Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কমরেড সীতারাম, বামপন্থা এবং আজকের সময়

নীলোৎপল বসু

 


ভারতের সমকালীন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক হন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি। আর বামপন্থীদের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে হিন্দুত্ব ও আরএসএসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে আরও সক্রিয় এবং কার্যকরী হয় তাঁর ভূমিকা‌। কিন্তু মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হওয়ার জন্যই সীতারামের এই সত্যটি উপলব্ধি করতে কোনও সমস্যা হয়নি যে এই বৃহত্তর শক্তি সমাবেশে বামপন্থীদের একটি স্বকীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বৃহত্তর শক্তির অংশ হওয়া সত্ত্বেও শ্রমজীবী মানুষের বিশেষ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলি নিয়ে মুখর হওয়া জরুরি

 

সাম্প্রতিক সময়ে কোনও বামপন্থী নেতার মৃত্যু উপলক্ষে এত আগ্রহ চোখে পড়েনি। এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও সীতারামকে নিয়ে আলোচনার ঘাটতি নেই। এটাও বলতে হবে যে এই আলোচনার বিষয়বস্তু মূলত ইতিবাচক। কমরেড সীতারামকে নিয়ে লিখতে গেলে বিশেষ করে এই উগ্র-দক্ষিণপন্থার দৌরাত্ম্যের পটভূমিতে যে আপাত স্ববিরোধিতা রয়েছে, তা নিয়েই সূত্রপাত করা যেতে পারে।

সীতারাম চলে যাওয়ার পরে যে মূলধারার আলোচনা হচ্ছে তার নির্যাস সীতারাম মহান এবং সীতারামের ভূমিকা ও অবদান সবটাই দেশের জাতীয় স্তরের সাম্প্রতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে উপস্থিত করা হচ্ছে। কিন্তু স্ববিরোধিতার ধাঁধাটা সমাধান করাও সহজ হয়ে যাচ্ছে। সীতারাম মহান কিন্তু সীতারামহীন সিপিআই(এম) বা বামপন্থীরা কি আজকের সময়ের চ্যালেঞ্জগুলিকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে?

এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে ২০১৫ সালে বিশাখাপত্তনমে সিপিআই(এম)-এর ২১তম কংগ্রেস থেকে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই তাঁর কাজের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য থেকেছে আরএসএস এবং বিজেপি-বিরোধী বৃহত্তর গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে একজোট করা।

কিন্তু কমরেড সীতারামের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের উৎস কী? তা নিয়ে মূলস্রোতের সাংবাদিক বা স্তম্ভকারদের বিশেষ হেলদোল নেই।

এখানেই গুরুত্বপূর্ণ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হিসেবে কমরেড সীতারামের বিবর্তন এবং এই বিবর্তন সিপিআই(এম) ও বামপন্থার চর্চার সঙ্গে সমান্তরালে এগিয়েছে।

১৯৯১ ভারতের রাজনীতি এবং মতাদর্শ চর্চার ক্ষেত্রে মাইলফলক।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলির পশ্চাদপসরণ— এ-দেশেও স্বাধীনতা অর্জনে মৌলিক ধারণাগুলি, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, সামাজিক বৈষম্যহীন লক্ষ্য এবং অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা— সবকিছুর উপরেই প্রশ্নচিহ্ন।

কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যে বিশেষ দিকগুলির উপরে তার সন্দেহাতীত দক্ষতা ছিল এই সময়েই তা যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। পেশাদার অর্থনীতিবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণ তাঁকে বুঝতে সাহায্য করেছিল নতুন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত। নবউদারবাদী বিশ্বায়ন। কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিতের সহকারী হিসেবে পার্টির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাজটি সামলাতে গিয়ে সামগ্রিকভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নতুন চিন্তাভাবনা বিতর্ক এবং দেশে দেশে কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল আন্দোলন গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জগুলিকে গভীরভাবে আত্মস্থ করেন কমরেড সীতারাম। আর তার সঙ্গে ভারতীয় সমাজ-সভ্যতা, ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে গভীর আগ্রহ ছিল সীতারামের। মজার ব্যাপার সীতারাম ছিলেন গোঁড়া তেলেগু ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারের সন্তান। কিন্তু এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই কমিউনিস্ট হতে গিয়ে তাঁকে সম্পূর্ণভাবে শ্রেণিচ্যুত শুধু নয়, সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসচ্যুতও হতে হয়। কিন্তু পারিবারিক অতীত থেকে একটা বিষয় তাঁর আগ্রহের প্রসঙ্গে কাজে দিয়েছে। বেদ উপনিষদ এবং পুরাণের একটি শক্তিশালী প্রাথমিক ধারণা। কমিউনিস্ট আন্দোলনেও দক্ষিণপন্থার এবং বিশেষ করে আরএসএসের প্রধান বর্শাফলকের ভূমিকা যে নতুন পরিস্থিতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে তা সিপিআই(এম) যৌথ বোঝাপড়ারই অঙ্গ ছিল‌। আর সীতারাম ছিলেন ৮০-র দশকের শেষে এবং ৯০-এর দশকের শুরুতে সিপিআই(এম)-এর যৌথ নেতৃত্বের তরুণতম সদস্য। স্বভাবতই পার্টির অভ্যন্তরে মতাদর্শগত বোঝাপড়া গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি।

