বিষাণ বসু
আপাতত, আমরা আমাদের দাবিটুকু স্পষ্ট করে বলি। দাবি বলতে, অন্তত আমার কাছে, দফা এক দাবি এক। আদি ও অকৃত্রিম একটিমাত্র দাবি। সুবিচার চাই। ‘জাস্টিস’ চাই। জাস্টিস বলতে দোষীকে চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া। অথবা দোষীদের চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া। এবং দোষী/দোষীদের ধরার পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, দোষীকে/দোষীদের অপরাধ আড়াল করার কাজ যারা করেছে ও সে-কাজে যারা সাহায্য করেছে— তাদের চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া। জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনের মুখ হতে পারেন, কিন্তু এই আন্দোলন জনগণের আন্দোলন। জনগণ ‘জাস্টিস’ চাইছেন
দশ দফা দাবি বলতে এক-দুই-তিন করে ঠিক কী কী, এখুনি মুখস্থ বলতে পারব কিনা— এক টিভি-শোয়ে জনৈক তৃণমূল-নেতার এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘পারব না’ বলেছিলাম— এখনও না-ই বলছি, কেননা প্রথমত এই বয়সে হাজার সদিচ্ছে সহযোগে দশ-দশখানা পয়েন্ট ঝরঝরে মুখস্থ করতে চাইলেও সবসময় তা করে ওঠা যায় না আর দ্বিতীয়ত, আমার দাবি তো সাকুল্যে একটাই— দাবি বলতে আদি ও অকৃত্রিম একটিমাত্র দাবি— সুবিচার চাই।
সরকারি হাসপাতালে ডিউটিরত এক ছাত্রী-চিকিৎসক খুন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সুবিচার বলতে, নজিরবিহীন এই অপরাধের বিচার ও শাস্তি চাই। এবং এই অপরাধ যেহেতু— যে যেভাবে খুশি বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করুন না কেন— কোনও আচমকা ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, অতএব সুবিচারের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবেই, যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এমন নজিরবিহীন অপরাধ ঘটতে পারা— ঘটাতে পারা— সম্ভব হয়, সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই (নইলে এমন ঘটনা আবারও ঘটতে পারে, ঘটবে। অর্থাৎ আমাদের আশা, বর্তমান অপরাধের যথাযথ সুবিচার পরবর্তী অপরাধের নিরোধক হতে পারবে)।
বিচার হবে আদালতে। কিন্তু আদালতের সামনে বিচারের জন্য তথ্যপ্রমাণ সাজিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তদন্তকারী সংস্থার। এক্ষেত্রে সেই সংস্থার নাম সিবিআই। খুন ও ধর্ষণ যে করেছে— অন্তত প্রাথমিক তদন্তকারী সংস্থা কলকাতা পুলিশ ও তৎপরবর্তী তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই, দুই পক্ষই আপাতত সহমত যে এত বড় ঘটনা একজনই করেছে। তার বিরুদ্ধে সিবিআই চার্জশিট জমা দিয়েছে নিম্ন-আদালতে। (এ-প্রসঙ্গে খুনী-ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত সেই সঞ্জয় রায় নাকি আদালতের সামনে কিছু বলতে চেয়েছিল। প্রাথমিকভাবে তখনই সেই বলার অনুমতি মেলেনি।)
নিম্ন-আদালতে খুনি-ধর্ষকের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিলেও উচ্চতম আদালতের শুনানিতে নাকি সিবিআই দাবি করেছে, যে, তথ্যপ্রমাণ বিচ্ছিরিভাবে লোপাট করা হয়েছে এবং সিবিআই তদন্তভার হাতে পাওয়ার আগে কলকাতা পুলিশ যেভাবে ‘তদন্ত’ করেছে, তা দেখেশুনে সর্বোচ্চ আদালতের অন্যতম বিচারপতি নাকি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। যদি তথ্যপ্রমাণ লোপাট হয়েই থাকে, তাহলে নিম্ন-আদালতে সিবিআই যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ সহকারে অপরাধীর বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিতে পারল কী করে? আবার মাত্র একজনকেই খুনি-ধর্ষক হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা গেলে সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার ওসি খুন-ধর্ষণের মামলায় এখনও জেলে রয়েছেন কেন?
