Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডাক্তারগুলা চিল্লায় ক্যান?

কৌশিক দত্ত

 


চিকিৎসকেরা, বিশেষত জুনিয়র চিকিৎসকেরা কেন তিলোত্তমা বা অভয়া হত্যার ন্যায়বিচারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, কেন তার বাইরেও ‘নিরাপত্তা’, ‘থ্রেট কালচার’ ইত্যাদি আজগুবি কথাবার্তা বলছেন, কেন মুখ্যমন্ত্রী ক্যামেরার সামনে মিষ্টি করে চা খেতে বলার পরেও তাঁরা নিজেদের গোঁ ছাড়ছেন না, কেন দীর্ঘ কর্মবিরতি, এগুলো বোঝা দরকার। চিকিৎসকদের আন্দোলনে পাঁচ দফা, সাত দফা, দশ দফা দাবির কথা আমরা শুনেছি। আদতে মূল দাবি শুরু থেকে দুটোই। এক, তিলোত্তমার নারকীয় ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার, প্রকৃত দোষীদের সকলের যথোপযুক্ত শাস্তি বিধান। দুই, ভবিষ্যতে আর কাউকে যাতে এভাবে নির্যাতিত হয়ে মরতে না হয়, তা নিশ্চিত করা। বাকি সব দফা এবং দাবি এই দুটো মূল দাবি আদায় করার subclause বা প্রক্রিয়ামাত্র

 

আসলে অনেক দেরিতেই শুরু করেছি আমরা। হয়তো একটু বেশিরকম দেরিতে। টিউমারটা ছোট থাকতে গুরুত্ব দিইনি, সয়ে গেছি। যখন যন্ত্রণা সহ্যের মাত্রা ছাড়াল, তখন হঠাৎ স্ক্যান করে দেখা গেল ক্যান্সার সর্বত্র ছড়িয়েছে। ফুটপথবাসিনী থেকে ডিউটিফেরত কলসেন্টার-কর্মী মেয়ে যখন ধর্ষিত হয়েছেন, আমরা রাস্তায় নামিনি। নিজের মেয়েকে আরও আরও বেড়া দিয়ে বেঁধেছি। খালের পাশে বা রেললাইনের ধারে পড়ে থাকা লাশের জন্য বিচার চাইনি, আইপিএলের উত্তেজনায় মজে গেছি… ওই মারল ছক্কা সাড়ে বাইশ কোটির বোলারকে। প্রতিদিন নানা ধরনের দাদাগিরি সহ্য করতে করতে তাকে বাড়তে দিয়েছি৷ সরকারি হাসপাতালে চলতে থাকা অনিয়ম, নিম্নমানের ওষুধ, দুর্নীতিচক্র, অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট-রাজ ইত্যাদির বিরুদ্ধে হাসপাতালের অফিসার থেকে শুরু করে চিকিৎসক সংগঠনগুলো যখন সরকারকে চিঠি লিখেছেন এবং সরকার পাত্তাই দেয়নি, তখন সংবাদমাধ্যম সেই খবরকে গুরুত্ব দেয়নি এবং সাধারণ মানুষ গা করেননি। ২০১৮ সালে মেডিকেল কলেজের অনশন, পরের বছর এনআরএস মেডিকেল কলেজের আন্দোলন, ২০২১-এ আরজিকরের আন্দোলন, ২০২২-এ মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনের সময় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন চিকিৎসকদের জোট বেঁধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা ইত্যাদি ঘটনায় দুর্নীতি এবং অন্যায় দাদাগিরির বিরুদ্ধে চিকিৎসকমহলের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ বারবার সামনে এসেছে। সাধারণ মানুষ তখন সেভাবে গুরুত্ব দেননি, এগুলো চিকিৎসকদের ভেতরের ব্যাপার ভেবে। এর কারণ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে উভয়ের মধ্যে ফাটল তৈরি করার যে খেলা তিন দশকের বেশি ধরে চলছিল ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, তা ততদিনে অনেকটাই সাফল্য অর্জন করেছিল।

অন্ধকারের বেসাতি করা রাজনৈতিক রথের মসৃণ জয়যাত্রায় সহসা বাদ সাধল ‘তিলোত্তমা’। তার মৃত্যু হঠাৎ আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে জাগিয়ে তুলল “চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।” সেও মন্দ নয়। দেরিতে হলেও শুরু করতে পারাটা বড় ব্যাপার। মানুষ এখনও কাঁদতে ভুলে যায়নি দেখে ভাল লেগেছে। মানুষ এখনও রুখে দাঁড়াতে পারে দেখে আশায় বুক বেঁধেছি। মানুষ এখনও অচেনা সহমানুষের সঙ্গে জোট বাঁধতে সক্ষম দেখে শাসক এবং ত্রাসকেরা ত্রস্ত।

সম্ভবত স্থান-কাল-পাত্র মানুষকে স্তম্ভিত, আতঙ্কিত করেছে এবার। রাজ্যের রাজধানী শহরের একটি প্রথম সারির মেডিকেল কলেজের ভেতরে কর্মরত অবস্থায় একজন মহিলা চিকিৎসক বীভৎসভাবে নির্যাতিত এবং নিহত হলেন, এটা একটা “টিপিং পয়েন্ট”। এরকম একটা ঘটনায় আমরা বুঝতে পারলাম যে এতদিন যেসব বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছি আমরা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধে অভ্যস্ত ছাপোষা মানুষেরা, তা বস্তুত অর্থহীন। তথাকথিত নিরাপদ স্থানে তথাকথিত উচ্চশক্ষিত, এলিট, দুর্গাপূজা করা ভাল মেয়েরও এই পরিণতি হতে পারে। তারপর যেভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে, প্রমাণ লোপাট করতে এবং অপরাধীদের আড়াল করতে তৎপর বলে মনে হল, তাতে সুরক্ষার শেষ আশ্বাসটুকুও বুদবুদের মতো উবে গেল। স্পষ্ট হল, ক্যান্সারের চিকিৎসা না করলে বাঁচার উপায় নেই। এই মানুষখেকো কর্কট-ব্যবস্থাটির খোলনলচে না বদলালে কেউ নিরাপদ নয়।

এই বোধ থেকে শুরু হল প্রতিরোধ। দুটো মূল ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে আন্দোলন। একটা লিঙ্গ-রাজনৈতিক আন্দোলন, যার পুরোভাগে আছে “রাত দখল, অধিকার দখল।” পাশাপাশি চলছে চিকিৎসকদের মরণপণ লড়াই, যার নেতৃত্বে জুনিয়র ডাক্তারেরা। এই দুই ধরনের আন্দোলন এবার তেড়েফুঁড়ে শুরু হলেও আদতে কোনওটাই আনকোরা নতুন নয়, এক প্রবহমানতার নবীন ঢেউ। যেটা এবার নতুন এবং অসামান্য, সেটা হল এই দুই আন্দোলনে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান, যার ফলে এক বিশাল গণআন্দোলন গড়ে উঠতে পেরেছে। সব দোষ চিকিৎসকদের ঘাড়ে চাপানোর প্রকল্প কয়েক দশকের, আর নারী-ট্রান্স-কুইয়ারদের ঘাড়ে যাবতীয় যৌননিগ্রহের দায় চাপানোর অভ্যাস তো সুপ্রাচীন। দুটো ষড়যন্ত্রের এতদিনের সাফল্য এবার হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ল। মানুষ এঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। গ্রামেগঞ্জে সব মানুষের কাছে আমরা আমাদের বার্তা এখনও পৌঁছে দিতে পারিনি হয়তো, তবু এ-কথা অনস্বীকার্য যে এত বড়মাপের গণআন্দোলন এই রাজ্যে আমরা অনেকেই আমাদের জীবনে দেখিনি।

গত পৌনে দুই মাস ধরে বেশিরভাগ সময় রাস্তায় কাটিয়েছি এক বিপুল মানবসাগরের জলবিন্দু হয়ে। কখনও চিকিৎসকদের মিছিলে, কখনও রাতদখলের মিছিল বা সমাবেশে, কখনও ট্রান্স-কুইয়ার মানুষদের ডাকা সমাবেশে, কোনওদিন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনিদের মিছিলে, কবি-সাহিত্যিক-সহ বিভিন্ন পেশার মানুষের মিছিল বা কনভেনশনে, নাগরিক মিছিলে, যা হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছে যেন… আবার কখনও মেডিকেল কাউন্সিলের সামনে প্রতিবাদে বা সপ্তাহাধিক কাল সারারাত স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ভাইবোনেদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে। ভিড় বাড়ানো আর কিছু স্লোগানের অতিরিক্ত কিছুই দিতে পারিনি কিন্তু দুই মাসে শিখেছি অনেক। সেই শিক্ষার অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আমার মূল দায়িত্ব সংক্ষেপে চিকিৎসকদের আন্দোলন সম্পর্কে দু-চার কথা বলা।