আর ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বোধহয় ভারতের সংবিধানের বিরুদ্ধে অভিযানের সবচেয়ে সোচ্চার সূত্রপাত। হিন্দুত্বের এই চ্যালেঞ্জই যে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের ভবিষ্যত দশকগুলির প্রধান চ্যালেঞ্জ তার সম্যক উপলব্ধিও দ্রুত সামনে আসে। এই পর্যায়ে কমরেড সীতারামের অনন্য তাত্ত্বিক অবদান ১৯৯৩-এর নভেম্বর মাসে জনপ্রিয় আঙ্গিকে লেখা একটি দীর্ঘ প্যামফ্লেট— হোয়াট ইজ দিজ হিন্দুরাষ্ট্র (এই হিন্দুরাষ্ট্র ঠিক কী?)। এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল আরএসএসের সবচেয়ে প্রভাবশালী তাত্ত্বিক গোলওয়ালকরের লেখা— উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড্-এর আদ্যোপান্ত কাঁটাছেড়া। কমরেড সীতারাম সবসময়েই লেনিনের একটি বিশ্লেষণের পদ্ধতির নির্যাস অনুসরণ করেছেন— ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণই দ্বন্দ্বতত্ত্বের প্রয়োজনীয় আকর’। গোলওয়ালকরের কাঁটা সীতারাম উপড়েছেন গোলওয়ালকারের জমিতেই, সমাজ-সভ্যতা-ইতিহাসের প্রেক্ষিতেই। হিন্দুত্বের উপর এই সম্মুখ প্রহার এতটাই কার্যকরী হয়েছিল যে হিন্দুত্ববাদীদের ইট-পাটকেল বর্ষিত হতে থাকে। কিন্তু আবার সবটাই মিথ্যাচারের ভিত্তিতে‌। গোলওয়ালকরের লেখা নয় ওই পুস্তিকা বা গোলওয়ালকরকে বিকৃত করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। কিন্তু সীতারাম তাঁর উৎস এবং তথ্য এতটাই বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তির উপর নির্ভর করে উত্থাপন করেছিলেন যে গোলওয়ালকরের মৌলিক তাত্ত্বিক রচনাটি আরএসএস-হিন্দুত্ববাদীদের কাছে শাঁখের করাত হয়ে যায়; গোলওয়ালকরের গ্রন্থসত্ত্ব অস্বীকারও করতে পারেনি আর বিপরীতে তার ভয়ঙ্কর প্রস্তাবনাগুলির আত্মপক্ষ সমর্থনও প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে হয়নি। কমরেড সীতারামের এই অবদানটি আজও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের আন্দোলন ও রাজনৈতিক বোঝাপড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে রয়ে গিয়েছে।

এই সূত্র ধরেই সময় এগিয়েছে এবং দেশদুনিয়ার পরিবর্তনে উগ্রদক্ষিণপন্থার বিস্ফোরক আত্মপ্রকাশ এবং তার ভারতীয় অধ্যায়ে মূল সূত্রধর হিসেবে আরএসএসের ভূমিকাও চোখের সামনে এসেছে। আর ২০১৪ সালের পর বিষয়টি নিছক তাত্ত্বিক নয়, সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ এখন হিন্দুত্ববাদীদের হাতে।

ভারতের সমকালীন ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক হন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি। আর বামপন্থীদের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে হিন্দুত্ব ও আরএসএসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে আরও সক্রিয় এবং কার্যকরী হয় তাঁর ভূমিকা‌।

কিন্তু মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হওয়ার জন্যই সীতারামের এই সত্যটি উপলব্ধি করতে কোনও সমস্যা হয়নি যে এই বৃহত্তর শক্তি সমাবেশে বামপন্থীদের একটি স্বকীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বৃহত্তর শক্তির অংশ হওয়া সত্ত্বেও শ্রমজীবী মানুষের বিশেষ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলি নিয়ে মুখর হওয়া জরুরি। হিন্দুত্বের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য যা একাদিক্রমে শুধু সাম্প্রদায়িক নয় মেরুকরণ, স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিবাদী প্রবণতা, তীব্রতম জনবিরোধী অর্থনৈতিক অভিযান— এই সমস্ত কিছুর সমন্বিত কার্যক্রম— এই ধারণাগুলিকে স্পষ্টতার সঙ্গে উত্থাপন করা সময়ের দাবি। তত্ত্বগত প্রসঙ্গের যে উল্লেখ সীতারামের বিকাশ এবং বিবর্তনের পক্ষে আলোচিত হয়েছে তা তাঁর কাছে ছিল দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। ফলে হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কোনও ‘লেসার ইভিল’ খুঁজে বেড়ানোর মতো পাগলামি তাঁকে বা তাঁর দলকে করতে হয়নি।

তাঁর স্মরণসভায় দাঁড়িয়ে শুধু অন্যান্য বামপন্থী নেতারাই নয় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির নেতারাও দ্বিধাহীনভাবেই ঘোষণা করেছেন যে সীতারামের আকস্মিক চলে যাওয়া রাজনীতির প্রক্রিয়ায় শূন্যতা সৃষ্টি করবে। আসলে কমরেড সীতারাম কমিউনিস্ট ও বামপন্থী আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই যে রাজনৈতিক উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন তার মূল নির্যাস-ই হচ্ছে এই বোঝাপড়া হিন্দুত্ববাদী উগ্র-দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে। যে-উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে ‘ইন্ডিয়া’ প্ল্যাটফর্মের নির্মাণে, যা একটি মঞ্চ— কোনও জাতীয় মোর্চা বা নির্বাচনী জোটও নয়। এই বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সীতারামের অবদান ছিল। আর এর ধারাবাহিকতার মধ্যে দিয়েই শুধু তাঁর নয়, বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের ভূমিকার প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকবে এ নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ থাকার কারণ নেই।