আবার আরও একদিকে, তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই উচ্চতম আদালতের সামনে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের সপক্ষে ঠিক কী তথ্যপ্রমাণ/দাবি পেশ করলেন, যা দেখে অভিজ্ঞ বিচারপতিকেও স্তম্ভিত হতে হয়? না, বিচারপতি বিস্মিত হলেও আমাদের কোনওপ্রকার বিস্ময়ের সুযোগ নেই, কেননা সেসব তথ্যপ্রমাণ আমাদের কেউ দেখায়নি।
দু-মাসের বেশি পার হয়ে গেল, বিচারের দাবিতে লড়ে চলেছি, লড়েই চলেছি— ছেলেমেয়েরা অনশনে বসে আছে, সে-ও এক সপ্তাহ হয়ে গেল— এক-এক করে অনশনকারীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে— বাকি যারা এখনও অনশন চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের শারীরিক অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ, যে-কোনও মুহূর্তে তাদেরও হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তদন্তকারী সংস্থা কেমন তদন্ত করছেন, তদন্তে ঠিক কী কী উঠে আসছে, তদন্তে ঠিক কোন কোন কথা জানা গেল যা শুনে অভিজ্ঞ বিচারপতি স্তম্ভিত হয়ে যান— সেসব আমাদের একটুও জানার অধিকার থাকবে না?
শুনতে পাই, সর্বোচ্চ আদালতে মুখ-বন্ধ-করা খামে তদন্তের অগ্রগতির খবর জানাচ্ছে সিবিআই। খুবই ভাল কথা। কিন্তু সেই খামের মুখ আমাদের জন্য আর কতদিন বন্ধ থাকবে? হ্যাঁ, জানি, ‘তদন্তের স্বার্থে’ সব কথা সর্বসমক্ষে জানানো যায় না— কিন্তু ঠিক কোনরকম তদন্ত এ-ক্ষেত্রে চলছে? যেরকম ‘তদন্তে’ প্রমাণ করা যায় যে সঞ্জয় রায়-ই একক অপরাধী, সেই ‘তদন্তের স্বার্থে’ এমন গোপনীয়তা?
নাকি সেরকম তদন্ত, যেরকম তদন্ত হলে তদন্ত যে একদম ঠিকভাবেই চলেছে, আদালতের সামনে তা প্রমাণ করার জন্য রাজ্য সরকারকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে কপিল সিব্বালকে দাঁড় করাতে হয়?
এবং তদন্ত বলতে সেই অপরাধের তদন্ত, এক একক অপরাধীর আচমকা ঘটিয়ে ফেলা যেরকম ‘অনভিপ্রেত দুর্ঘটনা’ চাপা দেওয়ার জন্য পুলিশের সর্বোচ্চ স্তর থেকে চিকিৎসা-শিক্ষাব্যবস্থার ও চিকিৎসা-নীতিরক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের চিকিৎসকরা একযোগে মাঠে নামেন— আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, এই একযোগে মাঠে নামা স্রেফ এক সাধারণ তথা গোলমেলে চরিত্রের সিভিক ভলান্টিয়ারকে বাঁচাতে, এবং পুলিশের সদর দফতরে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করে এক গোলমেলে চিকিৎসককে চিহ্নিত করা হয় পুলিশেরই ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট’ হিসেবে, পুলিশ কমিশনার অব্দি মাঠে নেমে শেষমেশ প্রশ্নের মুখে উত্তেজিত হয়ে জানান, তাঁরা ‘রেসপন্সিবল ফোর্স’ এবং তাঁরা কাউকেই বাঁচানোর চেষ্টা করছেন না— এই সবকিছু নিয়ে কি সিবিআই তদন্ত করছে? চার্জশিট দেখে যেহেতু সেসব বোঝা যাচ্ছে না, সুবিচার দিতে হলে এই সবকিছু নিয়েও যে তদন্ত হওয়া উচিত, সিবিআই কি তা নিয়ে আদৌ ভাবছে? বা সিবিআই কী কী ভাবছে ও কী ভাবনা অনুসারে তদন্ত করে চলেছে— মানে, বৃহত্তর চক্রান্ত বলতে যা বোঝায়, মাননীয় সিবিআই কি সেসব নিয়ে ভাবছে নাকি ‘বৃহত্তর চক্রান্তে’র সম্ভাবনাকে স্রেফ আমাদের কষ্টকল্পনা হিসেবে নাকচ করতে চাইছে— এটুকুনি জানার অধিকারও কি আমাদের নেই?
