আশীষ লাহিড়ী
মাস কয়েক আগে আশীষদার রবীন্দ্রানুরাগ, ডিপারচার এবং আবারও রবীন্দ্রনাথে ফিরে আসা নিয়ে ওঁর সঙ্গে একটা লম্বা আড্ডা হয়েছিল আমার। "এনকাউন্টার" সিরিজের ওটা প্রাক-অন্তিম ইন্টারভিউ। কথায় কথায় ক্যানসেল কালচার, রবীন্দ্রনাথের ডাইকটমি, কন্ট্রাডিকশান ইত্যাদির বিষয়ে বেশ খানিকটা ঝগড়াও হয়। আজকের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং সেই রবীন্দ্র-কন্টেক্সটে "বুদ্ধিজীবী এবং তার দায়বদ্ধতা" বলতে তবে আমরা কী বুঝব সেই প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সিরিজের শেষ আড্ডাটায় সেই কথাটাই তুলে আনার চেষ্টা করেছি। -- রূপক বর্ধন রায়
রূপক: আমি আলবেয়ার কামু-র একটা কথা দিয়ে আড্ডাটা শুরু করি, তারপর ধীরে ধীরে অন্য প্রশ্নগুলোয় আসছি। “ক্রিয়েট ডেঞ্জারাসলি” বক্তৃতায় কামু বলছেন:
The only really committed artist is he, who, without refusing to take part in the combat, at least refuses to join the regular armies and remains a freelance.
কথাটার সঙ্গে আপনি কতটা একমত? মানে উনি তো এখানে মূলত স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর কথাই বলতে চাইছেন, সেক্ষেত্রে, তার নিরিখে আপনার মতে, হু ইজ অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল?
আশীষ: তোমার প্রশ্নটা আমি বুঝতে পেরেছি। এখানে একমত-দ্বিমতের থেকেও বড় কথা হচ্ছে সিচুয়েশানটা পরিষ্কার করে বোঝা দরকার। ওঁর কথাটা ইন এসেন্স আমি মানছি, কিন্তু, পরিস্থিতি অনুযায়ী কথাটার অ্যাপ্রিসিয়েশানটা বদলাবে। উদাহরণ হিসাবে চিনের কথাটা ধরা যাক। যে-সময়টা ওদের সিভিল ওয়ার চলছে, অর্থাৎ লং মার্চের সময়টা, ওটা এমন একটা সিচুয়েশান যেখানে প্রতিটা দিন হাতে বন্দুক ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। কিংবা আরও পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এহেন সিচুয়েশানে একজন আর্টিস্ট যদি বলেন যে— না, এই যে যুদ্ধ হচ্ছে এতে আমি ডিরেক্টলি পার্টিসিপেট করব না, কিন্তু যেহেতু আমি একজন কমিটেড ইন্টেলেকচুয়াল আমি এইটা নিয়েই শিল্প সৃষ্টি করব, আমার মতে এটা বাস্তবতার দিক থেকে অসম্ভব! আবার ধরো যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে রেসিস্ট্যান্স ওয়ার চলছে, ব্রেশট আমেরিকায় বসে তা নিয়ে নাটক বা কবিতা লিখছেন; উনি যদি তখন ফ্রান্সে থাকতেন বাস্তবতা কি সেটা পারমিট করত? কাজেই আমার মতে একজন আর্টিস্টের প্রাইমারি কমিটমেন্ট ইজ টু হিজ আর্ট ঠিকই, তাতে কোনও সন্দেহও নেই; তা সত্ত্বেও দেয়ার মে অ্যারাইজ সিচুয়েশানস, যেখানে তাঁর কমিটমেন্টটা তাঁর আর্টের চেয়েও বেশি করে বর্তমান লড়াইটার দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য! সেটা তাঁর ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে না। এটাই আমার মত।
কামু ফ্রিলান্স বলতে বোধকরি নন–পার্টিজান বোঝাতে চাইছেন। আজকাল আরজিকর ইস্যু নিয়ে একে অপরকে “অরাজনৈতিক” বলে দাগিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে জোর করে পার্টিপক্ষে টেনে অদলীয় আন্দোলনকে বাজেয়াপ্ত করার চক্রান্ত এটা। বাংলাদেশের ঘটনার ক্ষেত্রেও শুনি মোটামুটি তাই হয়েছে। “বুদ্ধিজীবী” কথাটাকেও মোটামুটি গালাগালির পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। আপনার কী মনে হয়?
এখানে শব্দের অর্থগুলোকে পরিষ্কার করে বোঝা দরকার। অ-রাজনৈতিক বলতে যদি বোঝানো হয় কোনও বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য না-থাকা, তাহলে অবশ্যই এটা অ-রাজনৈতিক। আমি নিজে তো বর্তমান ভারতবর্ষের কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য বোধ করি না। কিন্তু রাজনীতির যে-বড় অর্থ, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়া, যার ওপর আমাদের জীবনের সবকিছু নির্ভর করছে, সে-অর্থে এটা অতি তীব্রভাবে রাজনৈতিক। সেই বড় অর্থে রাজনীতি ছাড়া কোনও কিছুই হতে পারে না, শিল্পসাহিত্যও নয়। সুতরাং এককথায় তোমার প্রশ্নের উত্তর— আমার মতো অসংখ্য লোক অ-দলীয়, কিন্তু ঘোর রাজনৈতিক।
বাংলাদেশের ব্যাপারটা আমার কাছে ঘোলাটে মনে হয়। যোগ্য লোকেরা চাকরি পায় না, অযোগ্য ধান্দাবাজদের সরকার বড় বড় চাকরিতে নিয়োগ করছে, এটা নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক, অন্যায়। কিন্তু এর প্রতিকারের দাবিটা কোন শ্রেণির দাবি? যারা খেয়েপরে লেখাপড়া শিখে কেরিয়ার করতে চায়, তাদের। কাজেই ব্যাপক খেটে-খাওয়া মানুষের সঙ্গে এর কী সম্বন্ধ? বুদ্ধিজীবীরা, শিল্পীরা বুদ্ধিজীবীদের স্বার্থেই কথা বলছেন, জনগণের স্বার্থে নয়। মেরিটোক্র্যাসি কথার অর্থই তো তাই। কাজেই এই দাবির ভিত্তিতে একটা রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন ঘটানোর কথাটা অবাস্তব মনে হয়।। দক্ষিণপন্থী মোল্লাবাদীদের অনুপ্রবেশের ব্যাপারটা তো তুলছি-ই না। বাংলাদেশকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
বুঝতে পারছি। মূল প্রশ্নে ফিরি। শিল্প নিজেই তো বিপ্লবী যুদ্ধের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে! তাই নয় কি? সমর সেন আর সরোজ দত্তের মাঝের ডাইকোটমিটা তো এই জায়গাতেই?