চিকিৎসকেরা, বিশেষত জুনিয়র চিকিৎসকেরা কেন তিলোত্তমা বা অভয়া হত্যার ন্যায়বিচারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, কেন তার বাইরেও ‘নিরাপত্তা’, ‘থ্রেট কালচার’ ইত্যাদি আজগুবি কথাবার্তা বলছেন, কেন মুখ্যমন্ত্রী ক্যামেরার সামনে মিষ্টি করে চা খেতে বলার পরেও তাঁরা নিজেদের গোঁ ছাড়ছেন না, কেন দীর্ঘ কর্মবিরতি, এগুলো বোঝা দরকার।

চিকিৎসাক্ষেত্রে বড়মাপের কর্মবিরতি আমি ব্যক্তিগতভাবে আগে সেভাবে সমর্থন করিনি, কারণ রোগীরা আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ। এই প্রথমবার কর্মবিরতির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারলাম না, কারণ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে… শুধু চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের নয়, রোগীদেরও। শুরুতেই এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার যে আন্দোলন “ডাক্তার বনাম অডাক্তার” নয়, বরং এক অচিকিৎসক সিভিক ভলান্টিয়ারকে (যে ব্যক্তি হিসেবে একেবারেই ভাল নয়) একমাত্র অপরাধী বানিয়ে সরকারপক্ষ যখন তাৎক্ষণিক এনকাউন্টার বা এক সপ্তাহের মধ্যে ফাঁসির নিদান দিচ্ছিলেন, তখনই চিকিৎসকেরা রুখে দাঁড়িয়ে “প্রকৃত অপরাধী সকলের” শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন, এটা জেনেই যে এর ফলে কয়েকজন চিকিৎসক দোষী সাব্যস্ত হবেন। অর্থাৎ চিকিৎসকেরা লড়ছেন একটা নষ্ট সিস্টেম এবং কিছু ভ্রষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও, যাঁরা এই নষ্ট ব্যবস্থার অংশ।

চিকিৎসকদের আন্দোলনে পাঁচ দফা, সাত দফা, দশ দফা দাবির কথা আমরা শুনেছি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মাঝেমধ্যে “আবার নতুন দাবি” বলে ‘ব্রেকিং নিউজ’ করেছেন৷ আদতে মূল দাবি শুরু থেকে দুটোই।

  1. তিলোত্তমা বা অভয়ার নারকীয় ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার, প্রকৃত দোষীদের সকলের যথোপযুক্ত শাস্তি বিধান।
  2. ভবিষ্যতে আর কাউকে যাতে এভাবে নির্যাতিত হয়ে মরতে না হয়, তা নিশ্চিত করা।

বাকি সব দফা এবং দাবি এই দুটো মূল দাবি আদায় করার subclause বা প্রক্রিয়ামাত্র।

প্রথম দাবিটা বহু মানুষ করছেন। নির্ভয়াকাণ্ডের পরেও করেছিলেন, কামদুনি, হাথরাস, উন্নাওয়ের পরেও। এই দাবি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এর দুটো সীমাবদ্ধতা আছে। প্রথমত এটা রেট্রোস্পেক্টিভ, অর্থাৎ অপরাধ ঘটার পর শাস্তির দাবি। দ্বিতীয়ত এই দাবির মধ্যে মানবিকতার পাশাপাশি থাকে প্রতিশোধস্পৃহাও। বিশেষত দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের পর অনেকের কথা শুনে এবং পড়ে সেটা স্পষ্ট হয়েছিল। অনেকে অপরাধীদের ওপর যে ধরনের অত্যাচারের অভিলাষ প্রকাশ করেছিলেন, তা বীভৎসতায় মূল ঘটনাটির চেয়ে কম নয়।

অপরপক্ষে চিকিৎসকেরা শুধুমাত্র প্রতিশোধস্পৃহার বশবর্তী হয়ে লড়াই করতে পারেন না। তাঁদের মৌলিক প্রবণতা মানুষকে বাঁচানো। তাই যে মেয়েরা, শিশুরা, প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা, এমনকি ছেলেরাও এখনও বেঁচে আছে কিন্তু ভবিষ্যতে মরতে পারে যে-কোনওদিন, তাদের বাঁচানোর চেষ্টায় দ্বিতীয় দাবিটাই লড়াইয়ের মূল মন্ত্র। প্রথম দাবিটাও আসলে দ্বিতীয়টা অর্জন করার একটা ধাপ। চিকিৎসক হিসেবে আমরা যখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করি, তখন জীবাণুর ওপর অত্যাচার করার কথা ভাবি না, অসুস্থ মানুষকে বাঁচানোর ভাবনাই মন জুড়ে থাকে। চিকিৎসকদের আন্দোলনেও তাই। মাইক হাতে গলার শিরা ফুলিয়ে যখন চিকিৎসকেরা “বিচার চাই, শাস্তি চাই” বলে চিৎকার করছেন, তখন আসলে ভবিষ্যতের খুন-ধর্ষণ রোখার চেষ্টাই করছেন।

এই কাজটি করতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে তিল তিল করেই তিলোত্তমার জন্ম, একদিনে নয়। শাসক সব অপকর্মকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে চাইবে, কিন্তু আমাদের দৃঢ় ধারণা, এই হত্যাকাণ্ড এক কুৎসিত ঘটনাপ্রবাহের পরিণতি। এই ঘটনাপ্রবাহের ফলে শুধু চিকিৎসকদের জীবন দুর্বিষহ হয়নি, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা হয়েছে বিপর্যস্ত এবং রোগীদের প্রাণ হয়ে গেছে দুরন্ত শিশুর হাতের খেলনা। এই বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের হওয়া উচিত, কিন্তু সেদিক থেকে উদ্যোগ না দেখে চিকিৎসকদেরই শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়তে হল বাধ্য হয়ে। ঠিক এই জায়গাতেই ক্রাইম সিন্ডিকেট এবং থ্রেট কালচারের কথা উঠছে।

স্বাস্থ্যক্ষেত্র-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অল্পবিস্তর দুর্নীতি আমাদের রাজ্যে বা দেশে ছিলই। গত কয়েক বছরে সেই দুর্নীতি হয়ে উঠেছে সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী। কোনও কিছুকেই আর বাদ দিচ্ছে না। যেসব কাজ কিছুতেই করা যায় না বলে ভাবতাম, সেগুলোও হয়ে গেছে প্রাত্যহিক। সরকারি হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাওয়া ইত্যাদি নিয়ে এক শ্রেণির কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে কিছু দালালচক্র গজিয়ে উঠেছিল কয়েক দশক ধরেই। ছাত্রাবস্থায় চেষ্টা করেও তা আমরা ভাঙতে পারিনি, যদিও মাঝেমাঝে বাধা দিতে অন্তত পারতাম। সেই চক্রগুলো ইদানীং হয়ে উঠেছে মহাশক্তিধর। শুধু হাসপাতালের শয্যা নয়, ছাত্রভর্তির আসন, প্রশ্নপত্র, পরীক্ষার মার্কশিট, হসপিটাল সাপ্লাইয়ের ওষুধ, যন্ত্রপাতি, সবই তারা বিক্রি করে এবং দেখা যাচ্ছে স্বয়ং অধ্যক্ষও সেই চক্রের অংশ। রোগী (অ)কল্যাণ সমিতিগুলো দুর্নীতির আখড়া।

অতি নিম্নমানের (সম্ভবত জাল) ওষুধের কারণে রোগীরা মারা যাচ্ছেন, এই অভিযোগ চিকিৎসকেরা একাধিকবার করেছেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমল দেননি। এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে যাওয়া ওষুধের ডেট স্ট্যাম্প মুছে দিয়ে নতুন স্ট্যাম্প লাগিয়ে বিক্রি করা বা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নাম লেখা মোড়কে জাল ওষুধ ভরে বিক্রি করার র‍্যাকেট এই শহরেও আছে৷ ফেলে দেওয়া নোংরা সিরিঞ্জ, সূঁচ, ব্লেড ইত্যাদি অবৈধভাবে এবং অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রিসাইকল করে সেগুলো হাসপাতালের রোগীদের শরীরের ওপর প্রয়োগ করা এবং বাজারে বিক্রি করার অভিযোগ আছে। এগুলো ব্যবহার করার ফলে হেপাটাইটিস সি, এইচআইভি সংক্রমণ ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। হয়তো আপনি গত মাসে পাড়ার দোকান থেকে যে সিরিঞ্জ এবং সূঁচ কিনে ইঞ্জেকশন নিয়েছেন, সেটা এভাবে বাজারে এসেছে এবং তার মধ্যে কোনও মারাত্মক ভাইরাস ছিল, আপনি জানেনও না। কী ভাবছেন, নিশ্চিত হওয়ার জন্য টেস্ট করিয়ে নেবেন? রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য যে সূঁচ ব্যবহার করা হবে, সেটা বিষাক্ত নয়, আপনি নিশ্চিত? যাবেন কোথায়? বাঁচার কোনও রাস্তা যদি খোলা থাকত, তাহলে কি এতজন ডাক্তার দুই মাস ধরে রাস্তায় বসে থাকতেন?

