরণী পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেই রন্ধনশৈলীর আঞ্চলিক বিভিন্নতা অনুসারে ভারতকে মোট পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে— পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল। মূলত প্রধান আহারের ভিত্তিতে এই অঞ্চলীকরণ করা হলেও সহযোগী আহার্য হিসেবে প্রাতরাশের বেলাতেও তা সমান প্রাসঙ্গিক কেননা একই হেঁসেলঘরের সৌজন্যে সমস্ত ধরনের খাবারই পরিবেশন করা হয়।
বর্তমান নিবন্ধে আমরা যেহেতু প্রাতরাশের বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করব সেহেতু এই পাঁচটি প্রামাণ্য অঞ্চলের পাঁচটি লোভনীয় জলখাবারের কথাই এখানে আলোচনা করা হবে। আসলে ভারতের খাদ্যসম্ভারের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য এতটাই বিপুল যে প্রতিনিধিমূলক পাঁচটি অঞ্চলের প্রামাণ্য প্রাতরাশের তালিকা প্রস্তুত করা রীতিমত কঠিন কাজ। তবুও পঞ্চপ্রদীপের মতো পঞ্চ-প্রাতরাশের কথাতেই আমরা আজকের কথার রাশ সীমাবদ্ধ রাখব।
মেনুকার্ড হাজির
ইদানিংকালে, এ-প্রজন্মের নবীন বয়সীদের হোটেল রেস্তোরাঁয় গতায়াত অনেক অনেক বেড়েছে। আমাদের সেই আদ্যিকালে, হোটেল রেস্তোরাঁ ছিল না এমনটা মোটেই নয়, তবে ছাপোষা মধ্যবিত্ত ঘরের লোকজনের সেখানে যাওয়ার চল ছিল বেশ কম। ঘরে মা ঠাকুমা কাকিমা জেঠিমার হাতে তৈরি খাবারেই আমাদের তুষ্ট হয়ে থাকতে হত। ফলে মেনুকার্ডে ছাপা অগণিত নাম আমাদের কাছে কেমন অপরিচয়ের বাহুল্য বলে মনে হত। একটু সড়গড় হওয়ার পর অবশ্য নামের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমে গেছিল। আসলে যত বড় রেস্তোরাঁ তত লম্বা তাদের মেনুকার্ড। এটা একটা আভিজাত্যের প্রতীক।
খাবারের কথাই যখন হচ্ছে তখন গোটা দেশটাকে এক আশ্চর্য রেস্তোরাঁ ভাবতে বাধা কোথায়? আর এমন এক অভিনব অভিজাত রেস্তোরাঁ “দ্য গ্র্যান্ড ইন্ডিয়ানার” প্রভাতী নাস্তার বিপুল আয়োজনের তালিকাটি যদি আপনাদের সামনে মেলে ধরি, তাহলে আমার মতো আপনারাও যে বিলকুল নাজেহাল হবেন, সেই বিষয়ে আমি অন্তত একশো শতাংশ নিশ্চিত। ফলে মেনুকার্ডে ছাপা প্রাতরাশের খাদ্য তালিকা আমাদের বিভ্রান্ত করবে প্রতি পদে। এই কারণেই আলোচ্য নিবন্ধে পাঁচটি অঞ্চলের প্রামাণ্য প্রাতরাশের সঙ্গে আমরা পরিচিত হব এবং অবশ্যই পেট পুরে খাবার খাব। তাহলে চলুন বেরিয়ে পড়ি।
আমাদের যাত্রা হল শুরু
আজ সাতসকালেই আমরা হাজির হয়েছি ভারতের উদীয়মান সূর্যের রাজ্যে। দেশের একেবারে উত্তরপূর্ব প্রান্তসীমায় থাকা এই রাজ্যের প্রাতরাশ খেয়েই আমাদের নাস্তা এক্সপ্রেসের চাকা গড়াবে দেশের নানা প্রান্তে। গোড়াতেই বলি, দেশের এই অঞ্চলে মুখ্যত বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস, ফলে এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজনের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আচারব্যবহার, আদবকায়দা মায় খাবারদাবার দেশের বাকি অংশের থেকে বিলকুল আলাদা। তবে মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রাতরাশ টেবিলে হাজির হলে মোটেই নিরাশ হতে হবে না। তবে একটা বিষয়ে বলি— এখানে এসে মেনুকার্ড চাইলে বেশ বিব্রত হতে হবে। কারণ এখানকার জলখাবারের মেনু সম্পর্কে আমি-আপনি সড়গড় নই, তাদের গড়ন পিটন সোয়াদ তো দূরস্ত! প্রাতরাশের টেবিলে আপনাকে খানিকটা অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে কাউন্টারে থাকা মানুষটিই হয়তো এগিয়ে এসে বলবেন— “স্যার! হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ।” আপনি হয়তো একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে প্রায় অস্ফূট স্বরে উচ্চারণ করেছেন— “ব্রেকফাস্ট।”