হ্যাঁ, কিন্তু ওয়াট কাইন্ড অফ আর্ট? নট অল কাইন্ডস অফ আর্ট! সেটাই তো মাও সেতুঙেরও প্রশ্ন ছিল। একজন শিল্পী যদি বলে, আমি আমার শিল্প দিয়েই লড়াই করছি, তাহলে হি হ্যাজ টু চেঞ্জ হিজ আর্ট ফর্ম! সেই সিচুয়েশানে এমন একটা ফর্মে তাকে শিল্প সৃষ্টি করতে হবে যেটা সরাসরি মানুষের কাছে আবেদন করবে। সেটা রাস্তায় না নামলে সম্ভব না। রাস্তার মানুষটা যে লড়াইটা লড়ছে, তার সঙ্গে শিল্পের একটা সুসমন্বয় থাকতে হবে, শুধু অন্তর্বস্তুতে নয়, ফর্মেও। রাস্তায় যাঁরা লড়াই করছেন তাঁদের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল, কিন্তু আমি সংগ্রামের জন্যই অত্যন্ত গভীর কিছু একটা পেশ করলাম, যেটা আমারই মতো আর মাত্র তিনজন লোক বুঝবে, ওই পার্টিকুলার সিচুয়েশানে আমার মনে হয় দিস ইজ নট ডান!
সেক্ষেত্রে ওয়াট অ্যাবাউট আ জিনিয়াস? ধরুন রবীন্দ্রনাথ?
হ্যাঁ ঠিকই। স্বদেশি যুগে তিনি তো রাস্তায় নেমেছিলেন, গানের ফর্ম বদলেছিলেন। কিন্তু বেশিদিন রাস্তায় থাকতে পারেননি। সেটা তাঁর সীমাবদ্ধতা। কিংবা ধরো দেশ বন্যায় ভেসে যাচ্ছে, উনি বুঝছেন যে সত্যিই সাহায্যের প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্য উনি কী করলেন? না, আমাদের পুরনো পাড়ার ছায়া সিনেমাতে তাঁর শান্তিনিকেতনের গানের দল নিয়ে একটা অসাধারণ বর্ষামঙ্গল পেশ করলেন। করে বললেন যে এই প্রোগ্রামের পুরো টাকাটা তিনি বন্যাত্রাণে দান করবেন। ব্যাপারটাকে তখনই অনেকে ক্রিটিসাইজ করেছিল। মানুষ যখন ভেসে যাচ্ছে আপনি তখন সুরের সূক্ষ্মতা, ভাষার সূক্ষ্মতা, কবিতার সূক্ষ্মতা, নাচের সূক্ষ্মতা ইত্যাদির উপর মন দিচ্ছেন? আর আপনার একমাত্র যুক্তি এই যে এর থেকে যে টাকাটা আসবে সেটা আমি বন্যাত্রাণে ব্যয় করব! কাজেই ওঁর কমিটমেন্ট খালি ওই টাকাটা দেওয়াতে। বাকি যে কাজটা, সেটা কিন্তু নিছক শিল্পসৃষ্টি! এটা সত্যিই একটা ভ্যালিড পয়েন্ট! রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে— “আমি তো আর অন্য কোনওভাবে করতে পারব না, আমি শুধু এই কাজটাই করতে পারি।” অথচ অন্যরা তো পেরেছিলেন— প্রফুল্লচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা। কাজেই রবীন্দ্রনাথের অ্যাপ্রোচটা ফলস শর্ট অফ দি ডিমান্ড অফ দি সিচুয়েশান। উনি ইচ্ছে করলেই তো শান্তিনিকেতনের একটা ছাত্র-শিক্ষক দল সরাসরি বন্যাত্রাণে যোগ দিতে পারত। তাও এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিপ্লবী যুদ্ধ বা পরিস্থিতি নয়। সেরকম কোনও ক্রান্তিকারী ক্রাইসিসের সময় ‘আমি তো এছাড়া কিছু করতে পারব না’ কথাটা সুবিধেবাদের আবরণ হিসাবে কাজ করে, অনেকের ক্ষেত্রেই। কেন পারবেন না? আপনাকে তো রাস্তায় নেমে বন্দুক ধরতে হচ্ছে না, কিন্তু আপনি তো সরাসরি প্রচারে নামতে পারেন! আপনি তো লেখক, প্যাম্ফলেট ছেপে বিলি করতে পারেন। আপনি সেটা করবেন না, বলবেন আমি কবি, আমি শুধু কবিতা লিখব, যারা লড়াই করছে তাদের সমর্থনেই লিখব, কিন্তু সেটা আমার মতন আর চারজন লোক ছাড়া আর কেউ বুঝবে না, লড়াইয়ের মানুষরা এই কবিতা থেকে কিছু পাবে না, এটা কি ঠিক? কাজেই যেখানে রাস্তায় লড়াইটা চলছে, সেখানে এই যুক্তিটা আমার খুব ইন্যাডিকুয়েট বলে মনে হয়।
হয়তো সাধারণভাবে কামুর কথাগুলো ঠিক। তবে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ও-কথা খাটে না। এমন সিচুয়েশান তো তৈরি হতে পারে যেখানে আমি আর্টের প্রতি আমার প্রাইমারি কমিটমেন্ট ধরে রাখতে পারছি না! আমার বাড়িতে যখন আগুন ঢুকে আসছে তখন আমি কবিতার ছন্দ নিয়ে মাথা ঘামাতে পারি না! তখন ওই আগুন নেভানোটা আমার কাছে প্রাইমারি কাজ হয়ে দাঁড়ায়! সেটা থেকে সরে থাকা মানে তো আগুনকে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই এই জায়গাটায় কোথাও কামুর কথায় একটা ইন্যাডিকুয়েসি আছে!
সেক্ষেত্রে আশীষদা দুটো প্রশ্ন উঠছে…
বলো।
প্রথমত, তাহলে একজন আর্টিস্ট এবং একজন অ্যাক্টিভিস্টের মধ্যে পার্থক্য কী রইল? দ্বিতীয়ত, আমরা যেখানে রবীন্দ্রনাথের আলোচনাটা শেষ করেছিলাম, শুধুমাত্র জিনিয়াস বলে তাকে বেনিফিট অফ ডাউট দেব?
না, তা কেন? রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা নিশ্চয়ই করব, কারণ ওই সিচুয়েশানে আরও অনেক কিছু তাঁর করার ছিল। করেননি! ব্যাপারটাকে ছোট করে দেখার কোনও কারণ নেই। কিন্তু, আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই যে ওই সমালোচনার জায়গাটা ছাড়িয়ে বাকি কাজগুলোকে কি আমরা ছোট করতে পারি? সমালোচনার জায়গাটা এত বড় নয় যে তার কারণে রবীন্দ্রনাথের মতো এত বড় ইন্টেলেক্টের বডি অফ ওয়ার্ক-কে আমি নেগেট করতে পারি!