শুধু কি এটুকু? দুর্ঘটনায় মৃত মানুষের পোস্টমর্টেম (যা নিখরচায় হওয়ার কথা) বাবদ শোকাহত পরিবারের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা করে আদায় করা, অঙ্গপাচার, মৃতদেহ নিয়ে ব্যবসা, হাসপাতাল চত্বরে অপারেশন থিয়েটারে পঞ্চ ‘ম’-এর অপসাধনা, ছাত্রী এবং তরুণী চিকিৎসকদের ডেকে মাতাল লুম্পেনদের সঙ্গ দিতে বাধ্য করা… কোন অভিযোগটা নেই এদের বিরুদ্ধে? এর মধ্যে কোনটা হাসপাতালে হতে পারে বলে আপনি কল্পনা করতে পারতেন, যদি না সংবাদপত্রে পড়তেন? “ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন” কথাটার ভাবসম্প্রসারণ চলছিল যেন!

বাধা দিতে গেলে সিনিয়র ডাক্তারদের তৎক্ষণাৎ ট্রান্সফার এবং পানিশমেন্ট পোস্টিং (তৎক্ষণাৎ মানে যেদিন কেউ রুখে দাঁড়ালেন, সেদিন সন্ধেবেলাতেই অর্ডার বেরিয়ে গেল, এরকম), জুনিয়রদের রেজিস্ট্রেশন আটকে রেখে দেওয়া, সার্টিফিকেট কেড়ে নেওয়া, ফেল করিয়ে দেওয়া, ভয় দেখানো, শারীরিক নিগ্রহ এবং প্রয়োজনে হত্যা! এর আগেও আরজিকরে, বর্ধমান মেডিকেল কলেজে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের, যেগুলোকে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়েছে, কিন্তু তদন্তে (এমনকি রাজ্য সিআইডির তদন্তেও) আত্মহত্যার তত্ত্বে বিস্তর গোঁজামিল ধরা পড়েছে। তা সত্ত্বেও সব চাপা পড়ে গেছে, যেহেতু আমরা জেগে উঠিনি এবং যেহেতু জুনিয়র ডাক্তারেরা তখন রাজ্যব্যাপী কর্মবিরতিতে যাননি।

যেহেতু কুকর্মে বাধাদানের শাস্তিস্বরূপ এই তাৎক্ষণিক ট্রান্সফার থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রেশন কেড়ে নেওয়া জাতীয় যাবতীয় অর্ডার পাস হয় স্বাস্থ্যভবন, মেডিকেল কাউন্সিলের মতো নিয়ামক সংস্থার বড়কর্তাদের হাত দিয়েই, যার মাথার উপর স্বাস্থ্যসচিব স্বয়ং, তাই এটা স্পষ্ট যে অপরাধচক্রের পাণ্ডাদের সঙ্গে এই বড়কর্তাদের স্পষ্ট আঁতাত আছে, নাহলে ক্রমাগত এগুলো ঘটতে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং থ্রেট কালচার ভাঙতে গেলে এই জায়গাগুলোতে বেগন স্প্রে ছড়িয়ে রক্তচোষা ছারপোকা তাড়ানো জরুরি। এটাই স্বাস্থ্যভবন বা মেডিকেল কাউন্সিল অভিযানের পিছনের যুক্তি।

এখন যাকে ‘থ্রেট কালচার’ বলা হচ্ছে, তাকে আমরা তরুণ বয়সে ‘দাদাগিরি’ নামে জানতাম। ভয় দেখানো, ধমক-ধামক, এমনকি শারীরিক নিগ্রহের মুখোমুখি আমরাও হয়েছি গত শতাব্দীতেই, কিন্তু দুটোর মধ্যে কিছু তফাৎ আছে, যা গুরুত্বপূর্ণ। ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখা ক্রমশ একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যেটা অবশ্যই এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার পরিণতি, কিন্তু গত কয়েক বছরে সেটা সর্বব্যাপী এবং এর বাইরে কোনও শ্বাস নেওয়ার পরিসর নেই। দ্বিতীয়ত, এই ভয়ের সংস্কৃতি (যেটাকে সন্ত্রাসবাদ বলা যেতেই পারে) এখন ব্যবহৃত হয় এমন সব অনৈতিক, ঘৃণ্য কাজকর্ম চালানোর জন্য, যা অতীতে অকল্পনীয় ছিল। সেই কারণেই এটা আর স্রেফ মাতব্বরি বা দাদাগিরির পর্যায়ে নেই, তাই নতুন শব্দবন্ধের প্রয়োজন হল।

সিন্ডিকেট-রাজ, ক্রিমিনাল-রাজ, সন্ত্রাস-রাজের আবহে সবাই হাঁপিয়ে উঠেছিল। চুপ ছিল শুধু ভয়ে। হল কী, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের গলা টিপে ধরতে গিয়ে অত্যাচারীরা আমাদের গলায় পরানো ভয়ের বকলসটারই গলা টিপে ধরল আর সাঁড়াশি-আঙুলের প্রবল চাপে সেই বকলসটাই গেল ভেঙে। ঘরের তিনদিক বন্ধ করে বেড়ালকে মারলে আতঙ্কিত বেড়াল চতুর্থ দিকটি খুঁজে পালিয়ে যায়, কিন্তু চারদিক বন্ধ করে মারলে প্রাণের দায়ে ছোট্ট বেড়াল বাঘ হয়ে ওঠে, আক্রমণকারীর টুঁটি কামড়ে ধরাই বাঁচার একমাত্র উপায়, সেটা বুঝে ফেলে। তিলোত্তমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সন্ত্রস্ত মানুষের ভয়ের মৃত্যু হল। “Fight or flight” প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দ্বিতীয়টির পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতেই ‘লড়াই’ হয়ে দাঁড়াল একমাত্র বিকল্প।

মেয়েটি মারা যাওয়ার মুহূর্তে কিন্তু কেউ বলেনি যে সরকার বা ক্ষমতাসীন দল এই কাজের জন্য দায়ী। বস্তুত তারা নিজেরাই নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করেছে৷ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, প্রশাসন যেরকম অভাবনীয় তৎপরতায় সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার কাজে নেমে পড়ল, তাতে তাদের সকলকে ষড়যন্ত্রের অংশ না ভাবার কোনও উপায় রইল না। সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে এই বিষয়ক খুঁটিনাটি প্রায় সকলেই জানেন। (হয়তো যা ঘটেছিল, তার চেয়েও বেশি জানেন ‘’ফেক নিউজ”-এর সৌজন্যে।) তাই এই বিষয়ে বেশি কথা বলব না। একটি স্পষ্ট খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা, মৃতার বাবা-মাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেও তাঁদের তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখা, শরীর যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেই সেমিনার রুমে বহু লোকের প্রবেশ, সেই বহু লোকের মধ্যে শাসক দলের এবং অধুনা কুখ্যাত ‘’থ্রেট সিন্ডিকেট”-এর কয়েকজনের উপস্থিতি, কেমন যেন অবাক সমাপতনে বিভিন্ন শহরের কিছু কুখ্যাত নেতার সেইদিনই কলকাতায় উপস্থিত থাকা এবং সকাল সকাল এমনি এমনি আরজিকরে পৌঁছে যাওয়া, ঘটনাস্থলে দৃশ্যের বিনির্মাণ এবং পুনর্নির্মাণ, এফআইআর নিয়ে গোলমাল, ময়না তদন্তের ঝাপসা ভিডিও, অসম্পূর্ণ তথ্য, দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার প্রবল তাড়াহুড়ো, তাপগতিবিদ্যার নিয়মের বিপরীতে সিসিটিভির কয়েক ঘণ্টার ফুটেজ প্রবল গরমের দিনে সঙ্কুচিত হয়ে ২৭ মিনিট হয়ে যাওয়া, একটি সচল লিফটের দরজায় তালা লাগিয়ে সেটা অচল প্রমাণ করার চেষ্টা, ঘর সারানোর পরিকল্পনার কাগজে বক্ষবিভাগের ছাত্র-চিকিৎসকদের দিয়ে সই করানো (কবে কাজ হবে না জানিয়ে) এবং হাসপাতালের আর সব জায়গা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ঠিক বক্ষবিভাগের সেমিনার রুমের পাশের ঘরে ভাঙচুর করা…. এরকম অনেকগুলো ব্যাখ্যার অযোগ্য ঘটনা এক সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। সিবিআই সূত্রে আরও কিছু মারাত্মক সন্দেহের কথা জানা গেছে, যেমন অন্যত্র হত্যা করে সেমিনার রুমে দেহ রেখে যাওয়া এবং একটি ক্রাইম সিন সাজিয়ে তোলা, থানায় নথি বদল ইত্যাদি।