ব্যস আপনার কাজ শেষ। মুহূর্তের মধ্যে আপনার সামনে হাজির আপনার নাস্তা। এর নাম খুরা।
আসুন এর সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় কথা জেনে নিই। খুরা হল এক ধরনের প্যানকেক। এইটি অরুণাচল প্রদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাতরাশের একটি। আপনি যদি তাওয়াং গিয়ে থাকেন তাহলে জানবেন, আপনি খুরার একেবারে অন্তঃস্থলে পৌঁছে গেছেন। এখানে বসবাসকারী মনপা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাতরাশ আপনি এখন খাচ্ছেন। প্রাতরাশের টেবিলে খুরা ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করতে পারে না মনপারা। এইটি তৈরি হয় স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন buckwheat নামের দানা শস্যের আটা এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি বিয়ার, ছাং থেকে।
ওলন্দাজ শব্দ boekweit থেকে ইংরেজি শব্দ buckwheat-এর উৎপত্তি। হিন্দিতে একে বলা হয় ‘কুট্টু কে আটা’। এই আটা ছাঙে গুলে একটা থকথকে ব্যাটার বা লেই তৈরি করা হয়। তারপর এটিকে গাঁজানো হয়। সঙ্গে মেশানো হয় পরিমাণমতো লবণ ও অন্যান্য কিছু মশলা। তারপর হাতায় করে এই লেইটিকে গরম তাওয়ায় ছড়িয়ে এপিঠ-ওপিঠ করে ভেজে নিলেই তৈরি হয়ে গেল অরুণাচল প্রদেশের অন্যতম জনপ্রিয় প্রাতরাশ খুরা। এর সঙ্গে খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হয় মরশুমি সবজি দিয়ে তৈরি কোনও তরকারি যা খুরার টোকো স্বাদটাকে মোহময় করে তোলে। খুরার সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য টেবিলে হাজির অরুণাচলের বিখ্যাত জনপসন্দ চা পো। ইয়াক বা চমরি গাইয়ের দুধ দিয়ে তৈরি পো-এর পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আপনি উপভোগ করুন তাওয়াং-এর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পেটের কথা একদম ভাববেন না, খুরা সেটা ঠিক সামলে নেবে।
অরুণাচল প্রদেশের পাথুরে এলাকা থেকে আমাদের নাস্তা এক্সপ্রেসের চাকা এখন গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এসেছে একেবারে সমুদ্রের সমতল বেলাভূমিতে। এখানে এলেই পায়ের তলায় সর্ষে ফেলে হেথায় হোথায় চক্কর দিয়ে ফেরার ইচ্ছে জাগে সবার মনে। কখনও প্রাচীন বৌদ্ধ চৈত দেখতে ছুটছেন তো কখনও যাচ্ছেন দয়া নদীর তীরে অবস্থিত সেই ঐতিহাসিক রণাঙ্গনে, যে যুদ্ধ শুধু কলিঙ্গের নয় গোটা উপমহাদেশের ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এ-রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈভব ও পরম্পরা সম্পর্কে যত বলা যায় ততই মনে হয় সব কথা বলা হল না। সত্যিই তাই। নুলিয়াদের তত্ত্বাবধানে সমুদ্রে অবগাহন সেরে একনজরে দেখে নিন সুদর্শনের অপরূপ বালুকা ভাস্কর্য, তারপর গভীর শ্রদ্ধালু মন নিয়ে চলুন দারুব্রহ্ম সন্দর্শনে। কী! বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এত ছোটাছুটি করে? সকালে বেরিয়েছেন বলে নাস্তা করে আসা হয়নি? কালিয়া থাকতে ভয় কিরে দাদা? উৎকলভূমিতে কি প্রাতরাশের আয়োজনে ঘাটতি পড়িয়াছে? মোটেই না, বরং এত বিপুল আয়োজন দেখিয়া আপনিই নির্ঘাত ধাঁধায় পড়িয়াছেন!
