মোজাফফর হোসেন
‘ধরো, তুমি এমন কিছু একটা হতে চাও, কিন্তু জানো সেটা কোনও অবস্থাতেই সম্ভব নয়। আবার তুমি অন্য কিছু হতে চাও-ও না…।’ মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বৃদ্ধলোকটি আমাকে বলেছিলেন। মৃত্যু মানে আত্মহত্যা। বয়স যা হয়েছিল আর কটা দিন অপেক্ষা করলে এমনিতেই চলে যেতে হত। তবুও তিনি সিদ্ধান্তটা নিলেন। নিবেন যে সেটা আমাকে আকারে-ইঙ্গিতে বলেওছিলেন। আমি ততটা বুদ্ধিমান নই বলে তখন ধরতে পারিনি।
‘মরে যাওয়ার আগে একটা সিদ্ধান্ত অন্তত আমি নিজে নিতে চাই। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অদৃষ্ট কারও না; একান্ত আমার সিদ্ধান্ত সেটা।’ শেষ দিন চায়ের বিল পরিশোধ করে উঠে যাওয়ার মুহূর্তে ঝুলে-পড়া দেহটা কিছুটা শক্ত করে তুলে ধরে কথাগুলো বলেছিলেন।
আমরা প্রতি শুক্র এবং শনিবার দরগার সামনে পদ্মাপাড়ে বাঁশ দিয়ে দাঁড়ানো চায়ের দোকানটির একটু দূরে পাশাপাশি বসতাম। বহুদিন একসঙ্গে বসার পর আমরা হঠাতই একদিন আবিষ্কার করেছিলাম, আমরা দুজনে সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত অবধি, যতক্ষণ চায়ের দোকানটা খোলা থাকে পাশাপাশি বসে থাকি। আমরা প্রতিদিন পাশে নতুন একজন লোক বসেছে ভেবে এতদিন এড়িয়ে গেছি পরস্পরকে। সেদিন চায়ের দোকানদার যদি না বলত, ‘চাচাকে দেখছি না যে? গেল সপ্তায়ও আসেনি।’
‘কোন চাচাকে?’ ওর কোথাও ভুল হচ্ছে ধরে নিয়ে খুব স্বাভাবিক-স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম।
‘ঐ যে, প্রতিদিন আপনার পাশে বসেন? আপনারা একসাথে চা খান, তারপর দোকান বন্ধ করার সময় হলে যে যার বিল দিয়ে উঠে পড়েন?’
এরপর আমি বুঝে নিয়েছিলাম। পরদিন যখন উনি আমার পাশে এসে বসলেন, প্রথম কথাটা আমিই বলেছিলাম। জানি না কতদিন, কয়মাস আমাদের পাশাপাশি বসে থাকার পর সেদিন কথা হল। ‘আপনার কি শরীর খারাপ ছিল?’ আমি ছোট্ট করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
‘কি জানি!’ এইটুকু বলে আর না আসার কারণটি বললেন না। আমারও আগ্রহ বিশেষ ছিল না। অনেকক্ষণ দুজন দুজনার মতো বসে থাকার পর আমি ফের একবাক্যে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি কি রোজ এখানে এসে বসেন?’