সিবিআইয়ের একটি সন্দেহ চিকিৎসকমহলের মনে গোড়া থেকেই থাকা বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, ধর্ষণ নয়, হত্যাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কেন এই উদ্দেশ্য? সেখানেই ক্রাইম সিন্ডিকেট এবং থ্রেট সাম্রাজ্যের ভূমিকা। সেই কারণেই চিকিৎসকেরা মরিয়া হয়ে এই অপরাধচক্রগুলোকে ভাঙার জন্য লড়ছেন, কারণ তাঁরা বোঝেন যে এই চক্রগুলো সমূল বিনষ্ট না হলে শুধুমাত্র হাসপাতালেই বছরে ডজনখানেক তিলোত্তমাকাণ্ড ঘটতে থাকা শধু সময়ের অপেক্ষা।

শুরুর দিকে আরজিকরের ছাত্র হিসেবে জায়মান আন্দোলনের দখল নিতে চেষ্টা করেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্যরা, যাতে একদম গোড়া থেকেই প্রতিবাদকে বিপথে চালিত করতে পারে। ৯ আগস্ট শাসক দলের অনুগতদের ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে বা মাথা গলাতে বাধা দেওয়া হয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে অসম লড়াইয়ে কিছু অপচেষ্টা রুখে দেওয়া গেলেও অনেক অনিয়ম, অপকর্ম আটকানো সম্ভব হয়নি। সেই সুযোগে বহু প্রমাণ লোপাট করা গেছে সবাই জানতে পারার আগেই। ১০ তারিখেও আমরা হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়েছি। সিনিয়র ডাক্তারদের মারা হয়েছে, মাথায় আঘাত করা হয়েছে। সেই আক্রমণের নেতা আশিস পাণ্ডে সম্প্রতি সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন আর্থিক দুর্নীতির কারণে। পরবর্তী সময়ে প্রবল আন্দোলনের চাপে এই গোষ্ঠী পিছু হঠতে বাধ্য হয় এবং আন্দোলন সততায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। যদিও সেই সততাকে নষ্ট করার জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চলছেই, যার বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। আশার কথা এই যে তা সত্ত্বেও আন্দোলনের মৌলিক চরিত্র মোটের ওপর বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। গঠিত হয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট (WBJDF) এবং তার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে WBDF, DOPA, Joint Platform of Doctors ইত্যাদি সংগঠন। পাশাপাশি সদর্থক ভূমিকা রেখেছে চিকিৎসকদের বিভিন্ন প্রফেশনাল বডি এবং IMA, FAIMA-র মতো সর্বভারতীয় সংগঠনগুলোও।

আন্দোলনটিকে ধ্বংস করার জন্য রাজ্য সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল বহু ন্যক্কারজনক পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। অন্যভাবে বলা চলে, সেগুলো করতে গিয়েই আন্দোলনের আগুন তারা বারবার উস্কে দিয়েছে, আন্দোলনকারীদের জেদ বাড়িয়েছে। শাসকের সহযোগী কিছু রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনও নানাভাবে চেষ্টা করেছে বিভাজন সৃষ্টি করতে, যা সফল হয়নি সাধারণ মানুষের কঠোর অবস্থানের ফলে।

ডাক্তারদের আন্দোলন যখন সবে গুছিয়ে উঠছে, সেই সময় ১৪ আগস্ট রাতে সারা বাংলা কাঁপিয়ে শুরু হল রাতদখলের বিপুল আন্দোলন, যা প্রকৃত প্রস্তাবে এই লড়াইকে গণআন্দোলনে পরিণত করল। সেই রাতে কাতারে কাতারে মানুষকে রাস্তায় দেখে খুশি হওয়ার পাশাপাশি ভয় পেয়েছিলাম এত বড় কর্মসূচির পর আত্মতুষ্টি এসে আন্দোলন ঝিমিয়ে না পড়ে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের গুণ্ডাবাহিনি তা হতে দিল না। সেই রাতেই তারা আরজিকর হাসপাতালের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালাল, যার ফলে সবাই বুঝলেন যে বড় শক্তির প্রত্যক্ষ মদতে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে এবং কিছু বড় মুখকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে। আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা যে ভয়ের সংস্কৃতির কথা বলতে চাইছিলেন, তার হাতেগরম প্রমাণ পেলেন সবাই। তাতে আরও বেশি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।

এরপর হাইকোর্ট, সিবিআই, সুপ্রিমকোর্টের সুয়ো মোটো হস্তক্ষেপ, নিরাপত্তার দায়িত্বে সিআইএসএফ ইত্যাদি। দুঃখজনক সত্য এই যে আন্দোলনের প্রবল চাপ না থাকলে এর কোনওটাই হত না। সব প্রমাণ লোপাট করে একজন সিভিক ভলান্টিয়ারকে জেলে পাঠিয়ে সব ধামাচাপা দেওয়া হত। পরে কোনও এক সময়ে যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে সেই সিভিকবাবুও খালাস পেয়ে যেতেন অথবা তিনি চুনোপুঁটি বলে প্রয়োজনে তাঁকে বলি দিয়ে জনগণকে তুষ্ট করা হত। অবশ্য ‘শুঁয়ো’-মতো সবকিছুই শেষ অব্দি প্রজাপতি হয়ে ওঠে না, এই বাস্তবটা আমরা এতদিনে জেনেছি। রাজনীতির অদৃশ্য হাত টেবিলের তলায় কী করে, তা টেবিলের ওপরে থাকা চোখ দেখতে পায় না। সেই হাত আজকাল তদন্তকারী থেকে ন্যায়াধীশ, সবার গলা টিপে ধরতে সক্ষম। শ্বাসরুদ্ধ সিস্টেম মানুষকে কতটা ন্যায়বিচার দিতে সক্ষম, তা বলা কঠিন।

সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার কারণে ইন্ডিয়া জোটের প্রধান শরিক দলগুলো রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের ওপর খুব বেশি চাপ সৃষ্টি করার পথে হাঁটতে চাইছে না। একই কারণে কেন্দ্রীয় বিজেপি (এবং তাদের সরকার) প্রায় নীরব। রাজ্য-বিজেপির পথনাটিকাগুলো নিয়েও তারা খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছে না, জল মাপছে। সৎ বলে পরিচিত ভারতবিখ্যাত শ্রদ্ধেয় কিছু সাংবাদিক/সম্পাদক এবং তাঁদের স্বাধীন মিডিয়া, বহু সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিদ্বান, নোবেলজয়ী প্রমুখ হিরণ্ময় নীরবতা উপহার দিচ্ছেন। বৃহৎ এবং মহান রাজনৈতিক সমীকরণকে মনে রেখে তাঁরা এইসব ‘ছোটখাটো’ ইস্যুকে অবজ্ঞা করতে প্রস্তুত। তাঁদের দোষ দিই না, কিন্তু রাজ্য সরকার এই নীরবতার সুযোগ নিচ্ছেন। সিবিআইয়ের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন চার্জশিট খুব আশা জোগাল না, বদলে ক্ষমতাসীনদের অপপ্রচার তীব্রতর করার সুযোগ দিল। আর এসব যত ঘটছে, আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের পক্ষে নমনীয় হওয়া ততই অসম্ভব হয়ে উঠছে। খুব সংক্ষেপে ‘খেলা হবে ক্লাব’ বনাম ‘লড়াই হবে শিবির’-এর টাগ-অব-ওয়ারের গতিপথ ফিরে ভাবলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

