Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দেবীপক্ষ

সাম্য সরকার

 

বিজয়ার বিষাদ আস্তিক, নাস্তিক সকলের। বিসর্জন এবার কিছু আগেই। অন্য এক মেয়ের। সকলের মেয়ের। মন তাই ভাল নেই কারও। স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষা— মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত তিনটি প্রশাসনিক পরিকাঠামোর দুর্বৃত্তায়ন একদিনে হয়নি। বর্তমানে তা শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছে। অশুভ দুর্নীতির পাঁকে দুর্গাবধের জোগাড়। একটা মৃত্যু হিমশৈলের চূড়াটা দেখিয়ে দিয়ে গেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো আমরণ অনশনে বসেছেন। সভ্য দেশে যা যা থাকা/হওয়া উচিত স্বাভাবিকভাবে সেগুলিই পাওয়ার জন্য তাঁদের জীবন বাজি রাখতে হচ্ছে

 

কত দূর কুলতলি? হাঁসখালি, ধুপগুড়ি, সন্দেশখালি, পার্ক স্ট্রিট, বানতলা যতদূর, ততদূর? মা-বাবার ভুল ছিল দরজা খুলে রাখা। নয় বছরের ভুল ছিল ঘুমিয়ে থাকা। হয়তো মেয়ে হওয়াই ভুল ছিল। মনে রাখতে হবে এটাও এক প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা ছিল। পুলিশবাবু একটু তৎপর যদি হত বছর সেও আজ ঠাকুর দেখত রাত, দুপুর ভর। নয় বছর? নয় বছর! স্মৃতিতে একটু চাপ দাও। একটু ফিরে তাকাও। দেখতে পাবে এই তিলজলাতেই খুন হয়েছিল সাত বছর। তখন চর্চায় ছিল তন্ত্রসাধনা, বলি। আড়ালে ছিল— ধর্ষণ, খুন, সাত বছর। এ-সমাজে এমন হওয়াটাই তো তাই দস্তুর।

লখিমপুর খেরি।  সে কতদূর? এই তো কয়েকদিন আগে ধর্ষিতা হয়েছিল এক মেয়ে বাড়ির পথে। কষ্ট সয়ে, ভয় পেরিয়ে বলেছিল সব। মা-বাবা লজ্জা পেয়েছিল। জানাতে পারেনি কাউকে। নিতে পারেনি হাসপাতালে। দশ দিন পর যখন নিল তখন রক্তস্রোত আর থামেনি। মেয়ে আর ফেরেনি। মানতে হবে এ-ও এক প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা। সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানের, ‘লোকে কী বলবে’ ভাবনার। লখিমপুর খেরি এসে মেশে হাঁসখালিতে। বলি হতে থাকে আমাদের মেয়েরা সমাজের লজ্জার। পিতৃতন্ত্রে পুষ্ট সমাজে জীবনের মূল্যে, স্বাস্থ্যের মূল্যে মেয়ে মা-বাবার চোখেই সমানাধিকার পায় না। অপরের চোখে সে কেস-মাত্র। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে সব পরিচয় ভুলে মানুষ হিসেবে ভাবতে আমরা শিখিনি।

“আমার মেয়েটাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে—”

টিভিস্ক্রিন থেকে মায়ের আকুতি ভেসে এসেছিল ৯ আগস্ট সন্ধ্যায়। বীভৎসতায়, নৃশংসতায়, হত্যার প্রাতিষ্ঠানিকতায় এ ঘটনা সেরার সেরা যার অভিঘাতে মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যায়। প্রতিদিন একটু একটু করে খাওয়া বিষের মতো একটু একটু করে দুর্ঘটনার চিত্রনাট্য ও পরিকল্পনার উন্মোচন প্রচণ্ড অস্বস্তিতে অস্থির নয় শুধু, অসুস্থ করে তোলে। সৃষ্টিশীলতা থমকে যায়। মায়ের আকুতি মাথার ভিতরে প্রতিধ্বনি তুলতে থাকে। মিছিলে পা মেলানোটাই তখন একমাত্র কাজ। রাজপথই ক্যানভাস।

এমন কষ্ট বহুর ভেতরেই একটু একটু করে বাজে। মিছিল ছড়ায় দিকে দিকে। আগা মাথা ভারী হতে থাকে। স্বাস্থ্যভবনের সামনে পাতা খুঁটির মাথায় ত্রিপল যেন কোনও দুর্গাপূজার প্যান্ডেল। প্রতিমা নেই, আলোকসজ্জা নেই, তবু হাজারে হাজারে মানুষের ঢল। উপচে পড়া ভালবাসা— রান্না করে পাঠিয়ে দেওয়া/বয়ে আনা খাবারে, কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমুতে, পাশে দাঁড়িয়ে হাতপাখা ঘোরানোয়।