‘নদীর পাশে বসতে আমার ভালো লাগে।’ নদীর দিকে দৃষ্টি চুবিয়ে এরকমই কিছু একটা বললেন। শব্দগুলো মুখে জড়িয়ে এমনভাবে বের হল আমি সবটা বুঝতে পারলাম না।
‘আমি শুক্র এবং শনিবার আসি। বছর চার থেকে। খুব কাজ না পড়ে গেলে মিস করি না।’ বললাম আমি।
‘ওহ।’ কিছুক্ষণ মুখ নড়িয়ে নড়িয়ে এইটুকু শব্দ বের করতে পারলেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের একটি দুটি বাক্য বিনিময় হত।
‘আমি লিখি, নদী আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়। ঠিক দেয় না, আদায় করে নিই বলতে পারেন। ছোটবেলায় ডোবা দেখে দেখে বড় হয়েছি কিনা! এখান থেকে উঠার যাওয়ার পর বাসায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিংবা রবিশঙ্কর ছেড়ে দিয়ে ঘুমাই। এইটুকু না করলে বাকি দিনগুলো এক-কলমও লিখতে পারি না। এটা এখন বদ অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ এক শুক্রবার যেচে কথাগুলো বললাম আমি। লেখালেখি যা করি তেমন বলার মতো না, একটা কিছু যুৎসই বলতে হত তাই বলা। আমি চাচ্ছিলাম উনার বসে থাকার কারণটা জানতে। উনি সেদিন আর কিছু বললেন না। আমার কথাটা শুনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে নিলেন মাত্র। পরদিন শনিবার উত্তরটা দিলেন উনি, বললেন, ‘এমনিতেই বসি।’ কিছুক্ষণ থেমে ফের বললেন, ‘এখানে নদীটা খুব স্থির।’ আর কিছু বলেননি। আমিও আর সাধিনি। একা একা চুপচাপ বসে থাকার জন্যই এখানে আসা। বেশি আলাপে জড়িয়ে মূল কারণ থেকে বিচ্যুত হতে চাইনি। তবে টুকটাক কথা আমাদের রোজই হত। একদিন উনি বললেন, ‘এখানে সবসময় আলো থাকে। অন্ধকার আমার সহ্য হয় না।’
আমিও কি একই কারণে বসি? মনে মনে ভাবি তখন। এখানে বেকার মনে ভাবনাটা খুব আসে। এত দ্রুত সব ভাবা যায় যে প্রায়ই ভাবনা ফুরিয়ে গেলে শূন্য মনে বসে থাকতে হয়। এতদিন পর আমি নদীর পাড়ে ঠিক এখানেই বসি কেন সেই কারণটা ভাবার চেষ্টা করি। হতে পারে এখানে চায়ে চিনিটা পরিমাণমতো হয়। এই শহরের আর কোথাও এমন মাপের চিনি-চা খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। কিংবা যে বটগাছটার নিচে আমরা বসি তার সঙ্গে আমাদের গাঁয়ের বাড়ির সামনের চৌরাস্তার মোড়ের সেই বটগাছটির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে। এরপর অলস মনে সেই সম্পর্কটা দাঁড় করাতে চেষ্টা করি।
বাবা ব্যবসার কাজে গঞ্জের বাজারে চলে গেলে আমি একা একা ঐ বটগাছের নিচে পাতা বাঁশের চৌকির মতো বড়মাচার এককোণে শুয়ে থাকতাম। বাড়িতে থাকলে এটা-সেটা কারণ খাড়া করে সৎমায়ের অত্যাচার — হয় চুল টেনে ধরা নয় চুলার পাশে জড়ো করা খড়িগুলো একটার পর একটা আমার পিঠে ভাঙা। বাবা একদিন টের পেয়েই কিনা জানি না মজ্জেল চাচাকে বলেছিলেন, ‘ওর মাথাটা কদমছাট দিয়ে দিস তো।’ আমি রাজি হইনি। কারণ চুল ধরলে তুলনামূলক ব্যথা কম লাগে। যেদিন হাতের কাছে বাঁশের কঞ্চি কিংবা বাবলার চিকন চিমড়ি ডাল পড়ে যায় সেদিন আর রক্ষা নেই। চুলটা না থাকলে সব পিঠের ওপর দিয়ে যাবে শুনে মজ্জেল চাচা চুলে আর তেমন হাত দেয়নি। তবে আজ এতটা বছর পর আবিষ্কার করি, চুল কাটতে না দেওয়ার অন্য একটা কারণও ছিল। মিলার মা, ছোটদাদি, আমার মাথায় সুন্দর করে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিত। বাবা প্রায়ই অনেক রাত করে আমাকে মিলার মায়ের কাছে রেখে যেতেন। মিলা আর আমি প্রায় পিঠাপিঠি। মা-মরা শিশু বলে বিশেষ দরদ পেতাম ঐ বাড়িতে। শুনেছি আরও ছোট থাকতে মিলার মায়ের বুকের দুধও নাকি পান করেছি। সেই হিসেবে ছোটদাদি আমার দুধমাতাও। সুবিধা হল মিলার বাবা ফজু-দাদা দেশে ছিল না। ফজু-দাদার নাম শুনেছি, কখনও দেখিনি। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে জেনেছি ভিনদেশে গেছে কাজ করতে। এতদিনে দেশে ফিরেছে কিনা জানি না। মিলা বেঁচে থাকলে জানার আগ্রহ কিছুটা থাকত।
মাঝে মধ্যে বাবা আমাকে রাখতে গিয়ে আমাকে আর মিলাকে ঘরের ভেতর রেখে কয়েক মিনিটের জন্য ছোটদাদিকে নিয়ে বাইরে চলে যেত। পেছনে গরুর বিচালি কাটার অন্ধকার ঘর থেকে কুইচ্চা মুরগির মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ আসত কিছুক্ষণের মধ্যে। মিলার মায়ের চাপা শীৎকার। মিলা আর আমি একদিন ওদের পেছন পেছন গিয়ে দেখেছিলাম। ঘরে এসে মিলা বলল, ‘খুব মজা! খেলবি নাকি একবার?’ এরপর আমরা আর কথা বলিনি। দুজনে নগ্ন হয়ে ভয়ে-শিহরণে কিছুক্ষণ জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এর কয়েকদিন পরেই ঘটনাটি ঘটল। ঐদিন আমাদের দুজনের নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকার দৃশ্যটি দেখে ফেলে ছোটদাদি। বাবাও ছিলেন সঙ্গে। ঐ ঘটনার পর থেকে রাতে আর ও-বাড়ি যাওয়া হত না আমার। বাবা আর সৎমায়ের ঘরের বাইরে বারান্দাতে শুতাম। সেদিন রাতে ঘুম ভাঙল ওদের চাপা বাহাসে।
‘কই? উঠা কাপড়টা?’ বাবা বললেন।
‘আজ শরীরটা ভালো নেই। না করলে হয় না?’ সৎমায়ের উত্তর।
সামান্যতেই রেগে যাওয়া রগচটা বাবার অভ্যাস। বুঝতে পারলাম উঠে গিয়ে দরজার হুড়কোটা হাতে নিয়েছেন।
‘এটা দেবো নাকি ঢুকিয়ে? অসুস্থ মারাবার টাইম পাস না?’ — বলে পিঠে দুবাড়ি কষিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন সঠান — প্রাচীর টপকে শর্টকাটে মিলাদের বাড়ির দিকে।
সৎমা অকারণে উঠে এসে আমাকে লাথাতে লাগলেন। ‘ওঠ হারামজাদা? দূর হ আমার চোকের সামনি থেকি।’ আমাকে দেখলেই নিঃসন্তান সৎমায়ের নিজের অক্ষমতার কথা মনে পড়ে; আরও বেশি চড়াও হন তখন। আমি উঠে গিয়ে উঠোনে ছাগলঘরের বাইরে মুনিষের জন্য পাতা মাচাঘরে গিয়ে বসলাম। ঘণ্টাদুয়েক পরে সম্ভবত, বাবা প্রাচীর টপকে ভেতরে এলেন। টিউবওয়েলে হাত-পা ধুয়ে ঘরের ভেতর থেকে কিছু একটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