যেহেতু সবাই ঘটনাপ্রবাহে নজর রেখেছিলেন, তার অনেক নথি সহজে প্রাপ্য এবং সব লিখতে গেলে বই হয়ে যাবে, তাই সেই চেষ্টাই করব না৷ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করব শুধু।

সন্দীপ ঘোষ-সহ অনেকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আগেও লিখিত অভিযোগ ছিল। নিম্নমানের ওষুধে রোগীমৃত্যুর বিরুদ্ধেও চিকিৎসকেরা অভিযোগ করেছেন। সুতরাং সরকার এগুলো জানতেন না, তা হতে পারে না, যদিও তাঁরা না জানার ভান করছেন। আন্দোলনের চাপে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া সন্দীপ ঘোষকে চার ঘণ্টার মধ্যে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে সরকার নিজের মনোভাব স্পষ্ট করেছে।

মুখ্যমন্ত্রী ১৬ আগস্ট নিজে মিছিল করে “বিচার, ফাঁসি” ইত্যাদির দাবি তুললেন, অথচ যাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ, তাঁদের শাস্তি দিতে রাজি হলেন না। এটা স্পষ্ট দ্বিচারিতা। বদলে সিবিআইয়ের ঘাড়ে পুরো দায় চাপিয়ে শাসকপক্ষ নিজেদের আড়াল করতে লাগল। এদিকে সিবিআইয়ের ট্র‍্যাকরেকর্ড আহামরি নয় এবং সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চাপ তাদের ওপর থাকে। এই কারণে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টরস সিজিও কমপ্লেক্সেও মিছিল করেছে, ডেপুটেশন জমা দিয়েছে।

প্রথমদিকে আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করাই ছিল সরকারের নীতি। চাপ তুমুল হওয়ার পর সরকার বাধ্য হয়েছে আলোচনায় আগ্রহের ভাব দেখাতে, কিন্তু তার মধ্যে কোনও সদিচ্ছা ছিল না, তা বারংবার প্রমাণিত। অর্থাৎ চাপের মুখে বিবেক জাগ্রত হয়নি, কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে মাত্র। এই কৌশল অনেক ক্ষেত্রে তাদের পক্ষেই ক্ষতিকর হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, নগরপাল বিনীত গোয়েলের কাছে ডেপুটেশন জমা দিতে জুনিয়র ডাক্তারদের শিরদাঁড়া আর গোলাপ হাতে লালবাজার যাওয়ার কথা মনে করুন। গোয়েলবাবু প্রথমেই অফিসে বা রাস্তায় প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে সেগুলো গ্রহণ করলেই মিটে যেত। বদলে ওঁদের রাস্তায় আটকে রাখা হল সারারাত। শহরের বহু মানুষ সরাসরি ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে সামিল হলেন। শেষ অব্দি লালবাজারকে মাথা নোয়াতেই হল, অকারণে নিজেরাই একটা লড়াইয়ের জন্ম দিলেন এবং হেরে গেলেন।

আন্দোলনকারীদের ভয় দেখানোর জন্য নিজের দলের লোকেদের ‘ফোঁস’ করার আহ্বান জানালেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, যেটা সরাসরি ভায়োলেন্সে উস্কানি। এরপর বিভিন্ন জায়গায় রাতদখলের আন্দোলনে আক্রমণ হল, ছোটখাটো অনেক নেতা কুরুচিকর হুমকি দেওয়া শুরু করলেন এবং বিধায়ক হুমায়ুন কবীর-সহ বেশ কিছু বড় নেতা বারংবার চিকিৎসকদের শারীরিক আক্রমণ করার হুমকি দিতে লাগলেন।

পাশাপাশি চলল চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে জনগণকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা। জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির কারণে মানুষের হয়রানি হচ্ছে, কয়েকজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে, এই ভিত্তিহীন প্রচার চালানো হল। যেন এতদিন ভেজাল ওষুধ এবং নোংরা যন্ত্রপাতি মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছিল! যেন ডাক্তারদের অন্যতম দাবি ‘’সেন্ট্রাল রেফারাল সিস্টেম” গঠন আটকে দিয়ে গ্রামের গুরুতর অসুস্থ মানুষকে রেফারের নামে দশ জায়গায় ঘুরিয়ে প্রচুর ঘুষ আদায় করতে পারলেই তাঁদের বাঁচার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে! কিছু জায়গায় এই অপপ্রচার সফল হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু গ্রামগঞ্জের মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হল তাঁদের মধ্যে অনেকেই এসব প্রচার সত্ত্বেও চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সমর্থন করছেন। বন্যা-পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েও অপপ্রচার চালানো হচ্ছিল, কিন্তু বন্যাত্রাণেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন ডাক্তারেরাই, যখন রাজনেতারা বন্যাত্রাণে দান করা মানুষের চাঁদার টাকা নিজেদের পকেটে ঢোকাতে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে এই চেষ্টাও সফল হল না। ‘’অভয়া ক্লিনিক”-ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

জাম্প কাট করে শেষ কদিনের দিকে নজর দেওয়া যাক। ৯ সেপ্টেম্বর মহামান্য শীর্ষ আদালত জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার কোনও ‘নির্দেশ’ দেননি। ১০ তারিখ বিকেলের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন মাত্র। সঙ্গে শর্ত যোগ করেছিলেন, “যদি নিরাপত্তার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়” এবং তা হয়ে যাওয়ার পরেও কাজে না ফিরলে যদি রাজ্য সরকার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না, কিন্তু তার আগে কাউকে কোনও শাস্তি দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ নির্দেশ ছিল সরকারের প্রতি, চিকিৎসকদের প্রতি নয়। সরকার এই রায়কে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইল।

ভয় দেখালে ফল হয় উল্টো। “স্বাস্থ্যভবন” সাফাইয়ের ডাক দিয়ে করুণাময়ী থেকে বিশাল মিছিল করে স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান শুরু হল দুর্নীতিবাজ কয়েকজন আধিকারিকের অপসারণের দাবিতে। চিকিৎসকদের অনড় অবস্থান এবং তাঁদের সঙ্গে বিপুল সংখ্যায় সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান দেখে সরকার ভয় পেয়ে ১৩ আগস্ট নবান্নে আলোচনায় বসতে রাজি হল। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিদল গেলেন। স্বচ্ছতার জন্য তাঁরা আলোচনার লাইভ স্ট্রিমিং চাইলেন। সরকার কিছু আজগুবি কারণ দেখিয়ে লাইভ স্ট্রিমিং হতে দিল না এবং আলোচনা ভেস্তে গেল। যে সভাঘরের ছবি নাকি বাইরে দেখানো বারণ, সেই ঘরেরই ফাঁকা চেয়ারের ছবি প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রীকে দুঃখী প্রমাণ করার ‘’খেলা হল”। তারপরেও মানুষ স্বাস্থ্যভবনের সামনে আন্দোলনের পাশেই ভিড় জমালেন, কারণ সকলেই বুঝলেন যে সরকার বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই লাইভ টেলিকাস্ট চাওয়া হয়েছিল এবং সততার অভাবের কারণেই তা করতে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ। এটা শুধু শহুরে শিক্ষিত মানুষের ভাবনা নয়, সেই সময়ে অন্তত দুটি জেলায় চায়ের দোকানেও মানুষকে এই কথাই বলতে শুনেছি।