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নাস্তা এক্সপ্রেস নিয়ে আমরা ঠিক কোথায় এসে পৌঁছেছি। বাংলার ঘরের পাশের পড়শিরা যেখানে থাকেন সেই ওড়িশা রাজ্যে। এখানেই পাতা হয়েছে নাস্তা এক্সপ্রেসের প্রাতরাশের টেবিল। আগেই বলেছি এই রাজ্যের প্রাতরাশের মেনুকার্ড এতটাই সমৃদ্ধ যে সাতসকালে পেট ভরানোর মতো ‘সিগনেচার’ জলখাবার ঠিকঠাক বেছে নেওয়াটাই রীতিমতো চাপের বিষয়। আর মেনুকার্ডের লম্বাই ওড়িশায় অনেকটাই। ঘোষণা অনুসারে যেহেতু প্রতিটি অঞ্চল থেকে মাত্র একটি মেনুকেই আমরা বেছে নেব তাই তালিকাটিতে একবার নজর বুলিয়ে নেওয়া যাক্। ওড়িশার জনপ্রিয় প্রাতরাশের তালিকায় আছে— চাকুলি পিঠা ও আলুতরকারি, পাখালা, দহিবড়া-আলুদম, মুধি মনসা, পুরি ডালমা, বড়া ঘুগনি, সাঁতুলা, চুদা কদম্ব…..। কী বলছেন? পেটের ক্ষিদে আরও চাগিয়ে উঠল? আর দেরি না করে বেছে নিন আপনার পছন্দের জলখাবার। ওমা, একি! এক-একজন একেকরকম পছন্দ করেছেন? তাহলে তো মুশকিল। এক্ষেত্রে আমাদের পছন্দের খাবারকেই যে আপনাদের মেনে নিতে হবে। রাজি তো?
আমাদের পছন্দের জলখাবার বা নাস্তা হল— পুরি ডালমা।
পুরি ডালমা ওড়িশার একটি অতি জনপ্রিয় প্রাতরাশের আইটেম। কলকাতায় যেমন কচুরি ছোলার ডাল সহযোগে প্রাতরাশ করার বিপুল চল রয়েছে ওড়িশাতেও ঠিক তেমনি পুরি ডালমার জনপ্রিয়তা।
বাংলার বাইরে ধবধবে সাদা ময়দার লুচির দেখা সেভাবে মেলে না। যদিও ইদানিং বঙ্গীয় পর্যটকদের অভিরুচির কথা টের পেয়ে ১০০ শতাংশ ময়দার লুচি থুরি পুরি বানানো শুরু করে দিয়েছে ওড়িশায়। ভুবনেশ্বরের এক দোকানে বিজ্ঞাপন দেখে রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম— “এখানে কলকাতার স্টাইলে ময়দার লুচি পাওয়া যায়।” এখানে যে পুরি পাওয়া যায় তা গড়পড়তা বাঙালি লুচির থেকে আকারে বেশ বড়, অনেকটাই রুটির সাইজের এবং ময়দা ও আটা মিশিয়ে তৈরি করা হয়। ভাজাও হয় একটু কড়া করে যাতে তাতে বেশ মুচমুচে ভাব আসে। পুরি নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না, কেননা এর পরে আপনারাই হয়তো বলে বসবেন— মায়ের কাছে মাসির গপ্পো আর করতে হবে না। অগত্যা পুরি ছেড়ে সহযোগী ডালমা নিয়ে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনাই।
ডালমা হল এক বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি মুসুরডাল। এইটির কথা বলতে গিয়ে এক ওড়িয়া বন্ধু বলেছিলেন, “ডালমা হল উড়িষ্যার মানুষের আতমা।” ওড়িশার সবচেয়ে জনপ্রিয় নিরামিষ খাবার হল এই ডালমা যা দিনের প্রাতরাশ থেকে শুরু করে রাতের খাবারের মেনুতেও সমান গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা যেমন পুরি ডালমা নিয়েছি, ঠিক একইভাবে কেউ কেউ ডালমার সঙ্গে নিয়েছেন চাকুলি, পরোটা এমনকি পাউরুটি। এটাকে এক কথায় বলা যায় বিশেষভাবে তৈরি মুসুর ডালের স্ট্যু। তবে বিভিন্ন ডাল ব্যবহারের ফলে এইটি অত্যন্ত প্রোটিনসমৃদ্ধ এক খাবার। আর তাই সকলের কাছেই খুব আদরণীয়। ডালের মধ্যে বিভিন্নরকমের সবজি দেওয়া হয়, যার ফলে এর স্বাদ অন্য মাত্রা পায়। কিছু গোপন পেটেন্ট মশলা দেওয়ার ফলে এর সোয়াদ হয়ে ওঠে এক কথায় অসাধারণ। আপনাদের জানিয়ে রাখি, মহাপ্রভুর প্রতিদিনের ভোগে ডালমা একটি মাস্টসার্ভড রেসিপি। এ স্বাদের ভাগ হবে না গুরু!!