সকালে সেই বটগাছের নিচের মাচান থেকে উদ্ধার করা হল মিলার রক্তাক্ত শরীর। মৃত। বাবা নিরুদ্দেশ। আমার আর সৎমার সংসারে থাকা হল না। মামাবাড়ি হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। এরপর গাঁয়ে একবারই গেছি, ছোটদাদির মাথা নষ্ট হয়ে গেছে শুনে, দেখতে। মায়ের মৃত্যুর সত্য কারণটা সেবারই জানা হল। সঙ্গে মিলার অন্য একটা পরিচয়ের কথাও। মাথাটা নষ্ট হওয়ার পর থেকে ছোটদাদি এসব উল্টাপাল্টা বকছে বলে অন্যরা আমাকে বুঝ দিল। সেই বটগাছটার নিচে আর মাচানটা ছিল না। ভেঙে ফেলা হয়েছিল। রাতে ওখানে মিলার ভুত এসে নাকি ভয় দেখাত লোকজনকে। আমার একবার ইচ্ছা হয়েছিল রাতটা কাটাতে। পারিনি। ভুতে বিশ্বাস আমার ছিল না কোনওদিনই। আজ মনে হয়, ভয়ে। আমি ঐ সত্যটা জানার পর ভয় পেয়েছিলাম মিলাকেও। সেই নগ্ন হয়ে আমাদের জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকার কারণে নয়, ভয় পেয়েছিলাম অন্য কারণে। কারণটা কোনও একদিন জেনে যাব নিশ্চয়। হয়ত কোনও একদিন কোনও এক বটগাছের নিচে মিলা হঠাৎ করে নেমে এসে আমাকে বলে যাবে কারণটা। কিংবা কোনওদিন জানা হবে না। পাশের সঙ্গীটি চুপ করে বসে থাকার কারণে এভাবে আগের-পরের অনেক কিছু ভাবতে পারি আমি।
‘আমাদের নদীটা ঠিক এরকমই ছিল।’ বৃদ্ধলোকটি বললেন। ‘উঠোনটা বিস্তৃত হতে হতে আরও প্রসারিত হয়ে মিশে গিয়েছিল নদীতে। শুনেছি নদীতে বাসন মাজতে মাজতে মা জন্ম দেয় আমাকে।’
কোন নদী? একবার প্রশ্ন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপন মনে কথা বলছেন দেখে আর বাধা দিইনি।
‘মাছের আড়ত ছিল বাবার। বড় কারবার। ৪৬-এ বিহারের দাঙ্গায় ওরা এক অন্ধকার রাতে বাড়িতে ঢুকে বাবাকে চাপাতি দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে কোশির স্রোতের মুখে ফেলে দিয়েছিল। নদীর জলে ছেলের শরীরের গন্ধ নিতে নিতে দাদি নিজেও একদিন ভেসে গেল।’
‘এরপর কি চলে আসেন এপারে?’ আমি প্রশ্নটা করে বসি।
‘উম? কিছু বললেন? বাতাসটা দম ধরে আছে। ঝড় উঠতে পারে; উঠবেন নাকি?’ বলে বৃদ্ধলোকটি বাঁশের বেঞ্চ থেকে শরীরটা খুব কষ্ট করে তুলে আমার জবাবের অপেক্ষা না করে বাঁ-পাটা টেনে টেনে হাঁটা দেন নদীর ধার ঘেঁষে। ওদিক থেকেই আসেন রোজ।
গতরাতের ঝড়ে বটগাছটার একটা ডাল ভেঙে গেছে। উসকো-খুসকো অবস্থা গোটা গাছজুড়ে। একবার মিলার ধুলোঝড়ের পাল্লায় পড়ে কাঁধ-অবধি ঝুলে থাকা চুলগুলো এভাবেই জট-পাকিয়ে বিশ্রী অবস্থা হয়েছিল। পুকুরে পা চুবিয়ে সেই জট ছাড়াতে পারছিল না কিছুতেই। আমি সাহায্য করার নাম করে একমুঠো চোরকাঁটা সেঁটে দিয়েছিলাম ওর চুলে। মিলার সেকি কান্না, কান্না শুনে ছোটদাদি ছুটে এসে চুলের ওই অবস্থা দেখে পিঠের ওপর দিলেন ধুমাধুম। কান্নার ওপর কান্না। ওর কান্না দেখে কেন যে বোকার মতো হেসেছিলাম সেদিন, আজ আর মনে করতে পারি না।