এখানে সমর সেন-সরোজ দত্ত বিতর্কটা বোধহয় একটা ভাল এগজাম্পল।
অবশ্যই! ভাল তুলেছ প্রসঙ্গটা। সমর সেনের কথাটা ছিল যে, আমি একজন কবি, আমিও চাই এই সমাজটা বদলাক, কিন্তু এই বদল আনার লড়াইয়ে রূপটা আমি আমার কবিতার মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করতে চাইব। কিন্তু তুমি ভেবে দেখো, উনি কিন্তু নিজের স্টান্স বদলে ফেলেছিলেন। কেন বদলালেন? কেন নাউ বা ফ্রন্টিয়ার বের করলেন? কেন উনি বললেন যে ‘আমি কবিতার ন্যাকামি থেকে সরে এসেছি’? চারপাশে যে ধরনের ঘটনা ঘটছিল আর সে সময়ে যে ধরনের কবিতা লেখা হচ্ছিল সেগুলোকে উনি ন্যাকামি বলেই মনে করতেন।
তাহলে কোনটা ন্যাকামি নয়?
ওই যে নাউ বের করে, ফ্রন্টিয়ার বের করে উনি ওঁর আগের স্টান্স থেকে সরে এলেন, সেটা! এবং আমাকে উনি পার্সোনালি বলেছিলেন— “হ্যাঁ, আজকে পিছন ফিরে তাকিয়ে মনে হয় সরোজবাবুই ঠিক ছিলেন।” ফ্রন্টিয়ারের সময় আন্দোলনের মধ্যে থেকেই উনি আন্দোলনের একটা critique তৈরি করেছেন। আন্দোলনের বাইরে থেকে করেননি; যেমন আর পাঁচজন করছিল। আন্দোলনের ভেতরে থেকেই আন্দোলনের নানান দিক ক্রিটিসাইজ করেছিলেন। সেটাও সরোজ দত্তরা ভাল চোখে দেখেননি, তীব্র আক্রমণ করেছিলেন।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন। সমর সেনের সঙ্গে সরোজ দত্তর বিতর্কটা হয় তিরিশের দশকে। আর আমি এবং আমরা ওঁকে দেখি ওই ৬০-এর শেষ বা ৭০-এর দশকে। সেই সমর সেন অন্য সমর সেন। নইলে প্রচণ্ড রিস্ক নিয়ে ফ্রন্টিয়ারে-র মতো কাগজ বের করবেন কেন? কী অবস্থায় উনি কাজ করতেন আমি তো জানি! পুলিশ এসে ওয়েলিংটন স্ট্রিটের মডার্ন প্রেসে তালা ঝুলিয়ে যাওয়ার পর কোনও জায়গায় ফ্রন্টিয়ার ছাপা যাচ্ছিল না। তখন শ্যামবাজারের একটা অত্যন্ত সাধারণ লেটার প্রেসে খুব কষ্ট করে ছাপা হত, আমরা সকলে প্রুফ দেখে সাহায্য করতাম। নিছক বুদ্ধিজীবীরা তখন স্রেফ ভয়ে ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু সমর সেন কাগজটা বের করে গেছেন!
অশোক মিত্র একটা সময়ে ছিলেন না?
না না, অশোক মিত্র সমর সেনের নাউ পত্রিকায় ছিলেন। নাউ বন্ধ করে ফ্রন্টিয়ার তৈরির পর যখন কাগজটা নকশালবাড়িকে সমর্থন করল তখন আর অশোক মিত্র ছিলেন না। কারণ উনি নকশালবাড়িকে সমর্থন করেননি।
হ্যাঁ, মনে পড়ছে…
কবিতা থেকে সরে আসার পর সমর সেনের কাছে দেশি-বিদেশি নানান বড় বড় কাগজ থেকে অফার ছিল। আমি নিজের চোখে দেখেছি। উনি চাইলে সাংবাদিকতা করতেই পারতেন। সে সব না করে উনি ফ্রন্টিয়ার বের করতে গেলেন কেন? লাভ তো দূরের কথা, কাগজ কীভাবে চলত আমরা নিজেরা জানি। কাজেই ওঁর মতো অত বড়মাপের ইন্টেলেকচুয়ালের ডিসিশান প্রমাণ করছে যে ওই নির্দিষ্ট সিচুয়েশান ওটাই ডিমান্ড করছিল। উনি বাড়িতে বসে কবিতা না লিখে মুভমেন্টের মধ্যে বসে সরাসরি প্যাম্ফলেটের মতো ফ্রন্টিয়ার বের করছেন। কেউ তো ওঁকে ওটা করতে বলেনি। উলটে যাদের সমর্থন করছেন তারাই গালমন্দ করছে, আক্রমণ করছে। কারণ তারা শুধু অ্যাপ্রোবেশান শুনতে চাইছিল। সমর সেন সমর্থনের সঙ্গে সঙ্গে যে জায়গাগুলো ভুল মনে হয়েছিল, অ্যাজ আ পার্ট অফ দি মুভমেন্ট তাদের ক্রিটিসাইজও করেছিলেন। এইটাই তো সত্যিকারের বিপ্লবী ইন্টেলেকচুয়ালের কাজ। সে নিজে বন্দুক হাতে লড়াই করছে না, কিন্তু তার লেখা, তার ইন্টেলেক্টের মধ্যে দিয়ে সে বিপ্লবের অঙ্গ হয়ে উঠতে চাইছে। ভাবো, ওঁকে একদিকে রাজনৈতিক এস্টাব্লিশমেন্ট বিপদে ফেলতে চাইছিল, আবার অন্যদিকে সমালোচনা করার কারণে বিপ্লবীরাও বলছিল, ‘নিজে কিছু করছেন না, আর আমাদের লোকেরা মরছে, তাও ঘরে বসে তাদের ক্রিটিসাইজ করছেন?’ কাজেই, কামু যেটা বলেছেন তার একটা উত্তর এইখানে বোধহয় নিহিত আছে। বিপ্লবের সহযোগী হয়েই বিপ্লবের সমালোচনা করা।
তাহলে আমি কি বলতে পারি যে আপনি মিন করছেন— অ্যাট দি হায়েস্ট পিক অফ স্ট্রাগল লিটারারি অ্যাক্টিভিজম বিকামজ দ্য ডিউটি অফ অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল?
হ্যাঁ! একদম। আমি লিটারারি অ্যাক্টিভিজমের কথাই বলছি। পরিষ্কারভাবে! সমর সেনের মতোই, একইভাবে, বীরেন্দ্র চটোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় সরাসরি বিপ্লবের হয়ে কথা বলেছেন। ওই বিশেষ সিচুয়েশানে লিটারারি অ্যাক্টিভিজম বলতে এইটাই বোঝায়।
রাশিয়ায় আইজেনস্টাইনের সিনেমা যেটা করছিল সেই একই কথা বলছেন, বেশ।
হ্যাঁ, অবশ্যই!