শেষ পাতে একটু মিষ্টি না খেলে নাকি বাঙালির ভোজনপর্ব সুসম্পন্ন হয় না। উৎকলভূমিতে এসেছেন, পেটভরে পুরি ডালমা খেয়েছেন, অথচ মিষ্টিমুখ না করে চলে যাবেন তা হয় নাকি? কী খাবেন ভাবছেন? আমি বলি কি, চোখ বন্ধ করে ছানাপোড়া পরখ করে দেখুন। ঠকবেন না। ওড়িশার নয়াগড় জেলার দাসাপাল্লা গ্রামের হালুইকর সুদর্শন সাহুর আশ্চর্য আবিষ্কার এই ছানাপোড়া আজ দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। আপনিও কাঁপাবেন— তবে আতঙ্কে নয়, আনন্দে।
এবার চলুন আমাদের তৃতীয় গন্তব্য দক্ষিণের দ্রাবিড়ভূমে। নানান ভাষাভাষীদের এক আশ্চর্য লীলাভূমি হল এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মানুষের ভাষাগত বৈচিত্র্য যে আসলে আঞ্চলিক কৃষ্টি সংস্কৃতি আর বিবিধ যাপনবৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন তা বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে না। এই সকল বৈশিষ্ট্যের ছাপ পড়েছে দ্রাবিড়ভূমির রন্ধনশিল্পের ঐতিহ্যময় পরম্পরায়, প্রাতরাশের টেবিলে। খাদ্য-বিশারদদের মতে দক্ষিণ ভারতের হেঁসেলে অনন্য সব রন্ধনশৈলী যেমন চেট্টিনাদ শৈলী, উদুপী শৈলী, ম্যাঙ্গালোরীয় রীতি কিংবা ঐতিহ্যবাহী হায়দ্রাবাদি ঘরানার পাক-ধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রতিটি রীতির মিশেল ঘটলেও প্রত্যেক রীতির আপন আপন স্বাতন্ত্র্য দিব্যি টের পাওয়া যায় এই অঞ্চলের কালিনারি হেরিটেজ বা রান্নার পরম্পরায়। তেলেগু, তামিল, কন্নড় ও মালয়ালমভাষীদের খাবারদাবার তাই অনেকটাই একরকম হয়েও আঞ্চলিক বিভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্যের নিরিখে সমুজ্জ্বল।
দক্ষিণ মানেই হল চালের আটায় তৈরি নানান ধরনের উপচার যা পেট ও পকেটের পক্ষে স্বাস্থ্যকর ও সাশ্রয়ী। দক্ষিণের খাবার মানেই একান্ত গৃহজ উপকরণের প্রাধান্য, ফলে শরীরের উপর বাড়তি কোনও চাপ নেই। দক্ষিণে গেলে নাস্তা বা প্রাতরাশ নিয়ে বিশেষ কোনও ভাবনা থাকে না। ইডলি, দোসা, সম্বর, মেডু বডা, আপ্পামের মতো অতিপরিচিত জলখাবারের পাশাপাশি রয়েছে চিলা, উপ্পিন্ডি, পেসারাট্টু, পোপ্পু আন্নাম, ইডিয়াপ্পামের মতো বিপুল সংখ্যক অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত খাদ্যসম্ভার। জনপ্রিয় প্রাতরাশের আইটেম দোসার যে এত রকমফের রয়েছে তা এখানে না এলে আমরা টেরই পেতাম না। আসলে বেড়াতে গিয়ে খুব চেনা খাবারেই আমরা সবাই রসনাকে বেঁধে রাখতে চাই, তার ওপর রয়েছে কতগুলো ভুল ধারণা, যার ফলে অনেক লোভনীয় খাবার আমাদের পাতে ওঠে না। নাস্তা এক্সপ্রেস নিয়ে যখন দ্রাবিড়ভূমে এসেই পড়েছি সদলবলে তখন আমাদের প্রাতরাশের প্লেট ভরে উঠবে এক নতুন খাবারে। আমাদের এই পর্বের নিবেদন— ইদিয়াপ্পাম বা দক্ষিণি নুডলস্।