বৃদ্ধলোকটি আমার আগেই এসেছেন। চায়ের দোকানটি খোলেনি। ঝড়ে চালাটা উড়ে গেছে; ঠিক করতে আরও দুয়েকদিন লাগতে পারে। চায়ের নেশা দুজনকেই পেয়ে বসে।
‘হাঁটবেন নাকি?’ বৃদ্ধলোকটি বলেন। আমি উনার একটা পাজর ধরে উঠতে সাহায্য করি। আমরা হাঁটতে থাকি নদী ধরে।
‘কিন্তু বিহারের দাঙ্গায় তো অনেক মুসলমান পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। আপনি এদিকে এলেন যে? ভাষাও ছিল উর্দু। আপনি পরিস্কার বাংলা বলেন?’ আমি প্রশ্ন করি।
‘মা ছিল বাঙালি। কুষ্টিয়ার মেয়ে। বাবা মোহিনী মিলে কিছুদিন কাজ করেন। তখনই পছন্দ করে বিয়ে করেন। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে ছোটমামা গিয়েছিলেন আমাদের আনতে।’
কাছে-কিনারে চায়ের দোকান নেই। আমরা হাঁটতে থাকি। বৃদ্ধের একটা হাত কখন ধরেছি খেয়াল নেই। হাঁটতে হাঁটতে আমার বাবার কথা মনে পড়ে। যে বাবা একদিন রাতের অন্ধকারে মায়ের মুখে বালিশ-চাপা দিয়ে ঘরের আড়ার সাথে পরনের শাড়িটা পেঁচিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছিল সেই জন্মদাতা বাবাকে নয়। আমার মায়ের অপরাধ ছিল মিলার আসল পিতৃপরিচয় জেনে যাওয়া। সম্পর্কে মিলার মা আমার বাবার আপন ছোটচাচি। তারা চাননি বিষয়টি জানাজানি হোক। ফজুচাচা তখন ইটালিতে বা ইটালির পথে। শেষ ফোন এসেছিল লিবিয়ার সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার আগে। এরপর আর কোনও খোঁজ নেই। যে পিতৃপুরুষের হাতে ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হয়েছে মিলা, সেই রক্তমাংসের বাবাকে নয়, আমি ভাবি বাবা নামক বায়বীয় এক সত্তার কথা। আজন্ম বঞ্চিত এক অনুভূতির কথা।
‘কোশিতে ভেসে গেল বাবা, পদ্মায় মা। জীবন্ত কিংবা মৃত। বিহারের দাঙ্গাতে খুব কষ্ট করে মা বেঁচে এসেছিলেন। একাত্তরে আরও এক অন্ধকার রাতে বৃদ্ধমাকে নির্যাতন করে পাকিস্তানের বর্বর-সেনাদল নদীতে ফেলে দিল। হাত-পা বেঁধে আমার বাঁ-পায়ে একটা গুলি করে চলে গেল। আমি চিৎকার করেছিলাম যেন গুলিটা আমার মাথায় মারে। আরও একটা গুলির জন্য আমি চিৎকার করেছি। ওরা শোনেনি।’ বৃদ্ধলোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন।
‘আপনার বিশ্রামের দরকার। আমরা বসি এখানে?’ আমি জিজ্ঞেস করি হাতটা আরও শক্ত করে ধরে। রাত ঘন হতে হতে আরও জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। আমরা চা-খোঁজার কথা কখন যেন ভুলে গেছি।
‘আমাকে একটু আলোতে নেবেন? অন্ধকার আমি সহ্য করতে পারি না।’ বৃদ্ধ বলেন।
আমরা আরও খানিকটা হাঁটি আলোর খোঁজে।