কিন্তু আশীষদা, একটা আইডিওলজিতে যদি সরাসরিভাবে একজন শিল্পী বা ইন্টেলেকচুয়াল কমিটেড হয়ে যান তাহলে তাঁর স্বাধীনতার কী হবে?
ওই আইডিওলজিটাই তো তার ফ্রিডম। বিকজ হি ইজ ফ্রি, হি হ্যাজ চোজেন দ্য আইডিওলজি। সমর সেন তার প্রমাণ। তিনি যে আইডিওলজির মধ্যে বদ্ধ হয়ে যাননি, তিনি যে বিপ্লবীদেরই ক্রিটিসাইজ করছিলেন, এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আমার চেনা-পরিচিতর মধ্যে গৌরীপ্রসাদ ঘোষ, যিনি অত বড় মাপের শেক্সপিয়ার স্কলার, অত বড় ইন্টেলেকচুয়াল, তিনি সরাসরি ওই আইডিওলজিটা গ্রহণ করেছিলেন, করে তাদেরই ক্রিটিসাইজ করেছিলেন! সে লেখা আমরা ছেপেছিলাম। এইটাই আমি বলতে চাইছি। তাঁরা কিন্তু বদ্ধ হয়ে যাননি। বরং ওই আইডিওলজি তাঁদের ক্রিয়েটিভ এবিলিটিকে আরও এগিয়ে দিয়েছে। গৌরীদা ইংরেজি সাহিত্য আর শেক্সপিয়ার বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এহেন লোক বিপ্লবীদের জন্য নিজের বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন, তারা এসে তাঁর বাড়িতে রাত্তির দুটো-তিনটের সময় শেল্টার নিত, তাঁর স্ত্রী তাদের রেঁধে খাওয়াতেন। তাঁর কি দায় পড়েছিল তুমি বলো তো? তারা ইঞ্জিওরড হলে নিজে তাদের ড্রেসিং করতেন! করে তার পরের দিন তিনি প্রবন্ধ লিখতেন, ফ্রন্টিয়ারে-ই লিখতেন! কাজেই লিটারারি অ্যাক্টিভিজম কিন্তু এঁদের ক্রিয়েটিভিটিকে বদ্ধ করেনি। যাঁরা এই কথা বলেন, তাঁদের সঙ্গে আমি একেবারেই একমত নই। যাঁদের মধ্যে প্রথম থেকেই বদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপাদান ছিল একমাত্র তাঁরাই আইডিওলজির দ্বারা বদ্ধ হন, এমনকি আইডিওলজি না থাকলেও হন। আমি চোখের সামনে দেখেছি, তাই কথাটা আমি জোর গলায় বলতে পারি। আজকের বাংলায় যারা শাসকদের কাছে চার আনা-আট আনার জন্য বিকিয়ে গেছে, তারা কোন আইডিওলজির দোহাই দিয়ে সেটা করে? এবং সেটা তাদের ক্রিয়েটিভিটিকে কীভাবে মদত দেয়? সুতরাং সমস্যাটা আইডিওলজি নিয়ে নয়, ইন্টিগ্রিটি নিয়ে।
তাছাড়া তুমি আন্দোলনের যে দিকগুলোকে সমর সেন বা গৌরীদারা ক্রিটিসাইজ করতেন সেটা একবার ভাবো। এ-কথা প্রশ্নাতীত যে নকশালদের উদ্দেশ্যে কোনও খাদ ছিল না, সমস্যাটা ছিল পদ্ধতি বা অ্যাপ্রোচে। অ্যান্ড ইট ফেইলড, অবধারিত ছিল সেই ফেইলওর! বিরাট এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে তাদের ওই স্ট্র্যাটেজি একেবারেই কাজ করেনি। কৃষিবিপ্লবের কথা বলছে কিন্তু আন্দোলনটা কনসেনট্রেটেড হচ্ছে কলকাতা শহরে! কতগুলি ইশকুল পোড়াচ্ছে, মূর্তি ভাঙছে, কনস্টেবলকে মারছে… এটা তো বিপ্লবী কাজ নয়! শুধু স্লোগান দিয়ে পুলিশ পিটিয়ে পাবলিক সাপোর্ট বেশিদিন ধরে রাখা যায় না! ফলত যেটা হল, মানে যেটা সমর সেন গৌরীদারা ফোরসি করেছিলেন সেটা এই যে আস্তে আস্তে তারা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সুদেবের ঘটনাটা তো জানোই, ব্যাপারটা নিয়ে চারুবাবুর লেখাও আছে। সুদেব অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল এবং অত্যন্ত ডেডিকেটেড বিপ্লবী ছিল। সর্বস্ব ছেড়ে সে বিপ্লবের পথে গিয়েছিল। সেই সুদেব যখন গ্রামের লোককে, কৃষকদের গিয়ে বোঝাচ্ছে যে দেখো ওই জোতদারকে মারাটাই হচ্ছে বিপ্লবের পথ, তোমরা ওই জোতদারটাকে যদি না মারতে পারো… এই কথা বলতে বলতে কৃষকরা ক্ষেপে গিয়ে ওই সুদেবকে পিটিয়ে খুন করেছিল! এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি কেউ কোনওদিন শুনেছে? এইটা ভারতবর্ষের বিপ্লবের ক্ষেত্রে ঘটেছে। কিন্তু তাই বলে কি প্রচেষ্টাটা অকারণ ছিল? ভয়ানক জরুরি ছিল। গৌরীদা সমরবাবুর মতো বহু ইন্টেলেকচুয়াল, যাঁরা সরাসরি সংস্কৃতির সঙ্গে, সাহিত্যের সঙ্গে, নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন যে এত বড় আদর্শকে নিয়ে এরা নয়ছয় করছে। এই ক্রিটিসিজমটা রেখেছিলেন বলে সমর সেন নকশালদের একটা সেকশানের কাছে অত্যন্ত আনপপুলার হয়ে গিয়েছিলেন! সরোজ দত্ত তাঁকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলেছিলেন!
কাজেই যা দাঁড়াল তা এই যে সমর সেনের মতো একজন ক্রিয়েটিভ লোক কিন্তু তাঁর নিজস্বতা হারাননি। আইডিওলজি তাঁর নিজস্বতা নষ্ট করে দেয়নি!
একটা অন্য প্রশ্ন করি। সমর সেন বাংলায় লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন? এই প্রশ্নটার উত্তর হাজার খুঁজেও আমি পাইনি। কী কারণ?
