Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একরাত প্রতিরাত

তৃষ্ণা বসাক

 


রাত জাগা। শুধু যে মেয়েরা রাতের শহরে অবাধে ঘুরতে পারে, এটাই দেখানো নয়, এর মধ্যে আরও একটু গূঢ় কথা আছে। আমরা মনে রাখব যে ঘুমের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। সাধারণ মানুষ যখন ঘুমোয়, তখন তার ঘুমকে ব্যাহত না হতে দেওয়ার দায় পুলিশ-প্রশাসনের। সেই কাজে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ৩৬ ঘণ্টা টানা কাজের পর একটু ঘুমোতে চেয়েছিল একটা ডাক্তার। পচে যাওয়া সিস্টেম তাকে চিরঘুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়েরা, এবং তাদের সঙ্গে নতুন করে জেগে ওঠা সমাজ রাতদখল করে বার্তা দিচ্ছে, প্রতিটি মানুষকে কাজের এবং কাজের শেষে ঘুমের নিরাপত্তা দেওয়া হোক। নাহলে মশালের আলোয় সমস্ত রাজপথ গলি, মহল্লার কোনাকাঞ্চির অন্ধকার দূর করে সুরক্ষার দাবিতে হেঁটে চলবে জাগ্রত মানুষ

 

মার্গ চলতা কোই গিরে তাকো লগই ন দোষ
বিপদ ভয় যো বইঠা রহে ইয়হী মহা আফসোস

(পথ চলতে গিয়ে কেউ যদি পড়েও যায়, তবু তাতে কোনও দোষ লাগে না। পাছে পড়ে যেতে হয়, এই বিপদের আশঙ্কাতেই যারা বসে থাকে, এটাই দারুণ আফসোসের কথা।)

—কবীর

বরফের বল যেভাবে বড় হয়, তাকে বলে আইসবল এফেক্ট। দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, অবক্ষয়ের পিণ্ড ওইভাবে বড় হতে থাকে। ছোট্ট একটা গুটি মতো ছিল, চোখের সামনেই ছিল, তবু খুব ছোট্ট বলে কেউ তাকে লক্ষ করেনি, লক্ষ করলেও, তার থেকে বিপদ হতে পারে এমন আশঙ্কা করেনি কেউ, রাজা পরীক্ষিৎ যেমন অবহেলায় সামান্য কীট ভেবে সাপকে গলায় রেখেছিলেন, সেই কীট মহাসর্প হয়ে তাঁকে দংশন করল, মৃত্যু হল তখনি, তেমনি তুচ্ছ ভেবেছিল, সেই ছোট গুটলিটা সময়ের সঙ্গে গড়াতে গড়াতে একটা গোবর্ধন পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়।

ওই গুটলি মতো ব্যাপারটা আশির দশকের গোড়ার দিক থেকেই লক্ষ করতে শুরু করি। সেটা আমাদের অজ্ঞাতেই এত বড় হল? বুকে হাত রেখে বলতে পারব আমরা কিছুই জানতাম না? আমাদের ছোট শহরেই দেখতে পাচ্ছিলাম লোকাল কমিটি বা এলসি-র দাপট বাড়ছে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় তারা এসে সালিশি করছে, বাড়িতে ভাড়াটে বসাতে গেলেও এলসি-র অনুমতি লাগবে। মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতাই শুধু নয়, তাকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখা, সমস্ত সুযোগসুবিধা নিজেদের অনুগত ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করার সংস্কৃতি, অন্য মত ও পথের পথিকদের ‘অপর’ করে রাখা— এসব আমাদের কৈশোরেই শুরু হতে দেখেছি। বামপন্থী নেতারাও ভেতরে ভেতরে স্বীকার করেছেন সিস্টেম পচতে শুরু করেছে।

কিন্তু সেই পচন যে এই রূপ নেবে— তা বোধহয় কারও কল্পনাতেও ছিল না। আগের আমলে যা কিছুটা ধীরে ধীরে, চক্ষুলজ্জা রেখে, রেখেঢেকে হচ্ছিল, পার্টির একটা কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য, একটা ন্যূনতম ইডিওলজির পিছুটান ছিল, এ আমলে দেখা গেল সেসব বালাই নেই। আদর্শগত ভিত্তি না থাকার সুবিধে নিয়ে প্রথম থেকেই কর্পোরেট স্টাইলে সারফেস হিপনোটিজম করে ফেলা হল। সব ঝাঁ-চকচকে বিল্ডিং, পার্ক, রাস্তা, মোড়ে মোড়ে বসার বেঞ্চ, তার পেছনে বিচিত্র অদ্ভুতুড়ে মূর্তি। কলকাতা আর কলকাতা হয়েই থাকবে না, হয়ে যাবে লন্ডন। দামি ফরাসের নিচে কেঁচো কেন্নো, সরীসৃপ, একদম আদিম শ্বাপদসঙ্কুল পৃথিবী, দেখে প্রথমে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বামপন্থীরা আদর্শ বা বিবেকের পোকায়, কিংবা স্রেফ বদলে যাওয়া সময়কে বুঝতে না-পারায় কিংবা বুঝেও বুঝতে না-চাওয়ায়, অনেক সময় নিত, এদের চোখের পাতা ফেলার আগেই কাজ সারা হয়ে যায়।