হাল আমলে বহুজাতিক কোম্পানির তৈরি দু মিনিটের নুডলস্ আমাদের অনেকেরই প্রাতরাশ প্লেটের দখল নিয়েছে। প্রি-প্রসেসড মশলা ছড়িয়ে তাই গপাগপ গিলছে আমাদের আগামী প্রজন্মের শিশু কিশোর তরুণ থেকে শুরু করে একেবারে বৃদ্ধ বয়সীরা। অথচ বহু বহু বছর ধরে এই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ইদিয়াপ্পামের মতো টাটকা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া হচ্ছে। কথায় বলে না, চেনা যোগী ভিখ্ পায় না, আমাদের ইদিয়াপ্পামেরও অনেকটাই তেমন অবস্থা। আমাদের পাতে এই অনুপম খাবারটি পরিবেশিত হওয়ার অবসরে বরং এর সম্পর্কে কয়েকটি কথা শুনে নেওয়া যাক্।
এই দক্ষিণি নুডলস্ অত্যন্ত জনপ্রিয় গোটা দক্ষিণ ভারতে। আর তাই তামিলনাড়ুর ইদিয়াপ্পাম কর্নাটকের মাটিতে পরিচিতি পায় ওটু শাভিগে নামে, কেরলের মানুষজনেরা একে ডাকে ইন্দিয়াপ্পা হিসেবে, পুদুচেরির লোকজনের কাছে তার পরিচয় নুল পট্টু নামে, শ্রীলঙ্কার খাদ্যতালিকায় এর ঠাঁই হয়েছে স্ট্রিং হুপার নামে। এত বিচিত্র নামকরণ থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই যে কতটা পরিচিত একটা প্রাতরাশের পদ আপনাদের প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া হবে। দেশের বাইরে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও এই ইদিয়াপ্পাম জনপ্রিয় পুত্তু মায়াম্ নাম নিয়ে।
ইদিয়াপ্পাম তৈরি করা হয় তিনটি সরল উপকরণের সাহায্যে— চালের গুঁড়োর আটা, লবণ ও জল। প্রথমে বিশেষ ধরনের ইদিয়াপ্পাম প্রেষ-যন্ত্রে চালের আটা থেকে নুডলস্ তৈরি করা হয়। তারপর তাকে ভাপিয়ে নেওয়া হয় বিশেষ ধরনের ইডলি স্টিমারে। এরপর যে-কোনও আমিষ অথবা নিরামিষ পদের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় ইদিয়াপ্পাম, দক্ষিণের নুডলস্।
আমাদের কথার মাঝেই টেবিলে হাজির আমাদের প্রাতরাশ। নিন হাত চালান, দেরি করলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