ওঁর ওই একই উত্তর। ‘ঠিক আসে না, জানেন!’ সমর সেনের বাংলা আসে না? এই কথা আমায় মেনে নিতে হবে? (হাসি) এই বিষয়ে একটা মজার কথা বলি। তুমি তো জানোই আমার বন্ধু প্রবীরের বাড়িতেই অফিস করে আমরা প্রস্তুতিপর্ব কাগজ বের করতাম। রবিবার করে মিটিং বসত। তো ওই উত্তর পাওয়ার প্রায় মাস দেড়েক পর, হঠাৎ দেখি, এক শুক্রবার সকালের দিকে মানে ধরো দশটা-এগারোটা নাগাদ প্রবীর উত্তেজিত হয়ে ফোন করেছে: “আরে, অবাক কাণ্ড, সকালে উঠে দেখি বাড়ির লেটার বক্সে একজন এসে সমর সেনের নিজের হাতে লেখা একটা লেখা দিয়ে গেছে!’’ তুমি ভাবো! লেখাটার নামও ছিল ‘প্রস্তুতিপর্ব’। ‘কীসের প্রস্তুতিপর্ব?’— এই প্রশ্নটা উনি সে-লেখায় তুলেছিলেন। এবং ওঁর বাংলা লেখা আবার ওটা দিয়েই শুরু হয়েছিল। পরে বাবু–বৃত্তান্ত সঙ্কলনের অনেকগুলো লেখা এইটা দিয়েই শুরু হয়েছিল। আমি জোর গলায় বলতে পারি যে আমি পার্সোনালি ওঁকে আবার বাংলায় ফিরতে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলাম।
দারুণ! আপনার আগের কথাগুলো শুনে একটা চিন্তা এল। সরোজ দত্ত বিকামজ অ্যান অ্যান্টিথিসিস অফ সমর সেন, তাই নয় কি?
দেখো সরোজ দত্তর ব্যাপারটা অন্যরকম!
বলতে চাইছি, শুধুমাত্র আইডিওলজিকাল ন্যারেটিভকে সাপোর্ট করতে গিয়ে মূর্তিভাঙা এবং এমন আরও বোকা বোকা কাজকে কীভাবে উনি এন্ডোর্স করতে পারেন? যেভাবে কুৎসিত ভাষায় ক্রিটিকদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন, ইট ডাজ নট মেক এনি সেন্স টু মি! আমার সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হয় সরোজ দত্তর ক্ষেত্রে কমিটমেন্ট টু আইডিওলজি অথবা তার নিরিখে হওয়া তাৎক্ষণিক কার্যকলাপ ওঁর কমিটমেন্ট টু আর্টকে গিলে খেয়েছিল।
খুব সুন্দর তুমি পয়েন্টটা তুলেছ! কিন্তু সমর সেনের সঙ্গে সরোজ দত্তর তফাৎ হচ্ছে এই জায়গায় যে, সরোজ দত্ত ফ্রম ডে ওয়ান ওয়াজ আ পলিটিকাল ম্যান। এই সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি বরাবরই তাঁর কাছে গৌণ। কিন্তু সমর সেন হলেন প্রাইমারিলি এ ম্যান অফ লিটরেচার। তাঁর কাছে এই মতাদর্শগত জায়গাটা গৌণ ছিল। এটা তোমাকে মানতে হবে। কাজেই শেষমেশ সমর সেন একটা সমন্বয় সাধন করতে পারলেন, কিন্তু সরোজ দত্তর কাছে পলিটিক্সটাই একমাত্র রাস্তা হয়ে উঠল। তাঁর ওই বড় লেখক বা উঁচুদরের কবি হিসাবে পরিচয়টা তিনি নিজে হাতে সরিয়ে দিয়ে রাজনীতিটাকেই প্রধান করে দিলেন। কাজেই ওঁর ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভিটি রইল না কথাটা ঠিক নয়; বরং আমি বলব উনি ক্রিয়েটিভিটিকে বর্জন করেছিলেন, ইন ফেভার অফ পলিটিক্স। আমি এইটা বলতে চাইছি। ইট ইজ বাই চয়েস!
কিন্তু, আপনি যেমন বললেন, এ কথা ঠিক যে ওঁর সাহিত্যকীর্তি, ওঁর লেখা সনেট, স্বাধীনতার এডিটিং–এর কোনও তুলনা হয় না। আমি শমীক বন্দোপাধ্যায়ের ইন্টারভিউতেও শুনেছি।
হ্যাঁ, ওঁর সনেট অত্যন্ত উচ্চমার্গের।
কাজেই নিজের ক্রিয়েটিভ সত্তাকে তো উনি কোনওদিনই অস্বীকার করেননি বা ডিপ্রায়োরিটাইজ করেননি!
অস্বীকার না করলেও উনি যা কিছু করেছেন, সে-সবই ওয়্যার সাবসার্ভিয়েন্ট টু হিজ পলিটিক্স। উনি মনে করতেন যে ওঁর ক্রিয়েটিভিটি উইল সার্ভ পলিটিক্স ওনলি। প্রথম দিন থেকে। অর্থাৎ শিল্প বা কবিতা বা ভাষার স্বতন্ত্র চর্চার জায়গাটার যে একটা মূল্য আছে সেটা উনি প্রথম দিন থেকেই মানতেন না। এ-কথা ঠিক যে ওঁর এই পরিণতি খুব দুঃখের, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়, একে ব্যাখ্যা করা যায়। কাজেই আমার মতে এটা সমর সেনের অ্যান্টিথিসিস ঠিক হল না। ব্যাপারটা এমন নয় যে সমর সেনের মতো কবিতা লিখতে লিখতে উনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন। উনি যখন কবিতা লিখতেন তখন সেই কবিতাকে রাজনীতির অংশ হিসাবেই লিখতেন। সেটা সমর সেন কোনওদিনই করেননি। কাজেই ক্রিয়েটিভিটি খর্ব হওয়ার সম্ভাবনাটা ওঁর মধ্যে ছিলই। যাঁরাই সাহিত্যকে রাজনীতির সাবসার্ভিয়েন্ট হিসাবে মনে করেন তাঁদের ক্ষত্রে এমন ঘটনা দেশে বিদেশে সর্বত্র ঘটেছে।
বুঝলাম, যদিও আপনার সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত নই। এবার, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেই প্রশ্নটায় ফিরে যাই। আপনার মতে, হু ইজ অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল?