পরদিন সকালে স্বাস্থ্যভবনের ধর্নামঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর নাটকীয় প্রবেশ, সংক্ষিপ্ত ভাষণ এবং দ্রুত প্রস্থান। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, এটা “পলিটিক্স অব অপটিক্স” ছাড়া কিছুই নয়, যেখানে মাননীয়া নিজের পুরনো জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকারীদের লোকপ্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। তবু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মান দেওয়ার দায় আমাদের থাকে। তাই সেদিন সন্ধেবেলা অফিসের বদলে মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতেই যেতে রাজি হলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। গেলেনও। লাইভ টেলিকাস্টের দাবি জানানো হল এবং সেটা ফের নাকচ হল। ডাক্তারেরা বললেন, বেশ, তাহলে দু-পক্ষই একসঙ্গে ভিডিওগ্রাফি করি, যাতে দু-পক্ষের হাতেই প্রমাণ থাকে। ভিডিওগ্রাফার তাঁরা সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলেন। কী আশ্চর্য, সেই দাবিটাও নাকচ হল। ডাক্তারেরা সেটাও মেনে নিয়ে বললেন, বেশ, তাও চাই না। সরকার একাই ভিডিও করুক কিন্তু তার একটা কপি তখনই আমাদের দেওয়া হোক। সরকারপক্ষের তাতেও আপত্তি, যার একটাই ব্যাখ্যা হয়… পছন্দমতো এডিট করেই তাঁরা প্রমাণ নির্মাণ করতে চান, ঠিক যেমনটা হয়েছিল অভয়া হত্যার পরে আরজিকরে (এবং সিবিআইয়ের মতে টালা থানাতেও)। সরকারপক্ষ আশা করেছিল যে এরপর ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা আর আলোচনায় রাজি হবেন না, কিন্তু কাজে ফিরতে মরিয়া ডাক্তারেরা সেই আশায় জল ঢেলে দিয়ে আলোচনায় রাজি হয়ে গেলেন শুধুমাত্র মিনিটসটুকু দাবি করে। এবার ঘাবড়ে গেল সরকারপক্ষ, কারণ তারা আলোচনা চাইছিল না, বদলে “ডাক্তারেরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে” রটিয়ে গ্রামাঞ্চলে নিজেদের গড় মজবুত করতে চাইছিল। এই পর্যায়ে মাননীয়া চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে তাঁরা দেরি হয়ে যাওয়ার অজুহাতে সরাসরি আলোচনায় বসতে অস্বীকার করলেন। বিচক্ষণ মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু অতক্ষণ বাড়ির বাইরে বৃষ্টিতে দাঁড় করিয়ে রাখা ছেলেমেয়েদের “চা খেয়ে যাও” বলে ‘অপটিক্স’ তৈরি করতে ভুললেন না। চিকিৎসকেরা করজোড়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এদিকে ১৭ তারিখ সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের অনুমতি সহজেই পাওয়া যাওয়া যাবে বুঝে ১৬ তারিখ মাননীয় মুখ্যসচিব একপ্রকার হুমকির সুরে আরেকবার কালীঘাটে ডেকে পাঠালেন। প্রতিনিধিদল গেলেন এবং ভিডিওর দাবি ছাড়াই আলোচনায় বসলেন। দু-পক্ষই মিনিটস লিখেছিলেন এবং তার মধ্যে গরমিল ধরা পড়ল। চতুর রাজনীতিবিদ এবং অভিজ্ঞ আমলাদের সঙ্গে লড়াই করার কঠিন কাজটিতে তাঁরা কোনওভাবে সফল হলেন। মুখ্যমন্ত্রী ডিরেক্টর অব মেডিকেল এডুকেশন এবং ডিরেক্টর অব হেলথ সার্ভিসেস দুজনকে অপসারণ করলেন, কারণ এঁরা মামুলি চিকিৎসক-মাত্র, বড় আমলা নন। কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনারকে শাস্তির বদলে প্রমোশন দিলেন। ডিসি নর্থ বদলি হলেও ডিসি সেন্ট্রালের স্থানান্তর হল না (কেন তা পরবর্তী ঘটনাবলিতে স্পষ্ট)। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিবিধ দুর্নীতির মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত স্বাস্থ্যসচিবকে সরাতে রাজি হল না সরকার। কেন, তা অনুমানসাপেক্ষ।

যাইহোক, আংশিক দাবিপূরণ হতেই জুনিয়র ডাক্তারেরা কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাকি গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো পূর্ণ করার জন্য সরকারকে কিছুটা সময় দিলেন। যেই তাঁরা কাজে যোগ দিলেন, অমনি সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজ-সহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেছে বেছে জুনিয়র ডাক্তারদের পেটানো শুরু হল। মহিলা চিকিৎসকদের ভয় দেখানোর ভাষা বিভিন্ন জায়গায় অদ্ভুতভাবে এক… “আরজিকর করে দেব।” অর্থাৎ আরজিকরের ধর্ষণ ও হত্যা যে আসলে সামগ্রিক “থ্রেট কালচার”-এরই অংশ ছিল, তা স্পষ্ট হল। এগুলোকে অরাজনৈতিক ঘটনা ভাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে সাগর দত্ত হাসপাতালে তিন মহিলা চিকিৎসকের ওপর ঘটা শারীরিক আক্রমণকে সরাসরি জাস্টিফাই করে রাজ্য সরকারের উকিল প্রমাণ করলেন যে সরকার এই ধরনের আক্রমণে মদত দেবেন এবং আক্রমণকারীদের হয়ে আদালতে সওয়াল করবেন। সরকারি উকিল দাবি করলেন বেড পাওয়া যায়নি এবং তার ফলে উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি, তাই মেরেছে৷ যার ভাবার্থ হল, “বেশ করেছে।” অথচ সেই রোগিণী মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন মহিলা চিকিৎসক রিসাসিটেশন শুরু করেন এবং চিকিৎসার জন্য মিনিট পনেরোর বেশি সময় পাওয়া যায়নি। ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে বেড পাওয়া যায়নি, এই কথা সত্য। প্রশ্ন হল, আইসিইউতে পর্যাপ্ত শয্যা এবং যন্ত্রপাতির বন্দোবস্ত করার দায় কার? জুনিয়র ডাক্তারদের, নাকি সরকারের? কী করে কোনও সরকার বেড না থাকার জন্য মহিলা চিকিৎসকদের আক্রমণ করার পক্ষে সওয়াল করতে পারে, তাও আবার শীর্ষ আদালতে?

এই ঘটনাগুলোর পর জুনিয়র ডাক্তারেরা পুনরায় কর্মবিরতিতে যেতে বাধ্য হন, কারণ এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে সরকার আরও বেশি উদ্ধতভাবে দুষ্কর্মে মদত দিতে থাকলে সপ্তাহে একটা “আরজিকর করে দেওয়ার” ঘটনা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। দীর্ঘ জিবি মিটিংয়ে আন্দোলনের সামনের সারির নেতারা অনেকেই কর্মবিরতি বাদ দিয়ে অন্য পদ্ধতির কথা ভাবছিলেন, কিন্তু নারী চিকিৎসকেরা কাজ করতে রীতিমতো ভয় পাচ্ছিলেন। মূলত তাঁদের দাবিতেই দশ দফা দাবিতে দ্বিতীয়বার স্বল্পমেয়াদি কর্মবিরতি হয়। তার মধ্যে নিয়মিত দীর্ঘ মিটিং চলতে থাকে। যেহেতু সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, তাই প্রতিদানে তাঁদের সেবা দিতে অনেকেই আগ্রহী ছিলেন।

অক্টোবরের ৪ তারিখ দুপুরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কর্মবিরতি পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে। বদলে শহরের কোথাও একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানমঞ্চ করা হবে। সব চিকিৎসক নিজেদের ডিউটি করবেন এবং বাকি সময়ে পালা করে অবস্থানমঞ্চে থাকবেন। এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে মিছিল করে ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে এসে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পরিকল্পনা ছিল। এ-কথা জানতে পারা-মাত্র ডিসি সেন্ট্রালের অধীনস্থ পুলিশ সেই বিকেলেই জুনিয়র ডাক্তারদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করল, যাতে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মবিরতি তুলে নেওয়া সম্ভব না হয়। এই ঘটনার অভিঘাতে WBJDF বাধ্য হল সেই মেট্রো চ্যানেলে অবস্থান শুরু করতে, যা মাননীয়ার স্মৃতিবিজড়িত তীর্থস্থান বলে অন্যান্য আন্দোলনকারীদের জন্য নিষিদ্ধ। সেখানে একটি বড় ঘড়ি তুলে ধরে সাড়ে আটটার সময় জুনিয়র ডাক্তারেরা ঘোষণা করলেন যে তাঁরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করছেন কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সরকার কোনও সদর্থক পদক্ষেপ না করলে তাঁরা আমরণ অনশনে বসতে বাধ্য হবেন। সবাই আশা করেছিলাম যে সরকার এই বিষয়ে অন্তত কথা বলবেন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে, কিন্তু তাঁরা অবিশ্বাস্যভাবে নিশ্চুপ রইলেন এবং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে বিভিন্ন পুজোয় ফিতে কাটতে, ঢাক বাজাতে, ডান্ডিয়া খেলতে দেখা গেল।