পায়ে পায়ে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের নাস্তা এক্সপ্রেসের চাকা এখন এসে হাজির হয়েছে ভারতের পশ্চিমপ্রান্তীয় রাজ্য রাজস্থানে। আজকের প্রাতরাশ এখানেই সারব আমরা। রাজস্থানের হেঁসেলেও মজুত আছে মনবাহারি রকমারি খাবারের বিপুল পসরা। উত্তর-পশ্চিমপ্রান্তীয় রাজ্য রাজস্থানের রন্ধনপ্রণালীতে ওই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সুগভীর প্রভাব রয়েছে। রাজপুত রাজাদের বৈভবে ভরপুর রাজসিক জীবন, আম-নাগরিকদের যুদ্ধপ্রবণ সামরিক মানসিকতা, প্রাকৃতিক রুক্ষতার কারণে রসদের সন্ধানে নিরন্তর পরিযান, শুষ্ক মরুভূমির দেশে রান্না করে খাওয়া যায় এমন কাঁচামালের সুলভতা— এইসবের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। পাশাপাশি রাজস্থানবাসীর সংখ্যাগুরু অংশের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিষয়টিও রাজ্যের পরম্পরাগত রন্ধনশৈলীর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। অনেক অনেক ঝোল রেখে রসালো রান্নার তুলনায় শুকনো মশলাদার খাবার যা কিছুদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং গরম না করেই খাওয়া যায়, অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কলকাতার বিখ্যাত সব ভুজিয়াওয়ালার দোকানে গিয়ে ঢুঁ মারলেই এই পর্যবেক্ষণের সত্যতা যাচাই করে নিতে পারবেন।
রাজস্থানের শাহী হেঁসেলে অতিথি আপ্যায়ন করার মতো পাখোয়ানের অভাব নেই। কত নাম বলব?— পেঁয়াজ কচৌরি, ঘেভার, বাজরার রুটি ও লসুন চাটনি, লাল মাস, কাঁড়ি কচৌরি, বেসন চিল্লা, মাওয়া কচৌরি…। উঃ নাম আওড়াতে আওড়াতেই মুখ ব্যথা হয়ে গেলে খাব কোন্ মুখে? আর কথা না বলে আসুন আমাদের পছন্দের জলখাবার কাঁড়ি কচৌরিগুলোর সদগতি করা যাক্।
আমাদের পছন্দের জলখাবার কাঁড়ি কচৌরির দুটি প্রধান উপাদান রয়েছে— কচুরি ও কাঁড়ি। ভেতরে মশলাদার পুর ভরে তৈরি করা হয় খাস্তা কচুরি। এগুলো এমনি-এমনিই খাওয়া যায় বটে তবে রাজস্থানের মানুষজন কচুরির সঙ্গে আচার ও কাঁড়ি খেয়ে থাকে। কাঁড়ি হল বেসনের ঝোল। বেসনকে জলে গুলে নিয়ে তার সঙ্গে মেশানো হয় পরিমাণমতো টক দই, লবণ ও নানান ধরনের মশলা। আগুনে জ্বাল দিয়ে দিয়ে এই মিশ্রণটিকে নির্দিষ্ট ঘনত্বে নিয়ে আসা হয়। তারপর তাতে চড়ানো হয় স্পেশাল তড়কা মানে ফোড়ন। আর সঙ্গে থাকে রাজস্থানের অনন্য সোয়াদযুক্ত মশলাদার সব আচার। উপস্…। রসনাকে যে আর সামলাতে পারছি না। লালা ঝরছে সমানে।
আপনাদের ক্যায়া হালত?