(হাসি) এইটা একটা বিরাট প্রশ্ন, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ভয়ানক শক্ত! আমার মনে হয়, গ্রামসি তাঁর চিন্তাভাবনায় অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল বলে একটা কনসেপ্ট এনেছিলেন, আমি তার দিকেই ঝুঁকে। একজন ইন্টেলেকচুয়াল সে, যে স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করবে। কার সঙ্গে মিলল না-মিলল সে তার পরোয়া করবে না। এইটা এক নম্বর এবং প্রধান পয়েন্ট। দু-নম্বর হল সেই ইন্টেলেকচুয়াল সমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসবে। অক্সফোর্ডের প্রফেসার হলেই বুদ্ধিজীবী হওয়ার ছাড়পত্র পাওয়া যায় না। শ্রমিকদের মধ্যে থেকে, মধ্যবিত্তের মধ্যে থেকে, থ্রু দা স্ট্রাগল যে ইন্টেলেক্টের ডেভেলপমেন্টটা হবে, সেটা যখন শিল্প সাহিত্যে প্রবন্ধে প্রকাশ পাবে দ্যাট পার্সন বিকামজ অ্যান অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল। এই অর্থে ইন্টেলেকচুয়ালিজমকে আমি মানি।
কিন্তু যে ইন্টেলেকচুয়ালিজমকে ‘লাইসেন্স টু গেট ডিট্যাচড ফ্রম দি মাসেস’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়, যাকে বাংলায় আঁতলেমি বলে, যাঁরা ভাবেন জনগণ মূর্খ, তাদের কোনও সেন্স নেই, সেই ডেফিনেশানটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। আপনি বলুন যে আপনি খুব উচ্চমানের ফিল্ম-করিয়ে, আপনি উচ্চমানের একজন লেখক, কিন্তু যখনই আপনি বলছেন আপনি একজন বুদ্ধিজীবী, তখন যে মানুষ আপনার লেখা বা ফিল্মের ভাষা বুঝতে পারে না অথচ আপনার চেয়ে অনেক ভালভাবে একটা যন্ত্র বানাতে পারে, বা একবার বলে দিলে অতি সুন্দরভাবে একটা খারাপ হয়ে যাওয়া মেশিনকে সারিয়ে তুলতে পারে, তাকে আপনি ছোট করছেন। কেন? সেই মানুষটার বুদ্ধি কোন অংশে কম? একে তুমি বুদ্ধিজীবী বলবে না?
ঠিক, নিশ্চয়ই বলব!
সে লেখাপড়া জানে না, সে বিচ্ছিরি বাংলা বলে, সে একবর্ণ ইংরেজি জানে না, কবিতা তো দূরের কথা। সে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে মুখ বেঁকিয়ে চলে যায়। তা বলে কি সে ইন্টেলেকচুয়াল নয়? আমার আপত্তিটা এই জায়গাটায়। ইন্টেলেকচুয়াল মানে এমন কিছু যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে— আমার আপত্তিটা এই জায়গায়। হ্যাঁ ঠিক, সাধারণ মানুষ সত্যিই অনেক কিছু বোঝে না, কিন্তু সাধারণ মানুষের সব জিনিস কি আমরা বুঝি? তাদের ভাষা, তাদের চালচলন, তাদের রীতি নীতি, সমাজবিজ্ঞানের এই দিকটা দেখলে অনেক কিছুই আমরা বুঝি না। নকশালরা যারা গ্রামে যেত তাদের চারুবাবু নির্দেশ দিতেন যে, “তোমরা রেডিও নিয়ে যাবে না। কারণ রেডিও নিয়ে গেলে তোমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবে।” (হাসি) রবীন্দ্রসঙ্গীত যতই উচ্চমার্গের জিনিস হোক, গ্রামের সেই পরিস্থিতিতে সেটা বিপ্লবীকে মানুষের কাছ থেকে এলিয়েনেট করছে। এটা চারুবাবু বুঝতেন।
কিন্তু সেই চাষি যেসব লোকসঙ্গীত সৃষ্টি করেছে, যেগুলো রণেন্দ্র রায়চৌধুরী বা কালি দাশগুপ্ত গিয়ে-গিয়ে সেই নদীর ধারে, মাঠের মধ্যে বসে তাদের মুখ থেকে জোগাড় করেছিলেন, সেগুলো শিল্প নয়? সেগুলোকে কিন্তু রবীন্দ্রনাথও গুরুত্ব দেননি। রবীন্দ্রনাথ যে বাউলকে গুরুত্ব দিয়েছেন সে তো পূর্ববঙ্গের বাউল। সে অপেক্ষাকৃত আধ্যাত্মিক। কিন্তু সিলেটের বা উত্তরবঙ্গের বা ভাওয়াইয়া গানগুলো, যেগুলো অনেক বেশি ‘ডাউন টু আর্থ’, সেগুলোকে তো রবীন্দ্রনাথ একদমই গুরুত্ব দেননি! এটা তো রবীন্দ্রনাথেরই ব্যর্থতা।
কিন্তু কেন দেননি, সেটাই তো প্রশ্ন!
কারণ ওগুলো ওঁর আইডিওলজির সঙ্গে মেলে না। ওঁর ওই ঔপনিষদীয় আদর্শ ওঁকেও একটা জায়গায় গিয়ে ক্রিপল করেছে। আমি এইটা বলতে চাইছি। ‘আমার কালো পাখি গেল উড়ে ভালবাসার শিকল ছিঁড়ে’র মতো গান, রণেনদা আমাদের সামনে বসে গাইতেন, আমার এখনও কানে বাজে! তুমি বলো তো, এই গান বা লেখা যাঁদের গলা বা হাত থেকে বেরোতে পারে তাঁরা ইন্টেলেকচুয়াল নয়? ওই গান, ওই সুর! অথচ তাঁদের ওই চালচলন ভদ্রলোকি ডেফিনেশানের ব্র্যাকেটের বাইরে। গান গাইতে গাইতে নাক খুঁটছে, দাঁত মাজেনি, আর সেই নোংরা দাঁত বের করে গাইছে বলে তাদের আমি ইগনোর করব, সেটা আমার কাছে অসহ্য রয়ে উঠবে? আমার কালচারটাই যে প্রিডমিনেন্টলি সুপিরিয়ার, এটা কীসে প্রমাণিত হল? এইসব প্রশ্ন কিন্তু নকশাল আন্দোলনের মধ্যে থেকে উঠেছিল। এই যে কালি দাশগুপ্তর কথা বললাম, সেই কালিদার আমরা একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। কালিদা তো মূলত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে গানের সুর গানের ভাষা তুলে আনতেন, বিরাট কালেকশান ছিল! সদ্য সেগুলো বই হয়ে বেরিয়েছে। কালিদা বলতেন যে, ‘দ্যাখ, এই উত্তরবঙ্গীয় গানের মধ্যে দুটো তিনটে জিনিস আছে।’ এক হচ্ছে পরকীয়া প্রেম। যেমন, ‘ছাতা ধরো হে দেওরা’ এখন খুব জনপ্রিয় হয়েছে, আমরা কালিদার মুখ থেকে ৫০ বছর আগে প্রথম শুনেছিলাম। এখানে এক বৌদি আর দেওরের অবৈধ প্রেমের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, যেটা আমাদের ভদ্রলোকি ভিক্টোরিয়ান মরালিটিতে খাপ খায় না। কালিদা এটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করছেন। বলছেন, দ্যাখ ওই বধূটির স্বামী কিন্তু হাতির মাহুত হিসাবে কাজ করে। এবং মাসের পর মাস সে বাড়িতে থাকে না। দ্বিতীয়ত ওই বধূটি, বাড়িতে, শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে, নানাভাবে নির্যাতিত হয়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, প্রায় সমবয়সী দেওরের সঙ্গে তার একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠছে। সেটাকে অবৈধ বললে কি ঠিক বলা হয়? সেটা তো তার মুক্তির জায়গা! এই প্রশ্নগুলো কিন্তু নকশাল আমলে উঠেছিল। তাছাড়া কালিদা বলতন, ‘এইসব গানে আধ্যাত্মিকতা প্রচণ্ড। কথায় কথায় ঈশ্বর চলে আসছে। ওটা তোমার খারাপ লাগবে! কারণ তুমি তত্ত্ব দিয়ে বিজ্ঞান দিয়ে কেন ধর্ম খারাপ সেসব বুঝেছ। ওর কাছে সে সুযোগ নেই। ও দেখছে, যে সমস্ত জিনিস ও ব্যাখ্যা করতে পারে না, বা যা ওর বোধের অতীত তাই ইশ্বর। সে তুমি যে নামেই ডাকো। তুমি আজ বিজ্ঞান শিখেছ। তাই তুমি বলতে পারো যে এই অবধি বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল, বা এই নতুন আসা স্ট্রিং থিওরি জিনিসটা আদপে কী, তা তো বিজ্ঞানীরাই বলতে পারছেন না। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে যে নিরক্ষর লোকটা খেটে খায়, সে যদি বোধগম্যের বাইরের জিনিসকে ঈশ্বর বলে তোমার আপত্তির কী আছে? তুমি কে?’ একজন মার্কসবাদীর মুখ থেকে এই প্রশ্নটা আমাদের হতবাক করে দিয়েছিল! আমরা তো সত্যিই বলতাম যে এইগুলোই আমাদের দেশের সাধারণ লোকের পিছিয়ে থাকার প্রমাণ। এগুলো জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কালিদা বলতেন, ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে কিনা ভাল করে ভেবে দ্যাখ। তার সামনে অন্য কী বিকল্প আছে?
সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসদের ভালরকম পরিচিত ছিলেন কালিদা। উনি বামপন্থীদের এই বলে সমালোচনা করতেন যে, আমরা আমাদের গণসঙ্গীতের সুর নিয়ে গিয়ে ওদের গানের জায়গায় বসাতে চেয়েছি। এবং একটা সময়ে আমরা বুঝেছি যে দিজ ইজ ফিউটাইল! মানুষ হয়তো কমিউনিস্ট পার্টির কোনও সদস্যের প্রভাবে পড়ে সভায় আসছে, এসে গণসঙ্গীত গাইছে। কিন্তু সে যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ওই গান কিন্তু আর গাইছে না! হেমাঙ্গদার যেহেতু একটা ফোক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল, কারণ উনি আসামের গ্রামের লোক, উনি ওঁদের গ্রামের সুরের মধ্যে রেভোলিউশানারি কন্টেন্ট ঢুকিয়ে সেই ফর্মটা তাদের কাছে নিয়ে যাওয়ার বিরাট একটা চেষ্টা করেছিলেন। খানিকটা গৃহীত হয়েওছিল, কিন্তু আমরা সেটা ধরে রাখতে পারিনি। এইখানে তিনি পার্টির প্রশ্ন তুলছেন, তুলে বলছেন, ‘আমরা যারা কালচারাল ফ্রন্টে আছি, আমরা ছিলাম ভিড় জমাবার একটা উপকরণ মাত্র!’ ওঁদের গানের ফর্ম মানুষের চিন্তা-চেতনায় কীভাবে এফেক্ট ফেলছে বা আদপেও ফেলছে কিনা এটা নিয়ে পার্টির কেউ মাথা ঘামায়নি। এক পিসি জোশি খানিকটা মাথা ঘামিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে এসব কমিউনিস্ট পার্টি থেকে উঠেই গিয়েছিল। এইখানে আমি বলব নকশালদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হলেও, এই অফশ্যুটস অফ দি রেভোলিউশান থেকে এই ধরনের চিন্তাভাবনা অজস্র বেরিয়ে এসেছিল। একটা গানের মধ্যে ঈশ্বরের প্রসঙ্গ আসছে মানেই সেটা প্রতিক্রিয়াশীল নয়। একজন কৃষক সলিল চৌধুরীর গান গ্রহণ করছে না বলে সে প্রতিক্রিয়াশীল নয়! ওটা তার সাংস্কৃতিক অনুভূতির সঙ্গে মিলছে না। দায়িত্বটা আমাদের, তার নয়। তার অনুভূতির জায়গাটা আমায় বুঝতে হবে, সেইমতো, সেইভাবে গান, কবিতা, নাটক ইত্যাদি তৈরি করতে হবে। এটা কিন্তু মাও সেতুং-ও বলেছিলেন। কিন্তু আমরা কথাটাকে এমন রাজনৈতিক অর্থে নিয়েছিলাম যে তাঁর কথার সাংস্কৃতিক অ্যাঙ্গেলটা আমরা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছিলাম। পরবর্তীকালে কালিদা, হেমাঙ্গদার মতো মানুষেরা ব্যাপারটাকে সামনে আনায় আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম যে আমাদের তথাকথিত শহুরে প্রগতিশীলতা যদি গ্রামের লোকের মধ্যে ঢোকাতে না পারি তাহলে বিপ্লব হবে না। বিপ্লব তো এমনিও হয়নি, ওমনিও হত না, কিন্তু মাঝের থেকে যেটা হয়েছে তা হল এই পুরো কালচারাল প্রচেষ্টাটা ব্যর্থ হয়েছে। তবে এই ব্যর্থতার মূল্য দিয়ে অনেকেই অনেককিছু বুঝেছে।
বিফল চেষ্টা, কিন্তু খুব ভাল এক্সপেরিমেন্ট!
(হাসি) কিন্তু নকশালরা ছাড়া একেবারে ফান্ডামেন্টাল লেভেলে আর কে-ই বা কী চেষ্টা করেছিল বলো?
আর এক্সপেরিমেন্ট না করতে চাওয়াও তো একধরনের স্থবিরতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা। আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি।
হ্যাঁ! সিপিআই ইমার্জেন্সি সাপোর্ট করে দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছিল! আমার দেশের ব্যাপারে রাশিয়া কী বলছে সেটা মানতে গিয়ে! বাকি কমিউনিস্ট দলগুলোও বা কী করছিল বলো? সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নকশালরাই একমাত্র স্ট্যাটাস কুয়োটাকে ভাঙতে চেয়েছিল, বলেছিল কোনও কিছু মানব না!