এমন মিছিল কবে দেখেছিল আমার শহর, আমার দেশ? নেতাহীন, পরিচালকহীন এমন স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণ কবে দেখেছে কোন্ দেশ? অনামী সাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানে গণতন্ত্রের উৎসব শুরু দুর্গোৎসবের আগেই। জনপ্রতিনিধিরা তাই ভয় পেয়ে যায় খুব সাত চড়েও রা কাড়ে না যারা তারাও যখন স্লোগান তোলে। হাতে হাতে মানববন্ধন ছড়িয়ে পড়ে বারাসাত থেকে আরজিকরে। বুকের মধ্যে জ্বলছে বীতরাগ। শাসকও পাচ্ছে উত্তাপ। আস্তিকের ঈশ্বরের পরে, মায়ের পরে যে তারই যদি চোখ ফেটে রক্ত ওঠে তুমি আমি তো পোকা মাত্র।

ভিড়ের মধ্যে আবার মিলেমিশে ছিল কিছু গা ভাসানো লোক। বকলমে ধর্ষক বা সমর্থক। যেমন সেই পরিচালক যিনি প্রকাশ্যে এক ধর্ষককে সমর্থন করেছিলেন। তিনিই আবার বোধনে অভয়া শক্তির জাগরণের কামনা করেন শিক্ষকসমাজের আয়োজিত কনভেনশনে। একটু-আধটু ধর্ষণ যারা করে থাকেন বা কেউ করলে ভুল করে করে ফেলেছে মনে করেন তাদের (চন্দ্রবিন্দু বাদ) কাছেও কি এটা একইরকম ভয়াবহ মনে হচ্ছে? পা মিলাচ্ছে নাকি জল মেপে ভিড়-এ ভিড়ে যাচ্ছে?

পান থেকে চুন খসলে বা না খসলে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়াই যেখানে দস্তুর সেখানে প্রধান বিরোধী দলের আইটি সেল ও তাদের কর্মীবৃন্দ আশ্চর্যরকমভাবে নিশ্চুপ। তাদের অভিধানে নারী গৃহপালিত প্রাণী বই অপর কিছু তো নয় (বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধের তালিকায় যুক্ত করা যায় না তাদেরই ওজর আপত্তিতে)। এই জাতপাতহীন, ধর্মহীন মিছিলগুলো তাদের সিলেবাসের বাইরে পড়ে। শাসকদলের সঙ্গে তারাও সঙ্গত করে জনবিদ্রোহকে উপহাস করে যাচ্ছে। কৃষক আন্দোলনের সময় সিংঘু ও টিকরি বর্ডার সিল করে দিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। নিজের দেশের নাগরিককে আটকাবার জন্য রাস্তায় পুঁতেছিল গজাল যা পরে ক্রেন দিয়ে তুলতে হয়। কৃষি বিলও প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী শাসক। কিন্তু ততদিনে সত্তরটি প্রাণ ঝরে গেছে। দম্ভে, উদাসীনতায়, নিষ্ঠুরতায় একনায়কতান্ত্রিকতায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মানিকজোড়— একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। শাসক দল গুনে গুনে দেখাচ্ছে এই মুহূর্তে দেশে আর কোথায় কী কী ঘটছে। সেখানে তো কই এমন হচ্ছে না। এ রাজ্যেই কেন এমন হয়? এ রাজ্যে এমন হয় কারণ রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল এই মাটিতেই। আজাদ হিন্দ ফৌজের নায়ক কটকে জন্মালেও ধমনীতে তাঁর বাংলা ভাষা। আন্দামান জেলে বন্দিতালিকায় পঁচাশি ভাগ নাম বাঙালির। বিধবা মেয়েদের জ্যান্ত পোড়ানো বন্ধ করা বা আবার বিয়ে দেওয়া— সমাজের ঘেঁটি ধরে নাড়ানোর সূচনা হয়েছিল এ-বঙ্গেই। আশার কথা কয়েক শতক পার হয়ে মন্বন্তর, দেশভাগ, দাঙ্গা পেরিয়েও বাঙালির প্রতিবাদী সত্তা হারায়নি। আমাদের মেয়েরা পথ দেখিয়েছেন। জাতির মেরুদণ্ডে ক্যালসিয়াম জুগিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। ধাওয়া খাচ্ছেন বিধায়ক। ভয় কাটছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছেন মেয়েরা। ভাঙছে মৌনতা।