ইচ্ছাকৃতভাবে আন্দোলনকারীদের অনশনের দিকে ঠেলে দেওয়া হল, যা স্বল্প-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তরুণ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদদের এক নিষ্ঠুর গেমপ্ল্যান। ধর্মতলার মঞ্চে ছয়জন আমরণ অনশনে বসলেন, উত্তরবঙ্গে আরও দুজন। পরদিন ধর্মতলায় যোগ দিলেন আরও দুজন। ডিসি সেন্ট্রালের নেতৃত্বে কলকাতা পুলিশ চরম অসহযোগিতা এবং নির্যাতন শুরু করল। প্রথম দিনেই ডেকোরেটরের লোকজনকে ভয় দেখিয়ে ধর্নামঞ্চ এবং ছাউনি নির্মাণে বাধা দিল। যাদবপুরের কিছু ছাত্রের সহায়তায় চিকিৎসকেরা নিজেরাই মঞ্চ নির্মাণ করলেন, যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজে। তারপর মঞ্চের জন্য কিছু বাঁশ আনার গাড়ি আটকানো হল। ডাক্তার-অডাক্তার সব মানুষ বিচারের দাবিতে স্লোগান দিতে দিতে কাঁধে করে বাঁশ বয়ে আনলেন। অনশনে তিনজন মহিলা, বাকিদেরও শারীরিক শক্তি কমে আসবে না খেয়ে, তাই নিজেদের খরচায় বায়োটয়লেট আনানো হচ্ছিল৷ তাও আনতে দিল না পুলিশ। এমনকি অনশনকারীদের জন্য আনা জলটুকুও কেড়ে নিল। তা সত্ত্বেও আন্দোলন থমকাল না। সরকারি হাসপাতালে সিসিটিভি লাগানো নিয়ে বিস্তর গড়িমসি কিন্তু ধর্মতলার অনশনমঞ্চের সামনে নতুন সিসিটিভি ক্যামেরা লেগে গেল প্রথম দিনেই। ভালই হল, ওখানে কেউ লুকিয়ে চিকেন স্যান্ডুইচ বা বিদেশি চকোলেট খাচ্ছেন না, তা সকলের সামনে স্পষ্ট হল।

এদিকে মুখ্যমন্ত্রী সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ নাগাদ ফরমান জারি করে রেখেছিলেন যে খুন-ধর্ষণ, ওষুধ চুরি, মৃতদেহের ব্যবসা ইত্যাদি সবকিছুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়ে সকলের জন্য উৎসবে ফেরা বাধ্যতামূলক। উৎসবকেই হাতিয়ার করতে চাইলেন শাসক। সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ল আনন্দের প্রকট উচ্ছ্বাস এবং উৎসবের আবহ তৈরি করতে। পাশাপাশি শুরু হল ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সমর্থকদের তরফ থেকে অনশনক্লিষ্ট তরুণদের সম্বন্ধে কুৎসিততম মন্তব্যের বন্যা। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে উৎসবের গল্প প্রচার করে অনশন আন্দোলনের খবরকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হল। প্রত্যাশা ছিল, উৎসবের জোয়ারে মানুষের মনের শোক ও দ্রোহ মুছে দেবেন এবং মেট্রো চ্যানেলের অনশনস্থলটি খালি থাকবে, যাতে জনসমর্থন হারিয়ে আন্দোলনয়ারীরা ভেঙে পড়েন। সেই প্রকল্প ব্যর্থ। পুজোয় মানুষ ঘুরতে বেরোবেনই, যে শাসকই ক্ষমতায় থাকুন। এবারেও বেরিয়েছেন, কিন্তু সন্ধেটুকু বাদ দিলে এবারে রাস্তার ভিড় ছিল লক্ষণীয়ভাবে কম। যাঁরা বেরিয়েছিলেন, তাঁদের মনেও বিচারের দাবি ছিল। অনশনকারীদের নামে পুজো দিয়েছেন অনেকে৷ বহু প্যান্ডেলে অভয়ার মৃত্যু এবং বিচারের দাবি নিয়ে ছবি বা পোস্টার ছিল। বহু হাসপাতাল-সহ রাজ্যের বহু জায়গায় প্রতীকী অনশনে সামিল হয়েছেন শত শত মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা পূজার মধ্যে প্রতিদিন মেট্রো চ্যানেলের ভিড় ছিল বিপুল। সে-কথা সবচেয়ে ভাল জানে কলকাতা পুলিশ। অভয়া পরিক্রমায় বাধা দিতে ম্যাটাডোরের চাবি কেড়ে নিতে সাধারণ মানুষ হাত দিয়ে ঠেলে সেই গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চললেন। ঘাবড়ে গিয়ে পুলিশ যানজট সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বাস এবং পেট্রোল ট্যাঙ্কারের চাবি চুরি করে চম্পট দিল৷ মাঝরাস্তায় দাঁড় করানো একটা তেলভর্তি ট্যাঙ্কার যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের কারণ হতে পারে, সেই বোধটাও রইল না আইনরক্ষকদের। তাতেও কাজ না হওয়ায় শেষ চেষ্টা করল মরিয়া আরক্ষাবাহিনি। বিচারের দাবিতে যেমন বহু মানববন্ধন হয়েছে গত দুই মাসে, ঠিক তেমনভাবে বিচারের দাবি আটকাতে পুলিশবন্ধন গড়ে তোলা হল স্বয়ং ডিসি সেন্ট্রালের নেতৃত্বে। তাঁকে বদলি না করার কারণ স্পষ্ট হল। মাননীয় অভীক দে মহাশয়কে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ করে তোলা থেকে শুরু করে ধর্মতলার ঐতিহাসিক ঘটনাবলি অব্দি বহু চিরস্মরণীয় সার্ভিস তিনি দিলেন।

এদিকে রাজ্য সরকার অদ্ভুতভাবে নির্লিপ্ত রইল। যে মুখ্যমন্ত্রী ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে নিজেকে ‘’দিদি” এবং মাতৃতুল্যা বলে দাবি করছিলেন এবং সন্ধেবেলা চা-রাজনীতি করছিলেন, তিনি এই সন্তানসমদের জীবন বাজি রাখাকে হেলায় অগ্রাহ্য করে আনন্দে মেতে উঠলেন। অনশনমঞ্চের পাশে জনসাধারণের বিপুল ভিড় দেখে অনশনের ৯৬ ঘণ্টা পেরোনোর পর মুখ্যসচিব বাধ্য হলেন একটি লোকদেখানো মিটিং ডাকতে। জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হলেন। দেখা গেল, ইতোমধ্যে আন্দোলনকারীদের তরফে যে ইমেইল পাঠানো হয়েছিল, সরকার তা পড়েই দেখেনি। আলোচনায় চিকিৎসকেরা নিজেদের প্রতিটি দাবি বিশদে ব্যাখ্যা করেন। সেই প্রসঙ্গে মুখ্যসচিবের যাবতীয় বক্তব্যের নির্যাস হল, “পুজোটা কেটে যাক। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সরকার ভাববে এ নিয়ে আদৌ কিছু ভাবা হবে কিনা।” প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। মুখ্যসচিব স্মিত হাস্যমুখে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন কোনও নির্দিষ্ট বক্তব্য এড়িয়ে। দেখে মনে হল এই আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি মোটের ওপর খুশি।

চিকিৎসক এবং অ-চিকিৎসক মানুষের মেলবন্ধনের আরও একটি দিক সেই রাতেই সামনে এল। ত্রিধারা সম্মিলনীর পূজার কাছে বিচারের দাবিতে স্লোগান দিতে গিয়ে কলকাতা পুলিশের হাতে আটক হলেন নয়জন তরুণ। তাঁদের ছাড়াতে লালবাজারের সামনে অবস্থান করলেন চিকিৎসকেরা। পরদিন আলিপুর কোর্টে তাঁদের তোলার সময় দলে দলে হাজির ছিলেন চিকিৎসকেরা। কিছু মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে আটদিনের পুলিশ কাস্টডি ঘোষণা হতেই চিকিৎসক সংগঠন মামলাটি হাইকোর্টের অবসরকালীন বেঞ্চে তোলেন। সেখানে চিকিৎসকদের আইনজীবীরা ধৃতদের হয়ে লড়েন এবং প্রত্যেকের জামিন ছিনিয়ে আনেন। আদালত পুলিশের বক্তব্যকে নস্যাৎ করেন। এভাবে অত্যাচার করতে গিয়ে শাসক মানুষকে মানুষের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন।