ফ্যাসিবাদের চারটি স্তম্ভ— রাষ্ট্র, প্রশাসক, পুঁজি আর মিডিয়া। সর্বত্র টাকা ছড়িয়ে মাখনের মতো সিন্ডিকেট সিস্টেম। দুর্নীতি এখন বোরোলিনের মতো বঙ্গজীবনের অঙ্গ, শিশু স্বচ্ছন্দে মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করে ‘কত টাকা দিয়ে আপনি স্কুলে পড়ানোর চাকরি পেয়েছেন মাসশাই?’ এই একটি প্রশ্ন আমাদের দেখিয়ে দেয় আমাদের আসলে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম যখন জেনে যায় এটাই স্বাভাবিক, এইভাবেই চাকরি পেতে হয়, তখন তাদের কাছে মেধা উদ্যমের কোনও অর্থ থাকে না। তারা জেনে যায় পয়সা দিয়ে সব কেনা যায়। আমরা কোন পৃথিবী তাদের জন্যে রেখে যাচ্ছি? শিক্ষকরা বাচ্চা নিয়ে মাসের পর মাস রাস্তায় বসে, আমরা পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছি। আমরা কোনও কিছু দেখেও দেখি না। ওটিটি আর ফেসবুকে ডুবে থাকি। চারদিকে মোচ্ছব, দুয়ারে কার্নিভাল!

এসো কার্নিভাল এসো,
ময়ূর পাখাটি পিঠে বেঁধে নিয়ে এসো
চাঁদ ভেসে যায় গঙ্গাজলে…
পরপর নাচ আসে,
শক্তি সংঘ, আমরা কজন,
সিঁদুর ও নাচ হয়,
তেল মুখ, তেল-তেল মুখ
তেল হাসি, তেল-তেল হাসি
বসে দেখে,
এসো কার্নিভাল এসো, লাশ-নৃত্য হোক,
চাঁদ ভেসে যায় গঙ্গাজলে…
ঘটের সরল ডালপালা
নিজেরা নিজেকে খায়,
অটোফাজি…

৯ আগস্ট থেকে কিন্তু দুনিয়াটা পালটে গেল।

আমি কেবল মাংসের গন্ধ পাচ্ছি, আমার নিজের মাংস, আমার বোনের মাংস,
আমার ক্লাসের সব বন্ধুদের, জঙ্গলজিলাবি গাছের গায়ে হেলান দেওয়া আমাদের সাইকেলের মাংস…

কাল দেশ জুড়ে ফিমেল ব্ল্যাকআউট, কোনও পাখি উড়বে না,
পাখি উড়লেই যেহেতু গুলি করে নামানো হবে,
তাই জাতীয় সড়ক একটি নিখুঁত ভুগোল বইয়ের মতো, পাতাছেঁড়া,
আমরা মাঝে মাঝে দেখেছি ওরকম বই,
যখন আমরা ইস্কুল যেতাম, যেদিন আমরা ইস্কুল যেতাম,
জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে সারি সারি সাইকেল, লেডিবার্ড,
লেডিবার্ড হড়কে ধানক্ষেতে নামে, ঘষটাতে ঘষটাতে ধানক্ষেতে,
রক্ত খুব ভাল সার, হাড়ের টুকরোয় ভরপুর ক্যালসিয়াম,
আমরা জীবনবিজ্ঞান পড়েছিলাম একদিন,
আমার খুব ওইরকম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নারী শিশু,
দাবাখানা, চশমা পরা ডাক্তারনি, করিনা কাপুরের মতো,
ইচ্ছে ছিল, লেডিবার্ড চড়ে, জাতীয় সড়ক ধরে আরও আরও ভেতরের গ্রামে…

—তৃষ্ণা বসাক, দেবী সিরিজ থেকে

মৃতার শরীরে কোনও ভাঙা হাড় নেই। আসলে মৃতার শরীরে কোনও হাড়ই ছিল না। কারণ ফ্রি মাল এমনই হয়, ভাঙাচোরা, ডিফেক্টিভ মালগুলোকেই বছর শেষে ফ্রি অফারে গছিয়ে দেওয়া হয়। কাস্টমার ভি খুশ, গুদাম ভি খালি।