এদিকে কী আশ্চর্য, সিবিআইয়ের তদন্ত ও নিম্ন-আদালতে সিবিআইয়ের দাখিল করা চার্জশিট (ও সেখানে একটিই মাত্র নামের উল্লেখ) নিয়ে বিস্ময় (বা হতাশা) প্রকাশ করা হলে ইদানীং রাজ্য-সরকারি দলের মুখপাত্র ভয়ানক চটে যাচ্ছেন! তাঁর উৎকণ্ঠা, আন্দোলনের নামে সিবিআইয়ের মতো সংস্থার উপর (‘সিবিআইয়ের মতো’ বলতে ঠিক কী, সেটা বলতে পারব না— দক্ষ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ এরকম কিছু বলতে চেয়েছেন সম্ভবত) অন্যায় চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাতে চাপের মুখে সিবিআই আরও বিভিন্ন নাম অপরাধী-তালিকায় জুড়ে দেয়! সত্যিই তো, তেমন কিছু হলে তা সত্যিই ভারি অন্যায়! কিন্তু এ-ধোঁয়াশা তো স্বয়ং সিবিআই-ই জিইয়ে রেখেছে— প্রত্যক্ষভাবে না-হলেও, পরোক্ষে তো অবশ্যই। মাননীয় মুখপাত্র-মশাই, আসুন, আপনিও আমাদের সঙ্গে একযোগে দাবি করুন, যাতে তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে সিবিআই আমাদের সবাইকে (তদন্তের স্বার্থে কিছু রাখঢাক সহকারে হলেও) নিয়মিত অবহিত করতে থাকেন। নিদেনপক্ষে যাতে সর্বোচ্চ আদালতে আগামী শুনানির দিন, পূর্বতন শুনানির দিনে দাখিল করা মুখ-বন্ধ খামের বিষয়বস্তু জনসমক্ষে আনা হয়।
অবশ্য, সুবিচারের দাবি তুললে, ‘উই ডিম্যান্ড জাস্টিস’ বললে, যে-সরকারের পুলিশ জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দেয়, সেই সরকারি দলের মুখপাত্র আদতে কী চান, সে তো বলাই বাহুল্য। এবং যেখানে ‘জাস্টিস’ দেওয়ার দায় আপাতদৃষ্টিতে শত্রুপক্ষের শাসনাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-এর, সেখানে ‘জাস্টিস চাই’ স্লোগান তুললে রাজ্য সরকারের ধামাধরা পুলিশ তেড়ে আসছে কেন, তার উত্তরও তো পাওয়া মুশকিল।
তো রাজ্য সরকার, সরকারি দল ও সেই দলের মুখপাত্র-মশাইয়ের কথা ছাড়ুন। আপাতত আসুন, আমরা আমাদের দাবিটুকু স্পষ্ট করে বলি। দাবি বলতে, অন্তত আমার কাছে, দফা এক দাবি এক। আদি ও অকৃত্রিম একটিমাত্র দাবি। সুবিচার চাই। ‘জাস্টিস’ চাই।
জাস্টিস বলতে দোষীকে চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া। অথবা দোষীদের চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া।
এবং দোষী/দোষীদের ধরার পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, দোষীকে/দোষীদের অপরাধ আড়াল করার কাজ যারা করেছে ও সে-কাজে যারা সাহায্য করেছে— তাদের চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া।
জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনের মুখ হতে পারেন, কিন্তু এই আন্দোলন জনগণের আন্দোলন। জনগণ ‘জাস্টিস’ চাইছেন। আদালত বিচার দিয়ে থাকে— এবং শুনেছি, অনেকসময়েই আদালতের প্রত্যক্ষ তদারকিতে তদন্ত হয়ে থাকে।
অপরাধ যখন নজিরবিহীন, তখন, ধরুন নজিরবিহীনভাবেই, জনগণের প্রত্যক্ষ তদারকিতে এই অপরাধের তদন্ত চলুক। না, আমার এই দাবির অর্থ কখনওই এমন নয়, যে, তদন্তের ভার ‘জনগণ’-এর হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক— আমার দাবি, তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই তদন্তের ব্যাপারে জনগণের কাছে answerable হোক (আবারও ডিসক্লেইমার: এই দাবির অর্থ এমন নয় যে জনগণের পছন্দমতো পথ ধরে তদন্ত হোক বা জনগণের চাহিদা মেনে চক্ষুশূল কাউকে ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়া হোক)। তদন্তের স্বার্থে কিছু গোপনীয়তা অনিবার্য, এটুকু মেনে নিয়েও দাবি করছি— তদন্ত স্বচ্ছ ও দ্রুত হোক এবং তদন্তের ব্যাপারে নিয়মিত আপডেট দেওয়া হোক।
তো সুবিচার চাইছি। দাবি বলতে এটাই। আগের অনুচ্ছেদের দাবিটুকু সেই আদি ও অকৃত্রিম মূল দাবিপূরণের সহায়ক মাত্র। এবং যথাযথভাবে প্রযুক্ত হলে, এই অপরাধে সুবিচার পরবর্তী অভয়াদের সুরক্ষা দিতে পারবে, এ আমার আশা। না, আশা নয়— দৃঢ় বিশ্বাস।
*মতামত ব্যক্তিগত