আমাদের নাস্তা এক্সপ্রেস অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এখন এসে হাজির হয়েছে আরও এক নতুন গন্তব্যে। মরুভূমির দেশে প্রাতরাশ করতে গিয়ে ঘেমেনেয়ে নির্ঘাত গলদঘর্ম হতে হয়েছে। এবার এই নতুন দেশে এসে নিশ্চয়ই স্বস্তি বোধ করবেন সবাই। খাবার যতই মুখরোচক হোক না কেন খাবারঘরের পরিবেশটি যদি আরামদায়ক না হয় তাহলে যে খেয়ে বা খাইয়ে কোনওটাতেই সুখ নেই। আকাশছোঁয়া পর্বত আর সবুজ গালিচা বিছানো উপত্যকায় ভরা এই অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। এইজন্যই সবাই একে বলে মর্ত্যের বেহেশত। প্রতিবছর সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ এখানে এসে ভিড় করেন এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এখানকার হাউসবোট, শিকারা, পাহাড়ের গায়ে কারেওয়ার উর্বর মাটিতে মূল্যবান জাফরানের চাষ, এখানকার হস্তশিল্পীদের তৈরি পারসিক গালিচা, কাঠের ওপর জালিকাজের অসাধারণ উপকরণ, এখানকার আপেল, আখরোট, খুবানি— আর বলতে হবে না? বুঝতে পেরেছেন আমরা এখন কোথায় আছি? ঠিক বলেছেন, আজকের প্রাতরাশের টেবিল পাতা হয়েছে কাশ্মিরে।
কাশ্মিরের হেঁসেলে বহু বিচিত্র সব রন্ধনশৈলীর অনুপম মিশ্রণ ঘটেছে যা এখানকার অফুরান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের থেকে কম বৈচিত্র্যময় নয়। খাদ্য-বিশেষজ্ঞদের মতে কাশ্মিরি রন্ধনশিল্পের মধ্যে সাবেকি ফার্সি, মধ্য এশীয় ও ভারতীয় রন্ধনধারার এক অনুপম মেলবন্ধন ঘটেছে। আর হয়তো এই কারণেই এই অঞ্চলের জায়কা একান্তভাবেই এই অঞ্চলের হয়ে উঠতে পেরেছে।
কাশ্মিরের প্রাতরাশ কখনও তার অসাধারণ সব রুটি ছাড়া হতেই পারে না। আমরাও তার স্বাদ গ্রহণ করব তবে কোন্ রুটি আমাদের প্রভাতী নাস্তার টেবিলে হাজির হবে তা ঠিক করতেই যে নাস্তানাবুদ অবস্থা। এখানকার ‘কান্দুর ভানে’ প্রায় চোদ্দোরকমের ভিন্ন ভিন্ন আকারের, ভিন্ন চরিত্রের, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের রুটি তৈরি হয়। আর কী সব নাম তাদের— বাকরখানি, তোমলা চোট, কাতলাম, ঘিয়েভ চোট, রৌথ, গির্দা, লাভাসা তিলউর, শিরমল, কুলচা….। আর মনে রাখতে পারছি না। এসব করতে গিয়ে নাস্তার মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝি পার হয়ে যায়!
আমাদের পছন্দের জলখাবারের তালিকায় আজ ঠাঁই করে নিয়েছে গির্দা। সঙ্গে সঙ্গত করার জন্য টেবিলে হাজির হবে কাহওয়া চা। কাশ্মিরের প্রাতরাশ টেবিল আলো করে থাকা রুটি হল এই গির্দা। গোল গড়নের এই রুটিটি তৈরি করা হয় ময়দা ও তিল দিয়ে। মণ্ড মেখে তন্দুরে দেওয়ার আগেই আঙুল দিয়ে চেপে চেপে এর ওপরের অংশে ঢেউখেলানো টেক্সচার তৈরি করা হয়। গির্দার মজা হল যে এই রুটির বাইরেটা মুচমুচে আর ভেতরটা নরম। এই রুটির গড়ন আর গঠনের জন্য একে প্রায় সব কিছুর সঙ্গেই খাওয়া চলে— চা, তরকারি, আচার, মাখন আর মধু। এই কারণেই গির্দা রুটির দৌড়ে প্রথম। গির্দা শেষ হলে কাহওয়া চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে উপভোগ করুন চারপাশের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যপট, লক্ষ করুন কান্দুর ভানের মালিকের ব্যস্ততা, দেখুন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকদের আনাগোনা, বিচিত্র চলনভঙ্গিমা। আনন্দ পাবেন। গ্যারান্টি দিচ্ছি।
এবার ঘরে ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। অনেক অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী সব নাস্তায় পেট ভরিয়ে ঘরে ফেরার এক অপার আনন্দ আছে। সেই আনন্দসাগরে অবগাহনের সুযোগ আমরা পেলাম নাস্তা এক্সপ্রেসের সৌজন্যে। কেউ কেউ হয়তো ঈষৎ আক্ষেপ করে বলতে পারেন, সব হল, খালি আমাদের বাংলার কথাই বাদ গেল। আসলে নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটালে তাতে গৌরব বাড়ে না। আবার হয়তো বেড়িয়ে পড়ব কোনও একদিন, অন্য কোনও অবসরে। আপনারা আমার সঙ্গী হবেন তো?
১৮ মে, শনিবার, ২০২৪