মেয়েমানুষ মাটির পাত্তর, আর বেটাছেলে সোনার বাসন— এই ছাপ মেরেই বুঝি পাঠিয়েছিল বিধাতা? প্রশ্ন করেছিল সত্যবতী। মেয়েমানুষ যেন বানের জলে ভেসে এসেছে। তাই বলেই তো তাকে যখন বাসে ট্রেনে রাস্তায় যেমন ইচ্ছে ছোঁয়া যায়, আরোগ্য দেওয়ার হাত দুটিকেও দুমড়ে ভেঙে দেওয়া যায়, কারণ ও তো ডাক্তারের নয়, মেয়েমানুষের হাত, মেয়েশরীর।

মেয়ের নাম যখন ফেলি তখন বিয়ে দিলেও গেলি, আর মরে গেলেও গেলি। সে মেয়ে ডাক্তার হলেই বা কি। মেয়েই তো। আর কে না জানে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো উচ্চশিক্ষার জগতে মেয়েদের আসার কথাই নয়। ‘বিজ্ঞানসম্মতভাবেই নয়’। হাসপাতালের অন্ধকার করিডরে, ধর্ষণ–ফ্রেন্ডলি ভুলভুলাইয়ার দেওয়ালে কি লেখা ছিল না ‘স্ত্রীশিক্ষা অমঙ্গলের, কারণ তাহা বিজ্ঞান নহে’?

প্রশ্ন হচ্ছে এত বছর ধরে এত কাণ্ড তো হয়েছে, কামদুনি, সন্দেশখালি, তিলজলা— কোথাও তো পবিত্র স্বতঃস্ফূর্ত ক্রোধের এই বিস্ফোরণ দেখিনি। এটা কেন এবার হল? আসলে বিশেষ এক মুহূর্তে ইতিহাস পাশ ফিরে শোয়। তার জন্য এক একটা উপলক্ষ্য দরকার হয়। সিপাহি বিদ্রোহে যেমন মঙ্গল পাণ্ডে, সাম্প্রতিক গণজাগরণে তেমনি তিলোত্তমা, যে টানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করার পর নিজের কর্মক্ষেত্রে বিরলের মধ্যে বিরলতমভাবে খুন হয়েছে।

মেয়েরা অন্ধকারের শরিক না হতে চাইলে কতখানি মূল্য দিতে হয়! প্রতিবাদ করা তো আত্মহত্যারই সামিল। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তো ‘লাল শালু’-তে বলেইছেন— সমাজ নিয়ত আত্মহত্যার মালমসলা দিয়ে সাহায্য করবে, ফাঁকি দিয়ে তাকে আবার বাঁচতে দেবে না। মেয়েমানুষের শুধু মস্করা কেন, প্রতিবাদ সহ্য করবে— অতটা দুর্বল নয় সমাজ!

কিন্তু এই সমাজই তিলোত্তমার জন্য রাত জাগল। ১৪ আগস্ট, স্বাধীনতার আগের দিন মেয়েরা রাতের দখল নিল। রিক্লেইম দ্য নাইট।

রাত জাগা। শুধু যে মেয়েরা রাতের শহরে অবাধে ঘুরতে পারে, এটাই দেখানো নয়, এর মধ্যে আরও একটু গূঢ় কথা আছে। আমরা মনে রাখব যে ঘুমের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। সাধারণ মানুষ যখন ঘুমোয়, তখন তার ঘুমকে ব্যাহত না হতে দেওয়ার দায় পুলিশ-প্রশাসনের। সেই কাজে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ৩৬ ঘণ্টা টানা কাজের পর একটু ঘুমোতে চেয়েছিল একটা ডাক্তার। পচে যাওয়া সিস্টেম তাকে চিরঘুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়েরা, এবং তাদের সঙ্গে নতুন করে জেগে ওঠা সমাজ রাতদখল করে বার্তা দিচ্ছে, প্রতিটি মানুষকে কাজের এবং কাজের শেষে ঘুমের নিরাপত্তা দেওয়া হোক। নাহলে মশালের আলোয় সমস্ত রাজপথ গলি, মহল্লার কোনাকাঞ্চির অন্ধকার দূর করে সুরক্ষার দাবিতে হেঁটে চলবে জাগ্রত মানুষ।

চারদিক থেকে চাপ আসছে, উৎসবের চাপ, সেই উৎসব শেষ হলে কোজাগরী পূর্ণিমা আসবে। তখন জোছনার নিচে, দুধেল ধানের শিসের পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে দেবী যদি বলেন ‘কে জাগে?’, এই প্রথমবার তাঁকে চমকে দিয়ে সবাই সমস্বরে বলে উঠব ‘আমরা আমরা’!

যাক, জীবনানন্দের স্বপ্ন আজ সার্থক। ‘কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে’। কলকাতা আজ সত্যিই তিলোত্তমা হয়ে গেছে।


*মতামত ব্যক্তিগত