মায়ের বাপের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা, অপেক্ষার আনন্দ বাঙালি জীবনে বিশেষ। বিজয়ার বিষাদ আস্তিক, নাস্তিক সকলের। বিসর্জন এবার কিছু আগেই। অন্য এক মেয়ের। সকলের মেয়ের। মন তাই ভাল নেই কারও। স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষা— মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত তিনটি প্রশাসনিক পরিকাঠামোর দুর্বৃত্তায়ন একদিনে হয়নি। বর্তমানে তা শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছে। অশুভ দুর্নীতির পাঁকে দুর্গাবধের জোগাড়। একটা মৃত্যু হিমশৈলের চূড়াটা দেখিয়ে দিয়ে গেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো আমরণ অনশনে বসেছেন। সভ্য দেশে যা যা থাকা/হওয়া উচিত স্বাভাবিকভাবে সেগুলিই পাওয়ার জন্য তাঁদের জীবন বাজি রাখতে হচ্ছে। মেধাবী ছাত্রগুলি চাইলে পাশ কাটিয়ে যেতেই পারতেন এতদিন যেমন চলছিল। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে তাঁরাই সবচেয়ে ভাল জানেন কী বিভীষিকা সয়ে তাঁদের সহকর্মীকে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছিল। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অশুভ আঁতাতে গড়ে ওঠা সামন্ততন্ত্রের অবসানের জন্য, স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে আজ তাঁরা রাস্তায় অভুক্ত। দশ দফা দাবির একটাও তাঁদের নিজেদের জন্য নয়। সাধারণ মানুষের স্বার্থে, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিহীন স্বাস্থ্যপরিষেবার লক্ষ্যে। ওষুধদুর্নীতি, পরীক্ষাদুর্নীতি ছাড়াও মেডিকেল বর্জ্য যা নষ্ট করে ফেলাই নিয়ম তার পুনর্ব্যবহারে কোটি কোটি টাকা শাসক দলের বড়, মেজ, সেজ নেতাদের কাছে পৌঁছে শেষ হচ্ছে এমন নয়। সরকারি হাসপাতালে কোনওদিন চিকিৎসা করাতে যাবেন না এমন জনেরাও প্রভাবমুক্ত নন‌। ওয়ান প্লাস, মেড প্লাস-এর মতো রিটেইল চেইন ছাড়াও পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে কেনা গজে কখনও ছোট আরশোলার পা, চুল, শুকনো রক্ত, ঝুল পেয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে বাইরের রাজ্য থেকে আনাতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু আমাদের ডাক্তাররা নাকে রুমাল চেপে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে পাঁক পরিষ্কার করতে চাইছেন।

অনিকেত মাহাতো কোমার দরজায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। অন্যেরাও গুরুতর অসুস্থ। অনশনের ছয় দিন পার। অষ্টমীর পূজাপরিক্রমা অনশন মঞ্চমুখী। এমন শারদোৎসব কবে দেখেছিল কলকাতা! গোটা ধর্মতলা ওয়াই চ্যানেল জুড়ে রাস্তায় বসে রয়েছেন মানুষ। গান গাইছেন, স্লোগান তুলছেন, মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে সংহতি জানাচ্ছেন, অনশনকারীদের দেখে কেঁদে ফেলছেন। সরকার অনমনীয়। পুলিশের অনশনকারীদের খাট তুলে নিয়ে যাওয়া যদি হাসির খোরাক হয় নিজের বাড়ির সামনে দুর্গার রক্তচোখ আঁকার অপরাধে শাসকদলের ক্যাডারবাহিনির হাতে বৃদ্ধ মার খান দেখে ভয় হয়। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দেওয়ার অপরাধে ত্রিধারা পার্কের পূজা প্যান্ডেল থেকে নয়জনকে টেনেহিঁচড়ে পুলিশভ্যানে তুলে নেওয়া, জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্ৰেফতার করে কাস্টডিতে রেখে দেওয়া দেখে আতঙ্ক হয়।

কথা বোলো না, শব্দ কোরো না। চুউউউপ্, গণতন্ত্র চলছে।


*মতামত ব্যক্তিগত। হেডারের ছবি লেখকের আঁকা