কিন্তু এমার্জেন্সির ব্যাপারটাকে তো সিপিএম–ও সাপোর্ট করেনি। যদিও ওরাও চায়নাপন্থী (হাসি)!
চিন সেই সময়ে একরকম, কিন্তু তারপর তার কী দশা হল? আমি তো বলব আজ আমেরিকার চেয়েও বিপজ্জনক দেশ চিন। তারা মুখে সমাজবাদের কথা বলছে, এখনও কমিউনিস্ট পার্টির স্ট্রাকচার বজায় রেখেছে, কিন্তু কাজের দিক থেকে ওদের চেয়ে বড় পুঁজিবাদী আর কে আছে? তারা সেই ইথোসকে প্রমোট করছে। চায়না তো ফ্যাসিবাদের পথ তৈরি করছে। করে বলছে আমরা মার্কসের কথার নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছি।
আর সিপিএম–ইয়েচুরি তো এর মধ্যেও বললেন চায়নায় নাকি এখন ওয়েল পেইড লেবার! হাস্যকর!
(হাসি) কাজেই এগুলো আমি সোজাসুজি বলব না? চিনে কতটুকু ট্রেড ইউনিয়ন রাইট বা হিউম্যান রাইট আছে বলো তো? মান্থলি রিভিউ-তে ওদের সম্পর্কে যে সমস্ত কথা বেরিয়েছিল তা থেকে ওদের অবস্থা তো মোটেই ভাল বলে মনে হয় না! এই কি সোশালিজম! কাজেই ওরাও ফেল করেছে! কিন্তু এক্সপেরিমেন্টটা করে ফেল করেছে! আমার এইটাই কথা। আমরা পরীক্ষাও করব না আর তাকে জাস্টিফাই করার জন্য বলব, একপেরিমেন্ট করতে গিয়ে তো তোমাদের এই অবস্থা হয়েছে! আরে; এক্সপেরিমেন্ট না করলে সেটা যে ফেইল করেছে তা আমরা কি বুঝতে পারতাম?
দেখো সবকটা মার্কসিস্ট দেশ ফেইল করেছে। কিন্তু তার অর্থ কী ফেইলিওর অফ মার্কসিজম? আমরা শিখেছিলাম মার্কস নাকি ইকোলজি-টজি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি, নাকি বলেছিলেন প্রোডাকশানটা একধার থেকে বাড়িয়ে যাও, কেবল মালিকানাটা শ্রমিকদের হাতে ছেড়ে দাও! কিন্তু প্রোডাকশান, এমনকি চাষবাস যে প্রকৃতির ক্ষতি করতে পারে, এই কথাটা যে মার্কস নিজে বলেছেন, এবং শুধু বলেছেন নয় এই সমস্যাটা যে ভবিষ্যতে একটা প্রধান ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে সেটাও বলেছেন— এটা তো আমরা ওনলি রিসেন্টলি কোহেই সাইতো আর জবি ফস্টারের রিসার্চ থেকে জানতে পারলাম।
আমার শেষ প্রশ্ন! আমরা যে সময়ে বসবাস করছি, এবং প্রতিক্রিয়ায়াশীলতাকে যদি মতবাদের মধ্যে না ধরি, তাতে আপনার কী মনে হয় যে “আইডিওলজি” মৃত’?
না! এইটা আমি একেবারেই মানতে রাজি নই। এই কথাটা ইটসেলফ একটা আইডিওলজি! এই যে এখন আর কোনও আইডিওলজি বেঁচে নেই, আমরা একটা আইডিওলজিকাল ভ্যাকুয়াম-এ আছি, এই কথাটা আমি একেবারেই মানতে পারি না। যাঁরা এই কথাটা বলেন, কী ভেবে বলেন তা আমি বলতে পারব না। পোস্টমডার্নিজম এই কথার উপর দাঁড়িয়ে আছে। ওরা বলতে চায় এ পৃথিবীতে ডেফিনিট বলে কিছু নেই। ২+২=৪ একটা ডেফিনিট ব্যাপার তা কিন্তু আমি বলতে চাইছি না। কিন্তু সেটা প্রমাণ করতে গেলে একটা পদ্ধতি, একটা মেথড প্রয়োজন। আর মেথড যদি থাকে তাহলে তার পিছনে একটা আইডিওলজিও থাকতে বাধ্য। এর চেয়ে বেশি আমি এ নিয়ে কিছু বলতে পারব না, কারণ এর চেয়ে বেশি আমার এ বিষয়ে পড়াশোনা নেই। বলতে পারো এটা আমার হাঞ্চ! এমন তো হতেই পারে, যে-আইডিওলজি আজ প্রয়োজন তা এখনও ফর্মুলেটেডই হয়নি! একসময় “এন্ড অফ হিস্ট্রি” নিয়ে খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল। এর মানে হল পুঁজিবাদ ছাড়া আর কোনও গতি নেই, সমাজতন্ত-টন্ত্র সব ভেসে, ধুয়ে, মুছে, সাফ হয়ে গেছে! এই তো! কে বলতে পারে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে অন্য কিছু একটা গড়ে উঠবে না? আজ থেকে দেড়শো বছর আগে কেউ ভাবতে পেরেছিল যে রাশিয়াতে এই লেভেলের একটা বিপ্লব আসতে পারে? এইরকম একটা জিনিস ওঠে আবার পড়ে। মেথড সবসময় আছে, কাজেই তার পিছনে কোনও না কোনও আইডিওলজি অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা কী, আমি তোমায় বলতে পারব না। তার জন্য আরও অনেক লেখাপড়া দরকার। সেটা এ জীবনে আর হবে না। তবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি যতদিন না নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, ততদিন আইডিওলজি থাকবে। দিজ ইজ মাই ফিলিং! বিশ্বাস বলতে পারো। সাম কাইন্ড অফ রিলিজিয়ান, সেই আইনস্টাইনের কথায়, মোর রিলিজিয়াস দ্যান এনি বিলিভার! (হাসি)
(হাসি) আমি জাস্ট বলতে যাচ্ছিলাম! তাহলে সবশেষে দাঁড়াল ইউ আর মোর রিলিজিয়াস দ্যান এনি রিলিজিয়াস পার্সেন অ্যান্ড অ্যান ইনকরিজিবল অপ্টিমিস্ট! (হাসি)
বলতে পারো। তবে এ ধর্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস নয়, এ রিলিজিয়ন যুক্তিতে বিশ্বাস। যুক্তির পথটা আমি যুক্তি দিয়ে হয়তো প্রমাণ করতে পারছি না, কিন্তু যুক্তি আছে বলেই আমি বিশ্বাস করছি। এই আর কি। আসলে এর জন্য আরও অনেক পড়াশোনা প্রয়োজন। এ বয়সে সেটা পসিবল নয়। অল্পবয়সীরা পারবে। তোমরা পারবে! তোমাদের মাথায় অনেক কিছু ঘোরে। (হাসি!)