‘আপনি কী এমন হতে চেয়েছিলেন যেটা হওয়া সম্ভব নয় কখনও?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
‘কই; কিছু হতে চাইনি তো! শুধু কিছু না হতে হতে অতীতে ফিরে যেতে চেয়েছি। আমি বেঁচে থেকেছি ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে ফিরে যাব বলে।’ জড়ানো কণ্ঠে বলেন তিনি।
‘তাতে লাভ কী? ইতিহাসের বাঁকবদলে আপনার তো কোনও হাত ছিল না। আপনি ফিরে গেলেও ইতিহাসে আজ যা লেখা আছে, তার একটুও নড়চড় হত না।’
‘সেটা তো সমষ্টির ইতিহাস। ব্যক্তির ইতিহাস বলেও একটা বিষয় আছে। আমি পারতাম সেই সন্ধিক্ষণে নিজেকে থামিয়ে দিতে। বাঁচার স্বপ্ন এঁটে এতটা পথ ছুটে লাভ কি হল?’ আরও অস্পষ্ট করে বলেন তিনি, যেন নিজেকেই নিজে বলছেন। ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেঁচে থাকাটা কোনও সমাধান নয়, কিন্তু তার জন্যে আপনাকে বুঝতে হবে কখন নিজেকে থামাতে হবে।’ যোগ করেন তিনি।
পথ অনেকসময় নিজের চলা তৈরি করতেই ছুটিয়ে নেয় আমাদের। পথিক কি আর সব সময় মনের দিশায় চলতে পারে? আমি তো স্থিরই ছিলাম নিজের স্থানে। ভালো করে চোখ খুলে দেখি কতদূর ছিটকে এসেছি অতীত থেকে। মনে মনে ভাবি আমি।
পরের সপ্তায় চায়ের দোকানটা খুলেছিল। বৃদ্ধলোকটি খোঁড়াতে খোঁড়াতে যখন এলেন তখন দরগার মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছিল। আমি হাত ধরে বসালাম। শরীরটা কাঁপছিল টের পেলাম। ‘আপনার বিশ্রামের দরকার। আজ না এলেও পারতেন।’ বললাম আমি। এরপর আমরা দীর্ঘক্ষণ শিল্পীর আঁকা পাড়ভাঙা নদী এবং দুজন সর্বশান্ত মানুষের দৃশ্যপট হয়ে চুপচাপ বসে থাকি। কয়েকবার চা আসে। কিংবা আসে না। আসলেও আমরা মুখে তুলি কিংবা তুলি না। আমরা হালকা বাতাসে নদীর পানি সরে যাওয়ার কম্পন, বটগাছের পাতাগুলোর একটির সাথে আরেকটির ছোঁয়ালাগার মুহূর্তের অনুরণন, দরগার ভেতর থেকে জিকিরের আওয়াজ, চায়ের দোকানের ওপাশ থেকে কয়েকজন মাঝবয়সী লোকের সংসারী আলাপ, দূরে কারও বেসুরা বাঁশি, পেছনে রিকশাচালকদের বেহিসাবি কথাবার্তা — এর মধ্যে আমরা দুজন নৈঃশব্দ এঁটে বসে থাকি আরও অনেকটা সময়।
‘মরে যাওয়ার আগে একটা সিদ্ধান্ত অন্তত আমি নিজে নিতে চাই।…’ এরপর সেই কথাটা বলে পা টেনে টেনে হাঁটা দিলেন তিনি।
‘সব সিদ্ধান্ত আমরা একাই নিই কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কি আর একার থাকে?’ ঠিকমতো কথাগুলো না বুঝেই আমি নিজেকে নিজে উত্তর দিয়েছিলাম।
বৃদ্ধলোকটির চলার পথ ধরে নদীটা ঝাপসা হয়ে ওঠে। চায়ের দোকানটা সরে যেতে থাকে দৃশ্যপটের বাইরে। রাত আরও ঘন হতে হতে বাতাস কেটে নদীর চলার শব্দ, দরগার জিকিরের ধ্বনি, ল্যাম্পপোস্টের আলোটা — সবকিছু স্মৃতির ওপাশে লীন হতে থাকে আমাকে সাক্ষী মেনে। মুখোমুখি জেগে ওঠে কেবল বটগাছটি।