অনশনের আটদিন পেরোতে চলল। গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি অনিকেত মাহাতো, অলোক বর্মা এবং অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়। সরকারের অবিশ্বাস্য সংবেদনহীনতা তবু বজায় আছে। আসলে অনশন একটি মনুষ্যত্ব-নির্ভর অস্ত্র। শাসকের মধ্যে বিবেক বেঁচে আছে ধরে নিয়েই অনশনের মতো অহিংস আন্দোলনগুলো হয়। শাসকের বিবেক যদি একেবারে মরে যায়, তাহলে অনশনে তরুণদের মৃত্যুও কোনও ছাপ ফেলতে পারে না। বাধ্য হয়ে সিনিয়র চিকিৎসকদের তরফে চাপ বাড়াতে হচ্ছে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে গণ-ইস্তফা দিয়েছেন অধ্যাপক চিকিৎসকেরা, কিন্তু যেহেতু গণ-ইস্তফা দিয়েও রোগীর স্বার্থে তাঁরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাই সরকারের হেলদোল নেই। এই গণ-ইস্তফা যে স্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষকে অযোগ্য ঘোষণা করে, সেটাও তাঁদের লজ্জা দিল না। অতএব পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে চিকিৎসকদের বিভিন্ন প্রফেশনাল বডি, সেরকম সব সংস্থার মিলিত সংগঠন FEMA, সর্বভারতীয় সংগঠন FAIMA, IMA প্রভৃতি কঠোর ভাষায় রাজ্য সরকারকে চিঠি লিখে জানাল যে সরকার সদর্থক পদক্ষেপ না নিলে ১৪ অক্টোবর ভোর থেকে সব বেসরকারি হাসপাতালে, পলিক্লিনিকে, প্রাইভেট ক্লিনিকে কর্মবিরতি হবে। এই চিঠিগুলোর পরেও দু-দিনের মধ্যে সরকারের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। নিরুপায় হয়ে আগামীকাল (সোমবার) সকাল থেকে যাবতীয় নন-ইমার্জেন্সি সার্ভিস (আউটডোর থেকে অপারেশন) বন্ধ। গুরুতর অসুস্থদের জন্য ইমার্জেন্সি চিকিৎসা চালু রাখতেই হবে, কারণ ডাক্তারেরা নেতা-মন্ত্রী নন যে মানুষের মৃত্যু দেখে আনন্দ পাবেন।

এরপর কী হবে এখনও জানি না। শাসকের বিবেক বা লজ্জাবোধের ওপর একেবারেই ভরসা না রাখতে পারলে কিছু বলা বা ভাবা কঠিন। হয়তো শাসক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটিকে হিংসাত্মক করে তুলতে চাইছেন, যা আমরা চাই না। গোড়া থেকেই ব্যাপারটা অদ্ভুত। যে দাবিগুলোর পাশে প্রথম থেকেই যে-কোনও সুস্থবুদ্ধির শাসকের থাকার কথা এবং সংঘাত হওয়াই উচিত নয়, সেই জায়গা থেকেই রাজ্য সরকার অকারণে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে তুললেন। সুতরাং উদ্দেশ্য ভাল নয়, তা বোঝাই যাচ্ছে।

কয়েকটি বিতর্কের অতি সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে শেষ করি।

  1. বিচারের দাবিতে আমি কেন পথে নামব?
    কারণ এই আন্দোলন হেরে গেলে, অপরাধচক্রগুলো বেঁচে গেলে আমরা কেউ নিরাপদ নই। যে-কোনওদিন, যে-কেউ ধর্ষিত বা নিহত হতে পারি।
  2. একটা মেয়ের ধর্ষণ-খুনের বিচারের দাবিতে এত হাঙ্গামা কেন?
    তিলোত্তমা হত্যাকাণ্ড হিমশৈলের চূড়ামাত্র। অজস্র অপরাধের একটা, যা ভয়াবহতার কারণে সকলকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এরকম ঘটনা প্রতি মাসে বা সপ্তাহে ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। সেগুলোকে আটকানোর জন্যই আন্দোলন।
  3. কোন দলের আন্দোলন এটা?
    আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো অগণিত মানুষের অনেকেরই নানারকম রাজনৈতিক আনুগত্য বা বিশ্বাস থাকতে পারে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আন্দোলনটি নিজের অদলীয় চরিত্র ধরে রেখেছে।
  4. এ তো এলিটদের আন্দোলন!
    তাই কি? যে তিনজন গরিব ম্যাটাডোর ড্রাইভারকে মিথ্যা কেস দিল পুলিশ, তাঁরা ধনী এলিট ছিলেন? কুলতলির বালিকা?
  5. এ আন্দোলন কি কর্পোরেট স্বার্থে নয়?
    ঠিক উল্টো। একে তো প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসক বেশিরভাগ দু-মাস ধরে রাস্তায়। তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দশ দফা দাবি। পড়ে দেখুন। বেশিরভাগই জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত। সেগুলো পূর্ণ হলে সরকারি চিকিৎসায় মানুষের আস্থা বাড়বে, পরিষেবা উন্নত হবে এবং কর্পোরেটমুখী রোগী কমবে। বরং যারা এই অব্যবস্থা বজায় রাখতে চাইছে, তারাই কর্পোরেট স্বার্থে কাজ করছে৷
  6. ডাক্তারদের নিরাপত্তার দাবিগুলো নিয়ে আমি কেন মাথা ঘামাব?
    কারণ এগুলো হাসপাতালের নিরাপত্তার দাবি এবং অপরাধচক্র ভেঙে ফেলার দাবি। হাসপাতালে আপনিও এখন নিরাপদ নন। রোগিণীও ধর্ষিতা হতে পারেন। আজ সকালে এসএসকেএম হাসপাতালে হকিস্টিক হাতে তাণ্ডব চালিয়ে বহিরাগত গুণ্ডারা মাথা ফাটিয়েছে এক রোগীর আত্মীয়ের। সুতরাং নিরাপত্তার দাবি সবাইকে বাঁচানোর জন্য।
  7. এসব অপরাধের ভুক্তভোগী ডাক্তারেরা এতদিন মুখ খোলেননি কেন?
    কেউ মুখ খোলেননি, তা নয়, তবে অনেকেই পারেননি। কেন? আতঙ্কে। তিলোত্তমার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছেন, আতঙ্কটা কেমন ছিল? সেইজন্যই এর নাম ‘’থ্রেট কালচার”।
  8. আন্দোলন করে লাভ কী হল? বিচার তো হয়নি।
    ধর তক্তা মার পেরেক বিচার দাবি করা হচ্ছে না। বিচার সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে। তদন্ত এবং বিচার যাতে হয় আদৌ, তা নিশ্চিত করতে আন্দোলন চলছে এবং চলবে। কিছুটা তো এগোনো গেছে। সব প্রমাণ লোপ করে মাত্র একজনকে ‘ধনঞ্জয়’ বানানোর চেষ্টায় রত কলকাতা পুলিশের হাত থেকে সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার গেছে। সিবিআই পুরোপুরি ভরসাযোগ্য না হলেও এক্ষেত্রে মন্দের ভাল। সুপ্রিম কোর্ট নিজেকে জড়াতে বাধ্য হয়েছেন আন্দোলনকারীদের প্রবোধ দেওয়ার জন্য। কয়েকজন অন্তত গ্রেফতার হয়েছে, পুলিশ আধিকারিক-সহ। খেয়াল করুন লালবাজার অভিযানের সময় সন্দীপ ঘোষ এবং কালীঘাটের ব্যর্থ বৈঠকের রাতে টালা থানার ওসি গ্রেফতার হয়। অন্তত কিছু অভিযুক্তকে পদ থেকে সরাতে সরকার বাধ্য হয়েছে। এতদিনে নিরাপত্তার প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। দুর্নীতির মামলাও সিবিআইয়ের হাতে গেছে, যা রাজ্য সরকার এতদিন চাপা দিয়ে রেখেছিল। বিভিন্ন কলেজ কমিটি থ্রেট সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে এবং কয়েকজনকে শাস্তি দিয়েছে। এতদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিলেও এগুলো অর্জন করতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা অসংখ্য মানুষকে জাগিয়ে তোলা গেছে। একমাত্র বহু মানুষের বিবেক জাগলেই সমাজ বদলায়।
  9. তাহলে চাইছেন কী? মুখ্যমন্ত্রী বা শাসকের নতুন নাম?
    শুধু শাসকের নাম বদল নয়, চরিত্র বদল চাইছি। অফিসে যেই থাকুন, তাঁরা যেন মানুষের হয়ে কাজ করতে বাধ্য হন, ক্রিমিনালদের হয়ে নয়। সরকারি কুর্সিকে রাজসিংহাসন ভাবা চলবে না।


*মতামত ব্যক্তিগত